শ্রীলংকা – ভারত মহাসাগরের মুক্তো
বন্দনা দাশগুপ্ত
একদিন ফোনে হঠাৎ ছোটু জিজ্ঞেস করল, “চলো, শ্রীলঙ্কা যাবে? কলকাতা থেকে সিধে ফ্লাইট আছে শ্রীলঙ্কা এয়ারলাইনসের। সাতদিনে মোটামুটি ঘোরাঘুরি হয়ে যাবে।”
আমি তো একপায়ে খাড়া। তবে বাড়িতে অন্য লোকটি মহা ঘরকুনো। সে কাজ আছে, শিবরাত্রি আছে, এই সমস্ত বাহানা দিচ্ছিল। শেষে ২৮ ফেব্রুয়ারি যাওয়ার দিন আর ৪ মার্চ ফিরে আসব এরকম একটা সহমতে আসা গেল। অফিস থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি, ফ্লাইট, হোটেল, গাড়ি ও অন্যান্য প্রস্তুতিতে ছোটু ওস্তাদ। কোনও ঝকমারি ছাড়াই সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল জানুয়ারিতেই। টিম শ্রীলঙ্কার মেম্বর আমি, উপল, দিদি, জামাইবাবু আর ছোটু—চিরদীপ গুপ্ত, দিদির ছেলে। ক্যাপ্টেন ছোটু আর দুধুভাতু সহকারী আমি। ২০১০ সালে ILO-এর কাজে একবার কলম্বো গেছিলাম বলে এই পোস্ট দেওয়া হয়েছে আমাকে।
ফেব্রুয়ারিতে এদিকে কেরালায় দু’জন আর শ্রীলঙ্কায় একজন কোভিড-১৯ রোগী। তড়িঘড়ি সকলের মাস্ক আর স্যানিটাইজার কেনা হল। কোথাও হাত দিলেই স্যানিটাইজার ঘষতে হবে এরকম সাধু সংকল্প নিয়ে রওনা দিলাম দু্গ্গা দু্গ্গা বলে। যাওয়ার উড়ান ঘণ্টা খানেক দেরিতে ছাড়ল। কলম্বো পৌঁছেই আমরা সিধে চলে যাব ক্যান্ডি, গাড়ি বলা আছে। ক্যান্ডিতে আবার অপেক্ষা করে আছে আমার বন্ধু সজীবা, শ্রীলঙ্কার ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স অফিসের এক উচ্চ পদস্থ আধিকারিক।
কলম্বো পৌঁছে ইমিগ্রেশনের কাজকর্ম মিটিয়ে কিছু ডলার শ্রীলঙ্কা রুপিতে পালটে তড়িঘড়ি গাড়িতে চড়ে রওনা দিলাম। একটা ছয় সিটের আরামদায়ক মার্সেডিজ ভ্যান, এই গাড়ি আমাদের সঙ্গেই থাকবে এই ক’দিন। কলম্বো শহরে বেশ ঘন ট্রাফিক। মসৃণ সুন্দর রাস্তা, তবে গাড়ির গতি শ্লথ শহরের মধ্যে। তবে এটা উল্লেখযোগ্য যে ভারতের যেকোনও শহরের তুলনায় রাস্তা যথেষ্ট জনবিরল। ধীরে ধীরে শহরের পথ ছাড়িয়ে গাড়ি চলেছে ক্যান্ডির দিকে, যদিও দূরত্ব ১২৩ কিমি, পাহাড়ি পথে সময় লাগবে বেশি।
খানিক পরেই সন্ধ্যা নামল। মনটা চা চা করতে লাগল, পেটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে। অগত্যা একটি মিড ওয়ে রেস্তোরাঁতে থামা হল। চা-বিস্কুট ইত্যাদি খেয়ে আবার চলা শুরু। প্রায় ন’টা নাগাদ দেখি চারদিকে রাস্তা ঘেরা একটা বিরাট লেক। ড্রাইভার জানালেন, ক্যান্ডি লেক। একে কিরি মুহুদা বা দুধসাগরও বলা হয়। ক্যান্ডি শৈলশহরের মাঝখানে ১৮০৭ সালে রাজা বিক্রম রাজসিঙ্গে বুদ্ধের ‘Temple of the Tooth’-এর পাশে কৃত্রিমভাবে খনন করে তৈরি করেন। ধীরে ধীরে জনবসতির চাপে এটি আগের চেয়ে ছোটো হয়ে গেছে। এখন এটা সংরক্ষিত লেক, চারদিকে প্রচুর গাছ এবং মাছ ধরা নিষিদ্ধ।
যাই হোক, শেষ অবধি হোটেলে পৌঁছলাম। বৃটিশ আমলে তৈরি বিরাট হোটেল, কাঠের মেঝে, অন্দরসাজও মাপসই। ব্যালকনি থেকে লেক দেখা যাচ্ছে। অল্প ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। হাত-পা ধুতে ধুতে সজীবা এসে হাজির। ডিনার ওদের সঙ্গে। দিদি-ধ্রুবদা হোটেলে রইল, আমরা চললাম নেমন্তন্ন খেতে। ওদের গেস্ট হাউস ক্যান্ডি শহরের শেষ প্রান্তে, একটি ছোটো পাহাড়ি নদী পার হয়ে। সজীবার সঙ্গে রওনা দিয়ে দেখি চড়াই-উতরাইময় চমৎকার পথ। দু’পাশে সবুজ গাছের সমারোহ। মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে এখানকার প্রধান নদী। অবগুণ্ঠনবতী সুন্দরী ক্যান্ডি যেন আভাসে তার অসামান্য রূপের ইশারামাত্র দিয়ে গেলেন। ওই আর কী, ‘রূপসুধা ওষ্ঠে ছোঁয়ালুম কিন্তু পান করতে পারলেম না।’ তবে সে আক্ষেপ সুদে আসলে মিটে গেছিল পরে। একেবারে সিংহলি ধরনের খাওয়া পেটপুরে খেয়ে সেদিনের মতো দিন শেষ।
ক্যান্ডি লেক – দিনে ও রাতে
পরদিন সকাল সকাল উঠে প্রথমেই দৌড়লাম ব্যালকনিতে। দিনের আলোয় ক্যান্ডি লেক কেমন লাগে তার তদন্ত করতে। দূরে বুদ্ধের Tooth Relics Temple-ও দেখা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে ক্যান্ডি শহর আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠছে। গভীর আরামের ঘুম আর হালকা ঠাণ্ডা হাওয়ার পরশে গতকালের পথশ্রম একেবারেই উধাও। আজ সারাদিনে ক্যান্ডি ও তার আশেপাশের অনেক দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার কথা। পেট ভর্তি করে হোটেলের দেওয়া বিনামূল্যের বহুবিধ সুস্বাদু পদে প্রাতরাশ সেরে তড়িঘড়ি রেডি হয়ে রওনা দিলাম সিগরিয়ার (Sigiriya/ Sinhagiri) উদ্দেশে। পথে পড়বে ডাম্বুল রাজকীয় গুহামন্দির (Dambulla Royal Cave Temple and Golden Temple) ও বিশাল বুদ্ধমূর্তি। তারপর যাব কাছের মিনিরিয়া সংরক্ষিত জঙ্গলে হস্তীদর্শনে (অন্ধ না হলেও তাতে বাধা কিছু নেই)।
ক্যান্ডি থেকে সিগরিয়া প্রায় ১০০ কিমির দূরত্বে। শহর থেকে বেরোতেই পড়লাম প্রবল ট্রাফিক জ্যামের খপ্পরে। যাই হোক, শহর ছাড়িয়েই পেলাম শৈলশ্রেণীর ধাপে ধাপে চা-গাছের বাহার, সকালের আলোয় নির্মল সুন্দর। ন্যাশনাল হাইওয়েতে পৌঁছে গাড়ির গতি কিছু বাড়তেই একটু নিশ্চিন্ত হলাম। সিগরিয়া ট্রেকিংয়ে ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে। আবার মিনিরিয়াতে বিকেলের সাফারিতে যোগ দিতে হলে চারটের মধ্যে পৌঁছতে হবে। দেখতে দেখতে Dambulla Royal Cave Temple আর Golden Temple পৌঁছে গেলাম। কিন্ত গুহামন্দিরে ঢোকার আর সময় হবে না, সৌজন্যে ট্রাফিক জ্যাম । বিশাল বুদ্ধমূর্তি বাইরে থেকেই দর্শন হল আর সঙ্গে কমলা রঙের কিং কোকোনাটের সুমিষ্ট জল খাওয়া হল। এবার ছুট ছুট সিগরিয়ার দিকে।
সিগরিয়া
সিগরিয়া হল একটি প্রাচীন দুর্গের অবশেষ যা ৫ম শতাব্দীতে তৈরি করেছিলেন রাজা কাশ্যপ। একটি সমতল পাহাড় খণ্ডের উপর অবস্থিত এই দুর্গ। একটি সিংহদরজা, সাপের ফণার মতো খাড়া দেওয়াল আর দেওয়ালে অপূর্ব ফ্রেস্কো, আমাদের অজন্তার গুহাচিত্রের সঙ্গে তার অনেক মিল। পুরো ব্যাপারটাই মাটি থেকে প্রায় চার বা পাঁচশো মিটার ওপরে। ছবি দেখলে খানিকটা আন্দাজ করা যাবে। প্রাসাদ ও দুর্গ মিলে সমস্ত জায়গাটা। তাতে সভাঘর যেমন আছে, তেমনই আছে অন্দরমহল। প্রাকৃতিক বাতানুকূল ঘরে পৌঁছে আমি তো অবাক। দুর্গের সুরক্ষার জন্য তিনদিকে যথাক্রমে সিংহ, কুমির আর সাপসঙ্কুল তিনটি গেট। জীবন্ত আর প্রস্তরময় দু’রকমই ছিল, বর্তমানে কেবল প্রস্তরময় মূর্তিগুলোই দেখতে পাই। এমনকি পাথর কেটে জল ধরে রাখার ব্যবস্থাও ছিল। একটি সিংহের পা অবিকৃত আছে, তাতে চামড়ার আর নখের পাথরের পালিশ আলাদা।
অত যুগ আগে কীভাবে ওই বিপুল পাথর অত ওপরে তোলা হয়েছিল সেটা কল্পনাতীত। অর্ধেক ওঠার পরই মনে হল আমি পাখি হয়ে গেছি বা এরোপ্লেনের জানালা দিয়ে দেখছি অনেক নিচে কুট্টি কুট্টি মানুষ, চাষের জমি। তবে পুরোটা ট্রেক করতে শারীরিক সক্ষমতার কথা ভুললে চলবে না। হাঁপাতে হাঁপাতে সজীবার দেওয়া আদাজল (ginger water, শ্রীলঙ্কার জনপ্রিয় ড্রিঙ্ক) আর চিনাবাদাম খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম অপর প্রান্তে। গাড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সম্পূর্ণ ওঠানামায় সময় লেগেছে প্রায় তিন ঘণ্টা।
এরপরে দুপুরের খাওয়া। প্রচুর বিদেশি টুরিস্ট এই এলাকায়, তাই অনেক ভালো ভালো খাওয়ার জয়েন্টও আছে। তারই একটায় বুফে লাঞ্চ খেয়ে গাড়ি চড়ে বসলাম। এবারে গন্তব্য মিনিরিয়া সংরক্ষিত জঙ্গল।
মিনিরিয়া
গাড়ি করে গেলাম ‘প্রাইভেট জিপ সাফারি’ ট্যুর অপারেটরের কাছে। কস্টলি ব্যাপার, কিন্তু বেশ লজঝড়ে হুড খোলা জিপ। ড্রাইভার নাকি খুব দক্ষ। এদিকে জিপে ইংরেজিতে লেখা, ‘জুতো পরে সিটে দাঁড়াবেন না।’ কী জ্বালা, সিটে দাঁড়াব কেন? সিট তো বসার জন্যই। তখন কি আর জানি কী অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য!
জিপ তো একটা সরু পথে জঙ্গলে ঢুকল। কুল, বাবলা চিনতে পারলাম আর বাদবাকি সব অচেনা গাছ। তবে মহাদ্রুম আকারের কোনও গাছ নেই, সবই মাঝারি। শুনলাম যে জঙ্গলে প্রচুর হাতি, কিছু হরিণ, বাঁদর, ময়ূর, সামান্য ক’টি চিতা আর অসংখ্য পাখি আছে। শক্ত পাথুরে মাটির রাস্তা জঙ্গল ভেদ করে চলে গেছে। মাঝে মাঝে পাথর খণ্ডের ছোটো ছোটো টিলা, কিছু আবার বেশ বড়ো। এদিকে জিপ জঙ্গল চিরে এগোচ্ছে, প্রতিটি গাছের পাশেই সম্ভাব্য এবং কল্পিত হাতি বা হরিণের অংশ খুঁজে পাচ্ছি। ড্রাইভার নির্বিকার। হঠাৎ গাড়ি থামিয়েছে। বলছে, “right right, see!” বোঝা গেল ডানদিকে দেখতে বলছে। ওমা, দেখি দুটো হাতি খেলা করছে আর যা পাচ্ছে মুখে ঢুকাচ্ছে। কাছেপিঠে আরও কয়েকটি জিপ, আর পটাপট শাটারের আওয়াজ। আমিও আমার আইফোন বাগিয়ে জুম করে হস্তীলীলার ছবি তুলছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমি জুতো পরে সিটের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। লজ্জা পেয়ে দুচ্ছাই করে জুতো খুলে ফেললাম। মনে মনে ভাবছি ‘পয়সা উসুল’। নৈর্ব্যক্তিক কণ্ঠের নির্দেশ এল, “Go, go!” বুঝলাম গাড়ি আবার এগোবে।
হাতি টিম
এরপর দেখলাম গণ্ডা খানেক হাতি নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় রত। কেউ কেউ আবার বৃংহণ করছে, আর মুখ চলছে অবিরাম। আরও ক’টা এসে আড্ডায় যোগ দিল। আমাদের আহ্লাদ দেখে কে! পুরো সময়ই জিপ দাঁড়িয়েছে যথেষ্ট নিরাপদ দূরত্বে। তবে এতক্ষণে পুরো টিমই সিটে দাঁড়ানো। ধীরে ধীরে পুরো দলটাই দৃষ্টিসীমার বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমরা এবার অন্যদিকে চললাম। একট বড়ো সমতল ক্ষেত্রের সামনের রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করাল। একটা মা আর একটা ছানা হাতি খুনসুটি করছে। দেখতে দেখতে অসংখ্য (একটুও বাড়িয়ে বলছি না) হাতি রাস্তার দু’পাশে। অবস্থাটা এই যে চারপাশে হাতি আর মধ্যখানে কয়েকটা টুরিস্ট জিপ। তারা আমাদের অর্থাৎ গজেতর প্রাণীদের বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে নিজেদের রাস্তায় চলে গেল। দুয়েকটা অর্বাচীন ছানা নিয়মের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা যে করেনি তা নয়, তবে দলপতি বা মায়ের শুঁড়ের বাড়ি খেয়ে ‘মামেকং শরণং ব্রজ’ রুটের পথ ধরেছে। আমাদের জন্য ছেড়ে গেল একরাশ মুগ্ধতা।
বিকেল শেষ হয়ে আসছে, জিপ ফেরার পথ ধরেছে। এবার দেখলাম একটি দাঁতাল ও তার সঙ্গিনী ও একটা ময়ূর। জঙ্গল যেখানে হালকা হয়ে এসেছে সেখানে এক টিলার কাছে জিপ থেকে নামবার অনুমতি ছিল। ছোটু তো তড়বড়িয়ে উঠে গেল। আমি আর বুড়ো হাড়ে সাহস করিনি। দেখলাম এক জায়গায় বৃষ্টির জল জমেছে আর সেখানে নতুন জীবনের পদধ্বনি। প্রাচীনকে পায়ে ঠেলে নবীন সামনে এগোবেই।
মিনিরিয়া জঙ্গল
জিপ থেকে নেমে গাড়িতে বসলাম। ক্যান্ডি ফিরতে হবে। এদিকে উপলের জুতোর শুকতলা খুলে গেছে। দুই অর্থেই। মাঝরাস্তায় চা-বিস্কুট খেয়ে বাটার দোকানে ঢুকলাম। ট্যুরে চাই নতুন জুতো। এদিকে চা খেয়ে স্মোকিং জোন খুঁজতে খুঁজতে উপল কোথায় হারিয়ে গেল। সঙ্গে ফোন নেই, শুধু আমার আর ছোটুর ফোনে ইন্টারন্যাশনাল কানেক্টিভিটি আছে। গাড়ির নম্বর যে মুখস্থ নেই এ ব্যাপারে আমরা বাকিরা নিঃসন্দেহ। খানিকক্ষণ বাদে উপলবাবু একগাল হাসি নিয়ে ‘বাটা শুজ শপ’ জিজ্ঞাসা করতে করতে উপস্থিত।
যাই হোক, ক্যান্ডি পৌঁছতে পৌঁছতে রাতের খাওয়ার সময় হয়ে গেল, তাই ডিনার খেয়ে ঘুমের দেশে পৌঁছতে কালবিলম্ব করলাম না।
বুদ্ধের টুথ রেলিকস মন্দির
আজ পয়লা মার্চ। ক্যান্ডি থেকে যাব নুয়ারা এলিয়া। গোছগাছ করে গতকালের মতো খুব ভালো করে ব্রেকফাস্ট করে পোঁটলাপুটলি নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। প্রথমে যাব বুদ্ধের টুথ রেলিকস মন্দিরে। এটি শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ মন্দির, সিংহলি ভাষায় নাম শ্রী দালাডা মালিগাওয়া। ষোড়শো শতাব্দীতে ক্যান্ডি লেকের পারে এই মন্দিরটি বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি করেছিলেন তৎকালীন ক্যান্ডির রাজা। তবে পরবর্তীকালে অনেক সংযোজন হয়েছে বোঝা যায়। বিদেশিদের দর্শনী দিয়ে ঢুকতে হয় এবং সাদা জামা (পা এবং কাঁধ ঢাকা) পরে যাওয়া বাধ্যতামূলক। মূল চত্বর পার হয়ে মন্দিরে ঢুকতে হয়, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে মূল মন্দির। খুব অল্প সময়ের জন্য মূল মন্দির খোলে এবং যখন খোলে তখন প্রচুর ভিড়। যাই হোক, অনেকেই আমাদের মতো বন্ধ দরজায় মাথা ঠেকিয়ে, পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেও বেরিয়ে যাচ্ছে। বাইরে একটি বোধিবৃক্ষ আছে, শ্রদ্ধালুরা তাকেও প্রদক্ষিণ করছেন। জানা গেল, বুদ্ধের শ্রীদন্ত পরপর অনেকগুলো সোনার বাক্সের মধ্যে রাখা থাকে, সবাই সেই বাক্সই দর্শন করেন। Esala Perahera-র সময় একটি হাতির মাথায় ঐ স্বর্ণপেটিকা বসিয়ে শোভাযাত্রা হয়।
মন্দির থেকে বেরিয়ে যাব Royal Botanical Gardens। কোথাও এসে সেখানকার ফ্লোরা ও ফনা দেখাই আমাদের আসল উদ্দেশ্য থাকে, এখানেও তার ব্যতিক্রম করতে চাই না। এই Botanical Garden মহাবলী নদীর ধারে Peradeniya জনপদে প্রায় ১৪৭ একর এলাকা জুড়ে অবস্থিত, সমুদ্রপৃষ্ঠের থেকে ৪৬০ মিটার ওপরে। শুনলাম প্রায় ৪০০০ রকমের উদ্ভিদ আছে।
আমরা ব্যাটারিচালিত গাড়ি নিলাম এবং গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নিয়ে যেতে অনুরোধ করলাম। সবচেয়ে ভালো লাগল অর্কিডের সংগ্রহ, গোলাপ বাগান আর তালশ্রেণীর সমারোহ। নানারকমের নারকেলগাছ দেখেও মহা আমোদ পেয়েছি। যে যার মতো ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমি ফুলগাছের আলোছায়ার মাঝে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। মাঝে মাঝে বিশাল বিশাল সবুজে মোড়া মাঠ, বসবার চেয়ার আর জলের কলের ব্যবস্থা রয়েছে।
মহাবলী নদীর উপর একটা সরু (একজন যাওয়ার মতো) দড়ির ব্রিজ আছে, সেটা বেয়ে পা টিপে টিপে মাঝনদী অবধি যাওয়ার পর হাওয়ায় এমন দুলতে লাগল যে ভয় পেয়ে তড়বড় করে ফেরত চলে এলাম। নদীর পারে পিকনিক স্পট আছে, তবে রান্না করার অনুমতি নেই। ঘর্মাক্ত কলেবরে ফিরে আবার গাড়ি চেপে বসলাম। এবার নুয়ারা এলিয়ার পথে।
নুয়ারা এলিয়াকে বলা হয় Little England। সেজন্য উৎসাহ অসীম। খানিকক্ষণ সোজা রাস্তার পর শুরু হল প্যাঁচানো রাস্তা। যাকে বলে হেয়ার পিন বেন্ড। এত হেলে যাচ্ছি যে সিট বেল্ট বেঁধে বসলাম সবাই। বাইরে আকাশ আরও সুনীল আর দিগন্তবিস্তৃত চা-বাগান। ‘শ্যামলে শ্যামল তুমি নীলিমায় নীল’ যেন বাস্তবে প্রাণ পেয়েছে। তাপমাত্রা ক্রমশ কমছে। দূরে ছোটো ছোটো জনপদ চোখে পড়ছে, আবার কখনও রাস্তার পাশে ঘরদুয়ার, দোকানপাট। হঠাৎ দেখি একটি ছোটো জলপ্রপাত, তিরতির করে জল নামছে সুউচ্চ পাহাড়চূড়া থেকে। ড্রাইভার দাদা নাম বললেন ‘পুনা’। বর্ষাকালে জলের পরিমাণ বাড়ে। তখন অনেক টুরিস্টের কোলাহল থাকে। উপল ঠোঁট উলটে বলল, এর চারগুণ বড়ো ও সুন্দর জলপ্রপাত শিলং-শিলচর রাস্তায় অনাদৃত পড়ে আছে। ইস্ট খাসি পাহাড় কত সুন্দর! এর উপর নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা হয়ে গেল।
প্রায় তিনটে বাজতে চলেছে, খিদেতে পেট চুঁই চুঁই করছে। এদিকে ড্রাইভার দাদা কোন একটা হোটেলে বুফে লাঞ্চ বুক করে রেখেছে। বিরক্ত হচ্ছি মনে মনে, তোকে এত ওস্তাদি করতে কে বলল! কিন্তু যখন হোটেলটিতে পৌঁছলাম তখন দিলখুশ হয়ে গেল। খুব সুন্দর চারদিক খোলা রেস্তোরাঁ, আদিগন্ত চা-গাছে মোড়া। ঢোকবার পথে চা-শ্রমিকের কাট আউট, মুখ গলিয়ে নিলে তুমিও তাই। দিদি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে খিচিক ছবি তুলে ফেলল। দূরে আকাশ মেঘের চাদর গায়ে দিয়ে রেখেছে। তার সঙ্গে অতি সুস্বাদু বহুরকম খাবার ও পানীয়। লোভে পড়ে একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেল।
নুয়ারা এলিয়ার পথে
আমাদের হোটেল আর তিরিশ কিমি দূরে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছেই গেলাম। সেখানেও চমক। গলায় অর্কিডের মালা পরিয়ে অতিথি বরণ করল হোটেল সুন্দরীরা। দারুণ এক কাপ চা হল ‘welcome drink’। দারুণ সুন্দর কাঠের হাতি দিয়ে অন্দরসজ্জা। ঘরে দেওয়া চায়ের কোয়ালিটিও খুব ভালো, সঙ্গে ভালো ভালো কুকিজ।
বিকেলে আবার বেরোলাম শহরের চারদিকে হেঁটে হেঁটে ঘুরতে। নুয়ারা এলিয়া প্রধানত শীতপ্রধান, ছোটো ছোটো ইংলিশ বাংলো-ঘেরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটি ছোট্ট শৈলশহর। বৃটিশ সময়ে অবকাশ শহর হিসেবেই ওইসব বাংলো ব্যবহৃত হত। বাড়িতে বাড়িতে অনেক অনেক ফুল বাগান, Creeper Rose লতিয়ে রয়েছে ব্যালকনিতে। নিঝুম শান্ত শহর। নিশ্চিন্ত, জনকোলাহল রহিত চোখের আরাম।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামল। আমরা মনোহারি দোকান থেকে কিছু উপহার সামগ্রী কিনলাম। ছোটুর পছন্দ কারুকাজ করা মস্ত জোড়া হাতি। শেষ অবধি বিশাল এক্সাইস ডিউটির কাল্পনিক ভয়ে নিজেই নিরস্ত হল। আজকে পিৎজা হাটের পিৎজা দিয়ে ডিনার করে নিদ্রাদেবীর অঙ্কগত হলাম।
পুনা জলপ্রপাত নুয়ারা এলিয়ার পথে
আজ ঘুম ভাঙল নুয়ারা এলিয়ার হালকা শীতের আমেজে। টিম শ্রীলঙ্কার অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী সক্কাল সক্কাল রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়িতে চেপে বসলাম। প্রথমে যাব সীতা মন্দিরে। বলা হল যে লঙ্কার বন্দীদশায় সীতা এখানে এসে প্রার্থনা করতেন। দক্ষিণ ভারতীয় হিন্দু মন্দিরের ঘরানায় তৈরি ছোটো গোপুরম সহ তিনটি ছোটো ছোটো মন্দির, দুটি রামসীতার আর একটি হনুমান মন্দির (তবে জ্যান্ত হনুমানের সংখ্যাও কম ছিল না)। পাশে একটি ছোট্ট ঝরনার কলতান। তবে মন্দির খুব প্রাচীন বলে মনে হল না।
সীতা মন্দির ও পেড্রো টি গার্ডেন
দ্বিতীয় গন্তব্য পেড্রো টি গার্ডেন। প্রাইভেট টি গার্ডেন, প্রচুর জায়গা নিয়ে বিস্তৃত বাগান। বিস্তৃত বললে কম বলা হয়। যতদূর দেখা যাচ্ছে চা-বাগিচায় সবুজে সবুজ। আর দূষণহীন সুনীল আকাশ। বাগিচার মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা পাহাড়ি পথ। চলতে চলতে মনে হবে এ এক অন্য পৃথিবী। খুব যত্নের বাগান। পায়ে পায়ে অনেকটা নিচে পৌঁছে গেছিলাম, এবার হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোরকমে উঠে এলাম। ঢুকে পড়লাম এস্টেটের চমৎকার ছোটো কাফেতে। দু’পাশে কাচের দেওয়াল আর দু’পাশে ব্যালকনি। চা পাওয়া যায় আর সঙ্গে টা। আমরা অবশ্য শুধু কমলালেবুর গন্ধ ভাসানো চা খেলাম। এস্টেটে প্রক্রিয়াকরণ (processing and gradation) ইউনিটও আছে, সঙ্গে বিক্রয়কেন্দ্র। ছোটু আর উপল গেল সেই ইউনিটের গাইডেড ট্যুরে, ততক্ষণ আমরা কাফেতে বসে চারদিকের শ্যামলিমায় ডুবে ছিলাম।
ফিরে আসার পর জানলাম, উপল আসামে মামাবাড়ি হওয়ার সুবাদে গাইডের কাজটি নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে ছিল। ট্যুর শেষে সকলের থেকে একটা বড়ো হাততালিও পেয়েছে।
গ্রেগরি লেকের অপূর্ব বাহার
এরপরে গেলাম গ্রেগরি লেক সন্দর্শনে। শহরের ঠিক মধ্যিখানে প্রায় ২২৫ একর জুড়ে এই লেক। আসলে এটি একটি বিশাল জলাধার বা রিসার্ভার। তৈরি হয়েছিল ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ গভর্নর স্যর উইলিয়াম গ্রেগরির সময়ে। সেসময় পাহাড়ের পাদদেশে একটি জলাভূমি মাত্র ছিল। তালাগালা স্রোতের দিক পরিবর্তন করে ড্যামের আধারে এটিকে তৈরি করা হয়েছিল প্রধানত নগরায়নের জন্য জমির ব্যবস্থা করতে এবং শহরের জলের চাহিদা পূর্ণ করতে। ১৯১৩ সালে এই জলাধারের জলকে টানেলের মধ্যে দিয়ে Blackpool নামক জায়গায় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। আজও নুয়ারা এলিয়ার বিদ্যুৎ যোগানদার এই গ্রেগরি লেক।
এ তো হল ইতিহাস-ভূগোলের খবর। যেটা আমাদের আমোদের বিষয় তা হল এই লেকের চারদিকের অপূর্ব ফুলের বাহার, নেচার পার্ক ও নানা ওয়াটার স্পোর্টস। আমি আর ছোটু করলাম জেট স্কিইং, দিদি আর ধ্রুবদা পছন্দ করল স্পিড বোটিং এবং উপল দু’রকমের স্পোর্টসেরই মজা লুটল। লেকের একধারে দেখি অনেক পদ্ম ফুটে রয়েছে। কাছে গিয়ে দেখি শালুক। বহুক্ষণ কাটিয়ে পারে উঠতে হল। জল আমার সাংঘাতিক প্রিয়। সমুদ্রে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে পারি, কিন্তু এখানে কড়কড়ে কড়ির ঘায়ে এখানেই থামতে হল। পেটে ছুঁচোর ডনবৈঠকেও কাবু হয়ে রেস্তোরাঁতে পৌঁছলাম। ছবি দেখে অর্ডার দিয়ে বসে আছি। খাবার এলে দেখি প্রায় ডবল খাবার সাজিয়ে দিয়েছে। প্যাক করে নিয়ে নিলাম, এতেই ডিনার হয়ে যাবে।
হাকগালা গার্ডেন
খেয়েদেয়ে যাওয়া কথা হাকগালা গার্ডেনে। এটি শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে সুন্দর বাগিচা। সিনকোনা চাষের জন্য আদতে তৈরি হলেও পরবর্তীকালে বোটানিকাল গার্ডেনে পরিবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু হা হতোস্মি, হোটেল বালিকারা জানাল যে দেখভালের জন্য এটির অধিকাংশই বন্ধ। কিন্তু ‘প্রৌঢজলতরঙ্গ রুধিবে কে’- উপল ছোটুকে বগলদাবা করে সেখানেই যাবে! গিয়ে অবশ্য কিছু সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে আনল আর নতুন একটা প্ল্যান নিয়ে ফেরত এল।
যেহেতু আমাদের হাতে কিছু সময় বেঁচে গেছে আমরা মিরিসা চলে যেতে পারি। সেখানের সমুদ্রে নীল তিমি আছে এবং ভোর ছ’টায় ‘whale cruise’ হয়। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। তীরবেগে পোঁটলা বাঁধা হয়ে গেল। নুয়ারা এলিয়াকে টাটা বাই বাই করে গাড়ি চেপে বসলাম। মেরিসাতেও হোটেল বুক করা হল আর ডিনার তো সঙ্গেই আছে। ড্রাইভারদাদার পরিচিত whale cruise-ও ফোনে বুক করা হল। রাস্তায় ‘এলা’ শহর পড়বে আর পড়বে ‘রাবণ জলপ্রপাত’।
‘এলা’ শহর নুয়ারা এলিয়া শহর থেকে প্রায় ৬০ কিমি দূরে, পাহাড়ি এলাকা বলে সময় লাগবে বেশি। ইয়ার্কি করতে করতে হঠাৎ বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিত নিয়ে আমার আর উপলের ধু্ন্ধুমার ঝগড়া লেগে গেল। দিদির তাতে মাথা ঘুরতে লাগল, বমি পেয়ে গেল। ভয় পেয়ে আমাদের ঝগড়াও থেমে গেল। যাই হোক, গাড়ি থামিয়ে দিদিকে জল-টল খাইয়ে ঠাণ্ডা করে আবার গাড়ি চলল ‘এলা’র দিকে। ‘এলা’তে আবার চা-টা খাওয়ার জন্য গাড়ি দাঁড় করাতে গেলে ড্রাইভারদাদা আবার পুলিশের চালান খেল। দিদির অসুস্থতা দেখে বিনা ঘুষে আবার পুলিশদাদা ছেড়েও দিল।
এরপরে ২ কিমি দূরের স্টপ ‘রাবণ জলপ্রপাত’। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, ফলে খুব অন্যরকমের দর্শন হল। কিন্তু রাবণ গুহায় যাওয়া অসম্ভব। রাবণ জলপ্রপাত বর্ষাকালে দারুণ ফুলেফেঁপে ওঠে । তখন সে যেমন ভয়াল, তেমনই অপরূপ। মার্চের এই প্রথম সপ্তাহে আমরা তার ভগ্নাংশই দেখতে পেলাম, তাও আলো-আঁধারির জাফরি ঢাকা। এইসময় জলপ্রপাতে বহু লোক ট্রেকিং করে। আমাদের হাতে আর সময় নেই তাই ট্রেকিং এর বাসনা অপূর্ণই রাখতে হল।
এবার গাড়ির চাকা গড়াল মিরিসার দিকে, প্রায় ১৮৫ কিমি পথ। বাকি পথ নিরুপদ্রবেই পার হওয়া গেল। শুধু একবার দলছুট একটি বুনো হাতি আমাদের সঙ্গে আলাপ করবে বলে রাস্তার পাশে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল; আমাদের গাড়ির হেড লাইট চোখে পড়ায় শুঁড়টি তুলে সম্মান জানাল। আমরা গাড়ি থামিয়ে তার দুয়েকটি ছবি তুলে ‘আবার দেখা হবে’ বলে স্থানত্যাগ করলাম।
মিরিসা এলাকায় পৌঁছে গেছি বুঝতে পারলাম লবণাক্ত হাওয়া আর সামুদ্রিক মাছের গন্ধে। হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত সাড়ে এগারোটা। একেবারে বিচের উপর হোটেল। কোনোক্রমে রুমে ঢুকে স্নান করে, প্যাক করে আনা খাবার খেয়ে ঘুমের অতলে। কাল আবার ভোর পাঁচটায় উঠে রেডি হতে হবে।
মিরিসাতে ভোর
কাল তো ঘোর রাতে এসে ঢুকেছি মিরিসাতে। হোটেলটা সাধারণ, কিন্তু একেবারে সমুদ্রের ওপর। যদিও শান্ত সমুদ্র, মৃদুমন্দ ঢেউ, কিন্তু বিচের এত কাছে (খুব বেশি হলে ১৫০ মিটার) যে অবাক হয়ে গেলাম। মিরিসা শ্রীলঙ্কার সর্ব-দক্ষিণে মাতরা ডিস্ট্রিক্টের একটি ছোট্ট সমুদ্র শহর, কলম্বো থেকে প্রায় ১৫০ কিমি দক্ষিণে। এটি সম্প্রতি টুরিস্ট স্পট হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে প্রধানত ডলফিন ও তিমি দর্শনের কল্যাণে। অন্যথায় এটি শ্রীলঙ্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যশিকার ও মৎস্য রপ্তানি বন্দর। ১৯৮০ সালে প্রথম টুরিস্ট কেন্দ্র গড়ে ওঠে, ধীরে ধীরে ২০০০ সাল নাগাদ অনেক টুরিস্ট আসতে শুরু করে। তবে ২০০৪-এর সুনামিতে এখানে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ঝেড়ে এখন আবার একটি চমৎকার ছোট্ট সুন্দর ছিমছাম সমুদ্র শহর হিসেবে মাথা তুলেছে। এখানে লোকালের তুলনায় বিদেশি টুরিস্ট বেশি। তার অধিকাংশই সাদা চামড়া। ছোটোবড়ো নানা হোটেল ও হোম-স্টে। খবর নিয়ে জানলাম, নভেম্বর থেকে এপ্রিল, এটাই টুরিস্ট সিজন, বাকি সময় তীব্র গরমে মাছই জীবিকার প্রধান সাধন।
যাই হোক, আমরা তো খুব ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে তড়বড় করে রেডি হয়ে গাড়ি চেপে গেলাম “Whale and Dolphin Watching” পোর্টে। পৌঁছে তো হাঁ হয়ে গেছি। রাশি রাশি বিভিন্ন আকার ও আকৃতির ছোটোবড়ো একতলা দোতলা আধুনিক সজ্জিত দ্রুতগতিসম্পন্ন মোটরবোট বোঝাই। আমাদের ট্রিপ আগে থেকেই বুক করা ছিল। সেটি আবার দুই ইঞ্জিন সহ অতি সুসজ্জিত দোতলা বজরা। প্রথমেই বাইরের জুতো ছাড়তে হবে আর লাইফ জ্যাকেট পরতে হবে। বজরাটিতে সুন্দর কার্পেট পাতা, সেটাকে জল দাঁড়ায় না অথচ হাঁটতে সুবিধে হয়। দোতলা এবং একতলায় আরামদায়ক চেয়ার আর চারদিকে ঘোরানো বারান্দার মতো খালি জায়গা।
কাঁটায় কাঁটায় সাতটার সময় বজরা ছাড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে প্রাতরাশ দিয়ে দিল। বেশ তিন-চারজন তাগড়া যুবক গাইড। শুরুতেই ক্যাপ্টেন সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, সর্বনিম্ন দুই এবং সর্বোচ্চ ছয় ঘণ্টা তাঁরা সমুদ্রযাত্রা করবেন। যথেষ্ট সংখ্যার তিমি বা ডলফিনের দেখা পাওয়ার ওপর যাত্রার পুরো সময় নির্ধারণ হবে, অর্থাৎ ছয় ঘণ্টা সময়ের আগেই সেক্ষেত্রে ফিরে যাওয়া হবে।
খুব দ্রুতগতির কারণে আমাদের মোটরবোটটি তিরবেগে আরও দক্ষিণদিকে চলতে লাগল। তবে দূরে তটদেশও সমান্তরালভাবে চলতে লাগল। অন্যান্য সব মোটরবোট দৃষ্টির অগোচরে চলে গেছে। এখন চারদিকে ‘জল শুধু জল’। কিন্তু দেখে চিত্ত বিকল তো দুরস্থান বরং ভয়ংকর উত্তেজিত, কখন তারা কেউ দৃশ্যগোচর হন! বয়স মনে হল কমে গেছে অনেক। ঘোরানো বারান্দার উপর চড়ে বসে আছি আমি আর ছোটু, আর একজন গাইড ভাইকে (সে আবার বলিউডি সিনেমার ভক্ত আর হিন্দি বলতে পারে) নানান অবান্তর প্রশ্ন করে পাগলা করে দিচ্ছি। হিন্দি অভ্যাস করার আশায় সে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর শান্তভাবে দিতে থাকল। সমুদ্রে ভেসে থাকা প্রতিটি বুদবুদ বা ছায়াকেও সম্ভাব্য তিমি বা ডলফিন মনে হতে লাগল।
কতক্ষণ আর সে বেচারা দুটো খ্যাপার সঙ্গে কথোপকথন চালাতে পারে! সে তখন বলিউডের নতুন নায়ক-নায়িকার নাম বলে, ফিল্মের নাম জিজ্ঞাসা করে আমাদের ক্লিন বোল্ড করে দিচ্ছে। আমি তো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি! এর মধ্যে ছোটু কোন বন-বনান্তরে গিয়ে কী কী দেখার কথা ছিল, কিন্তু দেখতে পায়নি, সেই কথা ব্যাখান করে বলতে শুরু করেছে। গাইডভাই, সেও এমন অনামুখো, এককাঠি না এক কিমি এগিয়ে বলল যে গতকাল ছ’ঘণ্টা বোট চালিয়ে একটিমাত্র তিমির পিঠ দেখে ফেরত গেছে। আমার মুখটা নিশ্চয়ই কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছিল, তখন সে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “দিল ছোটা না করো ম্যাডাম।”
কথা পুরো শেষ হয়নি। হঠাৎ গাইডভাই ‘See right!’ বলে আঙুল নির্দেশ করতে লাগল। দেখি তেল চুকচুকে কালো মস্ত একটা পোঁটলামতো কী যেন জলে ভাসছে। বুঝলাম এই সেই থ্যাবড়ামুখো তিমিমশাই, ছোটুর আশঙ্কা অমূলক প্রমাণ করে আমাদের দর্শন দিতে গা দোলাচ্ছে। মোটরবোটও ধীরে ধীরে ওর কাছে এগোচ্ছে ফোটো নেওয়ার বৃত্তে তাকে পাওয়ার জন্য, আবার সে ‘ডুবুস’। গাইডভাই বলল, যেহেতু তিনি লাঙ্গুল প্রদর্শন করেননি, তিনি আশেপাশেই গা ঢাকা দিয়েছেন। সে আবার ভেসে উঠবে। মোটরবোটও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমরা নিমেষ গুনছি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তিনি দিক পরিবর্তন করে বাঁদিকে এসে ছোট্ট করে ‘টুকি’ দিল। এবার সবাই ক্যামেরা বা মোবাইল বাগিয়ে রেডি ছিল। খিচিক খিচিক। ফ্রেমবন্দি হলেন থ্যাবড়ামুখো। আবার অদৃশ্য, আবার দেখা—খানিকক্ষণ এই খেলা খেলে তিনি অতলে ডুব দিলেন। তখনও ঘড়ির কাঁটা সাড়ে সাতটার ঘর পার হয়নি। নবীন সূর্যের নরম আলো, ভারত মহাসাগরের ঘন নীল জনস্রোতে রোদের ঝিকিমিকি, আর আধঘণ্টার মধ্যে তিমি দর্শনের রোমাঞ্চ সব মিলিয়ে সবাই চরম আনন্দে বুঁদ হয়ে রইলাম। গাইডভাই নীরবতা ভেঙে বলে উঠল, “ক্যায়া ম্যাডাম, অব তো খুশ হো!” একগাল হাসি তখন সকলের মুখে চোখে।
তিমি মশাই ও কাছিম
খানিকক্ষণ বাদে মোটরবোট আবার চলতে লাগল। এখন তটদেশ বা মৃত্তিকার সংযোগ আর দৃশ্যমান নেই। আবার অনন্ত অপেক্ষা। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব চলছে অবিরাম। বুঝতে পারলাম, মোটরবোটগুলোর নিজেদের মধ্যে খবর আদানপ্রদানের ব্যবস্থা আছে। দূর থেকে হঠাৎ রোদ্দুর ঝিলিকের মধ্যে কালো নড়াচড়া দেখতে পেয়ে ‘ওই যে, ওই যে’ বলে হট্টগোল লাগিয়ে দিয়েছি। গাইডভাই শান্ত গলায় বলল, “Turtle”। তাই বা কম কী! কাছে পৌঁছে দেখা গেল সেখানে তারা দু’জন, গলায় গলায় ভাব তাদের। ছবিও তোলা হল পটাপট। কিছুক্ষণ এরপর অসীম সমুদ্রে তরী বাওয়ার কাল। রোদও উঠছে চড়চড় করে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রথম বা দ্বিতীয় চরণে সমুদ্র, সাগর বা তরী বাওয়ার গানের লিস্ট হয়ে গেল, এদিকে ‘তিমির দেখা নাই রে, তিমির দেখা নাই’।
মোটরবোট এগিয়েই চলেছে। অনেকক্ষণ বাদে দেখি সামনে বেশ কযেকটা মোটরবোট। দূর থেকেই মালুম হচ্ছে। সেদিকেই চলেছি আমরা। গাইডভাই হন্তদন্ত হয়ে বলতে এল যে ওখানে বেশ কয়েকটা ছোটোবড়ো তিমির দেখা মিলতে পারে। আমরাও চশমার কাচ-টাচ মুছে অ্যালার্ট হয়ে রইলাম গাইডভাইর নির্দেশের অপেক্ষায়। এবার দেখি তেনারা দু’জন, ভাসছে আবার ডুবছে। একটা বিশাল আর অন্যটি অপেক্ষাকৃত ছোটো, কী জানি মা আর ছানা কি না। আমাদের বেশ কাছে। এখন তাদের লুকোচুরি খেলা চলছে নিজেদের মধ্যে।
কতগুলো দু’পেয়ে যে তাদের ‘পানে চেয়ে চেয়ে খুশি’ হয়ে উঠেছে তাতে তাদের বয়েই গেছে। অনেকক্ষণ এই মনোরঞ্জনের পালা চলল, আমরাও আনন্দে উদ্বেল হয়ে গেলাম। কিন্তু সব খেলারই যেমন শেষের বাঁশি বাজে, এই তিমি দর্শনেরও শেষ হল যখন দু’জনেই অতল জলে ডুব দিল আর উঠল না। মোটরবোট কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করল আজকের মতো সমুদ্রযাত্রার সমাপ্তি, বন্দরে ফিরব আমরা। ডলফিন শো অধরাই রইল। কিছু অতৃপ্তি থাকা ভালো, তাতে প্রাকৃতিক অনিশ্চয়তার সাধারণ হিসেব বজায় থাকে পুরোমাত্রায়।
এবার তীরে ফেরার পালা। সূর্য প্রায় মাথার ওপরে। বেলা প্রায় এগারোটা। ড্রাইভারদাদা গাড়ি নিয়ে এসে গেছে। ফিরে এলাম হোটেলে। দুপুরের খাওয়া সেরে বেরোব কলম্বোর পথে। এদের ডাইনিং হলটা প্রায় সমুদ্রের ওপরে। সাধারণ চিকেন কারি, ভাত আর আলুভাজা অর্ডার করেছি। সমুদ্রের ঘন নীল জল আর আকাশের রঙের খেলা উপভোগ করছি। নানান কায়দা করে খাবার পরিবেশন করে গেল। মুখে দিয়ে ওয়াক থু! আমি জানতাম আমিই বিশ্বে নিকৃষ্টতম রাঁধুনি, কিন্তু ‘মিরিসা ওশেন ইন’-এর শেফ আমায় হারিয়ে দিয়েছে। কোনোরকম ঠুকরে ঠুকরে একটু খেয়ে উঠে পড়লাম।
বারোটা বেজে গেছে। এবার যাত্রা কলম্বোর পথে। মিরিসা থেকে গ্যল হয়ে কলম্বোর রাস্তা (১৭০ কিমি) খুব ভালো। তবে সত্যি কথা এই যে ক্লান্ত শরীরে সেই জার্নির বেশি সময়ই ঘুমিয়েছি। কলম্বোতে পৌঁছবার আগে থেকেই ঘন ট্রাফিকের ঝকমারি শুরু হল। যাই হোক, প্রায় দুটো-আড়াইটে নাগাদ হোটেলে ঢুকলাম। অতি মহার্ঘ্য, কিন্তু খুবই ভালো ‘তাজ সমুদ্র’ হোটেলে ঘরের জানালা দিয়ে সমুদ্রের দর্শন। গাড়ির টাকাপয়সা মিটিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল। ভালো গাড়ি ও অভিজ্ঞ ড্রাইভারদাদার জন্য আমাদের এত ভালো ঘোরাঘুরি হল। থ্যাঙ্ক ইউ, ড্রাইভারদাদা!
ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক, চকোলেট আর তাজা ফল খেয়ে বিকেলে গেলাম কলম্বো রামকৃষ্ণ মিশনে। সন্ধ্যারতি দেখে হোটেলে ফিরে এলাম। বন্ধু সজীবা ও তার মেয়ে শচীনী গাদা গাদা শাড়ি-কাপড়ের উপহার সামগ্রী নিয়ে হাজির। সবাই মিলে এই হোটেলেই সুস্বাদু ডিনার সারলাম। জিনিসপত্র গোছানো হল, কাল ফেরার ফ্লাইট। হোটেলই প্যাকড ব্রেকফাস্ট দিয়ে লাক্সারি গাড়ি করে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিল। এরপর বোর্ডিং পাস নিয়ে অপেক্ষা।
লাউঞ্জে একটি ছোটো গোলাপি বাচ্চা বারবার তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করে চলেছে, “বাবা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?” মনে মনে উত্তর দিলাম, ‘তুমি মা চলেছ তোমার অতুল অসীম ভবিষ্যতের দিকে।’ অন্যদিকে ‘সন্ধ্যা হয়ে এল ওই আর কত বসে রই’ আমি ফিরে যাচ্ছি আমার নিশ্চিত অপেক্ষিত জীবনাবসানের দিকে। আপাতত পৌঁছব কলকাতা, সদাব্যস্ত কর্মজীবনে।
অসাধারণ বর্ণনা… তবে শুধুই বর্ণনা নয়, তার সঙ্গে বিভিন্ন রসের মিশ্রণ, তা সে হাস্যরস ই হোক বা কাব্যরস… একে আরও বেশী সুখপাঠ্য করে তুলেছে।
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ
LikeLike