পোষ্য
ঋতা বসু
শিক্ষা বিশেষজ্ঞ। নির্দেশক, দিশারী
এই ধাঁধাটা নিশ্চয়ই সবাই একবার করে শুনেছে -কী জিনিস দান করলে বেড়ে যায়?
যারা জানে না তাদের জন্য-উত্তরটা হল ভালবাসা। এই একটা জিনিস যে মানুষের কতবড়ো সম্পদ সেটা সে বেশিরভাগ সময়ে ভুলে বসে থাকে। একমাত্র মানুষই পারে এই বিশ্বসংসারের প্রতিটা জিনিস-গাছপালা,তরুলতা,প্রাণী কীটপতঙ্গ সবাইকে ভালবাসতে। সবাইকে তার হৃদয়ের গন্ডীর মধ্যে টেনে নিতে।যারা নিজেদের এই সম্পদটিকে চিনতে পারে না বা আছে বলে বুঝতেও পারে না তারা সত্যিই অভাগা।
এখনকার ব্যস্ত জীবনে মানুষ নিজেকে নিয়েই নাজেহাল।পড়াশোনার চাপ,কর্মজগতের দায়,ইটের পরে ইট দিয়ে ঠাসা শহর, এরমধ্যে এইরকম সূক্ষ্ম বৃত্তির চর্চা একরকম অসম্ভব ব্যাপার। আধুনিকতার দায় মেটাতে গিয়ে পরিবার ছোটো,থাকার জায়গা আক্ষরিক অর্থেই তেঁতুলপাতা। সময় নেই কারও কাছে।এর দাম দিতে হচ্ছে আজকের পৃথিবীকে। মানুষ নিজেকে নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে তার কারও কথা ভাবার সময় নেই। যদিবা দু চারটে প্রিয় মানুষ বন্ধু স্বজন থাকেও, আশা-প্রত্যাশা রাগ-দুঃখ বিরক্তি এসবের মাঝে পড়ে হাঁফিয়ে ওঠে সেইসব সম্পর্ক। এদিকে মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব। সে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে ভালবাসে। নিজের জন্যই তার দরকার অন্যকে।
তবু একদম নিজের মতো দেখতে, নিজেরই মত আচার আচরণ এমন কাউকে ভালবাসা অপেক্ষাকৃত সোজা। সবাই আরাম পায় নিজের জানা চেনা জগতটির মধ্যে। সেইজন্য বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। কিন্তু এই শিশু একদিন বড়ো হবে।মায়ের কোলটি তাকে ছেড়ে দিতেই হবে। আজকের মা-ও ফিরবেন তাঁর আপন কর্মজগতে।
পরিবারের কাঠামো গত কয়েকবছরে এমন বদলে গিয়েছে যেন একটা যুগান্তর ঘটে গিয়েছে।পরিবার ছোটো হতে হতে তিন চার সদস্যে এসে ঠেকেছে।এরমধ্যে যেকোনো সদস্যের থাকার মেয়াদ হতেই পারে সাপ্তাহিক বা মাসিক বা কোনই নিয়ম নেই যখন খুশি তখন।পেশা, পড়াশোনা বা সম্পূর্ণ অন্য কোনো কারণে খুব কাছের লোকেদের এক সঙ্গে না থাকাটা ক্রমশ স্বাভাবিক আজকের দুনিয়ায়।ফলে যে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে এটাকে সামাল দেওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে।
নিশ্চয়ই অনেক রকম সমাধানের রাস্তা আছে। পন্ডিত ব্যাক্তিরা মাথাও ঘামাচ্ছেন নানাভাবে। খুব সহজে উপকার পেতে দেখেছি অন্য কিছুকে ভালবাসার মধ্যে। আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে এলে উপকার হবেই।
অনেকে বলতেই পারেন আমি তো বই ভালবাসি।ভালবাসার তালিকা আরও লম্বা হতে পারে- স্ট্যাম্প, শাড়ি, গয়না,সুন্দর শিল্পসামগ্রী। কেউ বেড়াতে, সিনেমা দেখতে ভালবাসে।
আমি ঠিক এইরকম ভালবাসার কথা বলছি না। যা ভালবাসছি তা জড় পদার্থ নয়। তা আমার মতোও নয়। মানুষী সম্পর্কের মধ্যে ভালবাসা স্বাভাবিক। আমরা সবসময় তা খেয়ালও করি না কিন্তু মনুষ্যেতর কোন প্রাণী যাকে শর্তহীন ভাবে ভালবাসব সে দেখতে সুন্দর কি না, ভাল গান গায় কিনা ক্লাসে ফার্স্ট হয় কিনা এসব বিচার্যই নয়। সেও তাই তার মনিব তাগড়া পালোয়ান নাকি মস্ত বড়োমানুষ নাকি দানবীর হরিশচন্দ্র এসব নিয়ে মাথাই ঘামাবে না। এইরকম নিকষিত হেম স্বর্গীয় ভালবাসা মনুষ্যেতর পুষ্যির সঙ্গেই সম্ভব।
ছোটো বয়সেই যদি এই ভালবাসার বীজ পুঁতে দেওয়া যায় মনের মধ্যে তবে সেই মানুষ বৃহত্তর জীবজগতকে যে ভালবাসবে তাতে সন্দেহ নেই। সেই মানুষ কোনদিন নিরীহ কুকুরের লেজে জ্বলন্ত কালীপটকা বেঁধে আমোদ অনুভব করবে না এটা জোর দিয়ে বলা যায়। কুকুর আমাদের সবথেকে কাছের চেনা প্রাণী আর এটি প্রায় ‘জাতীয় আমোদ’ বলে এই উদাহরণটাই দিলাম।এটা কিন্তু অন্য কিছুও হতে পারে।
কোনোভাবেই আমার মতো নয় এমন কিছুকে ভালবাসলে দয়া ও সহনশীলতা বাড়ে।তখন ডানাভাঙ্গা পাখিকে বুকে করে তুলে এনে ক্ষত সারিয়ে তোলা কঠিন মনে হয় না। লাল পিঁপড়ের কামড়ে কেঁচোকে ছটফট করতে দেখলে বুকটা মুচড়ে ওঠে।পথে যেতে যেতে তৃষ্ণার্ত গরুকে নিজের বোতল থেকে জল দিতে ইচ্ছে করে। নিজের ভাগ থেকে একটু মাছ জুলজুল করে তাকিয়ে থাকা পুষিকে দিয়ে দেওয়া প্রায় নিত্যকর্ম হয়ে দাঁড়ায়। এটা জরুরি নয় শুধু নিজের চার দেয়ালের মধ্যেই এই ভালবাসার চর্চা করতে হবে। পরিবার ও পরিবেশের মধ্যে এই গুণটি থাকলে সমান্তরাল ভাবে বয়ে যাওয়া বৃহত্তর প্রানের জগতটিকে আপনা থেকেই সহানুভূতি সহমর্মিতা বৃদ্ধি পায়। কত মানুষকে দেখি রাস্তার নেড়ি কুকুরদের বিস্কুট খাওয়াচ্ছেন। খাবার ছড়িয়ে দিচ্ছেন কাক চড়াই পায়রার জন্য। আশ্চর্য হয়ে যাই দেখে দুঃস্থ ভিখারীও এই রাজকীয় গুণের অধিকারী। যত সামান্যই থাক না কেন সেটারও যে ভাগ দেওয়া যায়,এত দয়া কে দেখাবে মানুষ ছাড়া?
গভীর দুঃখে হতাশায় পোষ্যর সঙ্গ বহু মানুষের মনে শান্তির বারি ছিটিয়েছে এমন উদাহরণও দুর্লভ নয়। বিশেষ করে শিশুর জীবনে পোষ্যর ভূমিকা খুব বড়ো বলেই মনে হয়। দুনিয়াটা যত তাড়াতাড়ি বদলেছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিশুর জন্য আমরা নির্ভরযোগ্য আশ্রয় রচনা করতে পারিনি। এই কঠিন নিষ্ঠুর,উদাসীন পরিবেশে একটি পোষ্য শিশুর নিঃসঙ্গতা ও অভিমানের পারা অনেকটাই নামিয়ে দিয়ে অনেকটাই ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। পোষ্যকে ঘিরে শিশুর মনে ভালবাসার মত সুকুমারবৃত্তির চর্চা হয় যা পড়াশোনা খেলাধুলোর মতই জরুরি।
দায়িত্ববোধের মত গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণও পরিণত হবে আশা করা যায়। যা আমার একান্ত নিজস্ব তাকে সার জল খাদ্য আমাকেই দিতে হবে,আমাকেই এর ভালমন্দের দায়িত্ব নিতে হবে,বিপদে শুশ্রূষা করতে হবে পোষ্যকে ঘিরে এমনএকটি ডিসিপ্লিন পুষ্টি লাভ করে। পোষ্য ছাড়া শিশুর তো আর কারও কাছে জবাবদিহির দায় নেই।
বেশিরভাগ পোষ্যেরই জীবনকাল সীমিত।কুকুর বেড়াল,গাছ,মাছ জীবন্তযা কিছু আমার চোখের সামনে জন্মাবে,বাড়বে,বদলাবে,ফলন্ত হবে তাকে ঘিরে উদ্বেগ আনন্দ সমস্তই পরম প্রাপ্তি। তারপর সে শেষও হবে আমারই চোখের সামনে।আমার ইচ্ছেমতো সবকিছু হবে না। প্রকৃতির নির্দিষ্ট নিয়ম আছে ফুলফল ফলাবার,নিয়ম আছে প্রাণের বিচরণ কালের-যতই আমার প্রিয় হোক না কেন আমি ধরে রাখতে পারি না এই রূঢ় অথচ সহজ সত্যটার পাঠও হয়ে যায় পোষ্যর হাত ধরেই। সেটাও কম জরুরি নয়।