বিচিত্র জীবজগৎ
যূথিকা আচার্য্য
১। শীতে পোকা গরমে ঘাস
গপ্পো শোনাতে এলুম বটে, কিন্তু নামটা নিয়ে আমার মনে বেশ খটকা লেগেছে। ঘাস বলাটা হয় তো ঠিক হল না, বুঝলে। ফাঙ্গাস মানে তো ঘাস নয়। ফাঙ্গাসের বাংলা হল ছত্রাক। কিন্তু সেকথা তুমি জানো আর আমি জানি। সাত মুল্লুক দূরে তিব্বতের লোকজন অত কিছু জানবে কী করে? তিব্বত কোথায়, জানো নিশ্চয়?
কী বললে, “কলকেতা, ডায়মণ্ডহারবার, রানাঘাট, তিব্বত, ব্যস!”
ইয়ার্কি হচ্চে! অ্যাঁ! কী ভেবেছ, ‘হ য ব র ল’ থেকে তুমি টুকে দেবে, আর আমি ধরতে পারব না? চুপ করে শান্ত হয়ে বসো দেকিনি বাপু। তবে না গপ্পোখানা শুনিয়ে মজা।
হ্যাঁ তো যা বলছিলুম। তিব্বত দেশখানার লোকেশন হল নেপালের আরও উত্তরদিকে। ঠিক ধরেছ, মাউন্ট এভারেস্টের গলা জড়িয়ে বসে থাকা আহ্লাদী ছোটো খুকির মতো ছোট্ট দেশ তিব্বত। বরফ ঢাকা পাহাড় চুড়ো ও সার সার মনাস্ট্রি দিয়ে সাজানো ছবির মতো দেশ। অত্যধিক উচ্চতার জন্য এই অংশটিকে বলা হয় ‘পৃথিবীর ছাদ।’ যে পোকা-প্রবরের কথা বলছি, তিনি এই পৃথিবীর ছাদেরই বাসিন্দা। এঁর ইংরিজি নাম ‘ব্যাট মথ’ বা ‘ঘোস্ট মথ।’ ইনি হেপিয়ালিডি (Hepialidae) পরিবারের অন্তর্গত পতঙ্গবিশেষ।
তোমরা তো সবাই জানো যে মথ বা প্রজাপতিদের ছোটবেলাটা কাটে শুঁয়োপোকা হিসেবে। ইংরিজিতে যাকে বলে ক্যাটারপিলার (caterpillar)। বেশ কিছু সংখ্যক ঘোস্ট মথেদের ক্ষেত্রে একটা ভারি দুঃখের ব্যাপার ঘটে। শীতকালে ঠাণ্ডা আবহাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এরা মাটির নিচে ছোট্ট সুড়ঙ্গ বানিয়ে আশ্রয় নেয়। শীত ও গ্রীষ্মের মাঝামাঝি ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে একরকমের ফাঙ্গাস বা ছত্রাক এই শুঁয়োপোকাদের আক্রমণ করে। এই ছুঁচো পাজি ফাঙ্গাস বাবাজীর পোশাকি নামটি হল অফিওকরডিসেপস সাইনেনসিস (Ophiocordyceps sinensis)। সোজা ইংরিজিতে বলে ক্যাটারপিলার ফাঙ্গাস । প্যারাসাইটিক নেচারের এই ছত্রাক শুঁয়োপোকাদের শরীরের ভেতর ঢুকে নিজেদের বাসা বানিয়ে ফেলে। গ্রীষ্মের শুরুতে এপ্রিল মাসে শুয়োঁপোকার মাথা ফুঁড়ে অঙ্কুরের মতো ছত্রাকটির ফ্রুটবডি বাইরে বেরিয়ে আসে। বলাই বাহুল্য, বাইরের দিক থেকে শরীর অক্ষত থাকলেও শুঁয়োপোকাটি মরে যায় এবং ফ্রুটবডির মাধ্যমে ছত্রাকটি আবার বংশবিস্তার করে।
পুরো ব্যাপারটাই অত্যন্ত বিশ্রী, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এই ক্যাটারপিলার ফাঙ্গাস ইউনিটটি চিনের মেডিসিন মার্কেটে সোনার দরে বিকোয় (2)। একটি মাত্র ফাঙ্গাসের মূল্য হতে পারে আটশো থেকে হাজার টাকা (ভারতীয় মুদ্রা)। চাইনিজ ট্র্যাডিশনাল চিকিৎসকদের মতে এই ক্যাটারপিলার ফাঙ্গাস সর্বরোগহরা। পৃথিবীর জটিল থেকে জটিলতম রোগের চিকিৎসা সম্ভব এই ছত্রাকের দ্বারা। চিনে এই ধরনের শুঁয়োপোকার স্যুপ অত্যন্ত জনপ্রিয়।
তিব্বতি ভাষায় এই শুঁয়োপোকা ছত্রাকের নাম, ‘ইয়ারৎসা গুনবু।’ সোজা বাংলায় এর অর্থ ‘শীতে পোকা, গরমে ঘাস।’ তিব্বতের মালভূমি অঞ্চল ছাড়াও, ভুটান ও চিনের কিছু অংশেও এই ক্যাটারপিলার ফাঙ্গাস পাওয়া যায়। গ্রীষ্মের শুরুতেই পার্বত্য অঞ্চলের চাষিরা ছত্রাক সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়ে। হাতে থাকে থলে এবং ছোটো ছুরি। পাহাড়ি ঘাসের মধ্যে মাথা উঁচু করে থাকা খয়েরিরঙা ছত্রাকের অঙ্কুর খুঁজতে হয় প্রথমে। তারপর অঙ্কুরের চারপাশের মাটি ছুরি দিয়ে খুঁড়ে দু’আঙুলে হালকা টানলেই শুঁয়োপোকার শরীরসহ সম্পূর্ণ ছত্রাকটি বাইরে বেরিয়ে আসে। বিক্রয়যোগ্য হওয়ার জন্য মৃত শুঁয়োপোকার শরীর ও ছত্রাকের অঙ্কুর দুটির একসঙ্গে থাকা দরকার।
তিব্বত, ভুটান ও চিনের এইসব দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলগুলিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও পাহাড়ি রুক্ষ মাটিতে ফসল ফলানো যায় না। যেটুকু ফসল হয় তাতে বিক্রি করা দূরের কথা, নিজের পরিবার-পরিজনের পেট ভরানোও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ সুস্থ সবল পুরুষ শেরপা হিসেবে পার্বত্য রাস্তায় গাইডের কাজ করে। পরিবারের বৃদ্ধ, নারী ও শিশু সদস্যেরা ক্যাটারপিলার ফাঙ্গাস খুঁজে ও বিক্রি করে যেটুকু রোজগার করে, সেটুকুই তাদের সম্বৎসরের রুজি-রোজগার। এছাড়াও ‘ইয়ারৎসা গুনবু’ সংগ্রহ করা এখনকার অধিবাসীদের জন্য স্যোশাল এন্টারটেইমেন্টও বটে। আমরা যেমন শীতকালে বন্ধুরা মিলে পিকনিক করি, চিড়িয়াখানা, গড়ের মাঠে ঘুরতে যাই, তেমনি ওসব দেশে গরমকালে সবাই দল বেঁধে শুঁয়োপোকা ফাঙ্গাস খুঁজতে যায়।
পৃথিবীর প্রথম সারির প্রাণীবিজ্ঞানীদের অবশ্য ধারণা যে এই ছত্রাকের সর্বরোগহরণের দাবী ভিত্তিহীন। চিনের অন্যান্য ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন যেমন গণ্ডারের শিং, বাঘের অণ্ডকোষের মতো এই ছত্রাকটিকেও পরীক্ষাগারে পর্যবেক্ষণ করে তেমন কিছুই বিশেষ ওষধি গুণাগুণ পাওয়া যায়নি। আমেরিকান পর্বত অভিযাত্রী এরিক হানসেনের মতে, “খেয়ে দেখলুম তাতে আমার পিঠের ব্যথা সারেনি, চোখের দৃষ্টিশক্তিও বাড়ল না, লাফিয়ে উঠে দৌড়োদৌড়ি করি তেমন ইচ্ছেও জাগল না, যৌন উদ্দীপনা বৃদ্ধির তো প্রশ্নই নেই।”
তাই বলছি, সত্যি অথবা মিথ্যে সে প্রশ্নের কোনও জবাব নেই। সাতশো বছর ধরে চলে আসা এই ওষধি ছত্রাকের গুণাগুণ হয়তো শুধুই মিথ। তোমরা যারা উন্নত দেশগুলিতে থাকো, হয়তো তারা ঠোঁট উলটে বলবে, “এ আর এমন কী! সবটাই গাঁজাখুরি।”
কিন্তু বিশ্বাস করো, তিব্বতি হতদরিদ্র চাষিদের কাছে এই মৃতজীবি ছত্রাকের সৌন্দর্য চাঁদের আলো ও বরফ ঢাকা পাহাড় চুড়োর চাইতেও অনেক অনেক বেশি। রুটি ও রূপকথার লড়াইয়ের ফলাফল সবদেশেই বড্ড একপেশে। তাই না?
২। প্রাণী জগতের পিপুফিশু
‘পিপুফিশু’ শব্দটার অর্থ জানো নিশ্চয়ই?
অ্যাঁ, কী বললে, ‘সেটা আবার কী?’
ঠিক আছে বাপু। আসল কথাটা বলার আগে তাহলে সেই গল্পটাই শোনাই। বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ ‘পিপুফিশু।’ এর অর্থ কুঁড়ের বাদশা। এই প্রবাদের পেছনের গল্পটি হল এইরকম—
একবার এক রাজা ঘোষণা করলেন যে তাঁর রাজ্যের সবচাইতে অলস মানুষটিকে তিনি পুরস্কার দিতে চান। শোনামাত্র রাজ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হল। সবাই বলে, আমি অলস। পুরস্কারটা আমাকেই দেওয়া হোক।
রাজা এবং মন্ত্রী দেখলেন ভারি বিপদ। রাজমহল জুড়ে আলসেদের ভিড়। কে সত্যি অলস এবং কে মিথ্যে অলস তা প্রমাণ করার উপায় কী? মন্ত্রীমশাই এক উপায় বের করলেন। ঠিক হল যে আলসেমির প্রতিযোগিতা হবে এবং প্রতিযোগিতার বিজয়ীকে অলস শিরোমণির খেতাব ও উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়া হবে।
প্রতিযোগিতার জন্য রাজ্যের শ্রেষ্ঠ কুঁড়েদের একটি মস্ত কুঁড়েঘরে রাখার ব্যবস্থা করা হল। প্রতিযোগীদের কোনও কাজ নেই। তারা শুধু খাবে-দাবে আর ঘুমোবে। মন্ত্রীমশাই তক্কে তক্কে রইলেন। যথাসময়ে তার আদেশে সেই কুঁড়েঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল। আগুন ছড়িয়ে গেলে একে একে সব আলসে লোকেরা সেই কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে এল। প্রাণের দায়ে তখন তাদের আলসেমি মাথায় উঠেছে। কিন্তু এরই মধ্যে মন্ত্রীমশাই ও তাঁর লোকজন দেখলেন যে তিনটি কুঁড়ে লোক এখনও ওই জ্বলন্ত ঘরে একসঙ্গে শুয়ে আছে। আগুনের তাপ লাগছে তাদের গায়ে কিন্তু তাতেও তাদের পরোয়া নেই। বিছানা ছেড়ে পালানো তো দূরের কথা, তারা চোখ খুলে কী হচ্ছে দেখতেও নারাজ।
আগুনের আঁচ পিঠে এসে লাগাতে প্রথম কুঁড়ে বলল, “কত রবি জ্বলে রে!”
অর্থাৎ কতগুলো সূয্যি উঠেছে একসঙ্গে!
দ্বিতীয় অলস বলল, “কেবা আঁখি মেলে রে?”
মানে চোখ খুলে দেখবে, তাতেও আলসেমি তার।
তৃতীয় কুঁড়ে সমস্যার সমাধান বাতলে দিল, “পিপুফিশু।”
অর্থাৎ কিনা পিঠ পুড়ছে, ফিরে শুই। সম্পূর্ণ বাক্যটি বলতেও তার আলসেমি। এই অবস্থায় মন্ত্রীমশাই ও তাঁর লোকজন এসে তাদের উদ্ধার করেন এবং তৃতীয় কুঁড়েটিকে ‘অলস শিরোমণি’ উপাধি এবং পুরস্কার দেওয়া হয়।
তাহলে বুঝতেই পারছ যে প্রাণী জগতের পিপুফিশু হতে গেলে কতখানি আলসে হতে হবে। তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ, পশুপাখিদের মধ্যে অ্যাত্ত অলস কেউ আছে নাকি! আছে বাবা, আছে! আলসে পশুদের সংখ্যা নেহাত কম নেই।
এই যেমন মনে করো কোয়ালা। মিষ্টি, নাদুসনুদুস টেডি বেয়ারের মতো দেখতে। অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি। কোয়ালাদের দেখলেই মনে হয় কোলে নিয়ে গাল টিপে দিই। এরা পুরো দিনে মাত্র দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা জেগে থাকে, বাকি সময় এরা গাছের ডালে ঘুমিয়ে কাটায়। জেগে থাকার সময়টুকু এরা ঢুলুঢুলু চোখে ভারি কষ্ট করে এদিক ওদিক তাকায় এবং মাতালের মতো টলোমলো পায়ে একটু আধটু নড়াচড়া করে। অবশ্য এমন আলসেমির জন্য দায়ী তাদের খাদ্যাভ্যাস। এদের প্রধান খাদ্য ইউক্যালিপটাস পাতা, আর এই পাতায় সায়ানাইড গোত্রের মারাত্মক কিছু বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যায়। কোয়ালাদের পাচকতন্ত্রের স্পেশালিটির জন্য তারা সহজেই এমন মারাত্মক বিষকে শরীর থেকে বের করে দিতে পারে, নইলে ইউক্যালিপটাস পাতা খেলে অন্য যেকোনও প্রাণী ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। প্রাণীবিজ্ঞানীদের মতে বিষাক্ত এই ডায়েটের ফলেই কোয়ালাদের ব্যবহার এমন অদ্ভুতুড়ে হয়। নইলে তারা বোধহয় এতখানি অলস হত না।
তারপর দেখো, কোকিলের কথা তো তোমরা জানোই। কোকিল বসন্তকালে গান-টান গেয়ে মন-টন ভোলায় ঠিকই, কিন্তু সে নিজের ডিম কাকের বাসায় পেড়ে পালিয়ে যায়। ভাই ডিম পাড়বে তুমি, আর তা দিয়ে ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা মানুষ করবে বেচারা কাক! এটা কেমন ব্যাপার হল! এটাও তো একধরনের আলসেমি, তাই না? বিজ্ঞানের ভাষায় এই ব্যাপারটিকে বলা হয় ‘ব্রুড প্যারাসিটিজম’।
হিপোপটেমাসের নাম নিশ্চয়ই শুনেছ তোমরা? তাদের বাড়ি আফ্রিকায়। হিপোর বাংলা নাম জলহস্তী। হাতির মতোই চেহারা বটে। হিপোরাও কিন্তু যথেষ্ট অলস। তারা দিনে সতেরো ঘণ্টা ঘুমোয় এবং বাকি সময়টুকু খেয়েদেয়ে রোদ পোহায়। আর কিচ্ছুটি করে না।
দেখো, সেরকমভাবে পাইথন সাপ, ওপোসাম, চিনদেশের পান্ডা এমন অনেক আলসে পশুর উদাহরণ দেওয়া যায়। তবে আমার মতে প্রাণীজগতের পিপুফিশুর সম্মানটা শুধু একজনেরই পাওয়া উচিত। নামটি তাহার স্লথ (Folivora Species)। স্লথ মহাশয় দক্ষিণ এবং সেন্ট্রাল আমেরিকার রেইন ফরেস্টে থাকেন। ইনি এতটাই ধীরেসুস্থে নড়াচড়া করেন যে দক্ষিণ আমেরিকায় এ নিয়ে একটা চলতি ইয়ার্কি রয়েছে, ‘What did the sloth say when a group of snails mugged him? Answer – It happened so fast!’
মানেটা নিশ্চয় বুঝেছ, স্লথ এতটাই ধীরে হাঁটাচলা করে যে শামুকেরও দলও তার জিনিসপত্র ছিনতাই করে পালিয়ে যেতে পারে এবং এরপরেও স্লথ বাবাজী বলবে যে শামুকগুলো বড্ড তাড়াতাড়ি দৌড়চ্ছিল তাই ধরতে পারলুম না!
দৌড়োদৌড়ি, ছুটোছুটি করতে পারে না, তাও না হয় বুঝলুম, কিন্তু তোমরা কি জানো যে স্লথ সপ্তাহে মাত্র একবার হাগু করে! অবশ্য সেটার জন্য স্লথের আলসেমিকে দোষ দেওয়া যায় না। ইনফ্যাক্ট প্রাণীবিজ্ঞানীদের মতে স্লথের আলসেমিটাও নাকি ইচ্ছাকৃত নয়। বেচারাদের ডাইজেস্টিভ সিস্টেম অত্যন্ত স্লো কাজ করে। স্লথের পেটে খাদ্যবস্তু হজম হতে সময় লাগে প্রায় এক সপ্তাহ। আর স্লথের খাদ্যিখানাও নিতান্তই সাদামাটা। বেচারারা মেইনলি গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। পাতার থেকে পুষ্টি তেমন কিছু পাওয়া যায় না, তার ওপরে আবার গদাইলশকরি হজমের গুণে স্লথ বেচারারা বেশি খেতেও পারে না। মানে বুঝতেই পারছ যে স্লো ডাইজেসশন মানে স্লো এনার্জি প্রোডাকশন, আর কম এনার্জি মানেই হল আলসেমি। কাজেই আপাত অর্থে যেটা কুঁড়েমি মনে হয় সেটা নিতান্তই এনার্জির অভাব। খাদ্যবস্তু হজম না হলে শক্তি পাবে কী করে?
সত্যি কথা বলতে কী, সপ্তাহে একদিন হাগু করার ব্যাপারটা শুনতে বিশ্রী লাগলেও সেখানেও স্লথ বেচারার দোষ নেই। প্রকৃতির নিয়মে হাগু করার জন্য তাদের মাটিতে নেমে আসতে হয়। আর সপ্তাহে একদিনই সে কাণ্ডটি হয় বলে নাম্বার টু ব্যাপারটার পরিমাণও হয় প্রচুর। ইনফ্যাক্ট প্রাণীজগতে স্লথই একমাত্র উদাহরণ যেখানে প্রতিবারে নিষ্কৃত বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ স্লথের নিজের ওজনের এক তৃতীয়াংশ হয়। অর্থাৎ পূর্ণবয়স্ক স্লথের ওজন সাত কেজি হলে তার পটির ওজন হয় প্রায় আড়াই কেজি।
সবচাইতে বড়ো কথা হল, পৃথিবীতে অর্ধেকের বেশি স্লথ মারা যায় গাছের তলায় নাম্বার টু করার সময়। শিকারি, হিংস্র পশুরা আক্রমণ করলে বেচারারা ছুটে পালাতে অবধি পারে না। এই সমস্যার কারণ কিন্তু একটাই। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে স্লথ বাবাজীর হেলতে দুলতে গাছের নিচে নেমে আসা। কেন রে ভাই, গাছের ওপর থেকে করলেই তো হত। কী দরকার বাপু তোমাদের নেমে আসার? হাঁটতে, চলতে, উঠতে বসতে তোমরা এত আলসেমি করতে পারো, তা পটি করার ব্যাপারেই এত বীরত্ব দেখাতে কে বলেছিল! স্লথেরা এমন কাণ্ডকারখানা যে কেন করে তা ভগবানই জানেন, প্রাণীবিজ্ঞান আজও এর উত্তর খুঁজে পায়নি।
৩। প্রজাপতির ছা পিঁপড়ে তাহার মা
তোমরা ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা’-র গল্প নিশ্চয়ই শুনেছ। আবার কাকের বাসায় কোকিল যে ডিম পেড়ে পালিয়ে যায়, এ খবরও সকলের জানা। কিন্তু সত্যি করে বল তো, নিজেদের ছানাপোনাদের নিয়ে প্রজাপতি ও পিঁপড়েরাও যে চু-কিৎকিৎ খেলে সেকথা কী কেউ জানতে আগে? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছি! জানতে না তো? নো প্রবলেম, চলো আজকে সেই গল্পটাই শোনাই তোমাদের।
ভারতবর্ষের গপ্পো কিন্তু নয় বাপু, সেকথা আমি আগেই বলে দিচ্ছি। আজকে যে দেশটাতে নিয়ে চললুম তোমাদের তার নাম ডেনমার্ক। ইউরোপ মহাদেশের উত্তরদিকে, আটলান্টিক মহাসাগরের কোলে চুপটি করে বসে থাকা ছোট্ট ছবির মতো দেশ। পৃথিবীর ম্যাপে দেখলে দেখতে পাবে ডেনমার্কের দু’পাশে বড়দা এবং মেজদার মতো গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে জার্মানি আর সুইডেন। ও-দেশের রাজধানীর নাম কোপেনহোগেন। ডেনমার্কের জনসংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। পুরো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে বিচ, ওক, ম্যাপল, হেজেলনাট গাছে ঢাকা সরু পথঘাট। ঘাস-ফুলে ঢাকা ঢালু উপত্যকা। পুরনো ধাঁচের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য্যের নানানরকম নিদর্শন পাবে সে-দেশে। ডিজনি চ্যানেলে যে লিটল মারমেড মুভি দেখেছ, সেই লিটল মারমেইড এরিয়েল এবং তার স্রষ্টা হানস ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসনের বাড়িও কিন্তু এই ডেনমার্কে।
তা যাক গে সেসব কথা। আসল কথায় আসা যাক। যে পিঁপড়েমশাইয়ের কথা বলছিলুম তার পোশাকি নাম হল মিরমাইকা (Myrmica Species) এবং প্রজাপতিটির নাম ম্যাকুলিনিয়া অ্যালকন (Maculinea alcon) বা সংক্ষেপে ব্লু অ্যালকন।
মিরমাইকা পিঁপড়ে অত্যন্ত কর্মপরায়ণ এবং কষ্টসহিষ্ণু। বেচারারা সারাদিন খেটেখুটে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাবার যোগাড় করে নিজেদের বাসায় জমায়। আর অন্যদিকে আহ্লাদী অ্যালকন প্রজাপতির দল সারাদিন সাজুগুজু করেই কূল পান না। অ্যালকন বাটারফ্লাই এমন আলসে যে নিজেদের ছানাগুলির দেখভালও এরা নিজেরা করে না। অবশ্য আলসে বলে ভেবো না যেন এদের মাথায় বুদ্ধি নেই। সেয়ানাগিরির ডিপার্টমেন্টে এরা বরাবরই এগিয়ে রয়েছে।
স্ত্রী অ্যালকন প্রজাপতি ডিম পাড়ে ছোটো গাছের পাতায়। এরপর প্রজাপতির ছানা মানে শুঁয়োপোকা বেরিয়ে এলে তারা ভরপেট পাতা খেয়ে পেটটি ফুলিয়ে, খুদে খুদে হাত-পা এলিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকে গাছের নিচে। ঠিক এইখানেই মজাটা শুরু হয়। অ্যালকন ছানার নাদুসনুদুস গোলগাল শরীরের ওপর একটি চকচকে আবরণ থাকে। মিরমাইকা পিঁপড়েদের ছানা বা লার্ভাদের শরীরেও এই একইরকমের আবরণ পাওয়া যায়। অ্যালকন ছানারা জীবন রক্ষার তাগিদে পিঁপড়ে ছানার আবরণের ফর্মুলা ডুপ্লিকেট করে নেয়। ফলস্বরূপ খাবার খুঁজতে এসে শ্রমিক পিঁপড়েরা প্রজাপতির ধাড়ি খোকাকে ভেবে বসে তাদের নিজেদের লার্ভা। এরপর ধেড়ে লার্ভাটিকে টেনেটুনে তারা তাদের নিজেদের গর্তে নিয়ে যায় এবং সেখানেই বহু যত্নে তাদের নিজেদের খোকাখুকুদের সঙ্গে নাইয়ে খাইয়ে বড়ো করতে থাকে। প্রায় দু’বছর পর অ্যালকন খোকাখুকুরা বেশ লায়েক হলে (মানে আক্ষরিক অর্থেই ডানা গজালে) তারা গুটিগুটি পিঁপড়েদের গর্ত থেকে পালিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতিরূপে আকাশে পাড়ি জমায়। অনেক সময় পিঁপড়ের দল নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে পালাতে চাওয়া প্রজাপতিদের আক্রমণ করে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ অ্যালকনের গায়ে শক্ত আঁশ থাকার কারণে তখন আক্রমণ করেও তেমন কিছু লাভ হয় না। ভুল তো যা হওয়ার হয়েই গেছে!
প্রাণী বিজ্ঞানী ডেভিড ন্যাশের মতে, শুধুমাত্র বাইরের আবরণ ডুপ্লিকেট করাই নয়, অ্যালকন ছানারা পিঁপড়ের বাসায় ঢোকার পর আরও একটি কেরামতি দেখায়। এরা রানি পিঁপড়ের আওয়াজ নকল করে ঠিক একইরকমভাবে হাঁকডাক করতে শিখে যায়। বেচারা শ্রমিক পিঁপড়েরা ভাবে এই ধেড়ে লার্ভাটাই বুঝি তাদের নতুন রানিমা। সেইমতো তারাও দিনরাত ধেড়ে খোকার ফাইফরমাশ খেটে মরে। একই কারণে বাসায় খাদ্যের অভাব হলে পিঁপড়ের দল নিজেদের ছানাপোনাদের ছেড়ে প্রজাপতির লার্ভাগুলোকে বাবা বাছা করে খাওয়ায়। ওই ধুমসো লার্ভার পেট ভরানো কি চাট্টিখানি কথা! ফলে যা হওয়ার তাই হয়, দু’দিন বাদে পিঁপড়েগুলো নিজেরাই না খেতে পেয়ে উপোস করে থাকে।
যে যাই বলুক, আমার মনে হয় পিঁপড়েগুলো বোকার হদ্দ। আচ্ছা বাবা, নাহয় বুঝলাম প্রজাপতির ছা পিঁপড়ে খোকার মতোই জামাপ্যান্ট বানিয়ে পরেছে। অমনি তাকে কোলে করে বাসায় নিয়ে যেতে হবে! একটু নেড়েচেড়ে, টিপেটুপে দেখবি না? ভাববি না একবারও যে এতটুকুনি পিঁপড়ের অ্যাত্ত বড়ো ছানা হল কী করে? সাদাসিধে হওয়ারও তো একটা লিমিট আছে রে বাবা! অ্যাত্ত হাঁদা হলে কি চলে আজকাল! তোমরাই বলো!