আশুতোষ ভট্টাচার্য
লাদাখ ঘুরতে যাবার কঠিন চ্যালেঞ্জটা নিয়েই ফেললাম। সেটা ফেব্রুয়ারি মাস শীত যাই যাই করছে আমাদের এই বঙ্গদেশে, সেখানেই সোয়েটার মাফলার পরে বন্ধু অনুজ জামিলের অনুরোধে সাড়া দিয়ে নাম লিখিয়ে ফেললাম। লাদাখ তো আর বাড়ির পাশে নয় যে বনগাঁ কি ক্যানিং লোকালে টিকিট কেটে বসলেই হবে , ম্যাপেই দেখা যায় সে বহুদূরের রাস্তা তারপর আমরা সমুদ্রতলের মানুষ আর সে জায়গা বহু উঁচুতে কথায় কথায় বরফ পড়ে , সে এক ক্যাটাভেরাস অবস্থা। জামিল আস্থা দিল, দাদা সব বন্দোবস্ত আমি করে দেব, তুমি শুধু চল।
শুনেই আমার স্ত্রী ভারি চিন্তিত হয়ে পড়লেন, আমার বাল্যবন্ধু তথা ডাক্তার দীপককে ফোন করে জানালেন, তুমি চেম্বারে আজ বসছ তো? আমরা যাচ্ছি। এসব ব্যাপারে আমি বিশেষ কথা বলি না, কারন উনি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনো করলেও ভেতর ভেতর চিকিৎসা শাস্ত্রের অগাধ জ্ঞান, ভালোবাসা উনার সঙ্গে সঙ্গে ফল্গুধারার মত বয়ে চলে।কোন রোগের কি লক্ষণ, কি ওষুধে তার উপশম, মানব দেহের কোথায় হার্ট, লান্স, কিডনি ইত্যাদি থাকে সব মুখস্থ। তা বিকেলে যাওয়া হল সেই ডাক্তারবাবুর কাছে, ডাক্তারবাবু লাদাখ ফেরত( মানে সেই পড়তে গিয়ে বিলাত ফেরত নন, উনিও ঘুরতে গিয়েছিলেন সস্ত্রীক) সুতরাং হাতে গরম অভিজ্ঞতা তো আছেই!
শুরু হল আমার মিসেসের জিজ্ঞাসা, সেখানে গেলে কি নিশ্বাসের কষ্ট হয়, নিজেকে হাল্কা হাল্কা লাগে? গা ববি বমি লাগে?কত পারসেন্ট অক্সিজেন আছে সেখানে, হাই অল্টিচুড সিকনেস বস্তুটা কেমন, হজমের অসুবিধে হয় না? ঘুম হয় ঠিকমত?স্মৃতিভ্রংশ হয়?কোষ্ঠকাঠিন্য? কান কটকট করে ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বভাবত ডাক্তার এসব প্রশ্ন শুনে অভ্যস্ত নন বরং তিনিই এসব প্রশ্ন এতকাল রুগীকে করে এসছেন। যাই হোক উনাকে একটা প্রেসক্রিপশন লিখতে হল লাদাখ ভ্রমণ স্পেশাল, তাতে কোন উপসর্গের জন্য কি ওষুধ, সকাল বিকেল রাত্রি ছবি টবি এঁকে দিলেন, প্রেসার ট্রেসার মেপে বিদায় দেবেন ভাবছেন( শত হলেও আমরা বিনি পয়সার রুগী আর বহু মানুষ বাইরে অপেক্ষারত) আমার উনি প্রশ্ন করলেন একটা ইনজেকশন জাতীয় কিছু দিলে হত না , ব্যাপারটা তাহলে বেশ পাকাপোক্ত হত! অনেক কষ্টে তাকে নিবৃত্ত করা গেল। তবু তাঁর মন ভরল না ঠিক , বিকেলে আমাদের পরিচিত হোমিওপ্যাথ ডাক্তার খগেন কাকুর কাছ থেকে কোকো আর কারবমেজ নিয়ে আসলেন।
প্ল্যান অনুসারে ফ্লাইট টিকিট কেটে প্রস্তুত যদিও যাত্রা প্রায় আট মাস পরে, পুজোর সময়, কোলকাতা থেকে শ্রীনগর, সেখানে দুদিন সোনমার্গ, গুলমার্গ ডাল লেক শিকারায় বসে পোজ দিয়ে ছবি টবি তুলে সড়কপথে কার্গিল হয়ে লে লাদাখ। তাতে দুটো লাভ , আরেকবার কাশ্মীর দেখা সঙ্গে সেই যাত্রাপথের আনন্দ আর আস্তে আস্তে লে লাদাকে উচ্চতা আরোহণ করলে সেই হাই অল্টিচিউড সিকনেস থেকে খানিকটা হলেও স্বস্তি। পরে অবশ্য সেই ৩৭০ ধারা রদ ও পারিপার্শ্বিক কারণে আমরা দিল্লী থেকে সরাসরি উড়ান পথে লাদাখ যাত্রা মনস্থ করি, অতএব কিছু আর্থিক ক্ষতি!
ঝুলন
ছেলেবেলায় ঝুলন সাজাতাম। পাহাড়, জঙ্গল, গুহা, নদী, ধানক্ষেত, মাঠ, বাড়ি, পুকুর সব থাকত। পাহাড় বানাতাম ছেঁড়া ন্যাকড়া, পুরোনো কাপড় কাদামাটিতে চুবিয়ে,শুকিয়ে গেলে বেশ মাটিমাটি পাথর পাথর এফেক্ট আসত।আর হ্যাঁ, মাঝে মাঝে সেই কাপড়, ন্যাকড়া ছিড়ে গুহা বানানো, কিছু কামিনী গাছের ডাল এদিক ওদিক বসিয়ে জঙ্গল বানাতাম, রথের মেলায় যে বাঘ সিংহ কিনতাম সেই জঙ্গলের গুহায় বসিয়ে দিলেই ব্যাস।পাহাড় থাকলে বরফ থাকবে, ন্যাশনাল জিও না দেখলেও সে বোধটা ছিল, তাই চুন ঘন করে গুলে সেই খেলনা পাহাড়ের ওপর তুলি বুলিয়ে দিতাম আমি পার্থ রাজু।
আজ প্রায় বছর চল্লিশ পর সেই পাহাড় দেখলাম,সত্যি সত্যি। একদম আমরা ঝুলনের সময় যেমন বানাতাম হুবহু তাই। আকাশ থেকে দেখছি লাদাখ মালভূমি। চারপাশে পাহাড় (পাহাড় না বলে পর্বত বলাই ভাল) তার ওপর ফুচকাওয়ালা যেমন চুরমুরের ওপর চানাচুর ছড়িয়ে দেয়, ঈশ্বর যেন বরফের কুঁচি দিয়েছে ছড়িয়ে। আর সেই বরফকুচির ওপর রোদ পড়ে ঝলমল করে উঠছে চারপাশ। বেটার হাফ আর ছেলে দেখি সামান্য নিদ্রা গেছেন(গোলযোগ সইতে পারেন না),আমি যেই না সেই দৃশ্য দেখতে ডেকেছি সে তো ধড়মড় করে উঠে বলে বলে কোকোর গুলি পাঁচ ছটা করে দিনে চারবার, আমার কার্মোমেজের শিশি কোথায়?
পাহাড়ের মাঝ দিয়ে নিপুন স্ট্রাইকারের মত ডজ করে গো এয়ার বিমান লে বিমানবন্দরে অবতরণ করল যখন ঘড়িতে দশটা।
লে- লাদাক ইতিহাস ভূগোল
লাদাখ, পাস বা গিরিখাতে ভর্তি। a-dwags কথাটার মানে করলে দাঁড়ায়, লা মানে পাস আর দ্বাগস মানে সেই পাস বা গিরিপথের মালিক। এ ছাড়াও লাদাখের অন্য অনেক নাম ছিল, maryul বা mangyul, বিভিন্ন জাতির দেশ। পরিচিত ছিল মধ্য এশিয়ার হিরে(central Asian ডায়মন্ড) নামে, কারণ লাদাখ ছিল বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গমস্থল। বলা হত moon land কারণ এই মালভূমি দেখতে নাকি চাঁদের পিঠের মত, hermit kingdom বলা হত স্তব্ধতা আর লামাদের উপাসনাস্থান হিসেবে। এসব তথ্য গুগুলে যত্রতত্র ছড়ানো আছে আমি টুকে দিলাম আর কি।
লাদাখ বহু আগে ছিল স্বাধীন রাজ্য আর ব্যাবসা-বাণিজ্যের পীঠস্থান মানে স্ট্রাটেজিক পজিশন যাকে বলে। বালতিস্থান ছিল উত্তর-পশ্চিম দিকে, তিব্বত ছিল পুবে, xinjiang (চীনের অংশ) ছিল উত্তরে, পশ্চিমে কাশ্মীর আর হিমাচল আর পাঞ্জাব ছিল দক্ষিণ দিকে। হাজার হাজার বছর ধরে এইসব দুর্গম পথে চলত বাণিজ্য। জমজমাট থাকত পুরো লাদাখ উপত্যকা।
লাদাখ এয়ারপোর্ট ছোট কিন্তু ছবির মত। প্রধানত কাঠ দিয়ে তৈরি, কলকাতা দিল্লি হিথরোর মত ব্যস্ত নয়, সারাদিন সাকুল্যে চার পাঁচখানি যাত্রী বিমান সঙ্গে অবশ্য সেনাবাহিনীর বিমানের ব্যস্ততা লেগেই আছে। নাম কুশক বাকুলা রিম্পোচি এয়ারপোর্ট। আমরা অপেক্ষা করছি আমাদের সারথি মিস্টার নুরবু-র জন্য। ইনি আগামী কয়েকদিন আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
হাই অল্টিচুড সিম্পটম, মানে সেই মাথা ধরা, গা গোলানো, অনিদ্রা ইত্যাদি ইত্যাদির রক্তচক্ষুকে যথাযথাযথ মর্যাদা দিয়ে আমরা হোটেলে একদিন পূর্ণ বিশ্রাম মনস্থ করলাম।
বিশ্রাম বললেই কি হয়, বৈকালে পদব্রজে চললাম মার্কেটে সিমকার্ডের খোঁজে। হ্যাঁ এখানে অন্য রাজ্যের প্রিপেড চলে না, লে শহরে এয়ারটেল সিগন্যাল আছে। বাকি স্থানে ভগবান ভরসা। বি এস এন এল আছে অবশ্য সর্বত্র। আর আম্বানিবাবু নাকি বেশ বাণিজ্য করছেন এখানে। আমার সেল ওয়ান আছে, বাকিরা জিও সিম নিয়েছে। দেখা যাক কোথায় কেমন সিগন্যাল পাওয়া যায়।
লাদাখ তিব্বতের গড়ার কথা
মাত্র সাড়ে বাইশ কোটি বছর আগে, মানে যখন ইন্টারনেট, কে এফ সি কি পিজা হাট, ফেসবুক, ২০-২০,ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান, ডাইনোসর, ডিম, মুরগি, মানুষ, নবান্ন, মিড ডে মিল, নস্ট্রাডামুস, নিউটন’স ল এসব কিচ্ছু ছিল না, এই ভারতবর্ষ তখন একটা দ্বীপের মত অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের কাছাকাছি ভাসছে। আর বাকি এশিয়া আর ভারতের মধ্যে টেথিস মহাসাগর সেখানে তখনো ফেরি সার্ভিস, টমাস কুক কিচ্ছু চালু হয় নি।তবে ভাগ্যবিধাতা ছিলেন, এবার ভারতবর্ষর ভবিষ্যৎ তো লেখা আছে এশিয়ার সঙ্গে সহাবস্থানের, সুতরাং সেই ৬৪০০ কিমি পাড়ি দেওয়া শুরু হল, সে এক অভিযান, বছরে ৯ থেকে ১৬ সেমি করে( মানে ১০০ বছরে মেরেকেটে ১.৫ মিটার!), স্লো বাট স্টেডি। এমনি করে মাস যায় বছর যায় দশক যায় শতক যায় , এশিয়া মহাদেশের( নাকি ইউরেশিয়া) বন্দরে এসে ভিড়ল ভারতবর্ষ। তখন আবার বন্দর জেটি নোঙর এসব কিচ্ছু নেই, ভয়ানক ধাক্কাধাক্কি লেগে গেল সেই ভারত উপমহাদেশ আর ইউরেশিয়ান মহাদেশের প্লেটগুলোতে, না এ প্লেট সেই চিনামাটির কাপ ডিশ নয়, মাটির নীচের স্তর যা পৃথিবীকে ধারণ করে আছে। ব্যাস একটা ছড়ানো আর্ট পেপারের দুপাশ থেকে চাপ দিলে যেমন মাঝখানটা উঁচু হয়ে ওঠে এখানেও তেমন হল, ভারত ভূখণ্ডের ওপর দিক মানে উত্তর দিক আস্তে আস্তে উঁচু হতে হতে হিমালয় পর্বতশ্রেণী, কারাকোরাম তৈরি হল,আর সেই হিমালয়ের একপাশে তৈরি হল তিব্বত মালভূমি ,আর সেই তিব্বত মালভূমির উত্তরে টাকলামাকান মরুভূমি। সে এক হুলুস্থুলু কাণ্ড। এই হল মোটামুটি হিমালয়, তিব্বত লাদাক তৈরির গল্প। এই তিব্বতকে আবার বলা হয় পৃথিবীর ছাদ, কেউ বলে থার্ড পোল মানে উত্তর দক্ষিণ মেরু বাদে এখানে যে পরিমান হিমবাহ আর বরফ আছে, মিষ্টি জলের এ এক অন্যতম বড় ভান্ডার।
চল খারদুংলা
এবারের যাত্রা খারদুংলা পাস হয়ে নুব্রা ভ্যালি। খারদুংলা পৃথিবীর অন্যতম উঁচু মোটর চালিত পথ, উচ্চতা ১৮ হাজার ফুটের বেশি। ভৌগলিক অবস্থানগত দিক থেকে এর গুরুত্ব অনন্য। সিয়াচিন সীমান্তের সঙ্গে এই পথেই যোগাযোগ। সৈন্যদের খাবার খাদ্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, যাতায়াত, ট্রাক, সামরিক অস্ত্রশস্ত্রর যোগান সব চলে এই পথ দিয়ে। এত উঁচু বলে এই পথের একটা অংশ অধিকাংশ সময় বরফে ঢাকা থাকে, নিয়মিত বরফ পরিষ্কার করে সামরিক বাহিনী আর বি আর ও মানে বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন, এরা অবশ্য ভারতের অধিকাংশ সীমান্তবর্তী রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ করে। যাহা হউক দুর্গা দুর্গা বলে সকাল নয় ঘটিকায় যাত্রা শুরু হল।মায়ের ইচ্ছে ছিল স্বামী আর পুত্র যেন খানচারেক সোয়েটার আর জ্যাকেট পরে এই অভিযানে যায়। কিন্তু অবাধ্য স্বামী-পুত্র সে কথা শুনলে তো! ওদিকে বুনু, জামিল আর লিসা পাঁচখানা সুটকেস নিয়ে এসেছে এই ভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে, এ অনেকটা সেই ‘পাঁচতলা মল পুরোটাই শাড়ি’-র ঢঙে বলা চলে পাঁচখানা সুটকেস পুরোটাই সোয়েটার বা জ্যাকেট। লে থেকে খারদুংলা রাস্তা ৩৯ কিলোমিটার,তার মধ্যে প্রথম ২৪ কিলোমিটার মানে সাউথ পুলু (South Pullu) অবধি মোটামুটি ভালো, বোল্ডার কংক্রিটের তৈরি। আর বাকি ১৫ কিলোমিটার উঁচু নিচু ঢেউ খেলানো, ভাঙাচোরা ধুলো কাদা ভর্তি। এসব উঁচু পাহাড়ে যাত্রাপথে ওপর দিকের রাস্তা দেখতে বা ফেলে আসা পথগুলো দেখতে দুরন্ত লাগে কি । জিগজ্যাগ জ্যামিতিক গঠন, নিচের রাস্তায় থাকা গাড়ি আস্তে আস্তে ছোট হতে হতে অন্য পাহাড়ের পেছনে হারিয়ে যায় আর ওপরের রাস্তা আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হতে থাকে।
আমি ছাপোষা মানুষ, দৌড় সেই এয়ারপোর্ট গড়িয়া রুট, রাস্তায় যত চলছি তত অবাক হচ্ছি, আর অবাক হবার হাজারটা কারণ, ভয়ঙ্কর সুন্দর বুঝি একেই বলে, অনায়াসে একটা সিনেমা বানিয়ে ফেলা যায়, পয়সা উসুল, আবার ভাবছি যারা এ রাস্তা বানিয়েছে, কি অসম্ভবকে সম্ভব করেছে! খোঁজ নিয়ে জানলাম এ রাস্তা মোটর চলাচলের জন্য তৈরি হয় ১৯৭৬ সালে, আর জনগনের জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৯৮৮ তে।
ওদিকে আমাদের মধ্যেকার ব্যানার্জিবাবু মাঝে মাঝে জানান দিচ্ছে, সকালে খবরের কাগজটা পড়া হচ্ছে না, রতনের দোকানের চা’টা মিস করছেন ট্যুরে আসা ইস্তক, মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি তাঁর বিরক্তিকর লাগে, বাড়ির সদর দরজায় তাড়াহুড়োয় তৃতীয় তালাটা লাগিয়ে আসতে ভুলে গেছেন, মনটা খচখচ করছে, মোবাইল কানেকশন পাওয়া যায় না, কতদিন মাছ খান না অথচ ট্যুর ম্যানেজার বলেছিল কাতলা মাছের পেটি খাওয়াবে।
পুলু পৌঁছনো অব্দি সহজ যাত্রাপথ, চোখ ভরে দেখছি প্রকৃতির এই অপার ঐশ্বর্য (আরে ঐশ্বর্য রাই নয়) মনি মানিক্য বিধাতার অকৃপণ দান। বলতে ভুলে গেছি এই রাস্তায় চলতে গেলে পারমিট লাগে, সেসব আমাদের ড্রাইভার আগেই করে রেখেছিলেন, পুলুতে সেসব দেখানোর পালা শেষ করে লাস্ট ল্যাপের জন্য তৈরি হলাম, মিশন খারদুংলা।
ড্রাইভার আগেই বলেছিল এই দশ কিলোমিটার রাস্তা খারাপ, তাতে তেমন গা করিনি কারণ বঙ্গদেশে খানাখন্দে ভরা এমন বহু রাস্তা আমরা পার হই, পার হয়েছি।
কিন্তু এ রাস্তা তো রাস্তাই নয়, বোল্ডার ফেলে বানানো আর ক্রমাগত তুষারপাত কি ধ্বসের কারণে যত্রতত্র ভাঙা, কাদা আর ধুলো ভর্তি। তবু সেনা ও বি আর ও যে এ রাস্তা চলাচলযোগ্য করে রেখেছে সেটাই পরম আশ্চর্যের। আর ড্রাইভার যাঁরা এ রাস্তায় গাড়ি চালান তাঁদের মিনিটে মিনিটে আমার ভগবান বলে মনে হতে লাগল, মারাদোনার পা যেমন কথা বলত, এক একটা ড্রিবল যেমন অতল গহ্বর থেকে হিরে তুলে আনত কি ঝিনুক থেকে মুক্তো, এ ড্রাইভারও যেন ঠিক তেমন। হাতে স্টিয়ারিং নিয়ে জীবন মৃত্যুর মাঝখানের সরু দড়ি দিয়ে অবলীলায় ট্রাপিজের খেলা দেখাচ্ছেন। না মানে বলছিলাম এত উদ্বিগ্ন হবার কিচ্ছু নেই, পাহাড়ি রাস্তা তো আর রেড রোডের মত হবে না, আর বোরলিনের বিজ্ঞাপনে তো কবেই বলা আছে জীবনের নানা ওঠাপড়া যেন গায়ে না লাগে। হ্যাঁ ওদিকে আমার স্ত্রী এই এক ঘণ্টায় একটা বোরলিনের কৌটোর প্রায় অর্ধেক ঠোঁটে মুখে মেখে শেষ করে ফেলেছেন, ঠোঁট ফাটা থেকে আগাম মুক্তির আশায়, আর মাঝে মাঝে জোর করে ছেলে আর আমায় সেই মহোৎসবে সামিল করছেন।
রাস্তা তো রাস্তা, এবার শুরু হয়েছে ঠাণ্ডা হাওয়া। পাঁচতলা মলের দোতলা ততক্ষণে গায়ে চাপিয়ে নিয়েছেন আমাদের বন্ধু দম্পতি। এতক্ষণ বরফের পাহারগুলো দূরে দূরে ছিল এখন আস্তে আস্তে কাছে চলে এসছে, যেন হাত বাড়ালেই ছোঁওয়া যায়, আমার বিল্পব মোটামুটি শেষ, হাতে দস্তানা মাথায় টুপি পরে নিয়েছি, গুরুজনদের কথামত মাঝে মাঝে জল খাচ্ছি শরীর যেন ডি-হাইড্রেটেড না হয়ে পড়ে। রাস্তার পাশে পাশে মাঝে মাঝে বরফ, দেখে মনে হল টাটকা , হয়ত কাল রাতে পড়েছে। ধীরে ধীরে পুরো রাস্তাটাই বরফে ঢেকে গেল, আজ বেশ রোদ। তাই বরফ গলছেও। শুনলাম এখানের খামখেয়ালি প্রকৃতির কথা, মানে ধর ঝলমলে রোদ, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই শুরু হল তুষারপাত, আধ ঘণ্টার মধ্যে রাস্তা বরফে ঢেকে গেল।
আস্তে আস্তে টুরিস্ট গাড়ির ভিড় বাড়ছে। এইভাবে কিছুক্ষণ, আচমকা একটা বাঁক ঘুরতেই দেখি খারদুংলা লেখা সেই মাইলফলক আর বহু গাড়ির মেলা বসেছে, লোকজন বরফে হাঁটছে, আনন্দে চিৎকার করছে ছবি তুলছে। সে এক স্বপ্ন ছোঁওয়ার আনন্দ।
আমাদের সেই টেম্পো ট্র্যাভেলার সেই গাড়ির ভিড়ে কোনমতে গ্যারেজ করে দিল, সঙ্গে সঙ্গে ছুট ছুট, দরজা খুলে আমরা নজন, যে যেদিকে পারলাম ছড়িয়ে পড়লাম।
খারদুংলায় বেশি ছোটাছুটি করলে অসুবিধে হয়, শরীর আনচান করে। তবে সেসব সাবধানবাণী তখন কার আর মাথায় থাকে! আর কি অদ্ভুত, এই বরফ রাজ্যে সবাই কেমন উদার হয়ে গেছে! জামিল মানে আমাদের ট্যুর ম্যানেজার তাড়া দিচ্ছে না, লিসা জামিলকে বগলদাবা করে সন্টামনা, মন্টাসোনা বলছে, বুনু যে শীতে একটু বেশি কাবু হয়ে পড়ে সে দিব্যি ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে, বিহু আর আদির বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়েছে, কীসব কমেন্ট্রি দিচ্ছে আর রেকর্ডিং করছে, আমার কিপটেমি কমে গেছে( হেলায় ড্রাইভার সাহেবকে চা সঙ্গে বিস্কুট খাইয়ে দিচ্ছি), আমার বেটার হাফ আমার আর পুত্রের সোয়েটার পরা নিয়ে তেমন আর ঘ্যানর ঘ্যানর করছে না, তনুশ্রী আর আমিতাভ বেশ হাসিতে গদগদ হয়ে সেলফি তুলছে আর অদ্ভুত একটা ভালোলাগা, খুশির ছোঁওয়া আশেপাশের পাহাড় জুড়ে। ওদিকে আমিও একাধারে খুশি আর সুখি, ভাবখানা এমন হে হে, দ্যাখ কেমন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে এসছি, বরফই বরফ, অন্যদিকে একটা স্বস্তি কাজ করতে লাগল এসব স্থানে ভ্রমণের পরে নিশ্চিত আগামী বছর দুই-তিন আমার বেটার হাফ বাৎসরিক ভ্রমণে ক্ষান্ত দেবেন।
কিন্তু খানিক পরেই বুঝলাম সে গুড়ে বালি, পরের বার কোথায় যাব? শ্রীলঙ্কা ভিয়েতনাম গেলেও হয় কিংবা গোয়া, কোঙ্কন উপকূল? শুরু হয়ে গেল সেই লং প্লেয়িং রেকর্ড বাজানো। রোদ মাঝে মাঝে মেঘের সঙ্গে খেলা করছে, যখন রোদ চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে, বরফে ঝিকমিক করছে সঙ্গে আশেপাশে লোকজনের মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, সত্যি তো এসব জায়গায় মানুষ তো একবারই আসে, তাতে খরচ আছে, অনেক হিসেব নিকেশ, ছুটি ম্যানেজ ইত্যাদি আছে, বাড়ির বয়স্কদের জন্য হয়তো বন্দোবস্ত করে আসতে হয়েছে, তাই এই আনন্দ, অসাধারণ মুহূর্তগুলো প্রিয়জনের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া, প্রকৃতির এই অকৃপণ ঐশ্বর্য চেটেপুটে নেওয়া এ তো খুব বেশি দাবি নয়।
সেখানেই একটা চায়ের গুমটি, গরম গরম চা সঙ্গে স্টোভের আগুনে খানিক উত্তাপ নিয়ে নেওয়া, বিস্কুট ম্যাগিও খেয়ে নিতে পার, আর বাইরের সেই হিমশীতল পরিবেশ থেকে এখানে ঢুকলে বেশ একটা আরামদায়ক অনুভূতি। সেখানেই দেখা এক বয়স্ক বাঙালি মহিলার সঙ্গে, বয়স তা প্রায় ৬৫ হবে অনায়াসে, বরফের ওপর হাঁটতে খানিক অসুবিধে হচ্ছে শাড়ি পরে, আমার ছেলে তার হাতখানি ধরে তাঁদের গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এল, আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনার তো খুব সাহস, উনি বললেন দ্যাখ বাবা ইচ্ছে থাকলে সবই হয়, তীর্থ করতে আগে দুর্গম স্থানে তো বৃদ্ধ বৃদ্ধারাই যেতেন আর তখন তো সেসব পথ ছিল আরও কঠিন। আমিও তাই ভাবলাম, মানুষ তো আগে এত চিন্তা ভাবনা বুকিং করে বেড়াতে বা তীর্থে যেতেন না, পথে পান্থশালা, গুরুদ্বারা, কি চটি মিলে যেত সেখানে কত মানুষ সবাই নতুন সবাই অচেনা কিন্তু লক্ষ্য তো সবার একই, এমন করেই পরিচিতি, বন্ধুত্ব হয়ে যেত পথচলতি মানুষের সঙ্গে। বিপদে আপদে দরকারে অদরকারে আনন্দে শোকে দুঃখে সেই দিনগুলো সবাই যেন এক পরিবারের মানুষ,লালন সাঁই এর সেই আক্ষেপ, ‘ বাড়ির কাছে আরশিনগর সেথা পড়শি বসত করে, আমি একদিন না দেখিলাম তারে’ হয়ত দূর হয় এই তীর্থযাত্রায়।
বলতে ভুলে গেছি এই যে লে থেকে খারদুংলা আসবার পথ, সেখানে ফিয়াং বলে এক গ্রাম আছে আর সেখানে আছে এই বৌদ্ধ গুম্ফা, লোকে বলে ফিয়াং মন্সট্রি। ভিন্ন মতে কেউ বলে ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে এ গুম্ফার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা তাশি নাংয়াল, ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের আশেপাশে। এ গুম্ফা পাকমাদ্রুপা দরজে গেল্পো ধারার অনুসারী(Phakmadrupa Dorje Gyelpo 1110-1170 CE) । এখানে একটা দারুণ মিউজিয়াম আছে, সেখানে বহু প্রাচীন প্রায় ৯০০ বছরের পুরনো, চিন, তিব্বত মঙ্গোলিয়ার নানা ব্রোঞ্জের মূর্তি, অস্ত্রশস্ত্র আছে।
এবার আবার যাত্রা, প্রায় ৩০ মিনিট খারদুংলায় কাটিয়ে গাড়িতে চড়লাম। সবচে বড় কথা সবাই সুস্থ, এই আধঘন্টায় সবাই অনন্দিত, মুগ্ধ। যতদূর চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ, তার মাঝে মাঝে আশেপাশে পাহাড়গুলোতে কালো ফিতের মত আঁকাবাঁকা রাস্তার চিহ্ন, এবার তনুশ্রী বসেছে সামনের আসনে, অবিশ্রান্ত ছবি তুলে যাচ্ছে তার মোবাইলে, সুতরাং আমাদের আর চিন্তা নেই, হোয়াটসএপে একটা লাদাখ গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে সেখানে এসব ছবি জমা হবে, আমার মোবাইল আদ্যিকালের আর আমি এসব ছবি তুলবার ঝঞ্ঝাটে থাকি না, কী তুলতে কী তুলে বসব সে আবার আরেক কেলেঙ্কারি। এ রাস্তায় যারা গাড়ি চালান মনে হয় প্রতি ইঞ্চি হাতের তালুর মত চেনেন, সাবধান তো হতেই হবে তবু মনে হয় এরা চোখ বেঁধে দিলেও এই রাস্তা উৎরে যাবেন।
(ক্রমশ)
শীর্ষচিত্রঃ নিকোলাস রোয়েরিখের আঁকা থেকে নেয়া।
লিখিয়ে ছবিছাবা কিস্যু দেননি। তাই কী আর করা। সম্পাদকের ক্যামেরায় তোলা ওই একই পথে আর এক ভ্রমণের ফটোগ্রাফ দিয়ে লেখাটাকে সাজিয়ে দেয়া গেল।
ভ্রমণ সব লেখা একত্রে