সংঘমিত্রা মিত্র
প্রথম দিনে নিজের মতো করে কলকাতা ঘুরতে বেরোনোটা মনে অনেকখানি দাগ কেটেছে। তাই ঠিক করলাম স্বাধীনতা দিবসের দিনে কলকাতাকে কেমন লাগে বেড়িয়ে দেখলে মন্দ হয় না। কথা মতো ১৫ই অগাস্ট সকালবেলা বেরিয়ে পড়লাম।
তবে আজ আমি একা যাব না। আমার সঙ্গে যাচ্ছে আরও দুজন। বাসব কাকু (বাসব চ্যাটার্জি) আর মহুল (ইমন চ্যাটার্জি)। নৈহাটি ষ্টেশনে দেখা হল এদের সঙ্গে। সবার প্রথমে বাসব কাকু আমাদের নিয়ে দমদম থেকে মেট্রো ধরে গেল অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে। যেতে যেতে বাসব কাকু বলছিল এই জায়গাটার সঙ্গে বাঙালির বহু পুরনো সম্পর্ক আছে। কারুশিল্পের স্থায়ী পরিচিতি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৩৩ সালে লেডি রানু মুখার্জি এই অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সময়ে চিত্রকলা প্রদর্শনী ও নাটকের মধ্য দিয়ে প্রায় আট দশকেরও বেশি সময় ধরে বাঙালি সংস্কৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে এই জায়গাটি।
প্রথমবার নাটক দেখব বলে খুব উৎসাহিত ছিলাম। ক্রাইম সাসপেন্স এ ভরা এই নাটকের নাম হন্তারক। নাটকের রেশ কাটতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। এরই মধ্যে অ্যাকাডেমির পিছন দিকের একটা অনামি স্টলে কী দারুণ মাছের চপ আর চা খেয়ে টিফিন সারলাম। তবে কলকাতা ঘুরলে এরকম অনেক অনামি স্টলের খাবার বড় বড় নামি রেস্টুরেন্টকেও হার মানায়।
আজ কলকাতার পথ ঘাট অনেক নির্জন, সমস্ত দোকান পাট বন্ধ একটা অন্যরকমের ছুটির আমেজ ছেয়ে আছে। অন্যরকম এই ছুটির আমেজে কোথাও কোথাও স্বাধীনতা দিবস পালন হচ্ছে। এরপরে গেলাম ৮ নং শেক্সপিয়ার সরনিতে ঋষি অরবিন্দ আশ্রমে। ঋষি অরবিন্দের জন্মস্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই আশ্রম। চারিদিকে নানারকম ছোট বড় গাছপালা, ফোয়ারা, বসার জায়গা দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো আশ্রমটি।
মেন গেট দিয়ে ঢুকে কিছুটা গিয়ে সামনে পরে একটা প্রকাণ্ড দোতলা বাড়ি। ইংরেজ আদলে তৈরি এই বাড়ি জুড়ে সংগ্রহ রয়েছে ঋষি অরবিন্দের নানান কথা, চিঠি, বাণী। ওইগুলো পড়ার সময় হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত, ছিমছাম চেহারার এক বয়স্ক ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন এবং তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু আগ্রহীর শ্রোতার দল। কথায় কথায় জানলাম ওঁর নাম পূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্য। বয়স ৯৯ পেরিয়েছে আর উনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীণ ঘোষের সহযোদ্ধা। ওঁর কাছ থেকে শুনলাম স্বাধীনতার কিছু ইতিহাস আর বিভিন্ন বিপ্লবীদের বীরত্বের কাহিনী।
শুনতে শুনতে একপ্রকার হারিয়ে গেছিলাম, চোখের সামনে ভাসতে শুরু করেছে সব ঘটনা। কখন যে বেলা গরিয়ে দুপুর হয়েছে বুঝতেই পারলাম না। খেতে যাওয়ার ডাক আসায় ছন্দপতন ঘটল। নীচে আশ্রমের গাছতলায় খাওয়ার আয়োজন। গরিব বড়োলোক সবাই একসঙ্গে পাত পেড়ে খাচ্ছে। আমারা নীচে গিয়ে খাওয়ার লাইনে দাঁড়ালাম। জায়গাটা বেশ ভিড়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমরাও গাছতলায় খাওয়ার জায়গায় বসলাম। আজকে খাওয়ারে আছে খিচুড়ি, আলুরদম, চাটনি আর ঘিয়ে ভাজা মিষ্টি।
প্লেটটা দেখেই মন জুড়িয়ে গেল। খাওয়ার সময় একটা বেশ মজার ঘটনা ঘটল। মহুলের কাকের ভয়, তাই খাওয়ার সময় চারিদিকে দেখে নিচ্ছিল যাতে কোনওদিক থেকে যেন কাক না এসে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাকের দেখা না পেয়ে যখন ও খাওয়া শুরু করবে এমন সময় মহুলের কাঁধের উপর বিষ্ঠা এসে পড়ল। ওপরে তাকিয়ে দেখি একটা কাক বসে আছে। তারপর মহুলের রাগী মুখটা দেখার মতো ছিল। যাইহোক ওখান থেকে একটু সরে গিয়ে খাওয়া শেষ করলাম। সারাদিনই প্রায় মেঘলা ছিল খাওয়া শেষ হতে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল, এই সুযোগে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম।
বৃষ্টি থামলে রওনা দিলাম শহিদ ক্ষুদিরাম মেট্রো স্টেশনের উদ্দেশ্যে। গন্তব্য বাসব কাকুর এক বন্ধুর বাড়ি। ভদ্রলোকের নাম চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। ওঁর বাবা স্বর্গীয় বিমল চট্টোপাধ্যায় যিনি সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথের মত অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। প্রায় ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পৌছালাম ওঁর বাড়ি। পরিচয়পর্ব সেরে উনি আমাদের নিয়ে গেলেন ওঁর বসার ঘরে। এই ভদ্রলোকের পুরনো জিনিস সংগ্রহ করার সখ এই যেমন অমূল্য চিঠি, বিরল কিছু ছবি, স্ট্যাম্প ইত্যাদি। সেই সব দেখে একপ্রকার অবাক হয়ে গেছিলাম।
গল্পে গল্পে সন্ধ্যা নেমে এল। ফিরতে হবে অনেকটা পথ, তাই আর দেরি না করে উঠে পড়লাম। ট্রেনে করে ফেরার সময় জানলার ধারে বসে সারাদিনের ঘটনাগুলো একের পর এক রোমন্থন করার চেষ্টা করছিলাম। বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় মিশে ছিল অনেকখানি ভালোলাগা। প্রতিদিনের ব্যস্ততা ভরা যান্ত্রিক কলকাতার মোড়কের আড়ালে প্রিয়তমা এই শহরকে চিনে নেওয়ার আগ্রহ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।