ভ্রমণ ক্যাপাদোকিয়া– আজব দেশের আজব বাড়িঘর উমা ভট্টাচার্য শরৎ ২০১৯

 উমা ভট্টাচার্য  -র সব লেখা একত্রে

ক্যাপাদোকিয়া–আজব দেশের আজব বাড়িঘ

উমা ভট্টাচার্য


বেড়াতে গিয়েছিলাম তুর্কিতে অর্থাৎ তুরস্কে। যে দেশকে সচরাচর আমরা টার্কিই বলি। আমাদের দেশে তুর্কি ঘোড়া, তুর্কি নাচন কথাগুলো ছেলেবেলা থেকেই শুনেছি। সেই তুর্কি ঘোড়ার দেশেই গিয়েছিলাম, তুর্কি নাচন অবশ্য দেখিনি, কিন্তু চারদিন তুর্কি ঘোড়ার মত এশিয়া আর ইউরোপের ভূখন্ডের মধ্যে ছুটে বেড়িয়েছি, অবশ্য বাসে চড়ে। সে দেশের মানুষেরাও নিজেদের দেশকে বলে তুর্কি, নিজেদের বলে টার্কস বা টুর্কিজ।
বেড়াতে গিয়ে সে দেশের অনেক ইতিহাস জানা গেল। প্রথমেই বলি একটা মজার ঘটনা। ওদের দেশে তৈরি তোয়ালে যা সারা পৃথিবীতে টার্কিশ টাওয়েল নামে বিখ্যাত, সেটিকে ওদের উচ্চারণে বলে ‘টুর্কিশ টাভেল’। আমাদের গাইড মহম্মদ নিজেকে বলে মহম্মদ ২, মজাদার মানুষ। ভারতীয় উচ্চারণে আমরা জানতে চাইলাম টার্কিশ টাওয়েল এর বিষয়ে, সে তো হেসেই বাঁচে না। আমাদের ভারতীয় জিহ্বায় ইংরেজি উচ্চারণ কেমন হয় সেটা জানি সবাই। তা আমাদের উচ্চারিত শব্দের অর্থ বুঝতে অনেক সময় নিয়ে শেষে হো হো করে হেসে বলল ‘ওহ ইয়া, ইউ আর আস্কিং অ্যাবাউট টুর্কিস টাভেল? আই সি।’
বোঝো তাহলে পদে পদে শব্দার্থ অনুধাবন করাতে ও তাঁর উচ্চারণ বুঝতে কী ঝামেলাই না হয়েছে চার চারটি দিন! কিন্তু গাইড হতে হয় এমনই। চারদিনে আমরা টার্কির ম্যাপ প্রায় মুখস্ত করে ফেলেছি তাঁর কৃপায়।
১৬ই মে সকালের ফ্লাইটে আমরা গ্রিসের অ্যাথেন্স থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে পৌঁছে গেলাম। যেটা একসময়ে ছিল কনস্টানন্টিনোপল নামে খ্যাত। মনে পড়ে গেল মান্না দের বিখ্যাত গানের কলি, ‘ইস্তাম্বুল ঘুরে প্যারিস কাবুল ঘুরে শিখেছি সহজ এই রান্না’ –ভজহরি রান্নার ঠাকুরের সেই গান। তবে আমরা অবশ্য রান্না শিখিনি বা দেখিওনি। দেখেছি আশ্চর্য সেই দেশের নানা আশ্চর্য সব জায়গা, অপুর্ব সুন্দর নানা ভূদৃশ্য।
জানলাম গত কিছুদিন ধরে লাগাতার বৃষ্টিতে টার্কিতে ট্যুরিজমের বারোটা বাজার মত অবস্থার সময়েই আমরা পৌঁছেছি টার্কিতে। গাইড মহম্মদ আমাদের জানাল আমরা ইন্ডিয়া থেকে তাঁদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে এনেছি, কারণ দীর্ঘদিন বাদে বৃষ্টি থেমে রোদ উঠেছে সেদিন, আর আগামি চারদিন সানি ডে থাকবে। এই কারণে সে আমাদের দেশের ভালো ভালো জায়গা দেখিয়েই দেবে, কোন চিন্তা নেই। বলেই সেই হাসি।
আমরা কোথায় যাচ্ছি বলায় সে বলে উঠল ‘ওহ ইউ দিদনত সি দ্য ইটেনারি, উই আর গোইং তু সি ‘দ্য গ্রেত আন্দারগ্রাউন্দ সিতি’ অফ ক্যাপাদোকিয়া। তাঁর কথার ভঙ্গিতে বাসে আবার হাসির রোল উঠল। পথে যেতে যেতে চলল তাঁর নিজের দেশের গুণকীর্তনের রানিং কমেন্ট্রি। দীর্ঘ বক্তৃতার পর খানিক থেমে যায়। আবার মিনিট পনেরো বিশ্রাম দিয়ে বলে ওঠে, ‘হাই লেদিস এন্দ জেন্তেলম্যান গেত আপ ফ্রম স্লিপ’-জানে যে সবই সিনিয়ার সিটিজেন, অতএব ফাঁক পেলেই ক্লান্তি কাটাতে একটু ঘুমিয়ে নেবেই। আবার শুরু হয় রানিং কমেন্ট্রি।
আমরা চলেছি নেভেশেহের প্রভিন্সের-মেন রোড ধরে। রাস্তাটি চলেছে বসফোরাস প্রণালীর উপরের বিখ্যাত বসফোরাস সেতু পার হয়ে। এই সেতু নিয়েও কাহিনি আছে। সেতুর ডানদিকে, আমাদেরও ডানদিকে সুনীল জলের সাগর মারমারা সি। ভূমধ্যসাগরকে টার্কির উত্তরে অবস্থিত কৃষ্ণসাগরের সঙ্গে জুড়েছে এই মারমারা সি। মারমারা শব্দটি নাকি এসেছে মার্বেল থেকে, সাগরের দুপাশের স্থলভাগে আছে মার্বেলের পাহাড়। মারমারার বাঁদিকে ইজিয়ান সি ভূমধ্যসাগর-সংলগ্ন। ইজিয়ন সি-কে মারমারা সির সঙ্গে জুড়েছে দার্দানেলিজ প্রণালী, আর মারমারা সি-কে কৃষ্ণসাগরের সঙ্গে জুড়েছে ইতিহাস বিখ্যাত সেই বসফোরাস প্রনালী। কৃষ্ণসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমে সাগরের গা ঘেঁষেই অবস্থিত ইস্তানবুল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের দিক থেকে এক সুবিধাজনক স্থানে অবস্থানের জন্য খ্রিস্টপূর্ব কাল থেকেই সাম্রাজ্যবাদী সব দেশেরই লক্ষ্য ছিল এই ইস্তানবুল জয় করা।
বসফোরাস পেরোলেই এশিয়া থেকে ইউরোপের ভুখন্ডে, আবার ইউরোপ থেকে এশিয়ার ভূখন্ডে যাতায়াত করা যায়। দুদিনে অন্তত ছ-বার পারাপার করে দুই মহাদেশের ভূখন্ডে যাতায়াত করতে বেশ রোমাঞ্চ লেগেছে। চোখ ভরে দেখেছি সুনীল জলের সাগরের পর সাগর, প্রাচীন অট্টালিকা সমৃদ্ধ জনপদ। দেখেছি ভূমধ্যসাগরের ধার ধরে প্রাচীন শহরকে ঘিরে থাকা সুলতানি যুগের বিশাল প্রাচীর, নজর মিনার, কোথাও ভাঙ্গা প্রাচীর। আবার সেই প্রাচীরের অংশে গড়ে উঠেছে নতুন বাড়িঘর।
নাগাদে শহর থেকে নেভেশেহের এ যেতে- রাস্তার একদিকে দেখলাম ক্ষেতখামার, জেলখানা যেটি নাকি একসময় ছিল মেরি চার্চ। আর রয়েছে সরকারি সহায়তায় গরিবদের জন্য তৈরি আবাসন। টিনের চালের এক কামরার কুঁড়ে নয়। তিনতলা বা চারতলাও নয় ১৬,১৭ তলা সেইসব বিল্ডিং। ১৩০ বর্গ মিটারের, তিনকামরার ফ্ল্যাট এক-একটি পরিবারের জন্য। বাসিন্দারা কিছু টাকা প্রথমে দেবে, আর বাকিটা দেবে সরকার। স্বল্প সুদে ১৫ বছরে শোধ করতে হবে সেই সরকারি ঋণ। বাসস্থানের অভাবে জনতার ছিন্নমূল হওয়া রুখতে সরকার তৎপর। দাম জান কত? এক একটির দাম ১৭ হাজার ডলার।
ক্ষেতের মাঝেমাঝে চাষীদের বাড়িঘর। ছোট চাষীদের ছোট বাড়ি আর ধনী চাষীদের বড় পাকা বাড়ি। খেতের মাঝেই সেইসব বাড়ি। সেচ চলে দুভাবে। বড় জমিতে চাষীরা জল দিচ্ছে স্প্লিটিং পদ্ধতিতে আর ছোট চাষের ক্ষেতে৩ জল দেওয়া চলছে ড্রপিং পদ্ধতিতে। ঊষর দেশের মাটি আগ্নেয় ছাই, উর্বরতা কম। জলের অপচয়ও করার উপায় নেই। সে-ব্যাপারে সবাই সচেতন।
রাস্তার ডানদিক ধরে বিস্তীর্ণ উপত্যকা, সবুজ গাছপালা, পাহাড়,নদী। দূরে নজরে এল উপত্যকাকে ঘিরে থাকা আগ্নেয় পাহারের সারি, টরাস মাউন্টেন একটা প্রাচীরের মত দক্ষিণ দিক জুড়ে ঘিরে রেখেছে সারা অঞ্চলটাকে। এই পর্বতশ্রেণিই ভূমধ্যসাগরের কোস্টাল অঞ্চল থেকে আনাতোলিয়া মালভূমিকে আড়াল করে রেখেছে।
সড়কপথে আমরা চলছি মধ্য আনাতোলিয়া্র মাঝখান দিয়ে। ক্যাপাডোকিয়া এই শহরের প্রধান দ্রষ্টব্য। প্রকৃতি নিজের খুশিমত সাজিয়েছে এই দেশটিকে। আনাতোলিয়ারকে এক সময় বলা হত এশিয়া মাইনর- মানে ছোট্ট
এশিয়া। দূরে যতদূরে দেখা যায় দেখতে লাগলাম সারি সারি উঁচু উঁচু সূঁচালো পাহাড়ের মাথা-যাকে ইংরেজিতে বলে পিনাকল। এক আশ্চর্য সুন্দর ভূদৃশ্য দেখতে দেখতে চলছি গন্তব্য নেভেশেহেরের ক্যাপাডোকিয়ার দিকে।
নেভেশেহের অর্থাৎ নতুন শহর বা নিউ সিটিতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে মহম্মদের কাছে শুনলাম ক্যাপাডোকিয়ার নানা কথা। রাস্তার ডানদিকে ক্রমশ দেখা দিতে লাগল অদ্ভূত আকারের পাহাড়। ধাপে ধাপে নেমে আসা সেই পাহাড়গুলির গায়ে ছোট ছোট খোপের মত ফাঁকা জায়গা। কোথাও কোথাও এগুলির সংখ্যা অসংখ্য। এইরকম পাহাড় দেখতে দেখতে চললাম ‘আন্দারগ্রাউন্দ সিতি-ক্যামাক্‌লি’র দিকে। কাছে যেতে সেসব পাহাড়ের গায়ের গর্তগুলোকে মনে হল পাহারের উদরে প্রবেশের পথ, যেমনটি দেখতে উদয়গিরির বাঘ গুহায় প্রবেশের দরজাটি তেমনই।

এখানে অবশ্য বাঘের মুখব্যাদান দেখা গেল না। অনেক গুহাপথের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে লাইমস্টোনের তৈরি আধুনিক বাড়িঘর। জানা গেল সেগুলি এখনকার বসতবাড়ি আর অনেকগুলি কেভ হোটেল। ট্যুরিস্টরা গুহাবাড়িতে থাকার স্বাদ নিতে এসব জায়গায় থাকতে আসেন, তবে গুহাবাড়ির অসুবিধাগুলির বদলে আধুনিক সুবিধার সব উপকরণ মজুদ আছে সেগুলিতে।
বাস থামল যেখানে সে-জায়গাটা একটা ফটো স্টপ পয়েন্ট। সেখান থেকে অর্ধচন্দ্রাকারে সমস্ত পাহাড়ি অঞ্চলটার একটা প্যানোরামিক ভিউ পাওয়া যায়। খানিকটা প্রাকৃতিক সমতল অঞ্চল পাথরের চট্টান। মহম্মদ আটকে দিল আমাদের। বাস থামবার উপক্রম হতেই সবাই নামতে গেল। আমরা বলে উঠলাম আমরা আগে ওই গুহাবাড়িগুলোতে যেতে চাই। সে বলল, ‘না আগে যাব এভেলাই- অর্থ এভেলাই দেখতে।’
আমরা ত কিছুতেই বুঝি না কী সেটা। আসলে এরা নানা জাদুবস্তুতে বিশ্বাস রাখে। এভেলাই-এর অর্থ উদ্ধার হতে বোঝা গেল শব্দটা হচ্ছে ইভল আই- শয়তানের চোখ। সেগুলো টাঙানো আছে এক একটা গাছের ডালে ডালে, নানা মাপের সেইসব ইভিল আই, সুতো দিয়ে বাঁধা। যেমন আমাদের দেশে বট গাছের ডাল, বা দেবদেবীর থানে কোনো গাছের ডালে ডালে ঢিল বাঁধা থাকে শত শত। গাইডের জীবিকায় যেন নজর না লাগে তাই সর্বাগ্রে এই ইভল আই ঝোলানো গাছের সামনে যেতে হবে, শ্রদ্ধা জানাতে। তারপরে সেদিনের কাজ শুরু। এলাকার লোকেরাও নানা কামনায়, নজর কাটাতে গাছে এগুলি বেঁধে দেয়।
সেখান থেকে সামনে দেখতে পেলাম অপার সৌন্দর্যে ভরা এক উপত্যকা- নাম পিজিয়ন রিজিয়ন। যেখানেই যাই পরতে পরতে অবাক করা সব বিষয়ের মুখোমুখি হই। পাশেই চা, কোল্ড ড্রিঙ্কসের আর মেমেন্টোর দোকান। দোকানী সামনে সাজিয়ে রেখেছে হিট্টাইটদের সময়ে ব্যবহৃত হত এমন একটি ঠেলা গাড়ি, লোহার চাকা, গাড়ির উপরে রাখা সে সময়ে ব্যবহার হত এমন সব জিনিসের রেপ্লিকা।
উল্টোদিকের চত্বরে সেই বহু ইভেলাই (নজর কাটানোর যন্ত্র) ঝোলানো গাছ। কাছেই একটি বিরাট গ্যাস বেলুনের রেপ্লিকা। টার্কির বিখ্যাত অ্যামিউজমেন্টের একটি হচ্ছে বেলুন রাইড।

যারা সেই রাইডে যাননি বা যেতে পারেননি তারা সেই বেলুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারে। পিছনেই খানিক নীচে সমতল পাথুরে জমি, সেখানে সবুজের সমাহার-ফসলের খেত। সেই খেতিজমিকে ঘিরে আছে পাহাড়ের সারি। আগ্নেয় ছাই জমে তৈরি ‘টাফ’ নামে নরম ‘পোরাস শিলা’র উচু নিচু টিলার সমন্বয়ে গঠিত সেই পাহাড়ের সারি, ধাপে ধাপে উপরে উঠেছে, নানান আকার ধারণ করেছে।। সেইসব পাহাড়ের গায়ে গায়ে অসংখ্য পায়রার খোপের মত খাঁজ। লেন্সে চোখ লাগিয়ে দেখা গেল হাজারে হাজারে পায়রা বসে আছে সেখানে। উড়ে যাচ্ছে, খাবার খুঁটে নিয়ে আবার এসে বসছে। জানা গেল এ কারনেই জায়গাটার নামই পিজিয়ন রিজিয়ন। ইতিহাসপূর্ব কাল থেকেই এখানকার আদিম জনজাতিরা পায়রা পুষতো। আগ্নেয় ছাইসমৃদ্ধ সমতল জমিতে চাষের সার হিসাবে ব্যবহার করতো পায়রার মল। জৈব সার হিসাবে সেটি যে উৎকৃষ্ট তা অতি প্রাচীনকালের অধিবাসীরা জেনেছিল। হাজার হাজার পায়রার মল জমিতে মিশে জমিকে উর্বর করতো। ভালো ফসল পেতে তাই এরা পায়রাদের জন্য পাহাড়ের গা জুড়ে বানিয়ে দিয়েছিল পায়রা নিবাস। এখনো সেই ট্রাডিশনই ধরে রেখেছে অনুর্বর অঞ্চলের মানুষজন। তাই সারা ক্যপাডোকিয়া জুড়েই পাহাড়ের গায়ে গায়ে আছে এরকম অজস্র পায়রা নিবাস।
এবার বাস গিয়ে থামল আসল গন্তব্যে। সকলেই পার্বত্যদুর্গের গুহানিবাস দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেই শুরু হল মহম্মদের সতর্কবাণী। সঙ্গে যোগ দিল আমাদের ট্যুর লিডার। সে একা ৬০জন লোক নিয়ে গেছে তিনটি দেশ বেড়াতে। সকলেই সিনিয়র সিটিজেন। কেউ রোগা, কেউ মোটা, কেউ কোমর আর হাঁটুর ব্যাথায় কাতর, কারো বা বিরাট ভুঁড়ি, কারো প্রেশার তো কারো আছে ক্লস্ট্রোফোবিয়া। অতএব মাটির নীচে বুনো খরগোশের আস্তানার মত গোলোকধাঁধাময় গুহাগর্ভে প্রবেশ করার সম্ভাব্য অসুবিধাগুলির বিষয়ে সতর্ক করার প্রয়োজন। আর সে-প্রয়োজন যে যে কতটা ছিল তা বুঝেছিলাম গুহাবাড়িতে প্রবেশের পর।
গুহাগর্ভে প্রবেশের আগে তাঁদের সতর্কবাণী শুনেই প্রায় ৩০জন বসে রইলেন মার্সেডিজ-বেঞ্জ বাসের পেটে। বাইরে তখন প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়া। যদিও সঙ্গে নীল আকাশে রোদ্দুর ঝকমক করছে। জানতাম কেউই বেশিক্ষণ বাসে বসে থাকবে না, কারণ সামনের চত্বরে রয়েছে সারি সারি মনোলোভা বস্তুবিপণি। ট্যুরিস্টদের জন্য স্মরণিকা সম্ভারের বিপুল আয়োজন নিয়ে অপেক্ষারত বিক্রেতারা। ভূঁড়িদার তিনচারজন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সঙ্গে গেলেন না কারণ আঁকাবাঁকা দীর্ঘ টানেলের মধ্য দিয়ে তাঁরা হামাগুড়ি দিয়ে চলতে পারবেন না। গুহাবাড়িতে দুইদফায় আমাদের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ মিটার দীর্ঘ, সরু টানেল পার হতে হয়েছিল এবং সেটা আক্ষরিক অর্থেই। টানেলগুলি কোথাও কোথাও এত খাড়াই আর সরু যে দেওয়াল ধরে ধরে কাত হয়ে চলতে হচ্ছিল। এদিকে হাঁটু মোড়া, আর মাথার প্রায় ছুঁইছুঁই গুহার এবড়োখেবড়ো ছাদ। আর সেখানে একবার ঢুকতে পারলেও খানিক গিয়ে ফিরে আসার রাস্তা বন্ধ, গেট খুলবে না, আর গাইড ছাড়া পথও চেনা যাবে না। কী অসাধারণ অভিজ্ঞতা, ভাবলে এখন গায়ে কাঁটা দেয় আর রোমাঞ্চ জাগে। মনে হয় আরেকবার ঘুরে দেখে আসি আরও ভালো করে। কী অপরিসীম দক্ষতা, ধৈর্য আর কল্পনাশক্তি ছিল সেইসব মানুষদের যারা এগুলি বানিয়েছিল খানিকটা দায়ে পরে, প্রাণ বাঁচাতে। অসামান্য পরিশ্রমী ছিল তারা।
টিকিট হাতে নিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে। টিকিট চেকিং এর কায়দা খানিকটা কোলকাতা মেট্রোরেলের মতই, তবে টিকিটটি ঠিকঠাক মেশিনের খোলাপথে প্রবেশ করালে তবেই গেটে খুলবে, নইলে নয়। সামনেই দেখি দীর্ঘ কাচের দেয়াল। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দরজা খুলে গেল। আমরা ঢুকলাম পর্বতগর্ভে। ভাবছিলাম ঠিক করলাম কি, না পারলে তো ফিরতেও পারব না। কিন্তু ৪০ মিনিটের অভিজ্ঞতায় বুঝলাম না যেতে পারলে কী অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতাম!
ভিতরে নির্দেশিকা রয়েছে, প্রবেশের আর বেরোবার। লাল তিরচিহ্ন দেয়া পথে প্রবেশ আর নীল তিরচিহ্ন দেওয়া পথে নির্গমন। এই নির্দেশ দেখে এগোতে লাগলাম। একে অপরের পিছে পিছে, মাথা নীচু, হাঁটু মোড়া, যেন সারবন্দী কয়েদীর দল চলছি পাতালে। কোথাও কোথাও আবার পথনির্দেশক চিহ্ন উধাও, খাড়া টানেল এমন বেঁকে গেছে যে সামনে বা পিছনে একটু তফাত হলেই কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

একতলা থেকে চারতলায় নামা-

শুরু হল আমাদের একতলা থেকে চারতলার দিকে নামা। হ্যাঁ সত্যি আমরা সাধারণত চারতলায় উঠতে উপর দিকে উঠি কিন্তু সাবটেরানিয়ান টানেলপথে গুহাবাড়িগুলি ক্রমাগত নীচের দিকে তৈরি করা। চারতলায় যেতে নীচের দিকে নামতে হয়। যেমন আমরা খ্রিস্টপূর্বাব্দ গুনি, ক্রমশ যত আগে তত বেশি খ্রিস্টাব্দ তেমনই খানিকটা আরকি। যত নীচে যাবে ততই তলের সংখ্যা বাড়বে।
প্রথমেই এসে পড়লাম একটি গোলমত ঘেরা জায়গায়, সেটা একটা ঘর, এক মানুষ উঁচু, কারণ আমাদের অনেকেরই মাথা ছুঁচ্ছিল ছাদ। এটা ছিল একটা আস্তাবল, যেখানে বিশটা মত ঘোড়া থাকতে পারত। গুহাগর্ভের দেওয়ালের দিকে মুখ করে ঘোড়াগুলো বাঁধা থাকত তা বোঝা গেল দেওয়ালের গায়ে দড়ি বাধার ব্যবস্থা দেখে। তুর্কি ঘোড়া বিখ্যাত। এদের থাকার জায়গাটার ছাদটা একটু উঁচু, এদের তো নীচে নামানো যাবে না এত সরু পথ দিয়ে। তাছাড়া শত্রু আক্রমণ হলে প্রথমেই আস্তাবল পেরোতে হবে, বা আক্রমণের আশঙ্কা হলেই একেবারে দরজার কাছে থেকে ঘোড়া নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে বেরোনো যেত। আশেপাশে একটু নীচে দেখলাম গৃহপালিত ছোট পশু-ছাগল, ভেড়া, ভোজ্য পাখিদের রাখার জায়গা। সেগুলিতে প্রবেশের পথ এখনো সাধারণের ব্যবহারের যোগ্য করা যায়নি তাই গর্তের মাথায় কাচ দিয়ে ঢাকা। সাবধানে সেই কাছের উপর পা দিয়ে অনেক জায়গা পেরোতে হল।
এবার মাথা সামলে, পোশাক সামলে সরু, খাড়া ১০ মিটার দীর্ঘ টানেল পেড়িয়ে নামা গেল দ্বিতলে। সেটা ছিল গুহায় আশ্রয় নেওয়া মানুষদের উপাসনালয়। ছোট্ট চার্চ; যাকে বলে চ্যাপেল। তাতে ছিল একটি উলটানো বাটির মত ছাদ আর এটির সামনেই একটি নেভ, অর্থাৎ ক্রসের লম্বা অংশটার আকারের একটি লম্বা জায়গা বা হল। সামনেই ছিল ব্যাপ্টাইজমের বেদি। হলটির দেয়ালের ধার ধরে ছিল বসার জন্য বেদি। সেগুলি যে চার্চ ছিল আর সেই গুহাবাসীরা যে খ্রিস্টান ছিল (বহুদিন সেখানে থাকত তারা) তা বোঝা গেল দেওয়ালের গায়ে আঁকা অর্থোডক্স ক্রশচিহ্ন আর প্রোটেস্ট্যান্ট ক্রুশ চিহ্ন দেখে। বহু অভিজাত, ধনী, নামকরা ব্যক্তিদের সমাধিও ছিল সেখানে। নাম লেখা আছে তাঁদের, আজ বোঝা যায় না খালি চোখে।
চার্চের মধ্যে ডোমের নীচেই ছিল একটা উঁচু জায়গা যেখানে বসে ধর্মগুরু তাঁর বাণী শোনাতেন। দেয়ালের ধারে ধারে ছিল অভিজাতদের আর ধনীদের বসার জন্য পাথর কেটে বানানো দীর্ঘ বেঞ্চি। মাঝখানের চত্বরে বসত সাধারণ জনতা। সেখানে ঢোকার পথে সুড়ঙ্গের মুখেই ছিল বিরাট বড় একটা পাথরের চাকা, শত্রুর আক্রমণ হতে যাচ্ছে বুঝতে পারলেই চাকাটি ঠেলে দিয়ে প্রবেশপথের টানেলের দরজাটি বন্ধ করে দিত এরা। নীচের দিকে শত্রুরদের প্রবেশ করার আর কোনো পথ থাকত না। আর উপরে আস্তাবলের মধ্যেই তারা আটকে থাকত বা ঘোড়া চুরি করে পালিয়ে যেত।
খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিট্টাইটদের আশ্রয়স্থল হিসাবে বানানো সেই গুহাবাড়িগুলিতে পরবর্তীকালে প্রধানত খ্রিস্টান মানুষজন আশ্রয় নিয়েছিল। আরব–বাইজানটাইন দীর্ঘ যুদ্ধের সময় খ্রিস্টানদের উপর আক্রমণ থেকে বাঁচতে যুগে যুগে খ্রিস্টানরা এখানে আশ্রয় নিত। দীর্ঘ অজানা সময়ের ইতিহাসকে ধারণ করে আছে গুহার সমস্ত বস্তু।
সাময়িক আশ্রয়ের জন্য এত ব্যবস্থা কেন, মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে। আমারও মনে ছিল সে প্রশ্ন। জানলাম, একসময় সারা অঞ্চল জুড়ে চারিদিকে ছিল ঘন বনজঙ্গল, হিংস্র বন্যপ্রাণীর উৎপাত ও আক্রমণ হত আখছাড়। এছাড়া দীর্ঘ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আর শত্রু-আক্রমনে অবরুদ্ধ থাকা বা এলাকায় অভিযানকারী কোন দেশের সেনাদলের চোখ থেকে নিজেদের আড়ালে সুরক্ষিত রাখার জন্য সেই গুহাবাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছিল ভূগর্ভস্থ দুর্গনগরী হিসাবে। একটি নগরীর ন্যুনতম প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই সেখানে ছিল। আমরা যেটিতে ঢুকলাম, সেই গুহাবাড়ির যেটুকু অংশ সংস্কৃত করা গেছে, সেখানে থাকতে পারত ৭০০ থেকে ১০০০ জনের মত। কিন্তু পুরো গুহাদুর্গে ৫০০০ লোকের থাকার জায়গা ছিল যার সমস্তটা এখনো উদ্ধার করা শেষ হয়নি। ছিল দীর্ঘ টানেল যে পথে শত্রুর চোখের আড়ালে থেকেই বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করা যেত, উৎপন্ন ফসল নিয়ে মাটির উপরে অবস্থিত দূরবর্তী বাজার অঞ্চলে পৌঁছুনো যেত। ছিল জল সরবরাহের জন্য ও বাতাস চলাচলের জন্য ছিল উলম্ব শ্যাফ্‌ট, বর্জ্য জল চলাচলের জন্য ছিল নিকাশী টানেল।
এরপরে আমরা চললাম আরও নীচে, তিনতলায়। সেটি ছিল শস্যাগার। সেই শস্যাগারের মধ্যেই ছিল বিভিন্ন প্রকোষ্ঠ, আর ছিল শষ্য পেষাই করার জন্য নানা মাপের জাঁতা। বিরাট একটি জাঁতার মত চ্যাপ্টা পাথরখন্ডে দেখলাম অনেকগুলি ছোট ছোট গর্ত খোদাই করা। সেটি একটি কঠিন আগ্নেয় শিলা। মনে হয় মেটালারজিতে ব্যবহারের জন্য এতে ৫৫টি অগভীর গর্ত রাখা হয়েছিল। সেটিতে নাকি মশলাও গুঁড়ো করা হত। পরে জানা গেছে এটি ব্যবহৃত হত কোল্ড-ফরমিং কপারের জন্য। কায়দাটা ছিল ১০ সেন্টিমিটার ব্যাসের সেই গর্তগুলিতে তামার টুকরো রাখা হত, তারপর হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সেগুলিকে নির্দিষ্ট আকার দেওয়া হত। মানে সেসময়ে তামার ব্যবহার চালু হয়েছিল। আশেপাশের শহরেই ছিল তামার খনি। শস্যাগারের মধ্যেই একধারে ছিল মদ তৈরির কারখানা। বড় বড় দুটো গর্ত রয়েছে যেখানে মদের পাত্র বসানো হত। শস্যাগারের অনেকগুলি প্রকোষ্ঠ ছিল। নানা ধাপে। এদিক ওদিক থেকে ছিল ছোট স্বল্পদৈর্ঘের কিছু ঢালু, সরু রাস্তা, কখনো নীচে নেমেই বাঁক নিয়ে আবার উপরে উঠছে। সবটাই অবশ্য তৃতীয় তলে, বিভিন্ন অংশে, যেখানে যেভাবে পাথরের দেয়াল কাটা সম্ভব হয়েছে সেখানে সেভাবেই পাহাড়ের নরম পাথরের দেয়াল কেটে প্রকোষ্ঠ তৈরি হয়েছে নানা কাজের জন্য। এই স্তরেই ছিল রান্নাঘর। চারদিকের দেওয়ালের গায়ে একটু উপর দিকে ছোট ছোট ঘরের মত জায়গাগুলি ছিল রান্নার জায়গা। কালো ধোঁয়ার চিহ্ন দেওয়ালে ও ছাদে। কালো দেওয়াল আর ঘরের ছাদের কালো স্তর প্রমান করে যে সেগুলি ছিল রান্নাঘর। অনেকগুলি এরকম ঘর পাওয়া গেছে ওই স্তরে অর্থাৎ তৃতীয় তলে। রান্না এবং খাওয়া চলত কমিউনিটি সিস্টেমে, সমবেত ভাবে, তাই রান্নার ব্যবস্থাও ছিল সামুহিক।
এবার একটা ২০ কি ২৫ মিটার দীর্ঘ সংকীর্ণ খাড়াই টানেল বেয়ে নীচের দিকে নামতে লাগলাম একে একে। যেখানে নামলাম সেখানে কিছু পাথরকাটা পিলারের পাশে, এধারে ওধারে কিছু সামান্য চওড়া জায়গা, সেখানে কর্মচারীরা থাকত, শোয়ার মত সামান্য চতুষ্কোণ জায়গা। নেমেই আবার বাঁক নিয়ে উঠলাম ১০ মিটার খাড়াই গলিপথে। এই গলিপথের ধারে দুদিকে ছোট ছোট খোপ, সেগুলিতেও জিনিসপত্র থাকতো, হয়তো বিছানা, পোশাক বা অন্যান্য দরকারি জিনিস। আরও খানিকটা নেমে যেখানে পৌঁছুলাম সেটা একটা প্রশস্ত প্রকোষ্ঠ। চার দিকে ছোট ছোট আলাদা আলাদা খোপ, সেগুলি অভিজাতদের ব্যবহারের জন্য,বাসগৃহ। সাধারন মানুষ, চাকরবাকরদের থাকার জায়গা ছিল কমন-সমবেত। বিভিন্ন পরিবার খানিকটা চওড়া জায়গায় পাশাপাশি রাতের ঘুমোবার জায়গা করে নিত। এবার আবার ফিরে আসার পালা। সেই পথে সুড়ঙ্গে চলতে হল আরও ২০ মিটার খাড়াই টানেল অবশ্যই সরু। সেই পথে যে দেওয়াল ধরে আমরা এগোচ্ছিলাম উপরের দিকে সেই দেওয়ালটি ছিল বেশ ঠাণ্ডা। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে জানলাম সেটি একটি ভেন্টিলেশন শ্যাফ্‌ট। ভিতরে ঠাণ্ডা বাতাস প্রবেশ করার আর ভিতরের গরম বাতাস ও ধোঁয়া বের করার জন্য তারা সেই প্রাচিন কালেই তৈরি করেছিল ভেন্টিলেশন শ্যাফ্‌ট। চারদিকের সমস্ত ঘর বা প্রকোষ্ঠগুলি তৈরি হয়েছিল শ্যাফ্‌টের গা ঘেষে, চারিদিক ঘিরে। সে সময়েই তারা জানতো ভেন্টিলেশনের প্রয়োজনীয়তা। শোবার ঘরে বেশ কিছু শস্যাধার এখনো আছে। দেখে মনে হল ধনীরা উদ্দ্বৃত্ত শস্য নিজেদের তত্বাবধানে রেখে দিত।
যখন তাদের দীর্ঘদিনের জন্য আত্মগোপন করতে হত, বিশেষত বিদেশী শত্রুর আক্রমন বা ওটোমান সাম্রাজ্য আর বিজানটাইন সাম্রাজ্যের মধ্যে দীর্ঘ দখলী লড়াইয়ের সময় তারা নিশিন্তে নিরাপদে এখানে থাকত, নিজেদের জানপ্রানসম্পদ রক্ষা করতে পারতো। পূর্বে বিজানটাইন সাম্রাজ্য আর পশ্চিমের তুর্কিদের উত্থানের সময়, আরবদের আক্রমনের সময় দূরন্ত বেগে ধাবমান সৈন্যদলের যাতায়াতের পথের পাশেই ছিল এই ক্যাপাডোকিয়া। এই দুই প্রান্তীয় অঞ্চলের দেশগুলির পারস্পরিক সাম্রাজ্য দখলের লড়াই চলেছিল খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই। সেটা আরো বেড়েছিল দ্বাদশ শতাব্দী থেকে। একসময়ে হিট্টাইট ট্রাইবরা যারা এখানে এসে বসতি গড়েছিল তারা প্রথমে এই উষর অঞ্চলে চরম শীত ও চরম গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে বাঁচার জন্য, আর বন্য প্রানীদের আক্রমন থেকে আত্মরক্ষার জন্য পাহাড়িদুর্গ তৈরি করেছিল, পাহাড় কুদে তৈরি করেছিল নিরাপদ আশ্রয়ের জায়গা। সেইসব আস্তানা কালক্রমে হয়ে উঠেছিল এক একটি পুর্নাঙ্গ শহর যেখানের জীবন চলত পুরোপুরি কমিউনিটি দ্বারা পরিচালিত। শত্রুর আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য, আর খ্রিস্টান-মুসলিম দীর্ঘ লড়াইয়ে আক্রমন এড়াতে সেই আস্তানাকে আরো বর্ধিত করা হয়েছিল নিশ্চিতভাবেই। ফলে কালক্রমে আরও অধিক মানুষ আশ্রয় নিতে পারতো সেখানে। সমগ্র ক্যামেকিয়ালি দুর্গনগরীর সবটুকু উদ্ধার ও সংস্কার করার পর দেখা যাবে যে সেটি ছিল অন্যটির থেকেও বিশাল গভীরতায়ও বেশী। বর্তমানে ক্যাপাডোকিয়ার দুটি ভূগর্ভস্থ নগরীর মধ্যে এটি দ্বিতীয়। আগামী দুবছরের মধ্যেই এই দুর্গনগরীর সবটুকুই খুলে যাবে পর্যটকদের কাছে।
প্রাচীন কালে ক্যামাকিয়ালির নাম ছিল এনেগুপ। এটি একটি আগ্নেয় অঞ্চল। অগ্ন্যুৎপাতে প্রথমে উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল আগ্নেয় ছাই। কালের প্রভাবে, প্রকৃতির হস্তক্ষেপে সেই ঝুড়ো ছাইয়ের আস্তরের নীচ থেকে বেড়িয়েছিল ‘টাফ’ নামক শিলাস্তর। ‘টাফ’ হচ্ছে ছাই জমাট বেঁধে তৈরি একধরনের নরম শিলা। ঝামাপাথরের মত গায়ে ছিদ্রযুক্ত। আগ্নেয় পাথরের থেকে নরম সেই শিলা কেটে খ্রিস্টপূর্ব ৮ম থেকে ৭ম শতাব্দীর মধ্যে প্রথমে ফিরিগিয়ানরা (Phriygians) বানিয়েছিল গুহাবাড়ি, ছোট আকারে। এরা ছিল ইন্দো ইউরোপিয়ান মানুষ। রোমান অধিকারে যাবার পরে যখন তাদের মুখের ভাষার স্থান নিল গ্রিক ভাষা, পাগানদের নিজেদের ভাষার সঙ্গে ধর্মও হারিয়ে গেল। তারা হয়ে গেল খ্রিষ্টান।
৭০০ থেকে ১১৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ বছর ব্যাপী আরব–বাইজানটাইন যুদ্ধের সময় মুসলিম আরবদের থেকে নিজেদের বাঁচাতে, ধর্মকে বাঁচাতে বহু খ্রিস্টানরা এখানে এসে আশ্রয় নিতে থাকে। বাইজানটাইন আমলেই তাই অধিক মানুষেকে ঠাঁই দেবার কারণে এই পাহাড়ি গুহাদুর্গ আরও সম্প্রসারিত হয়। ১৪শ শতকে মঙ্গোলিয়ান দস্যুনেতা তৈমুরের আক্রমণের সময় আরও খ্রিস্টান মানুষ ধর্মে ও প্রাণে বাঁচার জন্য এগুলিতে আশ্রয় নিত।
এরপর বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পতন আর ওটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের উত্থান। তখন এই বাড়িগুলিতে এসে আশ্রয় নিতে লাগলো মুসলিম টার্কি শাসকদের দেশ থেকে পালিয়ে আসা খ্রিস্টান উদ্বাস্তুরা। পরবর্তীকালে ২০ শতকের শেষের দিকেও যারা এখানে আশ্রিত ছিল তাদের নাম তখন হয়ে গেছে ক্যাপাডোকিয়ান গ্রিক। এর আরও পরে যখন এই অঞ্চল থেকে খ্রিস্টান খেদানো শুরু হল তখন গ্রিস আর তুরস্কের মধ্যে লোকবিনিময় চুক্তি হল। তখন এইসব আবাসন ছেড়ে অনেক খ্রিস্টানদের চলে যেতে হল গ্রিসে। আর মুসলিমদের চলে আসতে হল ক্যাপাডোকিয়ায়। অনেকে সেইসময় নিজের বাসস্থান, সম্পত্তি ছেড়ে যাবে না ঠিক করল, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এখানেই থাকার অধিকার বজায় রাখল। ১৯২৩ সালের লোকবিনিময়ের পর থেকেই এই গুহাবাড়িগুলি পরিত্যক্ত হয়ে গিয়ে চলে গিয়েছিল বিস্মৃতির আঁধারে। এখন তা আবার পুনরুদ্ধার করে সংস্কার করে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে।

আলোকচিত্রঃ লেখক

ভ্রমণ সব লেখা একত্রে

1 thought on “ভ্রমণ ক্যাপাদোকিয়া– আজব দেশের আজব বাড়িঘর উমা ভট্টাচার্য শরৎ ২০১৯

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s