মহাবিশ্বে মহাকাশে-আগের এপিসোডগুলো একত্রে
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
পাহাড়ে বা সমুদ্র তীরে বেড়াতে গেলে সূর্যোদয় দেখা অন্যতম আকর্ষণ। গোল চাকতির মতো রক্তাভ সূর্য পূব আকাশে যখন প্রথম দেখা দেয় তখন আকাশে শুরু হয় নানা রঙের আলোর খেলা। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আলোর তেজ। সরে যায় অন্ধকারের কালো আবরণ। ঝলমলে পৃথিবীতে তখন প্রাণের উচ্ছাস। প্রায় বারো ঘন্টা পর আবার রক্তিম বর্ণ ধারণ করে সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ডুব দেবার পর পৃথিবীতে নেমে আসে অন্ধকার। এটাই আমাদের কাছে প্রতিদিনের পরিচিত ঘটনা। সূর্য আছে তাই আমরাও আছি। সূর্য যেদিন থাকবে না আমরাও সেদিন থাকব না। অন্ধকারে ডুবে যাবে সমস্ত সৌরজগত। পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে প্রাণের স্পন্দন। বিজ্ঞানীদের ধারণা পৃথিবীই সেদিন থাকবে না। মৃত্যুর আগে সূর্য ফুলে উঠে বিশাল আকার ধারণ করবে আর সেইসঙ্গে গ্রাস করবে পৃথিবীকে। আমাদের জীবনধারণের মূলে যে সূর্য এই সত্যটা প্রাচীনকালের মানুষেরা বুঝেছিল। কিন্তু সেসময় বিজ্ঞান ততটা উন্নত না থাকায় সুর্য সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল অস্পষ্ট। ভয়েই হোক বা অন্য কোনো কারনেই হোক তারা সূর্যকে বসিয়ে ছিল দেবতার আসনে। উন্নত বিজ্ঞানের দৌলতে এই নক্ষত্রটি সম্পর্কে অনেক তথ্যই এখন আমাদের জানা। সেসব আমরা জানব। তবে তার আগে জেনে নেওয়া যাক এই তারাটি সম্পর্কে প্রাচীনকালের মানুষদের ধারণা কেমন ছিল।
প্রাচীন সভ্যতায় সূর্যঃ
সূর্যের ক্ষমতা বা শক্তির কাছে মানুষের ক্ষমতা যে অতি তুচ্ছ সে ধারণা আদিম সভ্যতার মানুষদের মধ্যে ছিল। তাই সূর্যকে তারা দেবতা রূপে পুজো করত। আজটেক সভ্যতায় সূর্যদেবতা ‘হুইটজিলোপক্তলি’ ছিলেন যুদ্ধের দেবতা। হামিংবার্ড বা মাথায় পালক গোজা নীল মানবরূপে তাঁকে কল্পনা করা হত। আজটেকদের কাছে ইনিই ছিলেন সকল দেবতাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।
প্রাচীন মিশরে সূর্যদেবতার নাম ‘রা’। তাঁরা মনে করতেন মহাকাশ হল এক মহাসমুদ্র। ‘রা’ নৌকায় করে সেখানে সারাদিন ঘুরে বেড়াতেন। দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়লে দেবী ‘নাট’ তাঁকে গ্রাস করে ফেলতেন কিন্তু প্রতিদিন সকালে ‘গুবরেপোকা’ হয়ে তাঁর পুনর্জন্ম হত। প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে ‘গুবরেপোকা’ (Scarab beetle) ছিল অতি পবিত্র। ‘রা’-এর প্রতীক পাখাওয়ালা সূর্যের গোলক হলেও দেবতারূপে তাঁর বর্ণনা রয়েছে বাজপাখির মাথাযুক্ত মানবদেহ। মিশরের ফারাওরা নিজেদের ‘রা’-এর পুত্র বলে প্রচার করতেন। ‘রি-হোরাকতি’ নামেও দেবতা ‘রা’ পরিচিত ছিলেন।
গ্রিসে সূর্যের দেবতার নাম ‘হেলিয়োস’। প্রাচীন গ্রিসের মানুষেরা বিশ্বাস করতেন যে ঘোরায় টানা রথে চেপে হেলিয়োস প্রতিদিন আকাশ ভ্রমণে বের হতেন। যতক্ষণ তিনি আকাশে থাকতেন ততক্ষণই তাদের দেশ আলোকিত থাকত। প্রাচীন রোমে সূর্যদেবতা ‘সোল’ নামে পরিচিত ছিলেন।
জাপানিদের কাছে সূর্যদেবতার চেয়ে সূর্যদেবী ‘আমাতেরাসু ওমিকামি’ অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। সেদেশের এক প্রাচীন গল্প অনুযায়ী পরিবারের কারও সঙ্গে সূর্যদেবীর বনিবনা ছিল না। প্রায়শই ঝগড়াঝাটি হত। শেষে একদিন পরিবার থেকে বিতারিত হলে তিনি মনের দুঃখে এক গুহায় আশ্রয় নেন। পৃথিবীর বুকে নেমে আসে অন্ধকার। চারদিকে ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে। দুর্ভিক্ষ, মহামারিতে তখন দেশের মানুষের নাজেহাল অবস্থা। দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য শুরু হয় দেবীবন্দনা। অবশেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে তাঁর সুন্দরতার প্রতিফলন দেখলে তাঁর পুনরাবির্ভাব ঘটে। অন্ধকার সরে গিয়ে পৃথিবী আবার ঝলমল করে ওঠে।
অন্যান্য সভ্যতাগুলির মতো ভারতেও প্রাচীন ঋষিগণ সূর্যকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করতেন। তাঁরা মনে করতেন সূর্য সর্বশক্তিমান। অথর্ববেদে সূর্যকে ‘চক্ষুসমূহের অধিপতি’ রূপে কল্পনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন ও সমস্ত সন্ধানী শক্তির উৎস। যে মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সূর্য বন্দনা করা হয় সেটা হল— “ওঁ জবাকুসুমসংকাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরং”। দেবতাজ্ঞানে কল্পনা করলেও প্রাচীন ভারতীয় ঋষিগণ সূর্যকে অন্য রূপেও দেখেছিলেন। ঋকবেদের অনেক শ্লোকেই সূর্যকে আকাশে দোদুল্যমান একটি মুক্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এথেকেই বোঝা যায় যে সূর্য যে একটি জড়পদার্থ সে ধারণা প্রাচীন ঋষিদের ছিল। শুধু তাই নয় সৌরবছর, চান্দ্রবছর, মলমাস, সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন ইত্যাদি সম্বন্ধেও তাঁদের জ্ঞান ছিল। কথিত আছে অত্রিমুনি ও তাঁর বংশধরেরা গণনা করে সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে পারতেন। সূর্য সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায় আর্যভটের ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ গ্রথে। এতে সূর্যের আবর্তন কাল, সূর্যগ্রহণ গণনা, উদয়ান্ত গণনা প্রভৃতি নানা বিষয় আলোচিত হয়েছে। এটি রচিত হয়েছিল খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে। পরবর্তীকালে ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’ নামে আরেকটি গ্রন্থের সন্ধান আমরা পাই। এর রচয়িতা ছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীর ভাস্করাচার্য। এই প্রামাণ্য গ্রথ দুটি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা যথেষ্ট উন্নত মানের ছিল।
সূর্যের উপাদান
সূর্য একটি জ্বলন্ত গ্যাসের পিণ্ড। এর কোথাও কঠিন বা তরল পদার্থের অস্তিত্ব নেই। এর উপাদানগুলি হল— হাইড্রোজেন(73.46%), হিলিয়াম (24.85%), অক্সিজেন(0.77%), কার্বন ( 0.29%), লোহা (0.16%), নিয়ন (0.12%), নাইট্রোজেন (0.09%), সিলিকন (0.07%), ম্যাগনেশিয়াম (0.05%), সালফার( 0.04%)।
সূর্যের সমস্ত শক্তির উৎসস্থল হচ্ছে এর কেন্দ্রীয় অঞ্চল। সেখানে অবিরত ঘটে চলেছে এক বিস্ময়কর বিক্রিয়া। এই নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার ফলেই হাইড্রোজেন পরমাণু (প্রোটন) রূপান্তরিত হচ্ছে হিলিয়ামে। চারটে হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে একটি হিলিয়াম পরমাণু তৈরি হচ্ছে। এই রূপান্তরের সময় 0.07% ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ফলে সূর্যের কেন্দ্রস্থলে সৃষ্টি হয় অফুরন্ত পারমাণবিক শক্তি ও উত্তাপ। এছাড়াও এই সময় বিকিরিত হয় গামা রশ্মি সহ আরও নানা ধরনের রশ্মি এবং নির্গত হয় আলোককণার সঙ্গে পজিট্রনস্ (Positrons) ও নিউট্রিনোস্ (Neutrinos) কণা। কেন্দ্রস্থলে উৎপন্ন এই শক্তি সূর্যের পৃষ্ঠদেশে এলে তবেই সূর্যের উপরিদিকের অংশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তবে প্রচন্ড চাপের দরুন কেন্দ্রে তৈরি হওয়া এই শক্তি আলোকমন্ডলে পৌঁছাতে প্রায় দশ থেকে কুড়ি লক্ষ বহু বছর সময় লাগে। সূর্যের পৃষ্ঠদেশ থেকে এই আলোকশক্তি পৃথিবীতে আসতে সময় নেয় মাত্র 8.3 মিনিট।
আলোকমণ্ডলের উপরে থাকে সূর্যের আবহমণ্ডল। এই আবহমণ্ডল তিন ভাগে বিভক্ত— বিশোষকমণ্ডল, বর্ণমণ্ডল এবং সৌরকিরীট বা করোনা। আবহমণ্ডলের এই স্তর সূর্যের পৃষ্ঠদেশে খুব অল্প এলাকা (প্রায় 1000 কিমি) জুড়ে আছে। তুল্পনায় বর্ণমণ্ডলের প্রসার অনেক বেশি (প্রায় 15000 কিমি) এর নয়নাভিরাম লালচে-কমলা রঙ সহজে দেখা যায় না। একমাত্র পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় খুব সামান্য সময়ের জন্য দেখা যায়। বর্ণমণ্ডলের উপরে রয়েছে সৌরকিরীট বা করোনা। এর বিস্তৃতি বহু দূর পর্যন্ত। এই অঞ্চলটি খুবই সুন্দর দেখতে। তবে আলোকমণ্ডলের অত্যাধিক ঔজ্জ্বল্যের জন্য একে আমরা সবসময় দেখতে পাই না।
সূর্যের গঠন
গঠনের বৈচিত্র্য অনুযায়ী সূর্যকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করা যায়। যেমন— ছটামণ্ডল (করোনা), বর্ণমণ্ডল (ক্রোমোস্ফিয়ার), আলোকমণ্ডল (ফোটোস্ফিয়ার), কনভেকশন জোন, রেডিয়ো অ্যাকটিভ জোন (তেজস্ক্রিয়মণ্ডল) এবং কেন্দ্র অঞ্চল।
পৃথিবীকে ঘিরে আছে বায়ুমণ্ডল। তেমনই সূর্যকে ঘিরে আছে একটা গ্যাসের (প্লাজমা) আবরণ। এর ঘনত্ব খুবই কম। এই গ্যাসের আবরণকেই বলা হয় সূর্যের আবহমণ্ডল। লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত ‘করোনা’ সূর্যের আবহমণ্ডলের সবচেয়ে বাইরের অংশ। এর বিস্তৃতি প্রায় 3.6 কোটি মাইল। অর্থাৎ প্রায় বুধগ্রহের সীমানার কাছাকাছি পর্যন্ত। সূর্যের এই অঞ্চলটি এতই উত্তপ্ত যে মনে হয় সর্বদা জ্বলছে। এই অংশের তাপমাত্রা দশ লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ত্রিশ লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে।
পৃথিবীর মতো সূর্যেরও আহ্নিকগতি আছে। যেহেতু সূর্যের শরীর উত্তপ্ত গ্যাসের তাই তার কোনো অংশ একটু বেশি বেগে ঘুরছে, আবার কোনো অংশ একটু কম বেগে। বিষুবরেখায় ঘুর্ণন বেগ বেশি হওয়ায় সেখানকার আবর্তনকাল 25 দিনে আর মেরুতে 31 দিনে। ফলে সূর্যের গোটা শরীর সবসময় একরকম থাকে না।
সূর্যকে একটি ডিমের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। কুসুম অংশটি হল সূর্যের ‘কেন্দ্র অঞ্চল’ বা ‘কোর’ (Core)। এই অঞ্চলটি সূর্যের মোট আয়তনের 2% ও মোট ভরের 60% নিয়ে গঠিত। এখানেই ঘটে হাইড্রোজেনের নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়া। এরফলে প্রায় সারে চার লক্ষ কিলোমিটার ব্যাসযুক্ত এই অঞ্চলে উদ্ভূত হয় প্রচন্ড তাপ— প্রায় দেড় কোটি ডিগ্রি কেলভিনের মতো। আর চাপ থাকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চাপের প্রায় একশো গুণ বেশি। এত উচ্চ তাপে কোনো পদার্থই গ্যাসীয় অবস্থায় থাকতে পারে না, থাকে প্লাজমা অবস্থায়। তাই সূর্যকে জ্বলন্ত গ্যাসের পিন্ড না বলে উচিত হবে জ্বলন্ত প্লাজমার পিন্ড বলা।
কেন্দ্র অঞ্চলের উপরেই থাকে ‘রেডিয়েটিভ জোন’ (Radiative Zone) বা ‘তেজস্ক্রিয় মণ্ডল’। কেন্দ্রে উদ্ভুত শক্তি এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পরবর্তী অঞ্চলে অর্থাৎ পরিচলন অঞ্চলে (কনভেকশন জোন বা কনভেকটিভ জোন) এসে পৌঁছোয়। এর ব্যাপ্তি প্রায় দু-লক্ষ কিলোমিটারের মতো অর্থাৎ কোর-এর বাইরে কুড়ি থেকে তিরিশ শতাংশ এলাকা জুড়ে। এই অঞ্চলে আয়নিত গ্যাসীয় বুদবুদ অতিরিক্ত শক্তি নিয়ে হালকা হয়ে অজস্রধারায় সূর্যের পৃষ্ঠতলের দিকে চলে যায়। সেখানে অতিরিক্ত শক্তি ছেড়ে ঠান্ডা ও ভারী হয়ে তা আবার পরিচলন অঞ্চলের শেষপ্রান্তে ফিরে আসে। আয়নিত গ্যাসীয় বুদবুদের এই চক্রাকার গতির্ কারণেই সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি।
পরিচলন অঞ্চলের ঠিক উপরেই থাকে আলোকমণ্ডল। এর উপরেই আছে সূর্যের আবহমণ্ডল। এটি তিন ভাগে বিভক্ত— বিশোষকমণ্ডল, বর্ণমণ্ডল এবং করোনা বা সৌর কিরীট।
বিশোষকমণ্ডলের বিস্তার খুব বেশি নয়। মাত্র 1000 কিলোমিটারের মতো। এই মণ্ডলটি সূর্যের অন্যান্য অংশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত শীতল হওয়ায় অধিকাংশ পার্থিব মৌল গ্যাসীয় অবস্থায় এই অঞ্চলে থাকে।
বর্ণমণ্ডলকে অনেক সময় বিশ্লেষণমণ্ডলও বলা হয়ে থাকে। এই অঞ্চলটি্র বিস্তৃতি প্রায় 5000 কিলোমিটার মতো। আলোকমণ্ডলের কাছাকাছি বর্ণমণ্ডলের তাপমাত্রা প্রায় 4000° সেলসিয়াসের মতো হয়ে থাকে। এখানকার ঘনত্ব সূর্যের অন্যান্য অংশের তুলনায় কিছুটা কম থাকে। বর্ণমণ্ডলের উপরের দিকের যে অংশটি করোনার কাছাকাছি থাকে সেখানকার তাপমাত্রা থাকে 5,00,000° সেলসিয়াসের মতো বা তারও বেশি। সূর্যের তীব্র আলোর জন্য বর্ণমণ্ডলের অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে বোঝা যায় না। একমাত্র পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় একে আমরা দেখতে পাই। সেসময় সূর্যের চারপাশে লালচে-কমলা রঙের যে নয়নাভিরাম আলোর ছটা দেখা যায় সেটাই হল বর্ণমণ্ডল। অতীব এই সুন্দর দৃশ্য এই একটি সময় ছাড়া আর কখনই দেখা যায় না। বর্ণমণ্ডলের লালচে-কমলা রঙ H+ আয়নের আধিক্যের জন্য হয়ে থাকে।
বর্ণমণ্ডলের উপরে রয়েছে অপূর্ব সুন্দর করোনা বা সৌর কিরিটি। তবে ফটোস্ফিয়ারের আলোর আধিক্যের জন্য বর্ণমণ্ডল এবং করোনা কোনোটাই আমরা দেখতে পাই না। বর্ণমণ্ডল থেকে গ্যাসের স্রোত ঘন্টায় প্রায় 30 লক্ষ কিলোমিটার বেগে নিক্ষিপ্ত হয়ে করোনাতে গিয়ে পড়ে। এই বিশাল আয়তনের গ্যাসের স্রোত বা চাদরকে বলা হয় ‘প্রমিনেন্সেস্’ (Prominences)। এগুলি সূর্যের পৃষ্ঠতল থেকে সর্বোচ্চ 4,80,000 কিলোমিটার উঁচু পর্যন্ত নিক্ষিপ্ত হতে পারে। সৌরকলঙ্কের উপর অবস্থিত চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে এগুলি লুপ বা ফাঁসের আকারে আবার সূর্যের পৃষ্ঠতলে ফিরে আসে। তাই করোনার ব্যাপ্তি বহুদূর। সূর্যের ব্যাসের প্রায় 4 গুণ অব্দি। এই প্রসঙ্গে বলি, বর্ণমণ্ডলের তাপমাত্রার তুলনায় করোনার তাপমাত্রা অনেক গুণ বেশি। বর্ণমণ্ডলের তাপমাত্রা যেখানে 10K – 25000 K সেখানে করোনা বা সৌর-কিরীট-এর তাপমাত্রা প্রায় 10,00,000K। এখান থেকেই সূর্যের তাপ বিকিরিত হতে থাকে এবং সেই তাপ গ্রহগুলিতে এসে পৌঁছোয়। ‘সৌর-ঝটিকা’ নামে করোনা প্রবাহের গতিবেগ থাকে প্রায় প্রতি সেকেন্ডে 400 কিলোমিটারের মতো। এই প্রবাহে থাকে অসংখ্য তড়িতাহিত কণিকা। বর্ণমণ্ডলের তুলনায় করোনা অঞ্চলের তাপমাত্রা(উষ্ণতা) এত বেশি কেন এই প্রশ্নের উত্তর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখনও খুঁজে পান নি। তবে অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, বিকিরণ ক্ষেত্রের কোনো আলোড়নের কারণে তাপের এই হেরফের।
সৌর লক্ষণীয়তা (Solar Prominences)
সৌরঘটনাগুলির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ঘটনা হল ‘সৌর লক্ষণীয়তা’। পৃথিবীর আকাশে যেমন নানা বৈচিত্রের মেঘ দেখা যায় তেমন সূর্যের আকাশে দেখা যায় এই সৌর লক্ষণীয়তা। এগুলি উৎপন্ন হয় মূলত সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে। লক্ষণীয়তা দু’ধরনের হয়ে থাকে— (i) ক্ষণস্থায়ী(Transient) এবং (ii) দীর্ঘস্থায়ী (Quiescent)। প্রথমটির কারণ প্রবল উষ্ণতা। আর দ্বিতীয়টির কারণ উচ্চমানের চৌম্বকক্ষেত্র। এগুলির তাপমাত্রা বা উষ্ণতা 30,000 K থেকে 1,00,000 K পর্যন্ত হয়ে থাকে। এগুলি থেকে প্রচুর পরিমাণে অতিবেগুনি রশ্মি বিকিরিত হয়। কোনো কোনো সৌর লক্ষণীয়তার উচ্চতা চার লক্ষ কিলোমিটারেরও বেশি হয়ে থাকে।
আর একটি অতীব সুন্দর সৌরঘটনা হল ‘সৌরশিখা’(Solar Flares)। সৌরশিখার সৃষ্টি সৌরকলঙ্ক থেকে প্রচুর পরিমাণে চৌম্বক শক্তি নিঃসরণের কারণে। সৌরশিখা নানা আয়তনের হয়ে থাকে। কোনো কোনোটার দৈর্ঘ্য পাঁচ লক্ষ কিলোমিটারও ছাড়িয়ে যায়।
মহাকাশে সূর্য কোথায়ঃ
বিগব্যাং-এর পর তৈরি হল মহাবিশ্ব। মহাকাশে জন্ম হল অসংখ্য কোটি নক্ষত্রর। এরা নিজেদের মধ্যে জোট বাঁধল। তৈরি হল ‘গ্যালাক্সি’ বা ‘তারাজগত’। মহাকাশে কতগুলি তারাজগত আছে? এর সঠিক উত্তর বিজ্ঞানীদেরও জানা নেই। কারণ মহাবিশ্ব বা মহাকাশের খুব সামান্য অংশই আমরা দেখতে পাই। বেশিরভাগটাই চোখের আড়ালে। তাই বলতে হয় অসংখ্য কোটি তারাজগত মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই রকমই একটি তারাজগতের নাম ‘মিল্কিওয়ে’ বা ‘ছায়াপথ’। এই ছায়াপথের এক ধারে আছে অতি সাধারণ মানের একটি তারা। নাম সূর্য। এই তারাটিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে সৌরজগত। এখানকারই একটি গ্রহের নাম পৃথিবী। সেটাই আমাদের বাসভূমি।
সূর্য G2V শ্রেণীভুক্ত নক্ষত্র। এর ভর সৌরমণ্ডলের সব গ্রহদের মোট ভরের 743 গুণ এবং পৃথিবীর ভরের 3,30,000 গুণ। সূর্যের শক্তি বিকিরণের হারকে বলা হয় ‘সৌর ধ্রুবক’ (Solar Constant)। এর মান হল 137 আর্গ/বর্গ মিটার/সেকেন্ড(ergs/m²/sec)। তবে প্রতি 11 বছর অন্তর যখন সৌরকলঙ্ক দেখা যায় তখন এই বিকিরণের হার অনেকটাই বেড়ে যায়। সূর্যের কেন্দ্রস্থলের চাপের পরিমাণ হল 3,500 কিলোবার(Kilobars)। সূর্যের কেন্দ্রে তাপকেন্দ্রকীয় বিক্রিয়ায় (Thermonuclear Reaction) বা কেন্দ্রকীয় সংযোজন (Nuclear Fusion) প্রক্রিয়ায় চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে একটি হিলিয়াম পরমাণু তৈরি হচ্ছে। চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ভর হল 4×1.0078=4.0312 তড়িৎ-চুম্বকীয় একক। আর একটা হিলিয়াম পরমাণুর ভর হল 4.0026 একক। দুই ভরের পার্থক্য হল 0.0286 (4.0312-4.0026) একক। আইনস্টাইনের E=mc² সূত্র মেনে এর থেকেই সূর্যের কেন্দ্রে বিপুল শক্তি উৎপাদিত হচ্ছে। সূর্যের কেন্দ্রে বর্তমানে যে হারে শক্তি উৎপাদন হচ্ছে তা যদি চালু থাকে তাহলে সূর্যের আয়ু 1000 কোটি বছরের মতো। তার মধ্যে 500 কোটি বছর অতিক্রান্ত। অতএব সূর্য ক্রিয়াশীল থাকবে এখনও আরও 500 কোটি বছর। তাই বলা যায় সূর্যের এখন ভরা যৌবন। এরপর সে ধীরে ধীরে এগোতে থাকবে বৃদ্ধকালের দিকে। তারপর একদিন কেন্দ্রে সঞ্চিত সবটুকু হাইড্রোজেন ফুরিয়ে যাবে। তখন সূর্য ‘লাল দানব’-এ পরিণত হবে। এইসময় এর আয়তন বাড়তে বাড়তে পৃথিবী পর্যন্ত তো আসবেই, এমনকী মঙ্গল গ্রহকেও সে গ্রাস করতে পারে। এরপর এর পরিণতি হবে ‘সাদা বামন’ (White Dwarf) নক্ষত্রে। ভয় নেই। এখনও 500 কোটি বছর নিশ্চিন্ত। অবশ্য ততদিনে জীবজগতে অনেক পরিবর্তন আসবে। আর সেই পরিবর্তনের ধাক্কায় পৃথিবীর বুকে মানবজাতি টিকে থাকবে কিনা জানা নেই।
এক নজরে সূর্য
পৃথিবী-সূর্য গড় দূরত্বঃ(i)1.496x. কিলোমিটার বা(ii) 8 মিনিট19 সেকেন্ড আলোর গতিতে।
ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে সূর্যের গড় দূরত্বঃ (i) 2.7×1017 কিলোমিটার বা (ii) 27200 আলোক-বর্ষ
সূর্যের বিষুব ব্যাসার্ধঃ (i) 696342±65 কিলোমিটার বা (ii) 109xপৃথিবীর বিষুব ব্যাসার্ধ।
সূর্যের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফলঃ (i) 6.09x 10¹² বর্গ কিলোমিটার বা (ii) 12000xপৃথিবীর পৃষ্ঠতল।
সূর্যের আয়তনঃ (i) 1.41×1018 ঘন কিলোমিটার বা (ii) 13,06,000xপৃথিবীর আয়তন।
সূর্যের ভরঃ (i)(1.98855±0.00025)x1030 কিলোগ্রাম বা (ii)333000xপৃথিবীর ভর।
সূর্যের গড় ঘনত্বঃ (i) প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে 1.408 গ্রাম বা (ii) 0.255xপৃথিবীর ঘনত্ব।
সূর্যের মুক্তিবেগ(Escape velocity): (i) 617.7 কিমি/সে (ii) 55xপৃথিবীর মুক্তিবেগ।
সূর্যের করোনার তাপমাত্রা(উষ্ণতা): 106 K(প্রায়)
সূর্যের ঔজ্জ্বল্যঃ (i) 3.846×1026 W (ii) 3.75×1028 lm
সূর্যের বিষুব অঞ্চলে ঘূর্ণন বেগঃ 7.189×103 কিমি/ঘন্টা
সূর্যের নিজ অক্ষের উপর আবর্তনকালঃ 25 দিন 3 ঘন্টা 21 মিনিট 36 সেকেন্ড।