শীতল অগ্নিশিখা
অগ্নিশিখা শীতল, মানে ঠান্ডা হতে পারে কি? আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে, তাতে একটুকরো কাগজ ধরা হল, কিন্তু কাগজে আগুন ধরল না। কী ধরনের এই অগ্নিশিখা?
জাদুকর একটা কনিক্যাল ফ্লাস্কে অল্প জল আর অন্য কিছু একটা ঢুকিয়ে দিয়ে তার মুখে একটা রবারের কর্ক টাইট করে লাগিয়ে নিলেন। কর্কের মধ্যে ছোটো একটা ছিদ্র করে তার মধ্যে তিন সেন্টিমিটার একটা কাচের জেট লাগানো আছে। এই ফ্লাস্কতন্ত্রটাকে একটা তেপায়া স্ট্যান্ডের ওপরে রেখে এর তলায় একটা বার্নার জ্বালিয়ে জাদুকর বলতে শুরু করলেন—
“এই জেটের মধ্যে দিয়ে একটু বাদেই সবুজ-নীল রঙের এক অগ্নিশিখা বেরিয়ে আসবে। এ শিখা এত ঠান্ডা যে একটা কাগজকে পর্যন্ত জ্বালাতে পারে না। সেটাই দেখানো হবে।”
কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্লাস্কের জল টগবগ করে ফুটতে শুরু করল আর ওই জেটটার মুখে দেখা দিল এক সবজে-নীল অগ্নিশিখা। অগ্নিশিখাটা প্রায় তিনচার সেন্টিমিটার লম্বা। তাতে আঙুল ছোঁয়ালে হালকা গরম টের পাওয়া যায় মাত্র, আঙুল পোড়ে না।একটুকরো কাগজও সে শিখায় ধরা হল কিন্তু কাগজটা অক্ষত রইল।
শিখাটা একেবারে ঠান্ডা নয় ঠিকই কিন্তু কাগজ পোড়াতে তা সমর্থ নয়। সেই সুবাদে একে শীতল অগ্নিশিখা বলা হয়।
কী করে ঘটছে
ফ্লাস্কে জলের সঙ্গে কয়েকটুকরো সাদা ফসফরাস দেয়া হয়েছিল। জল ফুটতে শুরু করলে সাদা ফসফরাস স্টিম ডিস্টিলড হয়ে জলীয় বাষ্পের সঙ্গে নিজেও বাষ্পাকারে বেরিয়ে আসা শুরু করে। বাইরে বেরিয়ে তা বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে জ্বলতে শুরু করে। তাতে তাপ যথেষ্ট তৈরি হলেও তার সিংহভাগ মিশ্রণের জলীয়বাষ্প শুষে নেয় বলে তার দাহিকাশক্তি থাকে না।
P4+5O2–>2P2O5+তাপ+আগুন
আগুন+জলীয়বাষ্প+তাপ–>à রয়ে যাওয়া অবশিষ্ট তাপ +আগুন
জলের ভেতর আগুন জ্বলে
শাগরেদ- ওস্তাদ! জল আগুন নেভায়?
জাদুকর- নেভায়।
শাগরেদ- জলের ভেতর আগুন জ্বালাতে পারবেন?
জাদুকর- কেম্যাজিকেশ্বরের ইচ্ছা হলে সব সম্ভব।
শাগরেদ- তাহলে সেই চমৎকারটাই একবার করে দেখান।
জাদুকর- যা। আমার কামানটা নিয়ে আয়।
বলতে বলতে নিজেই একটা বড়ো বিকার নিয়ে এসে তাতে জল ভরে কয়েক টুকরো কিছু একটা জিনিস ঢুকিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে শাগরেদ নিয়ে এসেছে মস্ত এক সিলিন্ডার। সিলিন্ডারটার বহির্গমন নলে লাগান আছে একটা লম্বা রাবার টিউব। তার সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে সরু ছিদ্রবিশিষ্ট একটা কাচের নল।
কাচের নলটা বিকারের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে জাদুকর গাইতে শুরু করলেন, “হে কেম্যাজিকেশ্বর, তোমার চমৎকারিত্ব দেখিয়ে দাও। জলের ভেতর আগুন জ্বলে উঠুক, জলের ভেতর আগু-উ-উ-উ-ন জ্ব—লু-উ-উ-উ-উ-ক—”
এইরকম বলে বলে যখনই সিলিন্ডার থেকে নব ঘুরিয়ে গ্যাস ছাড়ছেন তখনই বিকারের মধ্যে আগুন জ্বলে উঠতে দেখা যাচ্ছে। আবার খুব তাড়াতাড়ি সেটা নিভে যাচ্ছে।
কীভাবে আগুন জ্বলছে?
বিকারের জলের ভেতর কয়েক টুকরো সাদা ফসফরাস রেখে দেয়া ছিল। সিলিন্ডারে আছে অক্সিজেন। যখনই নব ঘুরিয়ে জলের তলাকার ফসফরাসের ওপর অক্সিজেন ছাড়া হচ্ছে তখনই ফসফরাস ও অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় ফসফরাস পেন্টোক্সাইড তৈরি হচ্ছে ও সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিশিখার সৃষ্টি হচ্ছে। জলের নীচে থাকায় তা আবার সঙ্গেসঙ্গে নিভেও যাচ্ছে।
P4 + 5O2 –> 2P2O5 + fire
টেস্ট টিউব থেকে তরল আগুনের স্রোত
একটা বড়ো হার্ডগ্লাস টেস্ট টিউবে বেশ কিছু সাদা গুঁড়ো নিয়ে বারনারে তা গরম করতে করতে জাদুকর বলতে শুরু করলেন, “হে অগ্নি, তুমি অদৃশ্যভাবে এর মধ্যে প্রবেশ কর। তোমাকে এর ভেতরে যেন কোনভাবেই প্রত্যক্ষ না করা যায়। এখান থেকে বের হলে তুমি স্বমূর্তি ধারণ করবে। তুমি যে তরল স্রোতের আকারেও প্রবাহিত হতে পার তা তুমি দেখিয়ে দাও।”
এই বলতে বলতে টেস্টটিউবটা ক্রমশ তীব্র গরম হয়ে উঠতে একসময় তা থেকে ধোঁয়া বের হতে লাগল আর সেই সাদা পদার্থটা ধীরে ধীরে চিকমিকে কালো রঙের পদার্থে পরিণত হল। এবার জাদুকর টেস্টটিউবটাকে কাত করে বলতে শুরু করলেন, “হে অগ্নি, প্রবাহিত হও, প্রবাহিত হও–”
অমনি টেস্ট টিউবের মুখ থেকে লম্বা আগুনের স্রোত তলায় রাখা একটা বড়ো পাত্রের মধ্যে পড়তে থাকল। এভাবে কয়েকবারই টেস্ট টিউব থেকে তরল আগুনের স্রোত বইয়ে দিয়ে জাদুকর সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন।
কী ঘটছে?
টেস্টটিউবে নেয়া সাদা পদার্থটা হল শুকনো লেড টারট্রেট। এটা বানানো খুবই সোজা। লেড নাইট্রেটের দ্রবণে টার্টারিক অ্যাসিডের দ্রবণ মেশালে যে সাদা অধক্ষেপ পড়ে সেটাকে ছেঁকে ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিলেই হল। একে প্রচন্ডরকম উত্তপ্ত করলে এর বিযোজন ঘটে, জল, কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে গিয়ে ধাতব লেড বা সিসে টেস্ট টিউবে পড়ে থাকে। এই ধাতব লেড গরম অবস্থায় অত্যন্ত সক্রিয়। একে বলে পাইরোফোরিক লেড। টেস্ট টিউব কাত করে এই পাইরোফোরিক লেডকে যখন ওপর থেকে নীচের দিকে ফেলা হয় তখন তা বাতাসের অক্সিজেনের দ্বারা জারিত হয়ে লেড অক্সাইড তৈরি করে। এ বিক্রিয়া এতই তাপোদ্দীপক যে বাতাসের সংস্পর্শে লেড আগুন বের করে জ্বলতে থাকে। এ এক বিশুদ্ধ জারণ বিক্রিয়া।
লেড টারট্রেট + তাপ –>পাইরোফোরিক লেড +কার্বন-ডাই-অক্সাইড+ জলীয় বাষ্প
পাইরোফোরিক লেড + অক্সিজেন(বাতাসের)–> লেড অক্সাইড + তরল অগ্নিস্রোত।
সাবধানতা
- টেস্ট টিউব হোল্ডার ব্যবহার করতে হবে।
- পাইরোফোরিক লেড প্রায় গলিত অবস্থায় থাকে। অতএব সাবধান।
- অতি অবশ্য হার্ড গ্লাস টেস্ট টিউব ব্যবহার করবে।
- ওপর থেকে লেড নীচে ফেলবার সময় তলায় বালি থাকা বড়ো নিউম্যাটিক ট্রাউতে (pneumatic trough) অতি সাবধানে ফেলবে।
- সাবধান, গায়ে যাতে কোনমতেই না পড়ে।