স্বপ্না লাহিড়ী
কল্যাণীয়া জয়,
আজ তোর জন্মদিনে তোর ছোটবেলার কিছু কিছু কথা মনে পড়ছে। খুব ছোটবেলার নয়, তখনকার যখন তুই কলেজে পড়তিস আর আমি পড়াতাম। তুই first year-এ ভর্তি হলি geology, physics নিয়ে। আমাদের কলেজ তখন দুটো আলাদা সাইটে চলত—নিউ সাইটে Arts, commerce বিভাগ আর old site-এ science faculty-গুলি। দুটির মধ্যে প্রায় মাইল খানেকের সরু পাহাড়ি রাস্তা। রাস্তাটির দু’ধারে ছিল আদিবাসীদের ছোটো ছোটো খড়ের চাল ছাওয়া বাড়ি আর সবজি বাগান, আর কিছু মহুয়াগাছ যার টসটসে পাকা পাকা ফল পড়ে থাকত রাস্তার ওপরে—গন্ধে ভারী হয়ে থাকত বাতাস।
হিন্দি, ইংরাজি পড়ে ফেরার পথে তোদের class-এর মনোজের পোষা বাঁদর ক্ষেত থেকে ভুট্টা, শসা তুলে আনত আর অশোক হাতের টিপ প্র্যাকটিস করে মুরগি মেরে আনত, আর সেগুলির সদ্গতি হত আমার রান্নাঘরে, যখন আমি কলেজে থাকতাম।
মনে আছে জয়, আমাদের প্রথমবার অমরকন্টক যাওয়া? আমরা যখন পেন্ড্রা পৌঁছলাম, তখন প্রায় বিকেল। এখান থেকেই অমরকন্টক যেতে হয়। তখন এত ভালো রাস্তাঘাট, যানবাহন ছিল না। পাহাড়ি রাস্তা ধরে একটা খোলা ডালা ট্রাকে চেপে ধুলি-ধূসরিত হয়ে যখন আমরা অমরকন্টক পৌঁছলাম তখন সন্ধে হয় হয়। ওই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় আমরা দুই বোন দুটো বিছানার চাদর জড়়িয়ে নেমে গেলাম সীতাকুণ্ডের (নর্মদার উৎসস্থল) জলে। স্নান সেরে শিবমন্দিরে (ক্ষমা করো শিবঠাকুর) জামাকাপড়় ছেড়়ে যখন কমনভাবীর দোকানের গনগনে কাঠের আগুনের সামনে বসে চা-ভাজিয়া খেলাম, তখন মনে হল, আহা স্বর্গ বোধহয় ‘অমিন অস্ত অমিন অস্ত’।
কলেজে দুয়েকদিনের ছুটি পেলেই আমরা বেরিয়ে পড়তাম কাছে কিনারে কোনও জায়গা দেখতে। পাহাড়-জঙ্গল-নদী সবসময় যেন আমদের হাতছানি দিয়ে ডাকত। এইরকম কোনও একটা ছোট্ট ছুটিতে বেরিয়ে পড়লাম রামগড়ের পথে, মহাকবি কালিদাসের রামগড় (রামগিরি)। মহাকবির শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য মেঘদূত এই রামগিরিতে সৃষ্ট হয়েছিল। ভোর ভোর বাসে করে রামগড় পাহাড়ের নিচে যখন আমরা বড়া তুর্রার (ঝরনা) কাছে পৌঁছেছি, তখন সকাল গড়িয়ে গেছে আর তোর ধুম জ্বর। পিছনে ঝমঝম করে ঝরনার জল পড়ছে, তার সামনে একটা বড়ো পাথরের ওপর বসে ওষুধ খেয়ে একটু জিরিয়ে তোর জ্বর কমলে আমরা পাহাড়ের পাশ দিয়ে সরু পথ ধরে ওপরে ওঠা শুরু করলাম। রাস্তার একদিকে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে, আরেকদিকে গভীর খাদ। আমরা একসারিতে ওপরে উঠছি, পায়ের তলে নুড়িপাথর গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। অনেক নিচে বড়ো বড়ো গাছের মাথাগুলি দেখা যাচ্ছিল। ভগ্নপ্রায় হাতি-গেটে যখন আমরা পৌঁছলাম তখন সবাই বেশ ক্লান্ত। হাতি-গেট পেরিয়ে দেখতে পেলাম সেই বিখ্যাত গুহা যা নাকি রাজা বিক্রমাদিত্যের সময় স্টেজ হিসেবে ব্যবহৃত হত। সামনের অর্ধগোলাকার জায়গাটিতে পাথরে খাঁজ কেটে বসার জায়গা। অনেকটা amphitheater-এর মতো। এটি সম্ভবত বিশ্বের প্রাচীনতম গুহা নাট্যশালা বা cave theater। গুহার দেয়ালে ব্রাহ্মীলিপিতে কয়েকটি লাইন খোদাই করা আছে যা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব দুই শতাব্দী পুরনো। পরে জেনেছি, অসামান্যা নৃত্যশিল্পী সুতনুকার উদ্দেশ্যে এটি লেখা। এই জায়গাটির আরেকটি পরিচিতি আছে, সীতাব্যেঙ্গড়া। শ্রীরাম, সীতা ও লক্ষ্মণ তাঁদের নির্বাসনের সময় নাকি বেশ কিছুদিন এখানে কাটিয়েছিলেন। এইখানেই লক্ষণ রেখা টেনে তাঁর বৌদি সীতাকে এর বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলেন ও রাবণ সীতাকে অপহরণ করেছিলেন এখান থেকেই। গুহার ঠিক মুখেই বেশ বড়ো একটি পায়ের ও ওপরে হাতের চিহ্ন আছে যা নরোত্তম রামের বলে স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস।
সেদিন রাতে আমরা ওখানকার গঁউঠিয়ার (গাঁ-মোড়ল) মাটির ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তখন ওখানে হোটেল বা কোনও থাকার ব্যবস্থা বিশেষ ছিল না। মাটির মেঝেতে খড়়ের গাদা, তার ওপরে চাদর পেতে শোওয়া। সামনে মাটি দিয়ে লেপা উঠোনে কাঠের আগুনে রাঁধা ধোঁয়া-ওঠা গরম গরম ভাত, দিশি মুরগির ঝোল আর আমলকির মোরব্বা ছিল রাতের আহার। খোলা আকাশের নিচে আগুন ঘেঁষে বসে গঁউঠিয়ার গল্প শুনতে শুনতে খাওয়া—একটা আলাদা জগতের স্বাদ পেয়েছিলাম সেদিন।
পরদিন গঁউঠিয়ার ছেলেকে নিয়ে আমরা গেলাম লছমনব্যেঙ্গড়া দেখতে। জায়গাটিকে হথফোড়়ও বলা হয়। ছেলেটির হাতে একটা মোটা লাঠি, কাঁধে কুড়ুল আর একটা না জ্বলা মশাল। জঙ্গল এত ঘন যে পাশাপাশি দু’জনের বেশি চলা যায় না। বড়ো বড়ো গাছের ফাঁক দিয়ে টুকরো টুকরো রোদ এসে পড়ছে মাটিতে। বন-প্রান্তর স্তব্ধ, মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় ওড়া শুকনো পাতার আওয়াজ আর পাখির ডাক। প্রায় ঘণ্টা খানেক চলার পর এসে পৌঁছলাম বেশ বড়ো একটি গুহার সামনে। গুহার প্রবেশপথ বেশ প্রশস্ত। অপর পারেও হালকা আলো দেখা যাচ্ছিল। বোঝা গেল, গুহাটা লম্বা সুড়ঙ্গের মতো, যার দু’দিক খোলা।
ভেতরে ঢুকে ছেলেটি মশাল জ্বালিয়ে দিল। সেই আলোতে ভেসে উঠল, গুহার দু’দিকের দেয়ালে মানুষ-পশু-গাছপালা-ফুলের নানারকমের রেখাচিত্র। আমরা অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম। কতক্ষণ সেখানে ছিলাম জানি না, হুঁশ এল যখন পথপ্রদর্শক ছেলেটি আমাদের মনে করিয়ে দিল, এবার ফিরতে হবে। রাত হয়ে গেলে এই ঘন জঙ্গলে বিপদ হতে পারে। আমাদেরও ফেরার বাস ধরতে হবে। তাই ফেরার পালা।
এ-জায়গাটা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানতে পারিনি আজও। হয়তো আমাদের দু’জনের কেউই archaeology-র ছাত্র নই বলে। রাত্রে বাড়়ি ফিরে দেখলাম তোর সেই দুটো রোডেশিয়ন কুকুর টফি আর ইডিয়ট বসে আছে পাঁচিলের ওপরে। আমাদের দেখে ঐকতানে চেঁচিয়ে ও লেজ নেড়ে অভ্যর্থনা করল।
এ-গল্প 1966—67-এর। এর পরে আরও অনেক জায়গায় আমাদের অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে, সেসব কথায় পরে আসা যাবে। এখন এই পর্যন্ত।
আজ তোর শুভ জন্মদিনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, তুই সুস্থ থাক, আনন্দে থাক। অনেক ভালোবাসা শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ সহ—
রাঙাদি
সুতনুকা পত্রলেখর ছবিঃ ইনটারনেট
অন্যান্য ফটোগ্রাফিঃ দেবজ্যোতি