গুজরাট পর্ব(৫)
বিতস্তা ঘোষাল
গাড়ি আবার ছুটছে। ড্রাইভারকে বলা ছিল, সবরমতি আশ্রম দেখে হোটেল ঢুকব। সে এবার সবরমতি নিয়ে বলতে শুরু করল।
কথিত আছে, স্বয়ং ভগবান শিব গঙ্গাকে গুজরাতে নিয়ে এসেছিলেন, আর তাঁদের সঙ্গেই সবরমতিও আসেন। পুরাকালে এর নাম ছিল ভোগ্যা। সুলতান আহমেদ শাহ এই নদীর ধারেই বিশ্রাম নেবার সময় দেখেছিলেন একটা খরগোশ এক কুকুরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়াই করছে। একটা খরগোষের এত সাহস দেখে তিনি যুগপৎ আশ্চর্য ও মুগ্ধ হয়ে এখানেই নগর স্থাপন করেন।
গান্ধিজীর এই আশ্রমকে কেউ বলেন হরিজন আশ্রম আবার কেউ বলেন সবরমতি আশ্রম। কিন্তু এখন এই আশ্রম পরিচিত গান্ধী আশ্রম নামেই। সবরমতি নদীর ধারে মহাত্মা গান্ধীর আবাসস্থলও ছিল এই আশ্রম। এখান থেকেই তিনি স্বাধীনতার আন্দোলন করেছেন। ঐতিহাসিক ডান্ডি পদযাত্রা করেছেন।
আহমেদাবাদ শহরের উপকণ্ঠের উত্তরে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে সবরমতী নদীর তীরে ৩৬ একর জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে আশ্রম। গান্ধীজিতো ব্যারিস্টার ছিল। তিনি আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে আসেন। এ সময়ই তিনি আহমেদাবাদ শহরে একটি আশ্রম গড়ে সেখানে নিজের ভক্তদের নিয়ে বসবাস করার উদ্যোগ নেন। ওই বছরই কোচরাব পল্লিতে প্রথম গড়ে তোলেন আশ্রম। পরবর্তী সময় সেখানে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়লে তিনি আশ্রম গড়ার জন্য সবরমতী নদীর তীরে পেয়ে যান উপযুক্ত জায়গা। তারপরই সেখানে গড়ে তোলেন এই আশ্রম। এখানে আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষিকাজ, গবাদিপশু পালন, দুগ্ধ খামার এবং খাদি কাপড় তৈরির উদ্যোগ নেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এই গান্ধী আশ্রমকে গান্ধী স্মারক হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তী সময় এখানেই গড়ে ওঠে বিশাল গান্ধী সংগ্রহশালা। স্মারক রূপে এখানে একটি গান্ধী সংগ্রহশালাও তৈরি হয়েছে।
গল্প শুনতে শুনতে সাড়ে পাঁচটায় আমরা পৌঁছলাম আশ্রমে।কোনো প্রবেশমূল্য নেই। বিরাট এলাকাজুড়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে আশ্রম। ঢুকেই বোর্ডে সব ভাষায় লেখা সবরমতি আশ্রম।সামনেই সুন্দর বাগান। নানা গাছ ও ফুল গাছে কাঠবিড়ালীরা নিশ্চিন্তে খেলছে সেখানে। আশ্রমের পাশ দিয়ে চলেছে সবরমতি নদী। দূরে দেখা যাচ্ছে নদীর ওপর এলিজ সেতু। প্রবেশদ্বারের থেকে দু’পা এগিয়েই রয়েছে বিশাল বোর্ড। সেখানে আশ্রমের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং পথনির্দেশিকা। বাঁ দিকে গান্ধী সংগ্রহশালা। একতলা ভবন। নতুনভাবে তৈরি এ ভবনে ঢুকতেই সামনের দিকে গান্ধীর বিরাট এক তৈলচিত্র। সঙ্গে সহধর্মিণী কস্তুরবা। ছবিটি ১৯১৫ সালের তোলা। এরপর আমরা দেখলাম সংগ্রহশালা, গ্রন্থাগার, ফটো গ্যালারি, গান্ধীজির ব্যবহৃত নানা স্মারক, পাণ্ডুলিপি, চিঠি, তৎকালীন নানা খবরের কাগজ ইত্যাদি। চোখে পড়ল গান্ধীজির এক অবাক করা মূর্তি ও একটি তাম্রমূর্তিও। অপূর্ব এসব মূর্তি। কাচের ঘরে রক্ষিত গান্ধীজির মূর্তি দেখে প্রথম দর্শনেই মনে হলো দিব্যি বসে আছেন গান্ধীজি! সেই চেহারা!
সংগ্রহশালার এক কর্মকর্তা জানালেন, এখানে রয়েছে গান্ধীজির লেখা বিভিন্ন গ্রন্থের আট হাজার ৭৮১ পাতার পাণ্ডুলিপি, ৩৪ হাজার ১১৭টি চিঠি, স্বাধীনতাসংগ্রাম, ডান্ডি পদযাত্রা থেকে গান্ধীজির জীবনের নানা মুহূর্তের আট হাজার আলোকচিত্র, গান্ধীজিকে নিয়ে ১৬৫টি তথ্যচিত্র এবং ৩৫ হাজার বই। ওই কর্মকর্তা আরও জানালেন, এখানে রয়েছে হিটলারকে লেখা গান্ধীজির চিঠি, গান্ধীজিকে লেখা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি। এখানে নিয়মিত দেখানো হয় গান্ধীজির তথ্যচিত্র। আরও বললেন, প্রতিবছর গড়ে সাত লাখ মানুষ এই আশ্রম পরিদর্শন করে। গান্ধীজির স্বাধীনতা আন্দোলনের সার্বিক প্রামাণ্য তথ্য এখানেই সংরক্ষিত রয়েছে। রয়েছে বইয়ের দোকানও। এখানে বিক্রি হয় গান্ধীজির বইসহ নানা স্মারক।
আমরা সংগ্রহশালা দেখে পেছনের দিকে নদীতীরে চলে এলাম। এখানে রয়েছে গান্ধীজির আবাসস্থল। নাম দেওয়া হয়েছে হৃদয়কুঞ্জ। চৌচালা টালির ঘর। পাকা দেয়াল। এখনো অবিকল। এই ঘরে থাকতেন গান্ধীজি। চার কক্ষের ঘর এটি। বারান্দায় এখনো রয়েছে একটি সুতা কাটার চরকা। পাশেই গান্ধীর চরকায় সুতা কাটার ঘর। ঘরটি বন্ধ থাকলেও জানালা দিয়ে দেখা যায়। ছবিও তোলা যায়। বারান্দার পর রয়েছে গান্ধীজি ও কস্তুরবার ঘর এবং একটি অতিথিঘর ও রান্নাঘর। রান্নাঘরে এখনো গান্ধীজির ব্যবহার করা সেই সব তৈজসপত্র, চুলা ইত্যাদি।
দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল, এই হৃদয়কুঞ্জ থেকে গান্ধীজি ভারতের স্বাধীনতার জন্য ডান্ডি যাত্রা শুরু করেছিলেন। সেই ১৯৩০ সালে। ব্রিটিশের লবণ আইনের প্রতিবাদে গান্ধীজি এখান থেকে শুরু করেন ডান্ডি পদযাত্রা। ৭৯ জন সত্যাগ্রহী সঙ্গে নিয়ে গান্ধীজি ২৪ দিনে ৩৯০ কিলোমিটার পথ হেঁটে ক্যাম্বে উপসাগরের ডান্ডি গ্রামে পৌঁছান। তারপর ৬ এপ্রিল সেখানে সমুদ্রের জল ফুটিয়ে নুন বানিয়ে ব্রিটিশের কালাকানুনের প্রতিবাদ জানান। ঘোষণা করেন, নুন তৈরিতে ব্রিটিশদের কোনো ট্যাক্স নয়। পরে অবশ্য এখানেই কারাডি গ্রামে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ৫ মে বন্দী হন গান্ধীজি। এই লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে গোটা দেশে ৮০ হাজারের বেশি আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ। এতে থেমে যায়নি এই আন্দোলন। এই আন্দোলনই পরে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়।
তখন গান্ধীজি ঘোষণা করেছিলেন, স্বাধীনতা না পাওয়া পর্যন্ত তিনি আর ফিরবেন না এই আশ্রমে। এ বাড়িতে গান্ধীজি বাস করেছেন ১৯১৮ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত। এখানে থাকাকালীন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাত্মা উপাধি দিয়েছিলেন গান্ধীজিকে।
দেখলাম আশ্রমের সামনেই ছোট্ট একটি উপাসনা মন্দির। পাকা বেদি, ফাঁকা জায়গা। তবে একটি বোর্ড রয়েছে। বর্ণনা রয়েছে উপাসনাস্থলের। এখানের এই চত্বরে গান্ধীজি উপাসনা করতেন সকাল-সন্ধ্যা। সামনে চারদিক বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা উন্মুক্ত উপাসনাস্থল। বলা হয় প্রার্থনা ভূমি। গান্ধী শুনতেন ভজন, গীতাপাঠ, পবিত্র কোরআন পাঠ ও বাইবেল পাঠ। সর্বধর্মের মিলনকেন্দ্র ছিল এই উন্মুক্ত প্রার্থনা ভূমি।
কাছেই আচার্য বিনোভা-মীরা কুটির।
কুটিরের বাইরে ফলকে লেখা, এই কুটিরে গান্ধীজির ভাবশিষ্য আচার্য বিনোভা ভাবে থেকেছেন সেই ১৯১৮ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত। ছিলেন এখানে ব্রিটিশ অ্যাডমিরালের কন্যা মীরাও। ১৯২৫ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত। গান্ধীজির বই পড়ে মীরা গান্ধীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। তারপর গান্ধীজির ডাকে তিনি চলে আসেন এই আশ্রমে। থাকেন এই কুটিরে। আজও সেই ছোট্ট কুটিরটি ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। আরও দেখা হলো মগন নিবাস। এই ভবনেই থাকতেন আশ্রমের ম্যানেজার মগন গান্ধী। রয়েছে এখানে নন্দিনী। গান্ধীজির আমলে এখানে থাকতেন দেশ-বিদেশের অতিথিরা। উদ্যোগ মন্দির, শিক্ষানিবাস ইত্যাদিও দেখলাম।
গান্ধী আশ্রমের বুক কাউন্টার থেকে চরকা আর গান্ধীর অটোবায়োগ্রাফি কিনে যখন বেরোলাম তখন সবরমতি নদী ছুঁয়ে সূর্য অস্ত গেল।ঘড়ির কাঁটা বলছে সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা ।
আর খানিক বাদেই হোটেল আইটিসি ফরচুন পার্কে ঢুকব।
শেখভাই বললেন, আমি রবীন্দ্রনাথ আর সাধু বিবেকানন্দকে জানি। রবীন্দ্রনাথের একটা গান জানি।
আমি ভাবলাম নির্ঘাৎ ‘যদি তোর ডাক শুনে…’ কিংবা ‘জনগনমন অধিনায়ক…’ বলবেন।আমার ভাবাকে নস্যাৎ করে সে গুনগুন করল, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা. .
চমক তখনো বাকি ছিল। তিনি বললেন, আমি পোস্টমাস্টার পড়েছি। তখনি মনে পড়ল, গান্ধী আশ্রমে একটু আগেই পোস্ট মাস্টার ইংরেজি অনুবাদ নির্মলকান্তি ভট্টাচার্যর ভূমিকায় দেখেছি।
ভাবী, সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ আমাদের গুজরাতে এসেছিলেন। বরোদার রাজা তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। অরবিন্দ ঘোষও বরোদায় চাকরি করতেন। পরে তিনি দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য বাংলায় চলে গেছিলেন। তারপর পন্ডিচেরীতে আশ্রম করেছিলেন।আর ছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত। বরোদার রাজার দেওয়ান। ভাবী আপনি নিশ্চয়ই পড়েছেন তাঁর কথা।তিনি অনেক কিতাব লিখেছিলেন।
আমি চুপ করে থাকলাম। রমেশচন্দ্র দত্তের কোনো লেখা পড়েছি বলে মনে পড়ল না।ভিন দেশে এক অবাঙালি মুসলিম বাঙালি লেখকের কথা জানে আর আমি বাঙালি হয়ে সেটুকুও জানি না ভেবে লজ্জায় মাথা ঘুরিয়ে নিলাম জানলার দিকে।
রজ্জাকভাই বোধহয় বুঝলেন, আমি জানি না। তিনি বললেন, আমিও পড়িনি।তবে শুনেছি। তিনি রামায়ন মহাভারত অনুবাদ করেছিলেন। আর অনেকগুলো নভেল লিখেছিলেন রাজ-রাজাদের কাহিনি নিয়ে।
আই টি সি ফরচুন পার্কের লবিতে গাড়ি ঢুকছে। ভোর বলল, মা ইনি বা এনার পরিবার নির্ঘাত হিন্দু বাঙালি ছিলেন, কোনো এক সময় কনভার্ট হয়ে মুসলিম হয়েছেন।
রজ্জাক ভাই গাড়ি থামিয়ে দরজা খুললেন। আমাদের সব জিনিসপত্র হোটেলের স্টাফ নিয়ে যাবার পর বিদায় জানাবার আগের মুহূর্তে নমস্কার জানিয়ে বললেন, চারশো বছর আগে আমার পরিবার এদেশে এসেছিলেন তুর্কিস্থান থেকে। এদেশকে ভালবেসে তখন থেকে এখানেই থেকে গেছে তারা। আমার পূর্বপুরুষ গান্ধিজীর সঙ্গেই ডান্ডি অভিযানে পা মিলিয়েছিল। আমার নানা বলতেন, আগে মানুষ, তারপর দেশ তারপর ধর্ম। মানুষ না থাকলে দেশের অস্তিত্ব নেই। আর দেশ না থাকলে ধর্ম দিয়ে কী হবে! মানুষ যদি নিজেদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে লড়াই করে মরে তবে আল্লা বা ভগবান সেই ইনসানকে ক্ষমা করে না। আমার তিন ছেলে-মেয়েকেও আমি তাই শেখাচ্ছি। আগে জাত না দেখে মানুষকে ভালবাসতে শেখো। বাকিটা আল্লা ঠিক করে দেবেন।
একটু চুপ থেকে আবার বললেন, ভাবী অপরাধ মাফ করবেন। গান্ধীজি নেহেরুকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য দেশটাকেই শুধু ভাগ করলেন না, সাধারণ মানুষের মধ্যে হিন্দু মুসলিম বিভাজনটাও ঢুকিয়ে দিলেন। একসাথে লড়াই করেই তো দেশ স্বাধীন হয়েছিল, যদি বলত, না দেশভাগ করব না, তবে আজ মুসলিম বলে আমাদের এত ঘৃণা করত না হিন্দুরা। মুসলিমরাও হিন্দুদের ঘেন্না করত না।
শেখভাই গাড়িতে উঠলেন।আমি আর ভোর হাত জোর করে প্রতি নমস্কার জানিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। লিফটে উঠতে উঠতে ভোর বলল, মা মাঝে মাঝে একটা গান গাও না তুমি! ভারতবর্ষ মানবতার এক নাম/ মানুষের লাগি মানুষের ভালবাসা/ প্রেমের জোয়ারে এ ভারত ভাসমান/ যুগে যুগে তাই বিশ্বের যাওয়া- আসা/ সব তীর্থের আঁকা-বাঁকা পথ ঘুরে/ প্রেমের তীর্থ ভারততীর্থে মেশে…। তোমার রামকৃষ্ণ বলেছিলেন সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের কথা। তুমি সেই আদর্শে বিশ্বাসী। তোমার কাছে তাই দেবতাও মানুষ হয়ে যায়, আর মানুষ হয় দেবতা।
মানে?
মা নইলে এই গুজরাতে যেখানে গোধরা কান্ডে এত মানুষ দাঙ্গায় মরে, সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে মানবাধিকার রক্ষার দাবীতে, সেখানে এক মুসলিম, যাকে তুমি সারা রাস্তা ভাই বলে এলে, আর তিনি তোমায় পুরাণ, মহাভারত শোনালো সারাটা পথ, সেটা অদ্ভুত নয় কী!
আমি শুধু, হুঁ, বলে নিজের মনেই আওড়াই ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম, আমরা রয়েছি সেই সূর্যের দেশে…।