ভূতের আড্ডা-গল্প-খুলির আর্তনাদ-মারিয়ন ক্রফোর্ড-অনুবাদ মহাশ্বেতা

bhooteradda012 (Small)মাঝেমধ্যেই বস্তুটাকে আমি চিল্লাতে শুনি। আরে না না, আমি ভিতু নই। কল্পনাশক্তির দৌড়ও বেশি নয় আমার। সবচেয়ে বড়ো কথা আমি কখনো ভূতে বিশ্বাসটিশ্বাসও করিনি। অবশ্য এ বস্তুটা ভূত হলে অন্য কথা। তবে জিনিসটা যাই হোক না কেন এটা লিউক প্র্যাটকে যতোটা ঘেন্না করত আমাকেও ততটাই করে। আমায় দেখলেই চ্যাঁচায়।

বুঝলেন, কখনো ডিনার টেবিলে বসে কাউকে কোন ভয়ানক খুনের কায়দাটায়দার গল্প শোনাবেন না। কে বলতে পারে আপনার পাশের লোকটা তার বাড়ির লোকজনের ব্যাপারে কী মতলব ভাঁজছে। মিসেস প্র্যাটের মৃত্যুর জন্য যেমন আমি সবসময় নিজেকেই দুষি। আমি তো চাইতাম তিনি বুড়ো বয়েস অবধি সুখেশান্তিতে বেঁচেবর্তে থাকুন, কিন্তু সেদিন ডিনার টেবিলে কেন যে মরতে গল্পটা বলতে গেছিলাম। নইলে হয়ত—

মনে হয় সেইজন্যই বস্তুটা আমায় দেখলেই অমন চিৎকার জোরে। মহিলা বেশ নরমসরম ভালোমানুষগোছের ছিলেন। তবে একবার আমি তাঁকে চিৎকার করতে শুনেছিলাম। ঘরের ভেতর থেকে পিস্তলের ফাঁকা আওয়াজ পেয়ে ভেবেছিলেন বুঝি তাঁর ছোট্টো ছেলেটা গুলি চালিয়ে দিয়েছে। বস্তুটার চিৎকারের শব্দ অবিকল সেইরকম। শেষের দিকে একই রকম একটা তীক্ষ্ণ কাঁপুনি থাকে। কী বলছি বুঝতে পারছেন তো? এক্কেবারে একরকম।

আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, ডাক্তার আর তার স্ত্রীর মধ্যে যে গন্ডগোল একটা চলছে আমি সেটা আগেভাগে একেবারে আঁচ করতে পারিনি। মাঝেমধ্যে একটু আধটু খিটিমিটি লেগে থাকত বটে, তখন মিসেস প্র্যাটের মুখটা লাল হয়ে উঠত আর লিউক বাজে বাজে কথা বলে ফেলত হড়বড় করে। তবে সে তো তার একেবারে ছোটোবেলার অভ্যেস। আমার জ্ঞাতিভাই। আমি তাকে ভালোই জানি। ইশকুলেও তো সেই একইরকম স্বভাব ছিল ওর। সত্যি বলতে কি সেই আত্মীয়তার সূত্রেই আমার এ বাড়ির মালিকানা পাওয়া।  ওর মৃত্যু আর ওর ছেলে চার্লির দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রাণ হারাবার পর বংশে আর কেউ ছিল না তো! সম্পত্তিটা বেশ ভালোই। আমার মত একজন বুড়ো নাবিকের শেষের দিনগুলো বাগান করে কাটিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।

লোকে দেখবেন নিজের বুদ্ধির কাজগুলোর থেকে নিজের ভুলভ্রান্তিগুলো বেশি পরিষ্কারভাবে মনে রাখে। আমি ব্যাপারটা প্রায়শই খেয়াল করি। একদিন প্র্যাটদের সাথে রাত্তিরের খাবার খেতে খেতে ওদের সেই গল্পটা বলেছিলাম। সে ছিল নভেম্বরের এক বৃষ্টিভেজা রাত। সমুদ্রটা গোঙাচ্ছিল-

–এই–এই–চুপ—কথা বলবেন না—চুপ করে শুনুন—এক্ষুণি শুনতে পাবেন—জোয়ার আসছে বুঝতে পাচ্ছেন তো? কেমন ভার করা শব্দ, তাই না? কেমন একটা—আরে—ওই তো—ওই যে হচ্ছে—ভয় পাবেন না, কোন ভয় নেই মশায়। আরে এ আপনাকে খেয়ে ফেলবে না—এ তো শুধু একটা চিৎকার—

যাক! আপনি যে চিৎকারটা শুনেছেন তাতেই আমি খুশি। নইলে লোকে ভাবে ও বুঝি বাতাসের আওয়াজ, কিংবা আমার কল্পনা, বা ওইরকম কিছু একটা। না না, আজ রাতে আর হবে না। এক রাতে একবারের বেশি এ কখনো চিল্লায় না।

বাঃ বেশ বেশ—আগুনে আরো দু একটা কাঠ গুঁজে দিন দেখি। আরেকটু পানীয় ঢেলে নিন। ব্লকলট নামের সেই বুড়ো ছুতোরকে মনে আছে আপনার? আরে ওই যে, ক্লন্টার্ফ নামের জাহাজটা ডুববার পর যে জার্মান জাহাজটা আমাদের উদ্ধার করে সেখানে কাজ করত। উপকূল থেকে শ পাঁচেক মাইল ভেতরে তুফানী দরিয়ার বুক থেকে আমাদের তুলে এনে ব্যাটা কেমন টলোমলো পায়ে গান ধরেছিল-“আহা দুবলাপাতলা খোকাগুলানকে পাড়ে লও—পাড়ে লও—” আমার মাঝেমধ্যেই এখন লোকটার কথা মনে পড়ে।

তা সে ছিল সেইরকমই একটা ঝড়ের রাত। আমি তখন কিছুদিন হল বাড়িতে আছি। অলিম্পিয়া জাহাজটার প্রথম সমুদ্রযাত্রায় যাবার অপেক্ষায়। এর পরের যাত্রাতেই তো অলিম্পিয়া রেকর্ড ভাঙল—মনে আছে? সেই যে বিরানব্বইয়ের—উম-নভেম্বর মাস, ঠিক ঠিক। মনে পড়েছে।

তা সে সন্ধেয় আকাশ বেশ মেঘলা ছিল। সঙ্গে একঘেয়ে বৃষ্টি। প্র্যাটের সেদিন মেজাজ গরম। রান্নাবান্না বেশ বাজে হয়েছে। তাতে প্র্যাটের মেজাজ আরো চড়েছে। তার ওপর আবার ঠাণ্ডাও পড়েছে জমিয়ে। সব মিলিয়ে প্র্যাটের মেজাজখানা সেদিন একেবারে বেজায় চড়া।

বেচারা বউটার অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন। সে বসে বসে খালি একটা ওয়েলশ রেয়ারবিট বানিয়ে কাঁচা শালগম আর আধাসেদ্ধ মাংসের ভুলচুক ঢাকবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। প্র্যাটের সেদিন সম্ভবত কোন রোগী মারা গিয়েছে। বিশ্রি আবহাওয়া, বাজে খাবার, সারাদিনের খাটুনি সব মিলিয়ে তার মেজাজের থই পাওয়া ভার। বলে, “আমার বউ আমায় কেমন বিষ খাওয়াবার চেষ্টা করছে দেখছিস? কোনোদিন খাইয়েও দেবে হয়তো।”

খেয়াল করলাম কথাটা তার বউয়ের মনে বেজায় লেগেছে। ব্যাপারটাকে হালকা করে দেবার জন্য বললাম, “ধুস। মিসেস প্র্যাট বুদ্ধিমান মানুষ হয়ে অমন বোকার মতন কায়দায় খুন করতে যাবেন কেন?” তারপর আমি জাপানিদের সেই কাচতন্তু আর কুঁচিকুঁচি করা ঘোড়ার লোম দিয়ে বিষ খাওয়াবার সুক্ষ কায়দাটায়দার গল্প শুরু করে দিলাম।

প্র্যাট ডাক্তার। এসব ব্যাপারে ভালোই জ্ঞানগম্যি আছে। কিন্তু আমিও কম যাই নাকি? বলে ফেললাম আয়ারল্যান্ডের সেই মহিলার গল্প। তিনতিনবার বিধবা হয়েছিলেন। কেউ তাঁকে সন্দেহও করেনি।

গল্পটা শোনেন নি নাকি? চার নম্বরের বার তাঁর শিকার জেগে ছিল। সে-ই তাঁকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। মহিলার ফাঁসী হয়েছিল। খুন করবার কায়দাটা দারুণ ছিল মহিলার। শিকার ঘুমোলে সরু একটা ফানেল দিয়ে তিনি তার কানের ভেতর কয়েক ফোঁটা গরম সিসে ঢেলে দিতেন। বাইরে থেকে দেখে কিচ্ছুটি বোঝবার জো নেই—

–না না –ওটা হাওয়ার শব্দ মশায়। ঝড়টা ফের ঘুরে আসছে কি না! ও আমি শব্দ শুনেই ধরতে পারি। তাছাড়া চিৎকারটা তো বললামই এক সন্ধেয় একবারের বেশি আসে না–

তা সে ডিনারের কিছুকাল পর মিসেস প্র্যাট ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করে মারা গেলেন। অলিম্পিয়ার পর যে স্টিমারটা ছেড়েছিল, তাদের কাছেই আমি নিউ ইয়র্কে বসে খবরটা পাই। সে বছর আপনি তো লিওফ্রিক নামের জাহাজে ছিলেন, তাই না? এই যে—এই পানীয়টা চেখে দেখুন দেখি একটু। একেবারে খাঁটি, পুরোনো হালসক্যাম্প মশাই। এ বাড়িটা যখন আমার হল তখন এর সেলারের মধ্যে বোতলটা খুঁজে পেয়েছিলাম। বোতলটা অবশ্য বছর পঁচিশেক আগে আমিই লিউককে কিনে এনে দিয়েছিলাম আমস্টারডাম থেকে। খুলেও দেখে নি কখনো। বেচারা বোধ হয় তার জন্য এখন ওপারে বসে একটু দুঃখ পায়।

হ্যাঁ, তা কত অবধি বলেছিলাম গল্পটা? মিসেস প্র্যাটের আকস্মিক মৃত্যু—হ্যাঁ। তার পর লিউক বোধ হয় এখানে একটু একা হয়ে গেছিল। মাঝেমধ্যে আমি এসে দেখা করে যেতাম। লিউককে বেজায় ক্লান্ত আর চিন্তিত দেখাত। বলত ডাক্তারিটা আর চালাতে পারছে না। তবে কোন অ্যাসিসট্যান্টও সে কিছুতেই রাখতে চায় না।

এইভাবে কয়েকটা বছর কেটে গেল। একদিন লিউকের ছেলেটা দক্ষিণ আফ্রিকায় মারা গেল। এরপর লিউক কেমন অদ্ভুত একটা হয়ে গেল। স্বাভাবিক মানুষের থেকে আলাদা। কিছু একটা  যেন ভর করেছিল ওর ওপর। না না, পেশার ক্ষেত্রে কোন ভুলভ্রান্তি করত না তা ঠিক, কিন্তু ওই কীরকম একটা যেন আচরণ—মানে—বুঝতে পারছেন তো?

কমবয়সে লিউকের গায়ের রঙ বেজায় ফর্সা ছিল। মাথার চুল ছিল লাল। ছিপছিপে গড়ন। মাঝবয়সে এসে সে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আর ছেলের মৃত্যুর পর বেচারা ক্রমশই রোগা হয়ে যাচ্ছিল। তার মাথাটা দেখে মনে হত একটা চামড়ায় মোড়া খুলি। চোখগুলো কেমন যেন চকচক করত সবসময়। দেখলে বুক কাঁপে।

মিসেস প্র্যাটের বাম্বল নামে পেয়ারের কুকুর ছিল একটা। এখন সেটা প্র্যাটের সঙ্গেসঙ্গে সবজায়গায় ঘুরত। ভারী ভালো স্বভাবের বুলডগ সেটা। মাঝেমধ্যে দাঁত খিঁচিয়ে অচেনা লোকজনকে একটু ভয় দেখাত শুধু। কখনো কখনো সন্ধেবেলা প্র্যাট আর বাম্বল একা একা চুপচাপ বসে একে অন্যের মুখের দিকে চেয়ে থাকত। হয়ত বসে বসে পুরোনোদিনের কথা ভাবত। মিসেস প্র্যাট যখন বেঁচে ছিলেন, বোধহয় সেই সময়গুলোর কথা। তখন এইরকম সন্ধেবেলায় তিনি বসে থাকতেন ওই যে—ওই—যে চেয়ারটায় আপনি বসে আছেন ওইটাতে। আর এই আমার চেয়ারটায় বসত প্র্যাট।

বসে থাকতে থাকতে বুড়ো মোটাসোটা কুকুরটা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ত। লাফাতে তো পারে না আর, তাই, প্র্যাটের চেয়ারের পায়া বেয়েই ওপরে উঠে পড়বার জন্য সেকী আপ্রাণ চেষ্টা তার। প্র্যাট তখন তার কংকালের মত মাথার সামনে কয়লার টুকরোর মত জ্বলন্ত দুটো চোখ নিয়ে কুকুরটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকত।  মিনিটপাঁচেক এইরকম চলবার পর হঠাৎ কুকুরটা থরথর করে কাঁপতে শুরু করত আর সেইসঙ্গে যেন গুলি খেয়েছে এইরকম করুণ আর্তনাদ বেরিয়ে আসত তার গলা থেকে। আর তারপর প্র্যাটের চেয়ার থেকে ছিটকে নেমে পড়ে চেয়ারের তলায় গিয়ে লুকিয়ে কুঁই কুঁই করে ডাকতে থাকত।

আমার কল্পনাশক্তি খুব কম, তবু আমি হলফ করে বলতে পারি সেই শেষের মাসগুলোতে প্র্যাটের মুখখানা দেখলে বহু দুর্বল হৃদয় মানুষই ভির্মি যেতেন। সেটার দিকে তাকালে একটা চামড়াঢাকা খুলি ছাড়া আর কিছু মনে হওয়া সম্ভব ছিল না।

এরপর পরের সংখ্যায়

1 thought on “ভূতের আড্ডা-গল্প-খুলির আর্তনাদ-মারিয়ন ক্রফোর্ড-অনুবাদ মহাশ্বেতা

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s