ভ্রমণ মিশন কার্মাটাঁড় দেবজ্যোতি গঙ্গোপাধ্যায় বর্ষা ২০২০

মিশন কার্মাটাঁড়

দেবজ্যোতি গঙ্গোপাধ্যায়

দিল্লি রোডের আসানসোল বাইপাসে তখন নিস্তব্ধ শুনশান কনকনে শীতের মাঝরাত। হাজারীবাগ থেকে কলকাতাগামী বাস হেমকুন্ত নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। এখান থেকে স্টেশন দুই-তিন কিলোমিটার।

আমার গন্তব্য কার্মাটাঁড়—বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শেষজীবনের আশ্রয়। প্রায় কুড়ি বছর যেখানে কাটিয়েছিলেন ১৮৯১-এ কলকাতায় মৃত্যুর আগে। অবশ্য একটানা এখানে খুব বেশি দিন থাকতে উনি কখনোই পারেননি।

ঝাড়খণ্ড-বাংলা সীমানায় কার্মাটাঁড়ের অখ্যাত রুখা-শুখা জমির সেই একশো কুড়ি বছর আগের বিদ্যাসাগর সংস্পর্শ ছাড়া আর কোনও দ্বিতীয় কৌলিন্যের পরিচয় নেই। কার্মাটাঁড় ও বিদ্যাসাগর বাঙালি মানসে সমার্থক। বিদ্যাসাগরের জীবনের সঙ্গে কমবেশি পরিচিত যেকোনও বাঙালিই সেই বিরল মানুষটার সাঁওতাল পরগনায় কাটানো এই অন্তিম পর্বের কথা মনে রেখেছে। যদিও সে মনে রাখা নিতান্তই কোনও ফিকশন পড়ার হালকা স্মৃতির মতো।

শেষজীবনে বিদ্যাসাগর সত্যিই যেন কতকটা ভদ্রলোক বাঙালিদের সংসর্গ ত্যাগ করবেন বলেই যেন সেই দূর পশ্চিমে তখনও রেল যোগাযোগহীন সাঁওতালদের দেশে গিয়ে এক নতুন দিকচিহ্নপুর গড়ে তুললেন।

২০১৯ শেষ হয়ে আসা একদিন চলে গিয়েছিলাম ভগ্ন মনোরথ বিদ্যাসাগরের শেষবেলার এই অন্তিম ঠিকানায়  সাঁওতাল পরগনার দিকচিহ্নহীন  এই শেষ ঠিকানায় যেখানে তিন বিঘা জমির ওপর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনের শেষ অঙ্কগুলোর কিছু অধ্যায় গল্পগাথা হয়ে আজও বাঙালি মনে মজুদ। এ দিকচিহ্নপুরেও তাঁর পিছু নিয়ে এসেছিলেন অনেকেই। যেমন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাই। তাঁর কার্মাটাঁড়ের স্মৃতিকথায় বিদ্যাসাগরের কার্মাটাঁড়ের দিনলিপি—সাঁওতালদের কাছে ভুট্টা কিনে তাদের পয়সা দেওয়া থেকে তাদের জন্য হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করা—এমন সাতসতেরো।

আসানসোল থেকে ভোররাতে ৩:২২-এর কলকাতা-যশিডি প্যাসেঞ্জার কার্মাটাঁড় পৌঁছে দিল প্রায় ভোর পাঁচটায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার আর নরম কুয়াশায় চারদিকে কিছুই ঠাওর করা যায় না। স্টেশন চত্বরের হালকা আলো আশ্বস্ত হবার মতো যথেষ্ট নয়। শুনেছিলাম যে সেই বাড়ি স্টেশনের খুব কাছেই। কিন্তু বিস্তারিত দিগনির্দেশ না নিয়েই পৌঁছেছি। কপাল ভালো, একজন প্রায় অন্ধকার ফুঁড়ে সামনে এসে হাজির হয়ে শুধাল, “কাঁহা যানা হ্যায়?”

বেশ ঘাবড়ে গিয়েই কবুল করলাম, “বিদ্যাসাগরজী কা মকান।”

“আইয়ে মেরে সাথ।” বলেই সে চলতে শুরু করল।

আক্ষরিক অর্থেই এ-গলি ও-গলি করে কিছুদূর গিয়ে এক বিশাল লোহার গেটের সামনে দাঁড় করিয়ে সে জানাল, “এহি হ্যায় মকান কা গেট। লেকিন আভি তো চৌকিদার গেট নেহি খোলেগা।”

আশ্বস্ত করলাম যে, চৌকিদারকে বলা আছে।

একথা শুনে সে যেমন এসেছিল তেমনি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। জীতেন্দ্র সাউ চৌকিদার সাহেব অবশ্য সেই ভোররাতেও ফোন ওঠালেন। জানালেন যে, ”দো মিনিট মে আ রাহা হু।”

আলো-আঁধারি আর কুয়াশায় মোড়া বিরাট চত্বরটায় ঢুকে ঠাওর হল না ঠিক কোথায় ঢুকলাম। চত্বরটার মধ্যে একটেরে একটা ঘরের দরজা খুলে  জীতেন্দ্র জানাল যে এটাই নতুন গেস্ট রুম। একটা প্রায় ন্যাড়া ছোটো ঘরে দুটো চৌকির ওপর ডাঁই করা তোষক আর কম্বল দেখে সেই ঠাণ্ডায় অন্য কোনও উপকরণের অভাব আর মাথায় থাকল না। ঘরের লাগোয়া বাথরুমটাও একটু ভরসা দিল। কম্বল বিছিয়ে, জলের ব্যবস্থা করে ভোর হলেই গরম চা জুটবে এই ভরসা দিয়ে জীতেন্দ্র চলে গেল। আলো না ফোটা অবধি ঘুমের চেষ্টা করতে হবে। সেই মাঝরাত থেকে হাড় হিম করা ঠাণ্ডার পর এতক্ষণে কিছুটা তো ওম জুটল।

ভোর হল।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে গরম চা এসেছিল। বেশ ক’বিঘা চত্বরটা তখন ভোরের সূর্যের আলোয় শেষরাতের কুয়াশামাখা আবছায়া থেকে বেরিয়ে চোখের সামনে আকার নিচ্ছে।

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বসতবাড়ি এই চত্বরটার ঠিক মাঝামাঝি। একেবারেই আড়ম্বরহীন, ছিমছাম কাঠামো। ঠিক যেন মানুষ বিদ্যাসাগরের ইট-কাঠের ঋজু অবয়ব। বাড়িটা প্রায় ভেঙেই পড়েছিল। যেমনটা হয় কালের নিয়মে। বিদ্যাসাগরের ছেলে নারায়ণচন্দ্র এ-বাড়ি বেঁচে দিয়েছিলেন কলকাতার জনৈক সিংহদাস মল্লিককে।

বিদ্যাসাগরের মতো মানুষের বাড়ি কেনার মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়ার বিনম্র প্রতিফলন আজও এই বাড়ির প্রবেশদ্বারে। এই সিংহদাস মল্লিকের থেকে ১৯৭৪ সালে এ-বাড়ি কিনে নেয় বিহার বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন (অবিভক্ত)। এরপর এই অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে এখানে চালু হয়েছিল অষ্টম শ্রেণী অবধি এক বিদ্যালয়। সে বিদ্যালয় অবশ্য শুনলাম বছর চারেক আগে উঠে গেছে। কারণ অনেক। সেসব সাতকাহনে এখন যাওয়ার কোনও সুযোগ বা দরকার নেই। বাড়ির ক’হাত দূরে চৌহদ্দির পাঁচিল ঘেঁষে একটা বয়োবৃদ্ধ আমগাছ। জীতেন্দ্রর কাছে শুনলাম যে, এই আমগাছ লাগিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর মশায় স্বয়ং। গরমে এই আমগাছ আজও জীতেন্দ্রর ছোটো পরিবারের নাস্তা জোগায়।

অদূরে ভেঙে পড়ে আছে সেই হোমিওপ্যাথি দাবাখানা  যেখানে নাকি বিদ্যাসাগর মশাই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করার চেষ্টা করতেন।

ভোরের নরম আলোয় গোটা চত্বরটায় এক নির্লিপ্ত প্রশান্তি। একটা বিরাট বাজপাখি এক লম্বা ইউক্যালিপটাসগাছের ওপর থেকে অনেকক্ষণ ধরেই আমার ওপর নজরদারি করছিল।

বিদ্যাসাগরের কাছে ভুট্টা বেচতে আসা সেইসব পাখির মতো সরল সাঁওতালরা আজ শুধুই স্মৃতিতে। কার্মাটাঁড়ে পৌঁছলাম যেদিন, সেই ২১ ডিসেম্বর ছিল ঝাড়খণ্ডে সদ্য হয়ে যাওয়া বিধানসভা নির্বাচনের শেষপর্ব। সেই ভুট্টা কিনতে আসা নির্বিকল্প সত্যবাদী সাঁওতালরা এখন শুধু বহুদূর ইতিহাসের পাতায়। তাদের গড়া সরকার বেশ ক’বার ঝাড়খণ্ড শাসনও করে ফেলেছে।

ভেঙে পড়া এ চত্বরটার পুনর্জন্মের কাহিনি শুনছিলাম চৌকিদারের কাছে।

“ইহা পর আভি যো ভি দেখ রহে হ্যায় না দাদা, ইসব কুছ নেহি থা। বাউন্ডারি টুটকে এ পুরা খুলা ময়দান বন গিয়া থা। পিছে বস্তিকা লোগ এহি পর কাচড়া গিরাকে চলা যাতা, ইধার সে আনে জানে কা রাস্তা বানা লিয়া সব।”

মানতেই হবে অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বিহার বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন এই চত্বরের তথা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মান রেখেছে। বাড়ির  জীর্ণোদ্ধার ও নতুন করে মেরামতে সরকারি সাহায্যও শুনলাম পাওয়া গেছে। ২০০২-তে অখণ্ড বিহারের থেকে বেরিয়ে আসা রাজ্য হিসাবে ঝাড়খণ্ডকে এখনও পূর্ণযৌবনা বলা চলে না। এ বাড়ির দেখভালে অখণ্ড বিহার সরকারের প্রথমদিককার মদত নেহাত কম ছিল না।

আমার বাকি সঙ্গীদের আসতে সেদিন দুপুর গড়াল। এশিয়াটিক সোসাইটির ডঃ জগৎপতি সরকার, বিশিষ্ট লেখক দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য এবং শান্তনু বন্দোপাধ্যায়। ক’দিন আগেই শান্তনুর কৃতী সম্পাদনায় জয়ঢাক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে বিদ্যাসাগরের ওপরে আধারিত একটি বই—ঈশ্বর এক নিঃসঙ্গ ফিনিক্স।

সে বইটি কার্মাটাঁড়ে খোদ বিদ্যাসাগরের বাড়িতে উন্মোচনের পরিকল্পনা ছিল প্রকাশকদের। পরদিন সকালে আগে থেকেই পরিকল্পিত ছিল সে অনুষ্ঠান। অবশ্য বললাম বটে অনুষ্ঠান, কিন্তু তেমন হাঁকডাকের কিছু করার কথা ইচ্ছা করেই ভাবা হয়নি। স্থানীয় কিছু মানুষের সক্রিয় যোগদানে ,কথায় ও স্মরণে হালকা ফুলমালায় বিদ্যাসাগরের বাড়িতেই হল সে বইয়ের নব উন্মোচন। সাক্ষী থাকল প্রাঙ্গণের এক বিশাল বট, অনেক আকাশচরা পাখি, আদিগন্ত টাঁড়-ভূমি, এমনকি চৌকিদারের পোষা ছাগলগুলোও। আর হ্যাঁ, বিদ্যাসাগরের বাড়িতে এখন যে এক সেলাই স্কুল চলে, তার বড়দিদিমণি আর ছোট্ট কিছু মেয়েরা। অল্পক্ষণের এ অনুষ্ঠানের পর স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে বসেছিলাম বিদ্যাসাগরের ব্যবহৃত বৈঠকখানায়।

স্থায়ী উদ্যোগের ও সর্বোপরি অর্থের অভাবে যে অনেক কিছুই ঠিকঠাক চলতে পারছে না সে আফসোস শুনলাম স্থানীয়দের মুখে। কে না জানে এ পরিস্থিতি শুধু যে এখানেই তাই নয়। কমবেশি সর্বত্র। জাতি হিসেবে আমরা কোনোদিনও যে উদ্যোগী ছিলাম অন্তত ইতিহাসে তার প্রমাণাভাব। কিন্তু বেঁটেখাটো লতাগুল্মের মাঝে হঠাৎ করে কখনও কিছু বিদ্যাসাগরের মতো মহীরুহ জন্মে গিয়ে আমাদের বিপদে ফেলে যান। ফিরে গিয়ে সাধ্যমতো কিছু করার আশ্বাস দিলাম আমরা সকলেই।

সেদিন বিকালে ৩:৫০-এর যশিডি-আসানসোল প্যাসেঞ্জারে ফিরছিলাম। প্রায় ১৫০ বছর আগের টাঁড়-ভূমিতে হারিয়ে যাওয়া একটুকরো অতীত থেকে আবার একালে। তারপর দিনই নির্বাচনের ফল। আবার যে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা সরকার গড়তে চলেছে সে আভাস ছিল। ভাবছিলাম যে মাত্র ১৫০ বছর আগের সেই ভুট্টা খেতে আসা মানুষগুলো সদ্যোজাত ঝাড়খণ্ডে আবার তাদের সরকার গড়তে চলেছে। ১৫০ বছরের মাপকাঠিতে পরিবর্তন হিসেবে এই বা কম কী! বিদ্যাসাগর মশায় দেখলে খুশিই হতেন।

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ চন্দন মুখার্জি, কার্মাটাঁড়

জয়ঢাকের ভ্রমণ লাইব্রেরি

1 thought on “ভ্রমণ মিশন কার্মাটাঁড় দেবজ্যোতি গঙ্গোপাধ্যায় বর্ষা ২০২০

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s