সুপর্ণা দেবের আগের ভ্রমণ ও অন্যান্য লেখাঃ ক্যানবেরা ক্যানভাস রোদ্দুরের চিঠি, ডিডগেরিডুর সুর, অরোর তিনখানা গল্প, গ্রাফিত্তি ইতালিয়া : মুরানো বুরানো, ডালাঘোড়া আর এমিলের গল্প
লম্বা সাদা মেঘের গল্প
সুপর্ণা দেব
১।
।পাউয়া শামুক।
যতদূর চোখ যায় দেখা যায় শুধু নীল। নীল সমুদ্র মিশেছে নীল আকাশে। নীল সমুদ্রের পাশে পাশে পাথুরে তটভূমি, সমুদ্রের পাড়। এবড়ো-খেবড়ো পাথর। পাথরের ওপর ছলাত ছলাত জল এসে পড়ছে। আবার যখন হাওয়ার গতি বেড়ে যায় সেই জল পাথরে আছড়ে পড়ে। ঝোড়ো হাওয়া বইলে সে এক উথালপাতাল অবস্থা। সেই সময় পাউয়া শামুক কী করে? তার দুটো মোটাসোটা পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে সেই পাথর। খুব শক্ত করে যাতে কোনোভাবেই ভেসে না যায়। ওরা খায় সমুদ্রের আগাছা। বেশ শক্তপোক্ত শামুক।
হালকা অগভীর জলে পাড়ের কাছে এই শামুকেরা থাকে। চেহারায় খুব ছোট্ট নয় কিন্তু। ওরা নাকি তাওঙ্গা! তাওঙ্গা মানে সম্পদ, মানে বেশ দামি। প্রকৃতি মা আমাদের যা যা হাত ভরে দেন সেইসবের মধ্যে পাউয়া নাকি খুবই পয়মন্ত।
পাউয়ার শক্ত খোলায় জাদুকরের তুলি। কত যে তার রঙ! রোদ্দুর পড়ে একেক সময় একেকরকম লাগে। রুপোলী, নীল, সবুজ, তামাটে, বাদামি। আর কী চমৎকার নকশা! একেকজনের একেকরকম। নীল আকাশের নীচে, নীল সমুদ্রের গা ঘেঁষে খয়েরি রঙের পাথুরে জমিতে রুপোলী, নীল, সবুজ, তামাটে, বাদামি রঙের তুমুল খেলা।
কিন্তু হলে হবে কী? মানুষের হাত থেকে কি কোনও কিছুর নিস্তার আছে? পাউয়া শামুককে জল থেকে পাথর থেকে উপড়ে তুলে নেয় তারা। এক খোঁচা দিয়ে নরম একদলা শরীরটা বের করে সেটাকে কুচি কুচি করে কেটে রেঁধে খায়। আর ওই যে জাদুকরের তুলির টান দিয়ে বানানো তার অপূর্ব খোলা, সেটা দিয়ে গয়না বানায়। নানারকম হাতের কাজ বানায়। খুব চড়া দামে বিক্রি হয়।
এই পাউয়া শামুক পাওয়া যায় কেবল নিউজিল্যান্ডের সমুদ্রে। এখানেই তাদের আস্তানা। প্রথম থেকেই এটা কাদের সম্পত্তি ছিল সেই গল্প বলছি দাঁড়াও।
২
আচ্ছা, মোয়ানাকে চেন তো? মোয়ানা, সেই বিচ্ছু মেয়েটা! গলায় শঙ্খের মালা, পাতা দিয়ে বানানো জামা। সোনালি বালির মধ্যে সরসর হেঁটে যাচ্ছে। গুটগুটে কচ্ছপছানা তার পায়ে পায়ে ঘোরে। সে একটা পাতার ঝাপটা দিয়ে পাখিদের হাত থেকে ছানাটাকে বাঁচায়, তাকে জলে ছেড়ে দেয়। নীল টলটলে জল। জলের সঙ্গে ভেসে আসে একটা শঙ্খ। সেই সমুদ্দুর দু’ভাগ হয়ে যায়। মোয়ানা টুকটুক করে দু’ভাগ হয়ে যাওয়া সমুদ্দুরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ও মা! কতকিছু দেখতে পায় ও! সমুদ্রের মধ্যে এত সুন্দর সুন্দর মাছ, প্রবাল, রঙচঙে প্রাণী, পাথর। সমুদ্রের জল মোয়ানার সঙ্গে খেলা শুরু করে দেয়। তার মাথার চুলে ঝুঁটি বেঁধে দেয়। তাতে একটা লাল ফুল গুঁজে দেয় আবার। সমুদ্র একটা বড়ো শামুকের খোলে মোয়ানাকে বসিয়ে ডাঙায় পৌঁছে দেয়। মোয়ানার বাবা দৌড়ে আসে। বাপ রে, সারা গায়ে উল্কি আঁকা মোটাসোটা মোয়ানার বাবা, ওকে তুলে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। সেই মোতুনাই গ্রামের মোয়ানার অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে ওয়াল্ট ডিজনির ছবি এখন খুব বিখ্যাত হয়েছে কিনা! ওই মোয়ানাও কিন্তু পাউয়া শামুকের মতো নিউজিল্যান্ডের গল্প থেকে উঠে এসেছে।
মোয়ানা, পাউয়া—এইসব নামগুলো না আমেরিকার, না ইউরোপের। এগুলো পলিনেশিয়ার নাম। মাওরিদের নাম। সেই কোন সনাতন কালে পলিনেশিয় দিদিমা-ঠাকুমারা পাতার ঝুপড়ির মধ্যে বসে নাতিপুতিদের গল্প শোনাত। মাওরিদের কথা গল্পে গল্পে ধরে রাখা আছে। এই মাওরিদের কাছে পাউয়া শামুক ছিল সম্পদ। এই বিশাল সমুদ্র, এই আকাশ, সমুদ্র ও বন থেকে পাওয়া সম্পদ নিয়ে পলিনেশিয় আদি বাসিন্দা মাওরিদের জীবন চলত।
৩
হে আও হে আও হে আওটিয়ারোয়া।
একটা মেঘ, একটা মেঘ, একটা লম্বা সাদা মেঘ।
পলিনেশিয় গল্পগাছা বলছে এক ডাকাবুকো লোকের কথা। তার নাম কুপে। কুপে ও তার বউ সমুদ্রে ডিঙি ভাসিয়ে চলছিল। ভেসেই চলেছে, ভেসেই চলেছে। ডাঙা দেখাই যায় না। এমন সময় একদিন কুপের বউ চেঁচিয়ে উঠল। ওই দেখো, একটা সাদা মেঘ, লম্বা সাদা মেঘ। চলো, ওইদিকে যাই। মেঘের দিকে যেতে যেতে তারা যে জায়গায় গিয়ে হাজির হল তার নাম দিল আওটিয়ারোয়া, মানে লম্বা সাদা মেঘের দেশ। এর মানে কী হল বলো তো? আজকের নিউজিল্যান্ডের আসল নাম আওটিয়ারোয়া—লম্বা সাদা মেঘের দেশ।
এরা হল মাওরি, নিউজিল্যান্ডের আদি বাসিন্দা যারা ব্রিটিশ আসার আগে এই দেশকে খুঁজে পেয়েছিল সমুদ্রের জলে ভাসতে ভাসতে।
মাওরি, নিউজিল্যান্ডের আদি বাসিন্দাদের সেই জল, আকাশ-বাতাস, গাছপালা, পাখপাখালি ঘেরা জীবন সে দেশের গল্পে গল্পে ধরা আছে। তাই মাওরিদের জীবনযাপনে গল্প বলার একটা খুব বড়ো ভূমিকা আছে, জানো!
প্রশান্ত মহাসাগরের জল আছড়ে পড়ছে, পাথুরে জমি, পাহাড়, এমনই দুটো সুন্দর জায়গা। ওটাকি আর পেরি পেরি উমু। হ্যাঁ, এ-দুটোও মাওরি নাম। মাওরিদের অনেকেই আধুনিক জীবন কাটায়। সময়ের সঙ্গে পালটে নিয়েছে। বাইরে থেকে সে দেশে যারা এসেছিল সেই ব্রিটিশরা মাওরিদের সঙ্গে বেশ মিলেমিশে গেছে। ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে। ইংরেজি ছাড়াও মাওরি ভাষা সে দেশের সরকারি ভাষার সম্মান পেয়েছে।
কিন্তু ওই যে দূরে নীল নীল দ্বীপ দেখা যাচ্ছে, সেইদিকে আঙুল তুলে একজন বলল, ওইখানে মাওরিরা থাকে নিজেদের মতো করে। লোকজনদের থেকে দূরে। আধুনিক জগত থেকে দূরে প্রকৃতির মধ্যে তাদের সরল জীবন। আমি তাকিয়ে রইলাম সেই আবছা নীল পাহাড়ের দিকে। দেখতে পেলাম জল থৈ থৈ লম্বা লম্বা ঘাস। তার মধ্যে হলুদ, গোলাপি আর বেগুনি ফুল, লম্বা ডাঁটি হাওয়ায় দুলছে। কত প্রজাপতি! একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর। পাতায় ছাওয়া। একজন দিদিমা বসে আছে আর তার চারদিকে কুচোকাচা একদল মানুষের ছানা। তাদের সবার মোয়ানার মতো পাতার পোশাক। একটা বুনো লতা দিয়ে দিদিমার চুলগুলো উঁচু করে বাঁধা। শঙ্খ আর কড়ি দিয়ে গলার মালা, হাতের বালা। ঘন বর্ষা ধোয়া বনভূমি। বৃষ্টি অরণ্য। দিদিমা আর ছানাপোনাদের হাতে কুলের মতো দেখতে একরাশ ফল আর বুনো বাদাম। দিদিমা গল্প বলছে আর ছানার দল হাঁ করে শুনছে। কী গল্প শুনছে ওরা? ওরা শুনছে জঙ্গলের দেবতা তানে মাহুতার গল্প। তানে মাহুতা, জঙ্গলের ঠাকুর, আসলে এক প্রকাণ্ড কাউরি গাছ, যে গাছের বয়স কত কেউ জানে না। সেই গাছ তাদের জঙ্গলের ঠাকুর। পৃথিবী তার মা আর আকাশ হল বাবা। আকাশের নিচে আর মাটির ওপরে তানে মাহুতা এক সুন্দর বসতি গড়ে তুলল।
ছানাপোনা কচিকাঁচার দল এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে বলল, “তারপর?”
দিদিমা কয়েক গাল তিসি ভাজা খেয়ে বলতে শুরু করল, “তারপর তানে মাহুতা লাল মাটি দিয়ে একটা সুন্দর মেয়ের মূর্তি বানাল। সেই দেখে বাতাসের দেবতা বলল, ‘আমি ওই মেয়েকে নিঃশ্বাস দিই তাহলে। তাহলে ও জ্যান্ত হয়ে উঠবে।’
“তানে মাহুতা তখন তার নাক ওই মেয়েটির নাকে ঘষে দিতেই সেই মেয়ে বলল, ‘তিহেই।’ তিহেই মানে হ্যাচ্চো করল।”
ছানাপোনার দল তখন হি হি হি হি করে করে হেসেই খুন! আজও মাওরিরা একে অন্যকে হাই হ্যালো বলে নাকে নাক ঘষে।
৪
আমি তো এতক্ষণ যেন সিনেমা দেখছিলাম। কী চমৎকার লাগছিল! এখন দেখি, ও মা! আমি সেই নীল পাহাড়টার দিকে হাঁ করে তাকিয়েই আছি। বন্ধুরা বলল, “চলো চলো, পা চালাই। তে পাপা দেখতে যাব না?”
তে পাপা কথাটির মাওরি ভাষায় মানে হল, আমাদের জায়গা। আমাদের ভূমি। আর সত্যিই তো, ব্রিটিশ ইউরোপীয় প্রভুত্বের আগে মাওরিরাই তো ছিল এই জায়গার মালিক। তাদের জীবনযাপন, শিল্প, সমাজ সব সবকিছু সুন্দরভাবে এই মিউজিয়ামে রাখা আছে।
জলে জঙ্গলের জীবন, তাদের ঘর, তাদের নৌকা, জামাকাপড়, গয়নাগাটি আর তাদের হাতের কাজ—সবই সুন্দর করে দেখানো আছে তে পাপা মিউজিয়ামে। কাঠের শিল্পকাজ বেশ সুন্দর। নানান রকম প্যাঁচানো নকশা দেওয়া। দেখলাম কী জানো? ওই পাউয়া শামুক দিয়ে ওরা বেশ ডিজাইন বানাত। বিশেষ করে চোখ বানানোর জন্য পাউয়ার খোলাটা ব্যাবহার করত। এতে চোখটা দুর্দান্ত সুন্দর দেখতে লাগে।
সেই যে বলছিলাম না, প্রাকৃতিক সম্পদ, পাউরি শামুককে মাওরিরা প্রাকৃতিক সম্পদ মনে করত। তেমনি মনে করত মানুকা মধুকে। মানুকা গাছের ঝোপঝাড় জঙ্গলে যে ঘন মধুর চাক জমাট বাঁধে সে তো গলানো সোনা। প্রকৃতি মা তাদের সেই অমৃতের সন্ধান দিয়েছে। ব্রিটিশ আগন্তুকেরা এসবই ধীরে ধীরে দখল করেছে বটে কিন্তু আসলে এ তো মাওরিদের একেবারে নিজস্ব সম্পদ, তাওঙ্গা। শুধু মধুই নয়, মানুকা গাছের অনেক অনেক গুণ। নানান অসুখ সারায়। চামড়া মসৃণ রাখে। জঙ্গলের গাছপালাই তো তাদের ডাক্তারবাবু ছিল! পরে এসব সম্পদ নিয়ে বাজারে ব্যাবসা করেছে ওই বাইরে থেকে যারা এসেছিল সাহেবের দল। মানুকা ফুলের মধু সোনার মত দামি! এখানে ওয়েলিংটনের বোটানিকাল গারডেনে বি লেডি (bee lady) একটা কাঠের মূর্তি। দেখলেই মনে হবে এ মেয়ে মাওরি না হয়ে যায় না। মুখে একটা মুখোশের মতো পরে আছে, হাতে ধোঁয়া ওঠানো লন্ঠন। মৌমাছি তাড়াতে গেলে এগুলো লাগবেই। সে মেয়ের চোখদুটো ভারি রহস্যময়। মনে হচ্ছে পাউয়া শামুকের খোলা দিয়ে বানিয়েছে। সেই নীল, রুপোলী মায়া।
ওরা বিশ্বাস করত, এই প্রকৃতি তোমাকে দু’হাত ভরে যা দেয় তাকে ফিরিয়েও দিতে হয় কিছু। কীভাবে? তাকে ভালোবেসে, তাকে যত্ন করে, তাকে রক্ষা করে। ফেলে ছড়িয়ে দুমড়ে মুচড়ে নয়, যেমন আমরা এখন করে চলেছি।