ভ্রমণ পরিব্রাজক (৩য় পর্ব) স্বামী বিবেকানন্দ (সম্পাদনা: অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়) শরৎ ২০২০

পরিব্রাজক(প্রথম পর্ব),পরিব্রাজক (২য় পর্ব)

(তৃতীয় পর্ব)

স্বামী বিবেকানন্দ

কলকাতা বন্দর থেকে বাষ্পচালিত জাহাজ গোলকোন্ডায় তিন সন্ন্যাসীকে সঙ্গে নিয়ে বিবেকানন্দ চলেছেন পশ্চিমের উদ্দেশ্যে। জাহাজে বসে উদ্বোধন পত্রিকার সম্পাদক স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছেন

ঝড়-ঝাপট হলেই ডেকযাত্রীর বড় কষ্ট, আর কতক কষ্ট যখন বন্দরে মাল নামায়। এক উপরে ‘হারিকেন ডেক’ ছাড়া সব ডেকের মধ্যে একটা করে মস্ত চৌকা কাটা আছে, তারই মধ্য দিয়ে মাল নামায় এবং তোলে। সেই সময় ডেকযাত্রীর একটু কষ্ট হয়। নতুবা কোলকাতা হতে সুয়েজ পর্যন্ত এবং গরমের দিনে ইওরোপেও, ডেকে বড় আরাম। যখন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রীরা তাঁদের সাজানো গুছানো কামরার মধ্যে গরমের চোটে তরলমূর্তি ধরবার চেষ্টা করছেন, তখন ডেক যেন স্বর্গ। এসব জাহাজের দ্বিতীয় শ্রেণী বড়ই খারাপ। কেবল এক নূতন জার্মান লয়েড কোম্পানী হয়েছে, জার্মানীর বের্গেন নামক শহর হতে অষ্ট্রেলিয়ায় যায়, তাদের দ্বিতীয় শ্রেণী বড় সুন্দর। এমনকি ‘হারিকেন ডেকে’ পর্যন্ত ঘর আছে এবং খাওয়া-দাওয়া প্রায় গোলকোণ্ডার প্রথম শ্রেণীর মত। গোলকোণ্ডা জাহাজে ‘হারিকেন ডেকে’র উপর কেবল দুটি ঘর আছে, একটি এপাশে আর একটি ওপাশে। একটিতে থাকেন ডাক্তার, আর একটি আমাদের দিয়েছিল। কিন্তু গরমের ভয়ে আমরা নীচের তলায় পালিয়ে এলুম। ঐ ঘরটি জাহাজের ইঞ্জিনের উপর। জাহাজ লোহার হলেও যাত্রীদের কামরাগুলি কাঠের। সে কাঠের দেয়ালে বায়ুসঞ্চারের জন্য অনেকগুলি ছিদ্র থাকে। দেওয়ালগুলিতে ‘আইভরি পেণ্ট’ লাগানো। ঘরের মধ্যে একখানি ছোট কার্পেট পাতা। একটি দেওয়ালের গায়ে দুটি খুরোহীন লোহার খাটিয়ার মত এঁটে দেওয়া; একটির উপর আর একটি। অপর দেওয়ালে ওইরকম একখানি ‘সোফা’। দরজার ঠিক উল্টোদিকে মুখ হাত ধোবার জায়গা, তার উপর একখানি আরশি, দুটো বোতল, খাবার জলের দুটো গ্লাস। প্রত্যেক বিছানার গায়ের দিকে একটি করে জালতি পেতলের ফ্রেমে লাগানো। ঐ জালতি ফ্রেম সমেত দেওয়ালের গায়ে লেগে যায়, আবার টানলে নেমে আসে। রাত্রে যাত্রীদের ঘড়ি প্রভৃতি অত্যাবশ্যক জিনিষপত্র তাইতে রেখে শোয়। নীচে বিছানার নীচে সিন্দুক প্যাঁটরা রাখবার জায়গা। সেকেণ্ড ক্লাসের ভাবও ওই, তবে স্থান সংকীর্ণ ও জিনিষপত্র খেলো।

জাহাজী কারবারটা প্রায় ইংরেজের একচেটে। সে জন্য অন্যান্য জাতেরা যে সকল জাহাজ করেছে, তাতেও লোকে বলে খাওয়া-দাওয়া নাকি অনেকটা ইংরেজদের মত করে করতে হয়। ইংলণ্ড, ফ্রান্স, জার্মানী ওরাশিয়াতে খাওয়া-দাওয়ায় এবং সময়ে অনেক পার্থক্য আছে। যেমন আমাদের ভারতবর্ষে—বাঙলায়, হিন্দুস্থানে, মহারাষ্ট্রে, গুজরাতে, মাদ্রাজে তফাত। কিন্তু এ সকল পার্থক্য জাহাজে অল্প দেখা যায়। ইংরেজীভাষী যাত্রীর সংখ্যাধিক্যে ইংরাজী ঢঙে সব গড়ে যাচ্চে।

বাষ্পপোতে সর্বেসর্বা কর্তা হচ্ছেন ‘কাপ্তেন’। পূর্বে ‘হাই-সী’-তে কাপ্তেন জাহাজে রাজত্ব করতেন। তিনি কাউকে সাজা দিতেন, ডাকাত ধরে ফাঁসি দিতেন, ইত্যাদি। এখন অত নাই, তবে তাঁর হুকুমই আইন। জাহাজে তাঁর নীচে চারজন ‘অফিসার’ বা ‘মালিম’, তারপর চার পাঁচ জন ইঞ্জিনীয়ার। তাদের যে ‘চীফ’, তার পদ অফিসারের সমান। সে প্রথম শ্রেণীতে খেতে পায়। আর আছে চার-পাঁচজন ‘সুকানি’—যারা হাল ধরে থাকে পালাক্রমে, এরাও ইওরোপী। বাকী সমস্ত চাকর-বাকর, খালাসী, কয়লাওয়ালা হচ্ছে দেশী লোক, সকলেই মুসলমান। হিন্দু কেবল বোম্বাইয়ের তরফে দেখেছিলুম, পি. অ্যান্ড ও. কোম্পানীর জাহাজে। চাকররা এবং খালাসীরা কোলকাতার, কয়লাওয়ালারা পূর্ববঙ্গের, রাঁধুনীরাও পূর্ববঙ্গের ক্যাথলিক ক্রিশ্চান। আর আছে চারজন মেথর। কামরা হতে ময়লা জল সাফ প্রভৃতি মেথররা করে, স্নানের বন্দোবস্ত করে, আর পায়খানা প্রভৃতি দুরস্ত রাখে। মুসলমান চাকর-খালাসীরা ক্রিশ্চানের রান্না খায় না। তবে অনেকটা আড়াল দিয়ে কাজ সারে। জাহাজের রান্নাঘরের তৈরি রুটি প্রভৃতি স্বচ্ছন্দে খায়, এবং যে সকল কোলকাত্তাই চাকর নয়া রোশনাই পেয়েছে, তারা আড়ালে খাওয়া-দাওয়া বিচার করে না। লোকজনদের তিনটা ‘মেস’ আছে—একটা চাকরদের, একটা খালাসীদের, আর একটা কয়লাওয়ালাদের। কোম্পানী প্রতি মেসকে একজন করে ভাণ্ডারী অর্থাৎ রাঁধুনী আর একটি চাকর দেয়। প্রতি মেসের একটা রাঁধবার স্থান আছে। কোলকাতা থেকে কিছু হিঁদু ডেকযাত্রী কলম্বোয় যাচ্ছিল; তারা ঐ ঘরে চাকরদের রান্না হয়ে গেলে রেঁধে খেত। চাকরবাকররা জলও নিজেরা তুলে খায়। প্রত্যেক ডেকে দেওয়ালের গায়ে দুপাশে দুটি ‘পাম্প’—একটি নোনা, একটি মিঠে জলের। সেখান হতে মিঠে জল তুলে মুসলমানেরা ব্যবহার করে। যে সকল হিঁদুর কলের জলে আপত্তি নাই, যারা খাওয়া-দাওয়ার সম্পূর্ণ বিচার রক্ষা করে, এই সকল জাহাজে বিলাত প্রভৃতি দেশে যাওয়া, তাদের পক্ষে অত্যন্ত সোজা। রান্নাঘর পাওয়া যায়, কারুর ছোঁয়া জল খেতে হয় না, স্নানের জল পর্যন্ত অন্য কোন জাতের ছোঁবার আবশ্যকতা নাই। চাল-ডাল, শাক-সবজি, মাছ, দুধ-ঘি সমস্তই জাহাজে পাওয়া যায়, বিশেষ এই সকল জাহাজে দেশী লোক সমস্ত কাজ করে বলে ডাল, চাল, মূলো, কপি, আলু প্রভৃতি রোজ রোজ তাদের বার করে দিতে হয়। এক কথা—পয়সা। পয়সা থাকলে একলাই সম্পূর্ণ আচার রক্ষা করে যাওয়া যায়।

এই সকল বাঙালী লোকজন প্রায় আজকাল সব জাহাজে—যেগুলি কোলকাতা হতে ইওরোপে যায়। এদের ক্রমে একটা জাত সৃষ্টি হচ্ছে; কতকগুলি জাহাজী পারিভাষিক শব্দেরও সৃষ্টি হচ্ছে। কাপ্তেনকে এরা বলে—‘বাড়ীওয়ালা’, ‘অফিসার’—‘মালিম’, মাস্তুল— ‘ডোল’, পাল—‘সড়’, নামাও—‘আরিয়া’, ওঠাও—‘হাবিস’ ইত্যাদি।

খালাসীদের এবং কয়লাওয়ালাদের একজন করে সর্দার আছে, তার নাম ‘সারেঙ্গ’, তার নীচে দুই-তিনজন ‘টিণ্ডাল’, তারপর খালাসী বা কয়লাওয়ালা। খানসামাদের কর্তার নাম ‘বট‍্লার’, তার ওপর একজন গোরা ‘ষ্টুয়ার্ড’। খালাসীরা জাহাজ ধোওয়া-পোঁছা, কাছি ফেলা তোলা, নৌকা নামানো ওঠানো, পাল তোলা, পাল নামানো ইত্যাদি কাজ করে। সারেঙ্গ ও টিণ্ডালরা সর্বদাই সঙ্গে সঙ্গে ফিরছে এবং কাজ করছে। কয়লাওয়ালা ইঞ্জিন-ঘরে আগুন ঠিক রাখছে। তাদের কাজ দিনরাত আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ করা, আর ইঞ্জিন ধুয়ে পুঁছে সাফ রাখা। সে বিরাট ইঞ্জিন, আর তার শাখা-প্রশাখা সাফ রাখা কি সোজা কাজ? ‘সারেঙ্গ’ এবং তার ‘ভাই’ আসিস্টাণ্ট সারেঙ্গ কোলকাতার লোক, বাঙলা কয়। অনেকটা ভদ্রলোকের মত। লিখতে পড়তে পারে, স্কুলে পড়েছিল, ইংরেজীও কয়—কাজ চালানো। সারেঙ্গের তের বছরের ছেলে কাপ্তেনের চাকর—দরজায় থাকে আর্দালী। এই সকল বাঙালী খালাসী, কয়লাওয়ালা, খানসামা প্রভৃতির কাজ দেখে, স্বজাতির উপর যে একটা হতাশ বুদ্ধি আছে, সেটা অনেকটা কমে গেল। এরা কেমন আস্তে আস্তে মানুষ হয়ে আসছে, কেমন সবল শরীর হয়েছে, কেমন নির্ভীক অথচ শান্ত! সে নেটিভি পা-চাটা ভাব মেথরগুলোরও নেই। কি পরিবর্তন!

দেশী মাল্লারা কাজ করে ভাল, মুখে কথাটি নাই। আবার সিকিখানা গোরার মাইনে। বিলাতে অনেকে অসন্তুষ্ট। অনেক গোরার অন্ন যাচ্চে দেখে খুশী নয়। তারা মাঝে মাঝে হাঙ্গামা তোলে। কাজে গোরার চেয়ে চটপটে। লোকে বলে, ঝড়-ঝাপ্টা হলে, জাহাজ বিপদে পড়লে গোরাদের সাহস থাকে না। কাজে দেখা যাচ্চে—ও অপবাদ মিথ্যা। বিপদের সময় গোরাগুলো ভয়ে মদ খেয়ে, জড় হয়ে, নিকম্মা হয়ে যায়। দেশী খালাসী এক ফোঁটা মদ জন্মে খায় না, আর এ পর্যন্ত কোন মহা বিপদে একজনও কাপুরুষত্ব দেখায়নি। বলি, দেশী সেপাই কি কাপুরুষত্ব দেখায়? তবে নেতা চাই। জেনারেল স্ট্রং নামক এক ইংরেজ বন্ধু সিপাহী হাঙ্গামার সময় এদেশে ছিলেন। তিনি ‘গদরে’র গল্প অনেক করতেন। একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করা গেল যে, সিপাহীদের এত তোপ বারুদ রসদ হাতে ছিল, আবার তারা সুশিক্ষিত ও বহুদর্শী, তবে এমন করে হেরে মলো কেন? জবাব দিলেন যে, তার মধ্যে যারা নেতা হয়েছিল, সেগুলো অনেক পেছনে থেকে ‘মারো বাহাদুর’—‘লড়ো বাহাদুর’ করে চেঁচাচ্ছিল। অফিসার এগিয়ে মৃত্যুমুখে না গেলে কি সিপাহী লড়ে? সকল কাজেই এই। ‘শিরদার তো সরদার’; মাথা দিতে পার তো নেতা হবে। আমরা সকলেই ফাঁকি দিয়ে নেতা হতে চাই। তাইতে কিছুই হয় না, কেউ মানে না!

(ক্রমশ)

কৃতজ্ঞতা: উদ্বোধন কার্যালয়, রামকৃষ্ণ মিশন

ভ্রমণ সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s