আগের পর্বঃ ব্যাঙ ও লাওস, নেপালি বাদুর, ইথিওপিয়ার সিংহ, পাহাড়িয়া খাবারদাবার, সাদা চামড়ার লেহ্যপেয় , পাশের বাড়ি বাংলাদেশ
পিকনিক পিকনিক
পেঁপের প্লাস্টিক চাটনিতে জল দিলে কী হতে পারে এবিষয়ে ধারণা আছে? অথবা ডিম দিয়ে চিচিঙ্গা কেমন খেতে? এ বিষয়ে জানতে ধৈর্য রাখতে হবে আর একটু।
পিকনিকে বাঙালির উৎসাহের অভাব নেই। আমি যেহেতু বড় হয়েছি শান্তিনিকেতনে, আর সেখানে কোপাই নদী খোয়াই সোনাঝুরি জঙ্গলের অভাব নেই, আর অভাব নেই উৎসাহী বাঙালির – সুতরাং বনভোজন ও তৎসংক্রান্ত হেনস্তার অভাব হয়নি কোনদিন। আমার জীবনের প্রথম রান্না পিকনিকে – একবারে পঁয়ত্রিশ জনের পিকনিক। ধারনা ছিল একরকম – রান্না বিষয়টা কী, কখন নুন দিতে হয় ইত্যাদি, পর্যবেক্ষণ করেছি ভালো করে – তবে হাতে কলমে পরীক্ষা না করেই সিদ্ধান্তে ঝাঁপিয়েছি শর্টকাটে। মাংস ব্যাপারটা জটিল হল না, ওই আদা পেঁয়াজ রশুন জল নুন ইত্যাদি মিলে একটা উতরে যাওয়ার অবস্থা দেখা দিল। এবারে স্পেশাল আইটেম পেঁপের প্লাস্টিক চাটনি। সকলের খিদে পেয়েছে – আমরা সবাই তখন কলেজের তৃতীয় বর্ষ। আমি বেশ গম্ভীরচালে মাংস করেছি, কনফিডেন্স এর অভাব আমার কোনদিনই ছিল না, আজও নেই। এবার এক কড়াই জল, তাতে চিনি দিয়ে ফুটিয়ে, চিনির রস যখন ঘন হয়ে আসবে তাতে পেঁপে দিয়ে সেদ্ধ – এই হল থিয়োরি। প্রথম ধাক্কা খেলাম যতই চিনি দিই – চিনির জল আর চিনির রস হয়না – সেই কড়াই-এর জল পুকুরের মত হয়ে আমাকে বিড়ম্বনায় ও লজ্জায় আত্মহত্যার আহবান জানাতে থাকে, কারণ সকলে ঘিরে ধরেছেন কড়াই, চিনি ফুটছে আর সকলের ক্ষিদে। কে যেন বলল – ‘এবারে পেঁপে দিয়ে দে, পেঁপে জল টেনে নেবে।’ পেঁপের টুকরো ঝাঁপ দিল – এবং সে চিনির সঙ্গে কোনরকম সখ্যতার নিদর্শন না দেখিয়ে একলা একলা সিল মাছের মত ভেসে বেড়াতে থাকল। শেষমেশ ওই ভাত মাংস ও চিনির দ্রবণে ভাসতে থাকা আধকাঁচা পেঁপে দিয়েই ক্ষুধার্ত কিশোর কিশোরীদের বিদ্রোহ দমন হল। বাড়ি ফিরে মা যখন জিজ্ঞাসা করলেন – “কতটা জল দিয়েছিলি” – আর উত্তর শুনে অবাক হয়ে যাওয়া মুখ দেখে আর কথা বাড়াইনি।
ছোটবেলায় পাড়া অথবা বাড়ির পিকনিকে সকাল সকাল রণক্ষেত্রে পৌঁছে যাওয়ার যতই ইচ্ছে থাক, অধিকাংশ সময়েই যদু, মধু ইত্যাদিকে ডাকতে ডাকতে দেরি হত। তারপর গরুর গাড়ি আসত দেরি করে, তাতে বাসনপত্র তুলে পিছন পিছন চলতে চলতে খিদে পেয়ে যেত। গিয়ে দেখতাম একদল আগেই হাজির, তারা উনুন খুঁড়েছে বটে তবে আগুন জ্বালাতে পারেনি – ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার। ভিজে কাঠ, কাঁচা কাঠ এই সব গবেষণা চলত – আলু ও মটরশুঁটি ছাড়ানো ও ময়দা মাখা চলত। খিদের জ্বালায় কিছু মটরশুঁটি পেটে চালান হত। শেষমেশ আগুন জ্বলে আলুরদম ও লুচি যখন পাতে পড়ত, তখন সূর্য মধ্যগগনে। লুচি উড়ে আসত ফ্লাইং সসারের মত, পাতে এসে পড়ত – ঠকাস। তা খেতে হত ওই ঝোল নামক তরল পদার্থ দিয়েই, কারণ আলু ও মটর সিদ্ধ হওয়ার জন্য সাধনা করার যথেষ্ট সময় পাননি। পরে অবশ্য আমরা চপ-মুড়ির সারল্যে নেমে আসি।
এরপর মধ্যাহ্নভোজ। ওই ভাত, এবং খাসির মাংস। যথারীতি দাঁতের ব্যায়াম। আমরাই এতদিনে সিদ্ধপুরুষ হতে পারলাম না, সামান্য দুঘণ্টায় খাসির কী হবে! আমরা সারাদিন খেলে খেলে ক্লান্ত – ওই একটি দিনে চানের বালাই নেই, নোংরা পা বলে বকুনি নেই, খাওয়ার আগে হাত ধুলাম কিনা সে নিয়ে বাড়াবাড়ি নেই – সোজা শাল্পাতার থালায় হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। ভাত, কিছু বালি, কাঁকড়, মাংস ও চাটনি – যেন অমৃত। ততক্ষনে সূর্য অস্ত যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছেন।
ইশকুলের পিকনিকে প্রস্তুতি বেশি, তাই ওখানে লুচি একটু নরম, আলু আরও আলুলায়িত। ভাতের সঙ্গে ডাল বাঁধাকপির তরকারি আর ডিমের ঝোল। মাস্টারমশাইরা পরিবেশন করতে করতে বলতেন – “ঢালাও ডিম একটা করে।” আর শেষপাতে রসগোল্লা। শালপাতার থালা থেকে ডিম বা রসগোল্লা প্রায়ই বলের মত গড়িয়ে যেত মাটিতে – হাঁ হাঁ ধর ধর করে আবার তাকে ফিরিয়ে এনে জল দিয়ে ধুয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হত।
অধুনা প্যাকেট ও প্যাকেজমুখী পিকনিকে খাবারের বিড়ম্বনা নেই বটে তবে বিড়ম্বনার আনন্দেও যেন কম পড়ে।
বিদেশে পিকনিকের চল আছে, তবে তার ধরণ ধারণ আলাদা। প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তেই ডিমসেদ্ধ স্যান্ডউইচ নিয়ে তারা পার্কে হানা দেয়, রোদ পোয়ায়। কারো কারো বাড়ির বাগানে থাকে মাংস পোড়ানর উনুন। জার্মানদেশে এরকম এক পিকনিকে যাওয়ার নেমন্তন্ন করে গৃহকর্তা বলেছিলেন – “মাংস নিয়ে আসবেন।”
“কতটা?” – আমি আঁতকে উঠি।
“আপনি যতটা খাবেন।”
একটুকরো শুওর কিনে গুটি গুটি পায়ে হাজির হই – ব্যাপারটা কী? বোঝা গেল যে যার পছন্দমত মাংস নিয়ে আসবেন, পোড়াবেন। বিয়ারের চালান থাকবে অফুরন্ত – ওই একটি জিনিসে জার্মানদের কোন কার্পণ্য নেই। নিজের মাংস নিজেই খেলাম, আর নানা ঘাস-ফুল-পাতার স্যালাড, বাগানে বসে গল্প করলাম। এই হল পিকনিক। দোকান রেস্তরাঁয় বাইরে বসে খাওয়ার চল গোটা ইয়োরোপ জুড়ে, তাই হয়ত সেই অর্থে পিকনিকের রোমাঞ্চ আলাদা করে নেই – বা থাকলেও, আমার সেই সৌভাগ্য হয়নি।
পিকনিক যে সবসময় বনভোজনই হতে হবে তার কোন মানে নেই – নিছক ঘরভোজনও হতে পারে, বন্ধু বান্ধব মিলে একসঙ্গে হৈ হৈ করে রান্না করে খাওয়াই পিকনিক। এরকম এর বাড়ির ছাদে তার বাড়ির বারান্দায় পিকনিকের অভিজ্ঞতায় একটি সংযোজন মুরগী পোড়া। গোটা মুরগীর পেট থেকে নাড়ি ভুড়ি বার করে নিয়ে সেটিকে পেয়াজ-আদা-রসুন-দই এর রসে ডুবিয়ে রেখে, পরে সেই আদা-পেয়াজের ছিবড়ে নুন-টুন দিয়ে মেখে মুরগীর পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে, তার দিয়ে সেলাই করে তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পোড়ান। মুরগীর ছাল থেকে যখন টুপ টুপ করে চর্বি গলে গলে আগুনে পড়ে – আ হা হা – সে কী গন্ধ! প্রথম্ বার সেই মুরগীর পেটস্থ মশলা খাওয়া হয়েছিল পাউরুটি দিয়ে – সে ভারি বিকট ব্যাপার। তারপর যতদিন গেছে, এই নৃশংস মুরগী পোড়ায় আমি আরও দক্ষ হয়েছি। মুরগী পোড়াতে আমার এখন নানা জায়গা থেকে ডাক আসে।
একবার চাঁদের আলোয় খিচুড়ি পিকনিক হবে এই রকম রোম্যান্টিক আয়োজন হয়েছিল। দিব্যি কবিতা, গান হল – রবীন্দ্রনাথ চাঁদ সম্পর্কে যেখানে যা রেফারেন্স দিয়েছিলেন, সব টেনে আনা হল – এদিকে চাঁদের আলোয় হাঁড়ির ভিতরে দেখা যায়না কত জল! বোঝা যায়না ডাল সেদ্ধ হল কিনা! শেষমেশ মধ্যরাত্রে এক অদ্ভুত তরল চালডালের মিশ্রণ গ্লাসে ঢেলে সুরুপ সুরুপ করে খেতে খেতে গান গেয়ে গেয়ে ক্ষুধানিবৃত্তি করতে হল।
আমি আর আমার এক বন্ধু একসময় একসঙ্গে থাকতাম, কমিউন সিস্টেমে। সেও প্রায় পিকনিকের মত। সেখানে আমার দায়িত্ব ছিল রান্না করার। কারণ, ওই যে আমার প্রাণঘাতী কনফিডেন্স। বাজার থেকে আনলাম চিচিঙ্গা – ওটা সব থেকে সস্তা। পিস পিস করে কেটে দেওয়া হল জলে (আবার সেই জল! আমার শিক্ষা হয় না) – নুন মশলা পরিমাণ মত। আমার ধারণা নাড়তে নাড়তে চিচিঙ্গা ঠিক সেদ্ধ ও ভাজা হবে – স্টেপ বাই স্টেপ। দেখা গেল চিচিঙ্গা ভাজার বদলে ক্রমশ পায়েসের দিকে এগোচ্ছে। তখন, মনে হল একটু ডিম ভেঙে দিয়ে দেওয়া যাক – যেমন চাউমিনে দেওয়া হয়।
অনেক কমিউনের মত সেই কমিউনও টেকেনি। সেই বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগও ক্ষীণ – কতটা অন্য কারণে আর কতটা ডিম-চিচিঙ্গার জন্য, তা জানি না।
অলঙ্করণঃ লেখক