কেম্যাজিক-> পান্নালাল গোস্বামী
“হেই ঘুরিন্দর”?(জাদুকর)
“হ্যাঁ ওস্তাদ।”(প্রথম শাগরেদ)
“হেই মহিন্দর?”(জাদুকর)
“আছি ওস্তাদ।” (দ্বিতীয় শাগরেদ)
“বাবার অনারে যজ্ঞ হবে কি হবে না?”
“হবে ওস্তাদ।”(দুই শাগরেদ)
“যজ্ঞবেদি কোথায়?”(জাদুকর)
“এই আনছি ওস্তাদ”-বলেই দুজন দৌড়ে গিয়ে উইংসের পাশ থেকে একটা চতুষ্কোণ যজ্ঞবেদি এনে টেবিলের ওপর রাখল। যজ্ঞবেদিটা সুন্দরভাবে ছোটোছোটো কাঠ-বাঁশের টুকরো দিয়ে সাজানো। তাতে আবার কয়েকটা ফুলটুলও আছে।
“যজ্ঞবেদিতে আগুন জ্বলবে কীভাবে?”
“ঘি ঢালতে হবে ওস্তাদ। সঙ্গে আপনার অগ্নি-আহ্বান মন্ত্র।”
“ঘি কোথায়?”
“আনছি ওস্তাদ”,বলেই একজন শাগরেদ ছুটে গিয়ে উইংসের পাশ থেকে একজোড়া কোশাকুশি এনে টেবিলের ওপর রাখল। ওটায় যে ঘি জাতীয় একটা কিছু তরল আছে তা দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে।
আরম্ভ হল যাদুকর মন্ত্র, “হে বাবা কেম্যাজিকেশ্বর, হে বাবা কেম্যাজিকেশ্বর, তোমার মহিমা দেখাও।অগ্নিদেবকে যজ্ঞস্থলীতে আসার জন্যে আজ্ঞা দাও। হে অগ্নি তুমি সর্বগ্রাসী হুতাশন,তুমি আঁধার বিনাশী সর্বপাপহর,তুমি দীপ্যমান তাপ উদ্রেককারী,তুমি আলোক বর্তিকা,তুমি যজ্ঞাধিকারী,আমার আহুতি গ্রহণ কর, তুমি স্বরূপে প্রকাশিত হও”, ইত্যাদি মন্ত্র জোরে জোরে বলছেন আর কুশিটা দিয়ে কোশা থেকে ঘি নিয়ে যজ্ঞস্তূপে ওপর থেকে ঢেলে যাচ্ছেন। ডম্বরু আর ঘণ্টার বাজনাও পূর্ণোদ্যমে চলছে।
আবারও মন্ত্র আরম্ভ, “O fire, O great energy, please appear, please appear,হে অগ্নিদেব,হে মহাশক্তি,তুমি এখানে আর্বিভূত হও,তুমি নিজেকে স্বরূপে প্রকাশ কর…”ইত্যাদি মন্ত্র পড়ছেন আর ক্রমাগত একটা ক্ষীণ ধারায় কুশিটা দিয়ে কোশা থেকে ঘি ঢেলে যাচ্ছেন।
কিছুসময়ের ভেতরেই যজ্ঞস্তূপটা থেকে প্রথমে অল্প অল্প ধোঁয়া বেরোতে লাগল,আর জাদুকর চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওইতো,প্রভু আসছেন,তাঁর আগমনবার্তা চলে এসেছে”,বলতে বলতেই যজ্ঞস্তূপ থেকে ফরফরিয়ে প্রচুর আগুন বেরিয়ে আসতে থাকল।
রহস্যটা কোথায়?
এখানে একটা সাধারণ জারণ(Oxidation) বিক্রিয়ার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। কোশাটায় ঘি নয়,ছিল বিশুদ্ধ গ্লিসারিন। যজ্ঞস্তূপটাতে কাঠের গুঁড়ো, কাঠের চোকলা, সরু সরু পাটকাঠি, বাঁশ ইত্যাদির তলায় যথেষ্ট পরিমাণে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের দানা রাখা। এই পারম্যাঙ্গানেট এক অতিশয় তীব্র জারক(Oxidising agent)। গ্লিসারিন এর সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে জারিত হতে শুরু করে দেয়।এই জারণ বিক্রিয়াটা প্রচন্ড রকমের তাপবর্জী(Exothermic)। এই তাপে বাতাসে থাকা অক্সিজেনের সাহায্যে কাঠ-বাঁশ ইত্যাদিতে সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়।আগুন জ্বালার ক্ষেএে এসবের সঙ্গে গ্লিসারিনও ইন্ধনের কাজ করে থাকে।
সাবধানতা
আগুন জ্বলার এক দেড় মিনিট পরই যজ্ঞবেদিটা হলঘর থেকে বের করে দেবে।
কাঠের গুঁড়ো,কাঠের চোকলা,কাঠখড়ি,বাঁশ ইত্যাদি শুকনো হতে হবে।
বিশুদ্ধ গ্লিসারিন লাগবে।
গুঁড়ো পারম্যাঙ্গানেট ব্যবহার না করে একটু ছোট-বড় দানাদার পারম্যাঙ্গানেট নিলে বিক্রিয়াটা অনেক মনোগ্রাহী হবে।
বিকল্প পদ্ধতি
এই কাজটা তোমরা আরেকভাবেও দেখাতে পার। একটা বড়ো কাঠের পিঁড়ির ওপরে মাটি দিয়ে একটা মস্ত পাহাড় বানিয়ে নাও। তারপর ওর মধ্যে এখানে সেখানে বেশ কয়েক জায়গায় আঙুল দিয়ে কয়েকটা ছোট ছোট গর্ত করে ওটা শুকিয়ে নাও।এখন ওই গর্তগুলোয় প্রথমে একটু শুকনো কাঠের গুঁড়ো দিয়ে ওর ওপর অল্প অল্প পারম্যাঙ্গানেট রেখে আলতো করে কাঠের চোকলা দিয়ে ঢেকে দিলেই তোমর যন্ত্র রেডি।
এখন স্টেজে পাহাড়টা এনে দর্শকদের বল যে এই পাহাড়টা দৈবশক্তিসম্পন্ন। এর ওপর বৃষ্টির জলের ফোঁটা পড়লেই এটা আগ্নেয়গিরিতে রূপান্তরিত হয়ে যায় আর এখান সেখান থেকে অগ্ন্যুৎপাত হতে থাকে। এই বলে একটা ঝাঁঝ্রির সাহায্যে পাহাড়ের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার মতো করে গ্লিসারিন পড়তে দাও,তারপরই খেলা জমে যাবে।
আমি তো মাত্র দু’খানা পরামর্শ দিলাম। তোমরা নিজের মতো ভেবে আরও অনেক বিকল্প বের করতে পার।
বিনা ইলেকট্রিসিটিতে বাল্ব জ্বলে
“ওস্তাদ,প্রভুর সামনে একটা বাল্ব জ্বালাতে হবে।”
“বাল্ব জ্বালাবি!এখানে ইলেক্ট্রিসিটি কোথায়?”
“ইলেকট্রিক কারেন্ট লাগবে না গুরু।আপনার মন্ত্র আর কেম্যাজিকেশ্বরের কৃপা হলেই বাল্ব জ্বলবে।”
“শুধু মন্ত্র হলেই হবে? যন্ত্র কোথায়?”
“আনছি ওস্তাদ”,বলেই এক শাগরেদ একটা পার্শ্বনলী থাকা কনিকেল ফ্লাস্ক এনে টেবিলের ওপর রাখলো। ফ্লাস্কের ভেতর যে অল্প পরিমাণে একটা বর্ণহীন তরল পদার্থ আছে সেটা দূর থেকে ভালো করে লক্ষ না করলে বোঝা যায় না।
“এটা কী?”(জাদুকর)
“বাল্বের বাইরের কাচের আবরণ।”(শাগরেদ)
“জ্বলবে কী?”(জাদুকর)
“এই আনছি গুরু”,বলে দ্বিতীয় শাগরেদ তারের জালি লাগানো একটা কাচদন্ড জাদুকরের হাতে দিল। ওই কাচদন্ডের একটা মাথায় একটা এক সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের ছোট পাতলা তারের কুন্ডলী ফিউজ করে লাগানো আছে।
“এইটা দিয়ে বাল্ব জ্বলবে?”(জাদুকর)
“আপনি মন্ত্র গেয়ে তারের এই কুন্ডলীটা এর ভেতর ঢুকিয়ে দিলেই কুন্ডলীটা জ্বলে দীপ্তিমান হয়ে আলো বিলানো শুরু করবে”,বলে কনিকেল ফ্লাস্কটা দেখিয়ে দিল।
“ঠিক আছে,তা-হলে দেখাই যাক”,বলে জাদুকর একদিকে তারের জালি আর অন্যদিকে তারের কুন্ডলী লাগানো কাচদন্ডটা হাতে নিয়ে একবার করে টেবিলের তলায় নামিয়ে দিচ্ছেন আর ওপরে ওঠাচ্ছেন,সঙ্গে চলছে তার “অংবং” করে মন্ত্র। একরকম করতে করতে হঠাৎই ওই কাচদন্ডটা ফ্লাস্কের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন। তারের জালির জন্যে কাচদন্ডটা লম্বভাবে ফ্লাস্কের মুখে ঝুলে থাকল আর কুন্ডলীটা রইল ফ্লাস্কের ভেতরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল যে তারের কুন্ডলীটা উজ্জ্বলভাবে জ্বলতে শুরু করে আলো ছড়াচ্ছে।সম্পূর্ণ ফ্লাস্কযন্ত্রটাকে মনে হচ্ছে একটা জ্বলন্ত বাল্ব।
এখানে কী ঘটছে?
এখানেও আসলে একটা জারণ বিক্রিয়াই সংঘটিত হচ্ছে। পার্শ্বনলীযুক্ত কনিকেল ফ্লাস্কটার ভেতর 15ml মিথানল (মিথাইল অ্যালকোহল) নেওয়া আছে,আর এটা ভালো করে লক্ষ না করলে চট করে নজরে আসে না। কাচদন্ডটার একটা মাথায় প্লাটিনামের পাতলা তারের কুন্ডলী পাকিয়ে ফিউজ করে আটকে দেওয়া হয়েছে। কাচদন্ডটার অন্যপ্রান্তে একটা তারের জালি এমনভাবে লাগানো আছে যাতে কুন্ডলীটা ওই তরলের ওপর দুই থেকে আড়াই সেন্টিমিটার উপরে ঝুলে থাকে।
জাদুকর যে দুই-তিনবার কাচদন্ডটা টেবিলের তলায় নিয়ে গিয়েছিলেন,সেটা ওই তারের কুন্ডলীটাকে একটা বার্নারে তপ্ত করে নেওয়ার জন্যে। এই জ্বলন্ত বার্নারটা টেবিলের পেছনে থাকায় দর্শকের কাছে অদৃশ্য ছিল। ওই তপ্ত কুন্ডলীটা যেইমাত্র ওই ফ্লাস্কের ভেতরের তরলের ওপর নির্দিষ্ট উচ্চতায় ঝুললো অমনি মিথানলের ভাপ আর বাতাসে থাকা অক্সিজেন ওই প্লাটিনাম তারের ওপর বিক্রিয়া শুরু করে দিল। এখানে প্লাটিনাম অনুঘটকের কাজ করছে আর মিথানল(অ্যালকোহল)জারিত হয়ে মিথানেল-এ(অ্যালডিহাইড) পরিণত হচ্ছে। এই জারণ বিক্রিয়াটা সাংঘাতিক ধরনের তাপবর্জী(Exothermic)বিক্রিয়া। যেহেতু বিক্রিয়াটা তারের ওপরই সংঘটিত হচ্ছে,ফলে উদ্ভূত প্রায় সমস্ত তাপই তারের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে ওটাকে দীপ্তিমান করে তুলেছে। বিক্রিয়াটা আরম্ভ করার জন্যে তারের কুন্ডলীটাকে প্রথমে একটু গরম করে নেওয়া হয়েছিল।জালির ফাঁক দিয়ে মিথানল আর জলবাষ্প ফ্লাস্কের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আর অক্সিজেন নিয়ে বাতাস পার্শ্বনালী দিয়ে ফ্লাস্কের ভেতর ঢুকছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ভেতরে মিথানল থাকবে ততক্ষণ ওই বাল্বটা জ্বলতে থাকবে।
এখানে তোমরা একটু মজাও করতে পার। জ্বলতে থাকা কাচদন্ডটা দশ-পনেরো সেকেন্ডের জন্যে বাইরে বের করে নিয়ে এসো,দেখবে কুন্ডলীটা নিভে গেছে। আবারও ঢুকিয়ে দিলেই সঙ্গে সঙ্গেই জ্বলে উঠবে।
সাবধানতা
এই ম্যাজিকটা দেখানোর আগে রিহার্সেল দিয়ে প্লাটিনাম তারের কুন্ডলীটার সঙ্গে ফ্লাস্কে থাকা মিথানলের সঠিক দূরত্বটা ঠিকঠাক করে নিতে হবে।
বিশুদ্ধ মিথানল ব্যবহার করতে হবে। মিথানল উদ্বায়ী এবং খুবই দাহ্য। সাবধানে ব্যবহার করবে।
প্লাটিনাম তারের কুন্ডলীটা যাতে সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকে সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
আরম্ভের সময় ফ্লাস্কে থাকা সম্পূর্ণ ভাপটা দপ করে জ্বলে উঠতে পারে। ভয় পেয়োনা,তোমাকে কিছু করতে হবে না।ওটা আপনা আপনিই নিভে গিয়ে তোমার উদ্দিষ্ট বিক্রিয়া আবারও ধীরে ধীরে শুরু করবে।