ভ্রমণ ওভার টু অসলো-২ টিনা সরকার শরৎ ২০২০

পর্ব ১

ওভার টু অসলো-২

টিনা সরকার

দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন হয়ে গেল এই শহরে। গাছগুলো পাতা ঝরিয়ে রিক্ত হয়ে শীতকে বরণ করতে প্রস্তুত হচ্ছে। ক’দিন পরে চারপাশটা বরফে ঢেকে যাবে। আস্তে আস্তে সব চিনছি, জানছি। কতকটা পরিয়ায়ী পাখির মতো, এক দেশ থেকে অন্য দেশে। বাসা আমার হল ঠিকই, তবে ঘর হল না। আবার ভাবি, যেথা জন্ম সেথা মৃত্যু—তার তুলনায় তো ঢের ভালো।

আসলে এখানে ভাষা আর ঠাণ্ডা, এই দুটি জিনিসকে মানিয়ে নিতে বেগ পাচ্ছি। ক্রান্তীয় অঞ্চলের মানুষ আমরা, ৩৮-৪০ ডিগ্রি গরমে হাঁসফাঁস করতে অভ্যস্ত। সেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা -২ আর সর্বনিম্ন -৭।

নিত্যদিনের এই হ্যাপা কোন অনভ্যস্ত বাঙালির প্রাণে সয়? বৃষ্টি না হলে রোজ ‘কাঁধে ঝোলা /চলল  ভোলা’ করে বেরিয়ে পড়ছি ইতিউতি। পায়ে হেঁটে পথ না চললে শহরের সঙ্গে আত্মস্থ হওয়া যায় না। এ আমার একান্ত নিজস্ব চিন্তাভাবনা। পথ হারাচ্ছি যেমন, তেমনি নতুন করে পথের সন্ধানও পাচ্ছি। আবার হারিয়ে যাবার ভয়টাও মনে বারো মাত্রায় কাজ করছে। মেন রোডে থেকে যে পথে ঢুকলাম তার ঠিক পরের রাস্তায় যাবার জন্য, আবার মেন রোডে ফিরে আসছি। হয়তো আগের রাস্তার ডানদিকের সরু গলি দিয়ে এক মিনিটেই পরের রাস্তায় যাওয়া যেত, ভয়ে সে পথ ধরলাম না। ‘কানা গরুর ভেন্নপথ’ যাকে বলে। তবে কিনা আমার ঘুরে বেড়ানোর গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে, শত্রুপক্ষকেও  ঈর্ষান্বিত করতে পেরেছি—‘করেছ কী, এখানেও পৌঁছে গেলে! দূর, গুল দিচ্ছ তুমি।’ অর্বাচীনের এসব কথায় ছবি সহ প্রমাণ দাখিল করছি। তিনি বাকরুদ্ধ হচ্ছেন।

উপকারী মানুষজন পরামর্শ দিচ্ছেন এখানকার আধার কার্ড সঙ্গে রাখতে, যাতে বিপদের মোকাবিলা করতে পারি। সৎ পরামর্শ শুনে নিচ্ছি চুপচাপ।

পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম এদেশে খুব ভালো। প্রতি পাঁচ-সাত মিনিটে ঘড়ি ধরে বাস-ট্রাম, প্রতি দুই মিনিটে ট্রেন-মেট্রোরেল। রাত একটা অবধি নর্মাল সার্ভিস পাওয়া যায়। তারপর চালু হয় নাইট সার্ভিস, প্রতি আধ ঘণ্টা অন্তর সব মেলে। ‘আম্রিগা’র মতো গাড়ি কেনাটা মাস্ট নয়। সেটা ছাড়াই স্বচ্ছন্দের জীবন কাটানো যাবে এখানে। আর, সেই যে ট্র্যাভেল কার্ডের কথা বলেছিলাম, সারা মাসে একখানা—তা দেখি সেই কার্ড কেউ চেক করে না! রাস্তাঘাটে, ট্রেনে, ফেরিতে কেউই দেখি কার্ড দেখতে চায় না। কোথাও পাঞ্চও করতে হচ্ছে না। (সিডনিতে ভয়ানক চেকিং হত)

City Guide to Oslo, Norway: Part 1 | Public Transportation ...

বিন্দাস ঘুরেফিরে বেড়াই আর পাপী ভারতীয় মন কুটকুট করে, খামোখা পয়সাগুলো নষ্ট করলাম, আমার একখান দামী শাড়ি হয়ে যেত গো! আসলে কোনও মানুষ যে বিনা টিকিটে ভ্রমণ করবে, এরা মনে হয় ভাবতেই পারে না।

বাসের ভিতরে আবার বড়ো করে বিজ্ঞপ্তি, ‘বাস যদি কুড়ি মিনিট লেট করে, আর আপনি যদি সেজন্য ট্যাক্সি করে আপনার গন্তব্যে পৌঁছাতে বাধ্য হন, তাহলে সরকারের তরফ থেকে আপনাকে সর্বোচ্চ ছ’শো ক্রোনার ট্যাক্সি ভাড়া দেওয়া হবে।’ ভাবা যায়! আমাদের কলকাতায় তো দু-চার ঘণ্টা হেলায় বাস, ট্যাক্সি, অটোর পিছনে নষ্ট করি। সন্ধে সাতটার জায়গায় নয়টায় বাড়ি ফিরি। তাহলে কত টাকা লস করলাম এ যাবতকাল, ভাবার চেষ্টা করতে থাকি।

আরেকটা উল্লেখ্য বিষয় হল, এখানে বাংলাদেশের মানুষজন, দোকানপাট নেই। আর চাইনিজদেরও নেই। কিছু চাইনিজ মানুষজন চোখে পড়েছে, কিন্তু তা অতি নগণ্য। আমেরিকা, ব্রিটেন বা দুবাই বাদই দিলাম, সাউথ আফ্রিকা, তার পাশের দেশ বৎসোয়ানা কিংবা অস্ট্রেলিয়াতেও যেভাবে চিনা জনগণে ছয়লাপ, বিশাল বিশাল চাইনিজ মার্কেট দেখা যায়, মনে হত চিনদেশেই আছি, এখানে কিন্তু সেটা একেবারে  নেই। এই বিষয়টি কেন জানি না আমায় বেশ আনন্দ দিয়েছে।

File:Turkish corner shop, Oslo.jpg - Wikimedia Commonsএদেশে তুর্কিদের দোকান প্রচুর। যেকোনও ফল, সবজি, মশলা দেখলাম ওদেরই একচেটিয়া। রাশিয়া, তুরস্ক, আজারবাইজান, ইউক্রেন, বেলারুশ থেকে প্রচুর মানুষ হেথায় মাইগ্রেট করে গেছেন। চোখের মণির রঙ আর চুলের রঙ দেখে বোঝা যায় তারা নরওয়েজিয়ান নন।

এখানে ভারতীয় খাবার বা মশলা বা মাছ পাওয়া যায় পাকিস্তানি দোকান থেকে। কয়েকটি পাঞ্জাবিদের দোকানও পেলাম। টুকটাক কথা বলে জানতে পারলাম, ১৯৮২ সালের সেই নারকীয় ঘটনার পর সব দেশ ছেড়েছিলেন। কানাডা, নরওয়ে, ব্রিটেন—নানা দেশে তারা ছড়িয়ে পড়েন। একেকটা ঘটনা কীভাবে কত মানুষের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়! শুনলে অবাক হবেন, এই পাকিস্তানি দোকানগুলোর প্রতিটাতে ভারত বিরোধী পোস্টার লাগানো আছে লাল কালি দিয়ে উর্দু আর ইংরাজিতে। যেমন সিনেমায় দেখা যায়, তেমনি। এত দ্বেষ! হাজার মাইল দূরত্বেও তার প্রতিফলন! গায়ে জ্বালা ধরলেও মুখে কিছু বলা বারণ, ফলে চোখে-চোখেই মানসিক যুদ্ধটা সেরে নিই, উভয়পক্ষই। তারপর দাম মিটিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে আসি। কী করব, বেঁচে থাকার তাগিদটা যে বড্ড বেশি।

***

এদেশে এসেই ঠাণ্ডাটাকে যেরকম প্রাণঘাতী মনে হচ্ছিল, এখন আর ততটা মনে হচ্ছে না। শরীর, মন সব মানিয়ে নিচ্ছে ধীরে ধীরে।

নরওয়ের সব তথ্য গুগলে পাওয়া যাবে। যেটা গুগল করে জানা যাবে না সেগুলো বলি।

প্রথম কথা হল, এখানকার মানুষজন বেশ সুন্দর। রোগা লম্বাটে গড়ন। সরু নাক-চোখ, চোখের তারা নীল। মেয়েদের গড় উচ্চতা পাঁচ-সাড়ে পাঁচ ফিট। ছেলেরা আরও একটু বেশি। মোট কথা, দেখলেই পছন্দ হবে। (আমাদের দেশের বেশিরভাগ নায়িকাদের নস্যি মনে হবে) তবে কোনও মহিলাকেই আমি সেই অর্থে সাজতে দেখিনি। দারুণ মেক-আপ বা আপাদমস্তক উগ্রতায় মোড়া কেউই নন। খুব ডিসেন্ট এবং পরিশীলিত পোশাক পরেন, আর যেটুকু উন্মুক্ততা তাও যেন দৃষ্টিসুখকর।

এবারে আসল কথায় আসি। এরা কিন্তু বেশ নাক উঁচু। একেবারেই বন্ধুসুলভ নন। অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে ভয়ানক অনিচ্ছুক। অন্য অনেক দেশেই মুখোমুখি হলে অচেনা মানুষের সঙ্গেও শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয় হাই-হ্যালো ইত্যাদির মাধ্যমে। নরওয়েজিয়ানরা তাকিয়েও দেখেন না। এমনকি নিজেদের মধ্যেও কথা বলেন খুব কম। ভরা বাস বা ট্রেনে কাঁই-ক্যাচাল একেবারে নেই। শান্ত হয়ে চুপচাপ করে সবাই চলেছেন। ধরুন রাস্তায় হয়তো কেউ উদাস হয়ে পথ হাঁটছেন, তো গাড়ি তার পিছনে পিছনে টুকটুক করে যাবে। কেউ ভুল করেও হর্ন বাজবে না, চেঁচামেচি তো বাদই দিন। যেখানে আমরা দু-তিনজন বাঙালি থাকলেই জায়গাটাকে মেছোহাটায় পরিণত করি, সেখানে এই নিঃস্তব্ধতার মধ্যে এসে অবসন্ন লাগে। আমার সারাটা দিন কাটে একপ্রকার কোনোরকম শব্দ বিনিময় ছাড়াই। আমার মতো বাচাল মানুষের পক্ষে এ এক শাস্তিই বটে।

পাবলিক ট্রান্সপোর্টেও দেখছি, সাদা মানুষরা চট করে আমাদের মতো বিজাতীয় মানুষের পাশে বসছেন না। একটু খেয়াল করে দেখলাম, খুব অসুবিধা হলে বয়স্করা বসছেন। অন্যরা সযত্নে এড়িয়ে যান। চাপা বর্ণবিদ্বেষ কাজ করে চলে তলে তলে। চোরাস্রোতের মতো। 

এখানকার মানুষের কাজ, কাজের চাপ, কাজ শেষের সময়সীমা সবই আছে, শুধু উদ্বেগ নেই। ফলে গড় আয়ুও বেশি। সত্তরের ওপরের মানুষরা দিব্যি সুস্থভাবে নিজের কাজ নিজেরাই করে নিচ্ছেন। সবরকম সরকারি সহায়তাও আছে। আমাদের পোড়া দেশে বিভিন্নরকম দূষণ আর রাজনৈতিক দলগুলোর হঠকারী সিদ্ধান্তের জেরে আমরা তো মরার আগেই বহুবার মরি।

নরওয়ে সরকারের জনহিতকর নীতি খুবই সুন্দর। সফলভাবে দেশের বা দশের উন্নয়ন চালু রয়েছে। ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয় ২৫% হারে (যেটা আমাদের ছেলেপুলেদের কাছে বিভীষিকার মতো। বিদেশে এসে যে আখেরে তাদের কোনও লাভই হয়নি, এই মাথা খোঁড়াখুঁড়ি চলেছে)। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা এবং বাড়ি ভাড়া পাওয়াও খুবই কঠিন।

জানা গেল নরওয়ে দেশটি মাথা পিছু আয় আর মাথা পিছু ক্রয় ক্ষমতায় বিশ্বে দ্বিতীয় নম্বরে আছে। লুক্সেমবার্গ এক নম্বর স্থানে, কাতার তিন আর ইউনাইটেড স্টেটস চার নম্বরে। কৌতূহলী হয়ে ভারতের স্থান খুঁজি। ১১৯। আজ্ঞে হ্যাঁ, একশো উনিশ নম্বরে আমার দেশের ঠাঁই মিলেছে। যাক গে, তালিকায় আছে তো! তাই ঢের।

সবচেয়ে আরামের জিনিস হল এখানকার ক্রাইম রেট পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে কম। তাই নিরাপত্তা নিয়ে কোনও ভাবনাই নেই। রোজ আমি বেড়াতে যাই পিছনের দরজা ভেজিয়ে রেখে। সন্ধেবেলায় ফিরে দেখি যেমনকার দরজা তেমনি আছে। ক্রমে ক্রমে নিশ্চিন্ততা চারিয়ে যাচ্ছে ভিতরে। জানি, দেশে ফিরলেই ঠোক্কর খেতে হবে।

যেখানেই যাই আমি, সেখানকার ছোটোখাটো জায়গাগুলো একটু দেখি। হাবিজাবি আর কী! নতুন শর্টকাট রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করি। মলে তো ঘোরাই যায়, সেটা বরফ পড়ার সময়ের জন্য তুলে রাখলাম। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন দেখতে পেলাম রেন ডিয়ার বা বল্গা হরিণের চামড়া, শিং সব বিক্রি হচ্ছে। দামও আয়ত্তের মধ্যে। মন নেচে উঠল কেনার জন্য। তারপর মাথায় চিন্তা ঢুকল, এসব নিয়ে দেশে ফেরা যাবে তো? স্মরণ করলাম দাদাকে (শ্রী পিনাকী চক্রবর্তী)। উনি খোঁজ নিয়ে দু’দিন পরে নিজে ফোন করলেন। বললেন, “বাঁচতে চাস তো খবরদার কিচ্ছু কিনিস না। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে জরিমানা তো হবেই, শ্রীঘরবাসও হতে পারে।” হতোদ্যম হয়ে ওটি বাদ দিলাম।

Finland, Sweden and Norway 2016 — Vic-Views - The Life & Times of ...

আরেকদিন চলছি আপন মনে, পথের ধারে বিশাল ঘেরা সুন্দর বাগান, চার্চও আছে দেখলাম। ঢুকে পড়েছি। কী নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারপাশে! তাকিয়ে দেখি, সিমেট্রি! কী পরিষ্কার আর মনোরম পরিবেশ! পাশে বোর্ডে লেখা, উলার্ন সিমেট্রি। ১৯০৩ সালে তৈরি। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক সেনানীর দেহ এখানে শায়িত রয়েছে। তবে কোনও পাথরের বেদী করা নেই। প্রতিটি কবরের সামনে ফুল গাছ লাগানো। ঘুরেফিরে দেখতে থাকলাম। একটাও মনিষ্যি নেই। একজন শুধু পাতা পরিষ্কার করছে। একেকটা জায়গা দেখে একবারে সদ্য খোঁড়া মনে হল। চুপ করে সামনের বেঞ্চে বসে রইলাম। নানাবিধ ভাবনা মনে আসছিল। কত কত ইতিহাস মাটির তলায় চাপা, কত না বলা কথা, কত অপ্রাপ্তি, কত ভালোবাসার অকাল মৃত্যু এখানকার বাতাসে!

হঠাৎ মৃদু গলা খাঁকারি দিল পাশে কেউ। সাংঘাতিক আঁতকে উঠেছি! দেখি বেঞ্চের ও-প্রান্তে এক বয়স্ক ভদ্রলোক, অল্প হাসলেন। কথা বলার আশায় জানালাম, “হাই, আমি শুধু ইংরাজিটা বুঝি।”

তা ভাঙা ভাঙা আলাপচারিতায় জানা গেল, একা থাকেন। স্ত্রী মারা গেছেন বহুদিন, নব্বইয়ের মাঝামাঝি। ছেলেও মারা যান অ্যাক্সিডেন্টে ২০০৩ সালে। তাঁরা দু’জনেই এখানে আছেন। আবার ওঁর দাদু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক ছিলেন। তিনি আর ভদ্রলোকের বাবার দেহও এখানে শায়িত, পুরো পরিবার একজায়গায় একসঙ্গে। উনি শুধু অপেক্ষা করে আছেন সবার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য। আরও কত কী বিড়বিড় করলেন।

আমার তখন রীতিমতো ভয় করছে। উঠে পড়ে বিদায় চাইলাম। অল্প হেসে পকেট থেকে একটা চকোলেট দিলেন। নিয়ে হাত নেড়ে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। এই প্রথম কেউ নিজে থেকে আমার সঙ্গে কথা বলল, সে যেই হোক। তবে পিছন ফিরে তাকাতে সাহস হয়নি। ঘাড় ঘুরিয়ে আর যদি না দেখতে পাই!

(চলবে)

ভ্রমণ সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s