পাহাড় শুশুনিয়া ও চন্দ্রবর্মার শিলালিপি
বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া ও সংলগ্ন অংশ ঐতিহাসিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাগৈতিহাসিক যুগের বহু অস্ত্রশস্ত্র যেমন এই অঞ্চল থেকে পাওয়া গেছে, তেমনি আনুমানিক খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে মহারাজ চন্দ্রবর্মাউৎকীর্ণশিলালিপিও মিলেছে এই ভূখণ্ড থেকে। জানাচ্ছেন অরিন্দম দেবনাথ
বেশ কিছুদিন আগের কথা। বাঁকুড়া শহরের বাসস্ট্যান্ড থেকে শুশুনিয়া পাহাড় যাবার বাসে ওঠার পরে, এক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার পাশের সিটে বসা, ধুতি পাঞ্জাবি পরা, গায়ে চাদর জড়ানো ভদ্রলোকটি বাস ছাড়তেই জানতে চাইলেন
“কোথায় যাবেন?”
“শুশুনিয়া পাহাড়।”
সময়টা নভেম্বরের শেষ। জাঁকিয়ে শীত পড়ে গেছে। বাসের বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে হু হু করে আসা হাওয়ার সাথে শীতটাও কণকণ করে উঠছিল। শীত ভুলতেই যেন কথা বলে উঠলেন ভদ্রলোক।“শুশুনিয়া পাহাড়ে অনেকেই বেড়াতে আসে, কিন্তু এর ইতিহাস ক’জন জানে? অনেকেই জানে না, যে এই পাহাড়ের গায়ে খোদিত আছে মহারাজ চন্দ্রবর্মার ‘শিলালিপি’।”
বললাম –“মহারাজ চন্দ্রবর্মার কথা আমারও কিছু জানা নেই। শুধু নামই শুনেছি। চন্দ্রবর্মা সম্পর্কে কিছু বলুন না।”
চলন্ত বাসে কায়দা করে হাতের আড়ালে বিড়ি ধরিয়ে ভদ্রলোক বললেন –“বাঁকুড়া জেলা সম্পর্কে দু-চার কথা বলে তারপর চন্দ্রবর্মার প্রসঙ্গে যাই, কি বলেন?”
–“আপনি যা ভাল মনে করেন।”
–“বাঁকুড়া জেলা জানেনই তো কি ভীষণ রুক্ষ। পাথুরে মাটি ছাড়াও জলাভাব এখানকার লোকের সবসময়ের সাথী। এই বাঁকুড়া জেলা ছিল রাঢ় দেশের পশ্চিম অঞ্চল। প্রাচীন কালে, আর্যরা এ দেশকে বলতেন বর্জনীয় দেশ। কারণ বিভিন্ন অনার্য জাতি, যেমন –কোল, দ্রাবিড় … মূলতঃ এরাই এখানে বাস করতেন। ফলে এক সময় এদের রীতিনীতি আচার – ব্যবহারেরই প্রাধান্য ছিল এ অঞ্চলে। অনার্যদের রীতি-নীতি আর্যরা এক রকম ঘৃণাই করত। অনার্যদের সাহচর্যও আর্যদের কাছে অসহনীয় ছিল। কোন ব্রাহ্মণ যদি এখানে কিছুদিন থাকতেন তবে তার সমাজ তাকে‘একঘরে’বা‘পতিত’করে দিত।”
“পরে এই রুক্ষ পাথুরে দেশে আর্যদের ভাষা, ধর্ম ও আচার-আচরণ আমদানি করেন জৈন ধর্মগুরুরা। বর্তমান বাঁকুড়া জেলার সীমান্ত ঘেঁষা পরেশনাথ পাহাড়ে জৈনদের একটি ধর্মকেন্দ্র ছিল। সেখান থেকে জৈনরা এই অঞ্চলে আসেন। ধর্মের বাণী প্রচারের সাথে সাথে তারা এই বর্জিত ভূমিকে আর্যদের বসবাসের উপযুক্ত করে তোলেন। আর্যদেরপরেই আসেন বৌদ্ধরা। আসেন বহু সম্রাট ও রাজারা তাঁদের বিজয় পতাকা ওড়াতে। শুশুনিয়া পাহাড়ের শিলাগাত্রে মহারাজ সিংহবর্মার পুত্র মহারাজ চন্দ্রবর্মার একটি শিলালিপিই বর্তমান বাঁকুড়া জেলার ইতিহাসের প্রথম লিখন। ব্রাহ্মি লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় খোদিত আছে-
চক্রস্বামিনঃ দাসাগ্রেনাতি সৃষ্টঃ
পুষ্করণাধিপতে মহারাজ শ্রী সিংহ।
বর্মনঃ পুত্রস্য মাহারাজা।
চন্দ্রবর্মনঃ কৃতিঃ।।”
এর মধ্যেই শুশুনিয়া এসে পড়ে। ভদ্রলোকের কাছ বিদায় নিয়ে বাস থেকে নেমে যাওয়ার পরে মনে পড়ল এই যা! ভদ্রলোকের ঠিকানা তো নেওয়া হ’ল না! নিদেন নামটাও জানা হয় নি। বাস থেকে নেমে, একটা দোকানে চা-জলখাবার খেয়ে শিলালিপির হদিশ জেনে, দুর্গাপুর -বাঁকুড়া সড়ক ধরে, শুশুনিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত’এর অতিথিশালা ও ইয়ুথহস্টেলকে বাঁয়ে রেখে খানিক এগিয়ে, সড়ক ছেড়ে বনপথ ধরে হাঁটতে থাকলাম। যদিও বনপথ বললাম, কিন্তু প্রায় বৃক্ষশূন্য এ বনপথ। শুশুনিয়া পাহাড়কে প্রায় বৃক্ষশূন্য করে ফেলা হয়েছে। স্থানীয় মানুষ অবাধে গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এদের বৃক্ষ হনন পদ্ধতিটা অদ্ভুত। ছোট ছোট গাছগুলো, শুকনো পাতা জ্বালিয়ে ঝলসে ফেলা হয়। গাছগুলো, মরে শুকিয়ে গেলে, কেটে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
ঘন্টা খানেক হাঁটার পর দূর থেকেই নজরে এল পাহাড়ের গায়ে একটি টিনের আচ্ছাদন। ওই আচ্ছাদনটির নীচেই রয়েছে চন্দ্রবর্মার শিলালিপি। শিলালিপির স্থানটি যমধারা নামে খ্যাত। কেন বলতে পারব না, তবে একটি
ছোট জলধারা আছে।
টিনের আচ্ছাদনের নীচে আধো অন্ধকারে দেখলাম চন্দ্রবর্মা তাঁর যে বিজয় কীর্তি খোদাই করেছিলেন সেটি। কিন্তু শিলালিপিটিতে উৎসাহী পর্যটকরা তাদের নাম খোদাই করে সম্পূর্ণ বিকৃত করে দিয়েছে।
মহারাজচন্দ্রবর্মার শিলালিপিটির ঠিক উপরেই আছে একটি গোল চক্র। চক্রটিকে ঘিরে আছে চোদ্দটি আগুনের শিখা। সম্ভবতঃ ঐ ছাপটি মহারাজ চন্দ্রবর্মার শীলমোহরের প্রতীকচিহ্ন।
শিলালিপিটি দেখা হলে জঙ্গলের খাড়াই বেয়ে শুশুনিয়া পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম। পাহাড়ের মাথাটি টেবিলের মত সমতল। এক স্থানে বেশ কিছু পাথর জড়ো করে ‘সামিট পয়েন্ট; করা হয়েছে।
ফিরে আসি চন্দ্রবর্মা প্রসঙ্গে। চন্দ্রবর্মার সময়কাল কি ছিল জানা যায় নি। তবে ঐতিহাসিকদের অনুমান, খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতকের শেষের দিক ছিল তার রাজত্বকাল। মহারাজ চন্দ্রবর্মা শুশুনিয়া পাহাড়ে একটি দুর্গ নির্মাণ করে বেশ কিছুদিন ছিলেন। এর বেশ কিছু প্রমানও ঐতিহাসিকরা পেয়েছেন।
কিন্তু কে এই মহারাজ চন্দ্রবর্মা? শুশুনিয়ার শিলালিপিটির তর্জমা করলে বোঝা যায় ‘পুস্করনা’ একটি জায়গার নাম। কিন্তু সেটি কোথায়?
দিল্লীর ‘মেহেরৌলি’তে পাওয়া একটি বহু প্রাচীন লোহার স্তম্ভে চন্দ্র নামে এক দিগ্বিজয়ী সম্রাটের কীর্তি লেখা আছে। এলাহাবাদের এক দুর্গের মধ্যে সম্রাট অশোকের এক শিলাস্তম্ভে চন্দ্রবর্মার উল্লেখ পাওয়া গেছে। হরিষেন লিপিতে লেখা সংস্কৃত ভাযায় ঐ অশোকের শিলাস্তম্ভে গুপ্ত সম্রাট সুমদ্রগুপ্তের প্রশস্তি গেয়ে, সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেন লিখেছেন যে, সমুদ্রগুপ্ত চন্দ্রবর্মা নামক এক জনৈক আর্যাবর্তীয় রাজাকে যুদ্ধে হারান।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বাংলার ইতিহাস’ বইতে লিখেছেন –‘রাজপুতনার মরুপ্রদেশের পুস্করনা নগরের অধিপতি চন্দ্রবর্মা সপ্তসিন্ধুর মুখ ও বাল্মীক দেশ হইতে বঙ্গদেশ পর্যন্ত সমস্ত আর্যাবর্ত জয় করিয়াছিলেন। এলাহাবাদ দুর্গের সমুদ্রগুপ্তের প্রশস্তির চন্দ্রবর্মা, শুশুনিয়া লিপির চন্দ্রবর্মা ও দিল্লী স্তম্ভলিপির চন্দ্রবর্মা যে অভিন্ন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।’
মহারাজ চন্দ্রবর্মা এখন ইতিহাস। বহু বৎসর আগেই লুপ্ত হয়েছে শুশুনিয়া পাহাড়ে তাঁর দুর্গ। দুর্গম বর্জিত অঞ্চল এখন হয়েছে মানুষের বসবাসের উপযুক্ত। আর অরন্যাবৃত শুশুনিয়া এখন বৃক্ষশূন্য হয়ে হয়েছে, পিকনিক স্পট ও পর্বতারোহীদের শিলারোহন অনুশীলন ও শিক্ষণ কেন্দ্র।
তোমরা শুশুনিয়া পাহাড়ে গেলে কিন্তু ১৬০০ বছরের এই প্রাচীন শিলালিপি দেখতে ভুলো না!