সুপর্ণা দেবের আগের ভ্রমণ ও অন্যান্য লেখাঃ ক্যানবেরা ক্যানভাস রোদ্দুরের চিঠি, ডিডগেরিডুর সুর, অরোর তিনখানা গল্প
গ্রাফিত্তি ইতালিয়া : মুরানো বুরানো
সুপর্ণা দেব
জল সইতে সইতে চলেছি। বড় একটা ঢেউ এসে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে এল। একটা আলোমাখা ছোট্ট শহর। জলছবির মতো। ফিরোজা রঙের জলের ধারে।
পুরোনো পুরোনো বাড়ি। সেসব বাড়িতে আবার বাহারি রঙ। শীতের পাতাঝরা ন্যাড়া গাছ। রোদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে সেই সব রঙদার বাড়ি। ছোট্ট ধুকপুকি শহরের মাঝখান দিয়ে তিরতির খালের জল বয়ে যায়। আর ছোট্ট ছোট্ট সেতু দিয়ে এদিক ওদিক এপার ওপার খাল পারাপার করে। রাস্তায় যেমন সার বেঁধে সাইকেল বাইক গাড়ি দাঁড় করানো থাকে, এখানে তেমনই ডাঙার গা ঘেঁসে বোট দাঁড়িয়ে আছে। অমুক বাড়ির বোট, তমুক বাড়ির বোট।
জায়গাটার নাম মুরানো। ঠুনকো রঙিন বেলোয়ারি কাঁচের দেমাক। রঙিন কাচের শিল্পকর্মের জন্য একরত্তি এই দ্বীপ বিখ্যাত। ভেনিস থেকে জল বাইতে বাইতে এই বেলোয়ারি দ্বীপে এসে পড়া গেল।
রঙিন কাচের নানান সামগ্রী। পথের ধারে ধারে ওয়ার্কশপ। কোনোটাই সস্তা নয় হে। মুরানোর জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া।
দোকানপাট খুলছে। বেশির ভাগ দোকানেই মেয়েরা বসে আছেন। হ্যাঁ, জিনিসপত্র ভালোই। কিন্তু আহা উহু করার মতো কিছু নয়। ইওরোপ সমঝদার সেয়ানা জায়গা। আমার এইটুকু আছে, আমি এতোখানি করে দেখাব। আমাদের মতো সেরা আর কেউ হতেই পারে না। ভাবখানা ভালো। আমাদের দেশের থেকে অন্তত ঢের ভালো।
মুরানোর পাশে বুরানো। সেই মেয়ে আবার সারাদিন ধরে লেস বোনে। মুরানোর কাচ আর বুরানোর লেস। এই নিয়েই দুই দ্বীপকন্যা কত কত বছর ধরে ঘরকন্না করছে। এত পথিকের আনাগোনা, এত মানুষের ভালোবাসা তাদের আর বুড়ি হতে দিল কোথায়? মোটা মোটা সোনালি বেণী ঝুলিয়ে ফিরোজা জলে পা ডুবিয়ে সেই কবে থেকে, হ্যাঁ তা প্রায় সাতশো আটশো বছর হবে, দুটিতে বসে লেস বুনছে আর কাচের জিনিস বানাচ্ছে! ভাবা যায় !
২
মুরানো আর বুরানো ঘুরে আসার কথা বলেছিল মিতিলা। মিতিলা অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে থাকে। অনেক অনেক গভীরে। মাঝে মাঝে পথ ভুলে ভেনিসের গ্র্যান্ড ক্যানালে হাবুডুবু খায়। ছলাত ছলাত জল ছিটিয়ে ভরসন্ধে বেলা যখন ভেনিসে নামলুম, কনকনে ঠান্ডা হাওয়া নাকের ডগা জমিয়ে দিল আর কানের পাশে শনশন করে বয়ে যেতে যেতে বলল, মিতিলা, মিতিলা, মিতিলা। সেই ডাক আমি আর আমার খুদে ভাইপো অরোস্মিত ছাড়া কেউ আর শুনতেই পেল না।
মিতিলা আমাদের বুরানো আর মুরানো ঘুরে আসতে বলেছিল। ভেনিস থেকে ঘন্টাখানেক। সেন্ট মার্ক-এর সামনেই সান্তা জাক্কারিয়া। সেখান থেকে সব নৌকো, জল বাস, জল ট্যাক্সি ধরা যায়। ভেনিসে রাস্তা মানেই জলপথ।
আমরা ওকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার সঙ্গে কবে দেখা হবে আমাদের? মিতিলা জলের ফেনার মধ্যে মিলিয়ে যেতে যেতে বলেছিল, হবে হবে, শিগগিরি।
মিতিলার কথামত আমরা মুরানো আর বুরানো দেখতে বেরুলাম। মুরানোতে একটা কাচের ওয়ার্কশপে বসে বসে কাচের শৌখিন জিনিস বানানোর কৌশল দেখলাম। লম্বা পাইপের মুখে ফুঁ দিয়ে নানান রকমারি নকশা আর আকার তৈরি হচ্ছে।
একটা পুরোনো সোঁদা বাড়ি। জলতরঙ্গের মতো ঠুং ঠুং বাজনা। মহার্ঘ শিল্পদ্রব্য আর সেই ফুঁ ভেলকি দিয়ে জিনিস বানানো দেখছি। নানান রঙে চুবিয়ে আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে ফুঁ-এর পর ফুঁ দিয়ে বানানো হল একটি রঙিন টলটলে হৃদয়। তখনো গরম! এ যেন এক টুকরো ভেলভেট কেক। পুড়ে পুড়ে তবে হৃদয়টি খাঁটি হল। হৃদয়টি আবার রঙে নাস্তানাবুদ! রঙ যেন মোর মর্মে লাগে! দেখতে ভারী সুন্দর। হৃদয়ের মূল্য অনেক। কোনো মানেই হয় না কেনার! হাত থেকে পড়ে গেলেই ভেঙে যাবে। তার চেয়ে আমরা গাদাগুচ্ছের ময়দা আর চিজ দিয়ে ফাটাফাটি লাঞ্চ করব। কী বল?
আমরা কালামারি ভাজা, স্প্যাঘোটি বোলোনিজ দিয়ে একটা ছোট্ট দোকানে লাঞ্চ খেলাম। তারপর আবার ঘুরে ঘুরে সব দেখি!
৩
লেসের জিনিসগুলো কী চমৎকার দেখতে। সুন্দর সুন্দর পোশাক, টুপি, টেবিল ঢাকা, কত শৌখিন, কত বাহারি! মেয়ে মহিলারা বেশ আলাপি, বাড়ির ব্যাবসা চলেছে অনেক প্রজন্ম ধরে। চিনের জিনিসে ছেয়ে যাওয়া বাজারে এগুলো খাঁটি ইতালিয়। একসময় কাচশিল্পের গুপ্তবিদ্যা বাইরে নিয়ে যাওয়া যেত না। ব্যাবসার জন্য নানান দেশে মালপত্তর নিয়ে যাওয়া হত। কোন কারগর নাকি গিল্ড বা স্থানীয় নিয়মানুযায়ী অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করতে পারত না। কিন্তু ঐ যে, রাঁধুনি সব বলবে কিন্তু একটা গুপ্তকথা থেকেই যাবে।
রঙবেরঙের বাড়ি, ঝিরঝিরে খাল, ছোট্ট ছোট্ট সাঁকো, গির্জা, লেস আর কাচের দোকান, এই নিয়েই মুরানো আর বুরানো। আমরা আস্তে আস্তে হাঁটছি। হঠাৎ দেখি ১১১ নম্বর বাড়ি! আবার ১০১ নম্বর বাড়ি! আশ্চর্য ব্যাপার! প্রচন্ড কৌতূহল ছটফট করছে! কিন্তু কাকে জিগ্যেস করব? সামনে একটা বাঁধানো খোলা চত্বর আর শুনশান গির্জা। এবং শুধু পিসার হেলানো মিনার নয় মালুম হচ্ছে ইতালির সব গির্জার চূড়া একটু একটু হেলে পড়া। ভালোভাবে ওলন দড়ি ব্যাবহারই করেনি। কিন্তু হাল আমলের আমাদের কলকাতার লেকটাউনের সেই ক্লক টাওয়ারও কিঞ্চিত হেলানো।
এমন সময় দেখি একটা ছেলে, ফিটফাট বাবু, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। আমরা অমনি সদলবলে গায়ে পড়ে, “হেঁ, হেঁ, এখানেই থাকেন বুঝি” গোছের কথা দিয়ে ভাব জমানোর চেষ্টা করতে থাকলাম। কোন এক জিপসি বেদের মেয়ে জোসনা, সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলিকে বিদেশের কোন এক শহরে প্রায় জাপটে ধরে বলেছিল আমরা তো এক দেশের ! ইন্ডিয়ার। আমাদেরও দলের কোনো কোন সদস্য মনে করেছিল ঐ ১১১ এর গেরো থেকে না জানি কী রহস্য বের হয় আর রাতের খ্যাঁটনটা তাদের ঘাড়ে চেপে খেলেই হয়!
তা সে ফিটফাটও বেশ আলাপি , সে বলল, হ্যাঁ, এটা “এক” সংখ্যা।
ওহ তাই? তোমরাও এভাবে এক লেখো?
তবে এটা এখন আর লেখে না কেউ। এটা পুরোনো, মানে বেশ পুরোনো, মানে আমার ঠাকুরদা বা তার বাবা এরম লিখতেন।
তোমরা খুব হেরিটেজ বাঁচিয়ে চলো, না?
ঠিকই ধরেছ। এই যে বাড়িগুলো, খুব পুরোনো। জলটল লেগে হেজেমজে গেছে, নোনা ধরা। কিন্তু যে পরিবার যে রঙ ব্যবহার করত সেই রঙই লাগানো হয়ে আসছে। একেকটা রঙ একেকটা ফ্যামিলির।
এতোক্ষণে বুঝলাম এই রঙমশালি শহরের রহস্য। তা, যাতায়াত তো সবই ঐ জল বেয়ে বেয়েই করো, তাই তো?
ফিটফাট বলল, হ্যাঁ, তাই তো! আমাদের তিনটে বোট আছে।
তিনটে?
হ্যাঁ , একটা আমার, একটা বাড়ির, আরেকটা আমার বউ-এর।
ওকে টাটা।
ইশ, কোনোরকম যোগাযোগই বেরুলো না বাংলার সঙ্গে! রাতের খাওয়া তো দূর, চা কফির ধার দিয়েও যেতে পারলাম না! মনের দুঃ খে একটা দোকানে গিয়ে এক চাঁদপানা মেয়েকে বললাম, এক লিখুন তো!
সে সরল মনে কোনো প্রশ্ন না করে ভুরু না কুঁচকে ইংরেজি ওয়ান লিখল। আমি বল্লুম, না না আরেকটা এক আছে আপনাদের। সে বলল, ওঃ, সে তো কেউ লেখে না এখন। সেটা খুউউব পুরোনো।
মনে একটা খটকা রয়ে গেল কিন্তু ফিটফাটের তথ্য যাচাই করে নিলুম এই বেলা।
৪
জলের ধারে একটা বাড়ির গায়ে মস্ত বড় একখানা ইংরেজি এস লেখা। সেই মার্কোপোলোর আমল থেকে বোধহয়। জলের ধারে বাড়ি, জলের দামে কিনে নিতে পারি কিনা জম্পেশ করে ভাবছি। ভাবছি হেজেলনাট আর সিনামন কফি আর কুড়কুড়ে স্কুইড ভাজা রাখব, দারুণ চলবে আমার দোকান। অমনি আমার দলের বেয়াক্কেলে লোকজনেরা “এই জল বাস(ওয়াটার বাস) এসে গেছে, এর পরেরটা অনেক দেরি।”
দৌড় দৌড় দৌড়।
বুরানো চোখের বাইরে চলে যাচ্ছে। একটা নাবিক জেলে, সেই কবে কে জানে বিয়ের ঠিক আগে আগে মাঝদরিয়ায় গিয়েছিল। তার হবু বউ-এর মুখখানা মনে পড়ে। হঠাৎ উথালিপাথালি ঢেউ-এর মধ্যে রাঙা আলো মাখা জলে ভুস করে মাথা তোলে এক মৎস্যকন্যা। ইনিয়েবিনিয়ে তাকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বল্ল। জেলেটি তাতে একটুকুও গলে গেল না। কে না জানে, মৎস্যকন্যারা কত কত জাদু জানে! তার চোখ জুড়ে হবু বউ-এর মুখখানা তারার মতো জ্বলে। মৎস্যকন্যা খুব আশ্চর্য হয়, কী ব্যাপার! জেলেটা তার মিষ্টি কথায় এতটুকুও গলে যাচ্ছে না যে! আবার খুশিও হয় তার ওপর। উপহার হিসেবে তার লেজের ঘূর্ণি তুলে সমুদ্রের ফেনা জমিয়ে জমিয়ে একটা অদ্ভুত ফুরফুরে নকশা সে জেলেটির হাতে তুলে দিয়ে ভুস করে ডুবে যায় কোথায় মিলিয়ে যায় স্বপ্নের মত।
সেই ভেজা নকশা রোদ্দুরের তাপে, মিঠে হাওয়ায় আস্তে আস্তে শুকিয়ে ওঠে। জেলে নাবিক বাড়ি ফিরে সেই ফেনা জমা নকশা বউ এর হাতে তুলে দেয়। সেই মেয়েটি ভারি অবাক হয়ে যায় ! এতো সুন্দর একটা জিনিস।
কোথায় পেলে? এর নাম কী?
মৎস্যকন্যার লেজ, জেলে উত্তর দেয়।
সুতো দিয়ে সেই মেয়েটি নকশা বুনতে শুরু করে। বুরানোর লোকগাথা। সেই লেস যা ইওরোপের ফ্যাশান আর স্ট্যাটাস সিম্বল ছিল এককালে।
এই গল্প শোনার পর আমি বুঝলাম কেন মিতিলা আমাদের বুরানো মুরানো দেখতে বলেছিল এতো করে। ভেনিসে নামলাম সন্ধের মুখে। সান্তা জাক্কারিয়া। দোকান থেকে কিনব অনেক খাবার দাবার, তেল মশল্লা, চিজ, মাশরুম। অরোর বাবা রাঁধবে।
তারপর কাশীর গলি বা উত্তর কলকাতার গলির গলি তস্য গলি দিয়ে আমাদের ভেনিসের বাড়িতে ফিরব। আর মিতিলা? সে তখন অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের গভীরে লেজের ঝাপট দিয়ে ফেনার ঘূর্ণি তুলছে।