আগের পর্ব- পায়ে পায়ে হরিপদ, লক্ষ গাছের কথা
ভ্যানরিকশোয় ছেলে পার্থ আর বউ শুক্লা। হু হু হাওয়ায় চলেছেন গৌরহরি। পাশে সমুদ্রের গর্জন। দাঁড়ালেন। দু-চোখ ভরে সমুদ্র। শুক্লা ছেলের হাত ধরে গুটি গুটি কত্তার পাশে। জীবনে প্রথম সমুদ্র দেখা। এই এক নেশা গৌরহরি কবিরাজের। পয়সা একটু জমলেই সপরিবার রিকশোয় বেরিয়ে পড়া। চন্দননগর স্টেশন থেকে স্টেশন। রোড ধরে কয়েক পা এগোলেই মন্টুদার চায়ের দোকান, তার পাশের বদ্যি বিষয়ক বইয়ের দোকানের সামনে রিকশোর উপর টানটান দেখা যাবে গৌরহরিকে। সবার গৌরদা। পেশায় রিকশোচালক। ষাট পেরোনো এই মানুষটার আচার-আচরণ অন্য | রিকশোচালকদের থেকে আলাদা। পেশার প্রতি সম্মান ও নিষ্ঠা আছে। আর আছে। উধাও হওয়ার নেশা। ‘১৩ নভেম্বর ২০০৮ সকাল ৫ ঘটিকায় আমি আমার স্ত্রী শুক্লা কবিরাজ এবং আমার পুত্র পাৰ্থ কবিরাজ এই তিনজন মিলে সাইকেল রিকশো করে চন্দননগর রবীন্দ্রভবন থেকে রওনা হলাম।’ রিকশোয় সপরিবার রওনা হয়ে গেলেন কোথায়?
“তিরুপতি।। শহুরে ভ্রমণবিলাসের হরেকরকমবার আহ্লাদ খসে যেতেই পারে। কিন্তু গৌরহরি প্রচারের কারণে এ কাজ করেননি। তার কাছে বিষয়টা অতীব সরল। পয়সা নেই। ইচ্ছে। আমার রিকশো আছে। তো চলো। চন্দননগর-তিরুপতি-চন্দননগর। সময় লেগেছে। তিনমাস। তিনি নিজের মতো করে লিখে রেখেছেন তার ভ্রমণলিপি – সন্ধ্যাবেলা নিজাম পৌঁছালাম। সেখান গ্রামে এক বিশাল মন্দির পেলাম। মন্দিরে রান্না বান্না করে খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়লাম। রাত্রে শিয়ালের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। ওখানে প্রচুর শেয়াল আছে। পরেরদিন আবার যাত্রা। সন্ধে ৬টা হবে আমরা একটা পাহাড়ের কাছে পৌঁছালাম। পাহাড়ে উঠলে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। কি সুন্দর জায়গা। দেখলে মন ভরে যায়।
মন্দিরে থাকছেন, স্থানীয় বাজারে বাজার করছেন,অচেনাদের বন্ধু করছেন। মিশছেন – ভারতদর্শন ছাড়া কী আর বলা যাবে। তারপর সন্ধে হয়ে এল আমরা একটা গ্রামে পৌঁছালাম। গ্রামের লোকেরা খুবই ভালো। ওরা থাকবার ব্যবস্থা করে দিল এবং বলল সকালে গ্রাম দেখে যেতে। আমরা সকালে গ্রাম ঘুরলাম। বেশ কিছু টাকাপয়সা ও চাল পাওয়া গেল। কোথাও আখের খেতের পাশ দিয়ে আখ খেতে খেতে রিকশো চালানোর মজা,কোথাও জলের অভাবে তেষ্টায় ছাতিফাটা অবস্থা। কোথাও লরিচালকরা নারকেল দিয়ে যাচ্ছেন। মন্দিরে তোলার লোক নেই,তাই চিবুতে চিবুতে এগিয়ে যাওয়া,আবার কোথাও অরক্ষণীয় ফল পড়ে আছে,তা দিয়ে খিদে-তেষ্টা মেটানো। এভাবেই গৌরহরি ঘুরে বেরিয়েছেন প্রায় ২৭ হাজার কিলোমিটার পথ। ২০১০ সালে এই রকম একটা বড়ো ট্যুর করেছিলেন। ধানবাদ-দেওঘর-জসিডি-গিরিডি-রাজগির হয়ে লখনউ-এলাহাবাদ-গাজিয়াবাদ-বারাণসী। পুরী, ভুবনেশ্বর আর কটকের রাস্তা চেনে তার রিকশোর আওয়াজ। ছেলে এখন একটি সাইকেল সারানোর দোকান দিয়েছে। বিলকুলিতে। চন্দননগর স্টেশন থেকে পশ্চিমদিকে অটোতে বিলকুলি সময় লাগে ৭ মিনিট। কবরস্থান ঘেঁষে বাঁশঝাড় লাগোয়া গৌরহরি-শুক্লার ঘরকন্না। ঘরের বাইরে। বেরোলেই গিন্নি তার সওয়ারি। ছেলে সাইকেল নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে এখন। পয়সা। জমলেই বেড়িয়ে পড়া। গৌরহরির ঘরে অনেক অনেক কিছু নেই যা আমাদের আছে। সম্বলহীন গৌরহরিবাবুর যা আছে,তা আমাদের ছা-পোষা কলিজাতে নেই। ভ্রমণভোজীদের হাজার রকমফের তথ্য-তালাশের বিপুল বস্তা এফোঁড়-ওফোঁড় করে রিকশো চালিয়ে মাইলের পর মাইল ঘুরে বেড়ায় গৌরহরি ভারতের মানচিত্রে। সরকারি বেসরকারি বদান্যতার তোয়াক্কা না করে ভ্যানরিকশোয় প্রচার করেন পরিবেশ। সচেতনতা ভারতবর্ষের গ্রামে গ্রামে।
উৎসঃ আশ কথা পাশ কথা” গ্রন্থ থেকে লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।
প্রকাশকঃ রূপালী পাবলিকেশন
২০৬, বিধান সরণি, কলকাতা ৭০০০০৬
অপূর্ব ।ইচ্ছা করে এই ভাবে আমি ও বেড়িয়ে পরি।
LikeLike