আগের পর্বঃ ব্যাঙ ও লাওস, নেপালি বাদুর, ইথিওপিয়ার সিংহ, পাহাড়িয়া খাবারদাবার, সাদা চামড়ার লেহ্যপেয়
পাশের বাড়ি বাংলাদেশে
অংশুমান দাশ
বাংলাদেশ আমার খুব প্রিয় দেশ। আর সে দেশের খাবার – আ হা হা হা হা।
এইটুকু লিখেই দিব্যি শেষ করা যেত – কারণ এর থেকে ভালো ব্যাখ্যা আর হয় না। কিন্তু অন্যরকম খাওয়ায় খবর দিতেই এই লেখা। তাই আর দু কলম লেখাই যাক।
আতিথেয়তায়, যত দেশ ঘুরেছি, তার মধ্যে বাংলেদেশিরা যে এক নম্বর তাতে কোন দ্বিমত নেই। একবার খাওয়ার চোটে, মানে অতিরিক্ত খাওয়ার চোটে, হাসপাতালে যেতে হয়েছিল – শরীরের সব নুন, চিনি, জল নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায়। সে দেশের সব থেকে বড় হাসপাতাল আমাকে সর্দিজ্বরের ওষুধ দিয়ে পেটখারাপ সারানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে, তারা আমাকে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন যে বাংলাদেশে আর যাই খাই, আমি আর ওষুধ খাব না।
অল্প খাওয়াকে এনারা খুবই অপমানের চোখে দ্যাখেন। সকাল শুরু হয় মোরগ পোলাও দিয়ে – ঘরোয়া দেশি মুরগীর বিরিয়ানি আর কি। সঙ্গে আলু সেদ্ধ – আর পাতলা মুসুরির ডাল। এর বিকল্প হচ্ছে খাসির পায়া দিয়া ফরোঠা। আজ্ঞে, ছাগলের টেংরির স্টু দিয়ে সাঙ্ঘাতিক তেলে ভাজা মুচমুচে খাস্তা বিস্কুটের মত পরটা। উচ্চারণগুলো আপনার কানে লাগবে বটে, কিন্তু দিব্বি বুঝতে পারবেন। আমি দু দিন মহানন্দে জলখাবারে এই সব খাই, তারপর জিভ মোটা হয়ে আসে, রাত্রে স্বপ্নে গিন্নি চোখ পাকিয়ে চোখের সামনে কলেস্ট্রলের রিপোর্ট নাচাতে থাকেন। গিন্নি ছুটি নিলে ডাক্তারবাবু স্বপনে দেখা দেন। আমার প্রাণ অকাল প্রয়াণের আশঙ্কায় একটু রুটি আর ভেন্ডিভাজার জন্যে খাবি খেতে থাকে। বাইরে খেলে কোন আশা নেই, তবে কারো বাড়িতে খেলে মোরগ পোলাও-এর পরে ময়দার রুটি আর আলু-বেগুন-গাজরের একটি ট্যালটেলে ঝোল আসতেও পারে – তাতে গৃহকর্ত্রী খুবই বিরক্ত হবেন যে আমি কী ফেলে কী খাচ্ছি একথা ভেবে।
দুপুরে ভাত। রাতে ভাত। সকালে ভাত। আর প্রতিবার তার সাথে ভর্তা। কিসের না ভর্তা। শিম, শিমের বীজ, কালোজিরে, ডাল, নানারকম শুঁটকি। ভর্তা মানে সেদ্ধ করে তেল দিয়ে ভাজা। এইটা খাওয়ার জন্য আমি প্রতিবার মুখিয়ে থাকি। আমার কাছে এটা একটা ক্যুইজ কনটেস্টের মত। আমি বলতে থাকি আর সকলে যেন হাততালি দিয়ে বলতে থাকেন – হয়নি হয়নি ফেল। মাঝে মাঝে ভুলও বলি ইচ্ছে করে – যদি আর একটু পাওয়া যায় এই আশায়। কালজিরের ভর্তাটা সাঙ্ঘাতিক, খাবেন আর আপনার গা দিয়ে ঘাম ছুটবে। ভীষণ গরম লাগে, বুক ধড়ফড় করে। সবথেকে জনপ্রিয় খাবার বিরিয়ানি। কচ্চি, পক্কি, আধকাঁচা, আধপাকা, সিকিপাকা – রকমের কোন শেষ নেই। গরু, ছাগল, মুরগী – এই তিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর তার সঙ্গে চমৎকার বুরহানি। যদি ভীষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহস থাকে তো মগজের কারি খেতে পারেন – গরু, ভেড়া, ছাগল। দেখতে অতি উপাদেয়। একটু খেলেই মনে হবে পেট ভরে গেছে। অবশ্য খাবার নিয়ে বাছবিচার থাকলে এই কারি জেনে বুঝে কদর করে খাবেন কতজন এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
আর আছে রকমারি মাছ। কিছু কিছু মাছের নামই শুনিনি। সবই মুলত পেয়াজ-রসুন দিয়ে গরগরে মাখামাখা জ্বালাময়ী রেসিপি। কখনও সবজি দিয়ে, তবে তাতে মশলার খুব কমতি হয় না। শাল, বাইন, আইড়, বাঘাইর, মহাশোল, বাইলা, বালিচুরা, বাঁশপাতা, চেওয়া, ফুলি, গেছুয়া, কাকুয়া, গরই, খরশুলা। কিছু কিছু, বুঝেছি, এপার ওপারে একই মাছ, উচ্চারণ আলাদা। আমি অবশ্য কোনোদিনই উচ্চারণ করে মাছ খাইনি – তাই ও সব নিয়ে চিন্তিত নই। একবার মনে আছে একজন মাঝি জ্যান্ত ইলিশ নাকে দড়ি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন – আহা সে দৃশ্য দেখেও সুখ। মাছ খেতে হলে যেতে হবে হাওড় অঞ্চলে। বছরে ছ’মাস বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলে ডুবে থাকে – তখন মাছ ধরা ছাড়া আর কিছু করার থাকেনা। এত মাছ যে ওই অঞ্চলের লোকেরা পুঁটি মাছের তেল বার করে সেটা জমিয়ে রাখেন – সেটা দিয়ে ভাত মেখে খান আর প্রদীপ জ্বালান। মাছ, মাছের মাথা, মাছের ডিম শুকিয়ে ফেলতেও এদের জুড়ি নেই। তবে আজকাল শুঁটকী মাছ সম্পর্কে সাবধান থাকাই ভালো – যেহেতু বাইরে রোদে মাছ শুকানর সময় পোকা লেগে যায়, তাই ডিডিটি মাখিয়ে মাছ শুকানোর চল হয়েছে।
বাংলাদেশে ভীষণ চিন্তার ব্যাপার এই খাবারের নিরাপত্তা। মাছের দোকানে লেখা থাকে, এখানে ফরমালিন মুক্ত মাছ পাওয়া যায়। মানে মাছের ডেডবডি বাঁচিয়ে রাখার জন্যে ফরমালিন দেওয়াটাই দস্তুর এখানে। তেমনি ব্যবহার মনোসোডিয়াম গ্লুটামেটের। লোকে বলে টেস্টিং সল্ট – টেস্ট ভালো হয় কত্তা। তাই পরোটার আটা মাখার সময় মুঠো মুঠো টেস্টিং সল্ট ছড়িয়ে দেন রাঁধুনি। হাইজিনের বাতিক থাকলে চোখে ঠুলি পরে খাওয়াই ভালো। প্যাকেটের খাবার কেনার সময় নিরক্ষর থাকার ভান করবেন – প্যাকেটে কী লেখা আছে আর কী নেই এ বিষয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো।
তবে পেশাগত সুত্রে গ্রামে গ্রামে যেতে হয় বলে মেঠো দেশজ খাবার খাওয়ার সুযোগও কম হয়নি। রাতে ঘুমানোর ইচ্ছা না থাকলে গরুর চর্বি দিয়ে রাধা এঁচোড় খেতে পারেন। কাঁচকলা দিয়ে রাঁধা ইলিশ খেলেন না তো কিই বা খেলেন। লাউ দিয়ে বকের মাংস – শুনতে যেরকম খেতে কিন্তু ততটা খারাপ নয়। শিমের বীজ দিয়ে ইলিশ মাছের মাথা – ইলিশ মাছের অপমান হলেও, খেতে বেশ।
সুরাপান এদেশে নিষিদ্ধ একরকম। প্রথমবার গিয়ে এক মারাঠি সহকর্মীর পাল্লায় পড়ে ঢুকেছিলাম এক বারে। দেখি গানটান হচ্ছে – হিন্দি গান। বাংলাদেশে হিন্দি? খবর নিয়ে দেখলুম গায়িকারা ফিলিপিন্সের। এক বাঙালি, এক মারাঠি, বাংলাদেশে বসে, জার্মানির বিয়ার খেতে খেতে, ফিলিপিন্সের গায়িকার গলায় হিন্দি গান শুনছে – গ্লবালাইজেশনের এতবড় বিজ্ঞাপন আর হতে পারে না।
সবজির চল এ দেশের শহুরে খাবারে প্রায় নেই। কিন্তু গ্রামে গেলে নানারকম অকৃষিজাত শাক খাওয়ার চল আছে। বিশেষত পাহাড়ি চাটগাঁয়। বরুনা শাক, ঢেঁকি শাক, বেই শাক, সিবন, সাবারাং, কাত্তলদিঙ্গি । আর আছে নানারকম আলু। কএং আলু, শিমুল আলু। নারকেল কচু, কুকি কচু, ছাম্বু কচু।
চট্টগ্রামে পাহাড়ি মানুষদের মধ্যে এসব খাওয়ার চল শুধু সেদ্ধ বা ভাজা। সব যে আমার জিভে ভালো লাগে তা নয়। কোনটা খেলে গলা চুলকায়, কোনটায় তামাকের মত গন্ধ – ভালবেসে এনে দিলে হাসি মুখে খাই। খাবার যে দেশে হোক, যেমনই খেতে হোক, আর আমার ভালো লাগুক না লাগুক – তাকে, অথবা তার উৎপাদককে বা রাধুনিকে অস্মমান করার কোন অধিকার আমার নেই।
ছবিঃ লেখক
লাউ দিয়ে বকের মাংস
bok er mangso ami kheyechi hoogly te,luchi diye,desi murgir motoi,khub bhalo.
khub bhalo laglo lekhata
LikeLike