দৃপ্ত বর্মন রায়ের আগের লেখা (উপন্যাস) অদ্ভুত আঁধার
দৃপ্ত বর্মন রায়
বেশ কিছুদিন ধরেই ফটিকের মনটা খুব খারাপ। কাজে-কম্মে কিছুতেই সুবিধে করে উঠতে পারছে না সে। এ নিয়ে কাল রাতে তো ঠাকমার সঙ্গে একচোট ঝগড়াই হয়ে গেল তার। ঝগড়া-টগড়া করে ঠাকমা রাগ দেখিয়ে রাতে কিছু না খেয়ে শুয়ে পড়ার পর আবার সেই সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই গজর গজর শুরু করে দিয়েছে। একবার ফটিক ভেবেছিল দুচ্ছাই বলে বেরিয়েই যাবে ঘর থেকে। তারপর আবার মনে হল যে এই বিশ্ব সংসারে তার আপন বলতে তো একমাত্র এই বুড়িটাই টিকে আছে। মা তো এতই ছোটবেলা মারা গেছে যে চেষ্টা করলেও মার মুখটা তার মনে পড়ে না। দু’বছর আগে যক্ষ্মায় বাবাও মরে গেল। তারপর থেকে এই ঠাকমার সঙ্গেই তো থাকে সে।
দুপুরে কলমিশাক দিয়ে চাট্টি ভাত খেয়ে পুকুরপাড়ে বসে গাছ থেকে একটা ডাঁসা পেয়ারা পেড়ে খেতে খেতে ঠাণ্ডা মাথায় ফটিক ভেবে দেখল, ঠাকমার কথা তো কিছু ভুল নয়। বুড়ি এই বয়সেও রোজ পরের বাড়ি এটা সেটা খেটেখুটে দুটো পয়সা আনে ঘরে। তাই দিয়ে কোনোমতে তাদের দু’জনের দিন চলে। আর সে সামনের আষাঢ়ে সতেরোয় পড়বে, বলতে গেলে সারাদিন টই টই ছাড়া আর প্রায় কিছুই করে না। মাঝে মাঝে মাসে একবার দু’বার লোকের বাড়ির উঠোনের আগাছা কেটে দিয়ে বা গাছে উঠে সুপুরি পেড়ে বা পুকুরের কচুরিপানা সাফ করে যদি বা কিছু পয়সা পায়। কিন্তু গাঁয়ে সাধারণত সবাই নিজের বাড়ির কাজ নিজেরাই করে। তাই কখনও মাসের পর মাস কিছুই জোটে না। তাই ঠাকমা বলছিল এভাবে শুয়ে বসে দিন না কাটিয়ে বাপ-ঠাকুরদার রাস্তায় চলে একটু রুজি-রোজগারের চেষ্টা করতে।
ফটিকের বাপ, ঠাকুরদা দু’জনেই ছিল চোর। শুধু চোর বললে তাদের খাটো করা হবে, বলা ভালো তারা ছিল নামকরা চোর। আশেপাশের পাঁচটা দশটা গাঁয়ের লোক একডাকে তাদের চিনত। ঠাকমার কাছে গল্প শুনেছে ফটিক, যে তার ঠাকুরদা ব্রজলাল নাকি একবার গ্রামের জমিদার দুর্জয়চন্দ্রের মেয়ের বিয়েতে বরকর্তা হিসেবে আসা পাশের গ্রামের জমিদার তারিণীবাবুর সোনার জল দিয়ে নাম লেখা রুপোর নস্যির কৌটো বিয়ের আসরেই হাওয়া করে দিয়েছিল। ব্যাপারটা ঘটেছিল এইরকম—
তারিণীবাবুর ছেলের সঙ্গে দুর্জয়চন্দ্রের মেয়ের বিয়েতে বাকি সবার মতো ব্ৰজলালেরও নেমন্তন্ন ছিল। তখনকার দিনে বিভিন্ন গ্রামের জমিদারদের মধ্যে কার গ্রাম সেরা এই নিয়ে একটা চাপা রেষারেষি চলত। বিয়ের আসরে তারিণীবাবুর সবেতেই হামবড়াই ভাব দেখাচ্ছিলেন। তাঁদের গ্রামের বটগাছটা বেশি পুরনো, তাঁদের গ্রামের জগত ময়রার রসগোল্লার সাইজ বেশি বড়ো, তাঁর নস্যির কৌটোর মতো শৌখিন নস্যির কৌটো এ তল্লাটে আর কারোর কাছে নেই, তাঁদের গ্রামের কালীমন্দিরের উচ্চতা বেশি—আরও কত কী। দুর্জয়বাবু ব্ৰজলালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর তিনি তাঁর পাশে বসা বরযাত্রী কালু চোরকে দেখিয়ে বলেন তাঁদের গ্রামের কালুর মতো চোর নাকি ভূ-ভারতে আর একটাও নেই। অথচ বছর খানেক আগেও কালু ব্ৰজলালের কাছে তালিম নিতে আসত। এই ঢাক পেটানো সহ্য করতে না পেরে দুর্জয়বাবু ব্ৰজলালের কানে কানে আদেশ দেন যে যেভাবেই হোক তারিণীবাবুকে দেখিয়ে দিতে হবে তাঁদের গ্রামও কোনও অংশে কিছু কম যায় না। ব্রজলালও দুর্জয়বাবুর আদেশ শিরোধার্য মেনে তারিণীবাবুর পাশে বসে নানা গল্প জুড়ে দিল। গল্পের ফাঁকে তারিণীবাবু একসময় নস্যি নেবার জন্যে তাঁর পাঞ্জাবির পকেট থেকে নস্যির কৌটোটা বের করেছিলেন। তখন তাঁর বাঁহাতে ধরা নস্যির কৌটোটার ঢাকনা খোলা আর ডানহাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে কিছুটা নস্যি বের করে নেবার এইটুকু সময়ের মাঝে ব্রজলাল তারিণীবাবুর বাঁহাত থেকে নস্যির কৌটোটা সরিয়ে সামনে রাখা পানের বাটা থেকে একই মাপের চুনের কৌটোটা সেই হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। এতটাই নিপুণভাবে সে কাজটা করেছিল যে তারিণীবাবু টেরই পাননি যে নস্যির কৌটো হাওয়া হয়ে গেছে আর উনি নস্যির বদলে নাকে চুন ঘষছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে হইচই পড়ে যেতেই অবশ্য ব্রজলাল ক্ষমা-টমা চেয়ে কৌটোটা তাঁকে ফেরত দিয়ে দিয়েছিল। তখনকার দিনে মানুষেরা গুণীদের কদর করতে জানতেন। তাই তারিণীবাবু ব্ৰজলালের এই ক্ষমতায় আশ্চর্য হয়ে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন আর সেদিনের মতো অন্তত ঢাক পেটানোটা বন্ধ করেছিলেন। দুর্জয়বাবুও এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই গ্রামের নাম উজ্জ্বল করার জন্যে ব্রজলালকে ‘চোরশ্রী’ উপাধি দিয়েছিলেন।
ফটিকের বাপ হরিপদ, সেও কিছু কম ছিল না বটে। সে এমনই ওস্তাদ চোর ছিল যে তাকে নাকি আশেপাশের গাঁ থেকে অন্য চোরেরা ভাড়া করে নিয়ে যেত চুরি করার জন্যে। সে নাকি কোনও বাড়িতে চুরি করতে ঢোকার আগে এমন মন্ত্র পড়ত যে সেই বাড়ির সব মানুষেরা তো বটেই, কুকুর, বেড়াল এমনকি মশা-মাছিগুলোও নাক ডাকিয়ে ঘুমোত। একবার টাউনের থানার বড়বাবু এক গেরস্থর বাড়িতে চুরির দায়ে বিনা দোষে হরিপদকে একরাত হাজতে পুরে রেখেছিলেন। হরিপদ বারবার তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে এমন আনাড়ির মতো কাজ তার নয়। সে এই চুরি করেনি। কিন্তু বড়বাবু বিশ্বাস করেননি। পরেরদিন আসল চোর ধরা পড়ায় হরিপদ ছাড়া পায়। এই হেনস্থার জন্যে বড়বাবুকে শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে দু’দিন বাদে হরিপদ রাতেরবেলা তাঁর বাড়িতে ঢুকে কিছু কম দামি টুকিটাকি জিনিসপত্র যেমন টেবিল ঘড়ি, রেডিও, বড়বাবু আর বড়বাবুর গিন্নির ফটোসহ ফটো-ফ্রেম, কিছু বাসনকোসন, বড়বাবুর আন্ডার-অয়্যার এইসব চুরি করে সেই রাতেই থানায় গিয়ে ঝিমোতে থাকা বাকি পুলিশদের চোখ এড়িয়ে বড়বাবুর ফাইল রাখার আলমারিতে সেগুলো রেখে এসেছিল। পরেরদিন সারা সকাল বাড়িতে চুরি হয়েছে বলে গিন্নির গালমন্দ খেয়ে আর বাকি পুলিশদের ওপর হম্বিতম্বি করে দুপুরবেলা থানায় এসে আলমারি খুলে জিনিসগুলো ফিরে পেয়ে বড়বাবুর মুখখানা নাকি দেখবার মতো হয়েছিল।
এই বাপ-ঠাকুরদার রক্ত যার শরীরে বইছে, সেই ফটিকের কিন্তু চুরি করতে একেবারেই ভালো লাগে না। একে তো সে রাতেরবেলা একদমই জেগে থাকতে পারে না, খালি ঘুম পায় তার। তার ওপর চুরি করার নাম শুনলেই তার হাত-পাগুলো কেমন জানি ঠাণ্ডা হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করতে শুরু করে। খালি ভয় হতে থাকে এই বুঝি কেউ দেখে ফেলল, সে ধরা পড়ে গেল। এমনিতেই লিকপিকে শরীর, ধরা পড়লে যে পিটুনি খেতে হবে এই ভয়েই চুরির নামে জ্বর চলে আসে তার। কী জন্যে যে লোকে বলে ‘চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা’ এটা সে কিছুতেই ভেবে পায় না। কিন্তু পেট চালাতে গেলে কিছু তো একটা করতেই হবে আর শুধু ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়া ফটিককে কেই বা কাজ দেবে। তাই উপায় না দেখে আর ঠাকমার মুখ ঝামটা খেয়ে তাকেও মাঝে মাঝে চুরি করতে বেরোতে হয়েছে। কিন্তু মুশকিলটা হল যতবারই সে চুরি করতে গেছে, সে দেখেছে প্রত্যেকবারই কেউ না কেউ কিছু না কিছু একটা গণ্ডগোল পাকিয়েছে। এই তো যেমন গেল মাঘ মাসে বিপুল ঘোষের বাড়িতে রাত দুটোর সময় সবে সে রান্নাঘরের গরাদ কেটে সেঁধিয়েছে, খুট করে কোথায় জানি একটা আলো জ্বলে উঠল। তড়িঘড়ি রান্নাঘরের বড়ো মিটসেফটার আড়ালে লুকিয়ে সে দেখল বিপুল ঘোষের মা ক্ষমাসুন্দরী ঠাকমা জল খাবে বলে ঘুম থেকে উঠেছে। রান্নাঘরটা ছিল বেশ বড়ো আর আশি বছরের বুড়ি দিনেরবেলাতেই চোখে ভালো দেখতে পেত না, তাই ফটিক আশা করেছিল যে আধো অন্ধকারে বুড়ি হয়তো তাকে দেখতে পাবে না। কাকের মতো চোখ বন্ধ করে ঘাপটি মেরে বসে ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই চুলের মুঠিতে একটা প্রচণ্ড টান আর পিঠে কয়েকটা খুন্তির বাড়ি খেয়ে তার ভুল ভাঙল। বুড়ি তাকে দেখতে তো পেয়েইছে, তার ওপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করেছে, “তবে রে হারামজাদা বিপুইল্যা, মাঝরাতে উইঠ্যা চুরি কইর্যা দুধ খাইতাসস। এই লাইগ্যা সকালে দুধ জ্বাল দেওনের সময় দুধ কম কম লাগে। রাখ! তোর দুধ খাওন বাইর করতাসি।” ফটিক বুঝল বুড়ি ভুল করে তাকে তার ছেলে বিপুল ভেবে বসেছে আর ধরে নিয়েছে বছর পঞ্চাশের বিপুল ঘোষ রাতে নিজের রান্নাঘর থেকেই দুধ চুরি করে খাচ্ছে। এদিকে বুড়ির চিৎকারে ততক্ষণে বাকি ঘরগুলোতেও আলো জ্বলে উঠতে শুরু করে দিয়েছে। লোকজনের গলাও শোনা যাচ্ছে। বিপদ দেখে ফটিক নিজের মাথার ঝাঁকড়া চুলের বেশ কয়েকগাছা ঠাকমার কাছে জমা রেখে কোনোমতে যে-পথে ঢুকেছিল, সেই পথেই পালিয়ে এসে বেঁচেছিল।
কিন্তু তার দু’মাস বাদে মদন পালের বাড়ির ঘটনাটা। দু’দিন বাদে মদন পালের নাতির অন্নপ্রাশন উপলক্ষে প্রচুর লোকজন ছিল বাড়িতে। ব্যাপার বাড়িতে চুরি করলে লাভ, তাই সন্ধে-সন্ধেই ফটিক এক ফাঁকে বড়ো ঘরের খাটের তলায় ঢুকে ঘাপটি মেরে বসে ছিল। ইচ্ছে ছিল রাত বাড়লে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বেরিয়ে এসে টুকটাক কিছু জিনিসপত্র নিয়ে কেটে পড়বে। কিন্তু খাটের তলায় যে এত মশা সে কী করে জানবে? অনেকক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করার পর সে ক্ষেপে গিয়ে নিজের পায়ের ওপর কামড়াতে থাকা একটা মশাকে মারার জন্যে চটাস করে একটা চড় মেরেছিল। খাটের ওপর বসে মদন পালের দুই ছেলে তখন খরচের হিসেব করছিল। হঠাৎ খাটের তলায় চাঁটির শব্দ শুনে অবাক হয়ে উঁকি মেরে দেখে ফটিক। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘরভর্তি লোক জড়ো হয়ে গেল। একই গাঁয়ের ছেলে আর ব্রজলাল-হরিপদর বংশধর বলে সেদিন যদিও অল্পের ওপর দিয়েই ছাড়া পেয়েছিল, তা সত্ত্বেও মদন পালের বুড়ো হাড়েও যে কত তাকত সেটা ভালোরকম টের পেয়েছিল ফটিক। মদনের দু’খানা কিলের চোটে প্রায় এক হপ্তা পিঠ সোজা করতে তার কষ্ট হত। কিন্তু আসল ব্যথাটা তো আর গতরে লাগেনি, লেগেছিল মনে। কম অপমানটা তো সইতে হয়নি সেদিন তাকে। বাগে পেয়ে কত কথাই না শুনিয়ে দিয়েছিল সবাই। ‘’ছিঃ ছিঃ, তোর লজ্জা করে না!’, ‘হরিপদর ছেলে, ব্রজলালের নাতি হয়ে তুই কিনা শেষে চুরি করতে এসে ধরা পড়লি!’, ‘অকালকুষ্মাণ্ড, তোর বাপ-ঠাকুরদার নাম ডোবালি তুই।’, ‘কুলাঙ্গার, বংশের মুখে কালি লেপে দিলি।’ ইত্যাদি আরও কত কী। রাগে, দুঃখে ফটিক বেশ ক’দিন বাড়ি থেকে বেরোনোই বন্ধ করে দিয়েছিল।
তারপরে মাস খানেক আগে আবার যেদিন ঠাকমার তাড়ায় চুরি করতে বেরোল সেদিনও হল আরেক কেলো। নিজের গ্রামে আগের দু’বার এরকম কাণ্ড করে সেদিন সে ঠিক করেছিল পাশের গ্রামে জীবন হালদারের বাড়িতে চুরি করবে। জীবন হালদার বেশ পয়সাওয়ালা লোক। মস্ত বড়ো জমিতে বাড়ি বানিয়ে থাকে। মদন পালের মতো তার বাড়িতেও ফটিক সন্ধে থাকতেই চুপি চুপি ঢুকে খাটের তলায় লুকিয়ে বসে ছিল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, এবার যতই মশা কামড়াক না কেন, কিছুতেই সে টুঁ শব্দটি করবে না। কিন্তু সেই যে কথায় বলে না, কপালে নেই ঘি, ঠকঠকালে হবে কী? গণ্ডগোল সেবারেও হল। তবে এক্ষেত্রে গণ্ডগোলটা আর মশারা পাকায়নি, পাকিয়েছিল পাকা আম। যে খাটের তলায় ফটিক লুকিয়েছিল, সেই খাটের তলায় রাখা ছিল জীবন হালদারের বিরাট আমবাগানের এক ধামা গাছপাকা হিমসাগর আম। লোভ সামলাতে না পেরে একটা দুটো করে করে চার-চারটে আম সাবড়ে দিয়েছিল সে। তখন কি আর সে জানত যে আম খেলে মারাত্মক ঘুম পায়? গভীর রাতের অপেক্ষা করতে করতে কখন যে তার চোখ লেগে গিয়েছিল, সে নিজেও বুঝতে পারেনি। তার সেই ঘুম যখন ভাঙল সূর্যি ততক্ষণে মাথার ওপর, মস্ত বেলা হয়ে গেছে। ঘরের সব লোকজন উঠে পড়েছে। দিব্যি গেরস্থালির কাজকর্ম শুরু হয়ে গেছে। ফটিক দেখল মহাবিপদ। এখন হয় আবার সেই রাত অবধি ঘাড় গুঁজে খাটের তলায় অপেক্ষা করা, নাহলে আবার ধরা পড়ে নিজের সঙ্গে বাপ-ঠাকুরদা সবার নাক কাটানো। কী করবে, কী না করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না সে। শেষপর্যন্ত আর উপায় না দেখে কোনও এক ফাঁকে হঠাৎ এক বাড়ি লোকের মাঝখান দিয়ে সবাইকে চমকে দিয়ে খাটের তলা থেকে বেরিয়ে চোঁ চাঁ দৌড়ে সে-যাত্রা কোনোরকমে নিজের কান আর মানটা বাঁচিয়েছিল ফটিক।
বারবার কোনও কাজে এরকম বাধা পড়লে কারুর কি আর সেই কাজ করার ইচ্ছে থাকে? ফটিকও তাই ঠিক করেছিল, আর যাই হোক না কেন, চুরিচামারির পথে আর সে কোনোদিন হাঁটবে না। কিন্তু সেকথা ঠাকমাকে কে বোঝাবে? দু’দিন ধরে বুড়ি খালি কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছে। ফটিক বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে সে আর কোনোদিন চুরি করতে রাজি নয়। কিন্তু বুড়ি তাতে প্রথমে তার বাপ-ঠাকুরদার নানা মহান কীর্তিকথা আওড়ে তাকে উৎসাহ দেবার চেষ্টা করেছে। শেষে তাতেও কাজ না হওয়ায় কাল রাত থেকে সরাসরি কথা বলা বন্ধ করে ভাববাচ্যে কথা বলছে, বাসনকোসন দুমদাম শব্দ করে করে নাড়াচ্ছে, সমানে গজগজ করে চলেছে আর কিছুক্ষণ পরপর ফটিকের এই দুর্দশা দেখে ওপরে বসে তার বাপ-ঠাকুরদা কত কষ্ট পাচ্ছে এই ভেবে ভেবে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে চোখের জল ফেলছে। তাও সে সব চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছিল। কিন্তু যখন ঠাকমা কাল রাতে উপোস করার পর আজ দুপুরেও ফটিকের খাওয়া শেষ হতে না হতেই ভাতের হাঁড়ি গুটিয়ে রেখে আবার না খেয়ে বারান্দায় চাটাই পেতে শুয়ে পড়ল, তখন ফটিক আর সহ্য করতে পারল না। মনে মনে ভাবল, ঠিক আছে, এত করে যখন বলছে, তখন না হয় বুড়ির কথায় আরেকবার চেষ্টা করে দেখাই যাক। তবে এবার আর নিজের গ্রাম বা আশেপাশের গ্রামে নয়। চুরি যদি করতেই হবে, এবার শহরে গিয়ে চুরি করার চেষ্টা করবে। সে শুনেছে শহরে নাকি সবার প্রচুর টাকা। একবার যদি কোনও বাড়িতে ঢুকে ভালোরকম একটা দাঁও মারতে পারে তাহলে পরের কয়েকমাস বুড়ি একটু শান্ত থাকবে। সেই ফাঁকে সে ঠিক একটা না একটা ছোটোখাটো ভদ্রস্থ কাজ জুটিয়ে নেবে।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। পেয়ারাটা শেষ করে সে গুটিগুটি পায়ে ফিরে এসে দেখল ঠাকমা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরে ঢুকে তোষকের তলা থেকে গোটা ত্রিশেক টাকা আর কুলুঙ্গিতে টাঙানো ঝোলাটা নিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল সে। এই ঝোলাটা তার বাবার। কী না আছে এতে, একটা ছোটো লোহা কাটার করাত, একগাদা ছোটোবড়ো চাবি, একটা ছোটো বাটালি আরও বেশ কিছু চুরির কাজে লাগার যন্ত্রপাতি। বেরিয়ে এসে ঠাকমাকে ডাকতে গিয়েও একবার থমকাল সে। ভাবল, থাক ঘুমোক বুড়ি। ফটিককে রাজি করাতে দু’দিন ধরে কসরত তো আর কম করেনি। এখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে যখন, ঘুমোক। জেগে উঠে ঘরে ঝোলাটা দেখতে না পেলেই বুঝে যাবে ফটিক কোথায় গেছে। আর রাতে সে বাড়িতে থাকার থেকে না থাকলেই যে বুড়ি বেশি খুশি হয় এটা এতদিনে ফটিক ভালোরকম বুঝে গেছে।
আধঘণ্টা পায়ে হেঁটে বাস-রাস্তায় এসে তারপর আরও ঘণ্টা দেড়েক বাসে চড়ার পর, বাসটা যখন শহরের রেলস্টেশনের সামনে এসে ফটিককে নামিয়ে দিল, স্টেশনের বড়ো ঘড়িতে সে দেখল সবে সাড়ে ছ’টা বাজে। হাতে এখনও মেলা সময়। চুরি করতে বেরোতে হলে বেরোতে হবে সেই রাত দেড়টা-দুটোয়। কিন্তু সমস্যাটা হল এতটা সময় সে কাটাবে কী করে? স্টেশনের পাশের একটা চায়ের দোকানে এক ভাঁড় চা খেয়ে, বেঞ্চের ওপর রাখা খবরের কাগজটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে, আশেপাশের রাস্তায় ইতিউতি ঘুরে, টাউনের আলো-ঝলমলে দোকানপাটগুলো বাইরে থেকে জুলজুল চোখে দেখে, রাতে স্টেশনের পাশেই আরেকটা ছোটো দোকানে দুটো রুটি আর তরকারি খেয়েও ফটিক দেখল হাতে আরও ঘণ্টা চারেক সময় রয়ে গেছে। তখন বাকি সময় কাটানোর জন্যে ঝোলাটা কোলে নিয়ে ফুটপাথেই পাঁচিলের গায়ে হেলান দিয়ে একটু চোখ বুজল সে।
না, এবার আর একঘুমে রাত কাবার নয়। আগেরবারের ভুলের জন্যে একটু সতর্কই ছিল সে। তাই পুরোপুরি ঘুমোয়নি, ঢুলছিল শুধুমাত্র। শেষপর্যন্ত যখন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল ঘড়িতে তখন পৌনে দুটো। রাস্তাঘাট শুনশান। আড়মোড়া ভেঙে সামনের রাস্তা ধরে এগোল ফটিক। কিছুদূর এসেই বুঝল প্রত্যেকবারের মতো এবারেও একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে আর এবার গণ্ডগোলটা পাকিয়েছে চাঁদ। তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সে খেয়ালই করেনি আজ পূর্ণিমা। এখন তাকিয়ে দেখল আকাশজোড়া মস্ত থালার মতো একখানা চাঁদ উঠেছে। মাঝে মাঝে সেটা মেঘের আড়ালে গেলে একটু অন্ধকারমতো হয় বটে, কিন্তু মেঘ সরে গেলেই জোছনার এতটাই আলো হয় যে অনায়াসে একটা ছুঁচে সুতো পরানো যাবে। কিন্তু কী আর করা? এতটা এগিয়ে এসে এখন আর পিছু হটার কোনও মানে হয় না। তাই মনে মনে একটু দমে গেলেও সে সামনের দিকেই হাঁটা লাগাল।
বেশ কিছুক্ষণ বিভিন্ন রাস্তায় অলিতে গলিতে হাঁটাহাঁটি করেও চুরি করার মতো একটাও বাড়ি খুঁজে পেল না ফটিক। প্রায় প্রত্যেকটা বাড়িই এক মানুষ বা দেড় মানুষ উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সেই পাঁচিলেও আবার পেরেক, কাচ এসব বসানো। যদি বা অনেক খুঁজেপেতে কয়েকটা বাড়ি পাওয়া গেল যেগুলোতে পাঁচিল নেই, সেই বাড়িগুলোর আবার জানালা-দরজা সব টাইট করে বন্ধ। তাও বা যদি একটা দুটো বাড়ি এমন পাওয়া গেল যেগুলোর জানালা খোলা, সেগুলোতে কোনও না কোনও ঘরে আলো জ্বলছে, মানে কেউ না কেউ জেগে আছে। হতাশ হয়ে মনে মনে নিজের পোড়া কপালকে দুষতে দুষতে এগিয়ে চলল সে।
কিছুক্ষণ আরও হাঁটার পর একটু দূরে একটা বাড়ি দেখে তার মনে হল যে এই বাড়িটা চুরি করার জন্য বেশ উপযুক্ত। যে রাস্তাটা দিয়ে সে হাঁটছিল, সেটা সামনে গিয়ে ডানদিকে আর বাঁদিকে দু’ভাগ হয়ে একটা তেমাথা তৈরি করেছে। এই তেমাথাটার একদম কোনার দিকের জমিতে সেই বড়ো একতলা বাড়িটা। সে বাড়িটার পিছন দিকটা দেখতে পাচ্ছিল। বেশ কিছুটা খালি জায়গা ছেড়ে তারপর বাড়িটার পিছনের দরজা। পাশে একটা খোলা জানালা। শিক আছে, তবে সেটা কাটা কোনও সমস্যা হবে না। পাঁচিল একটা আছে বটে, তবে মাত্র আধ মানুষ উঁচু, টপকাতে কোনও অসুবিধে হবে না তার। পিছন থেকে তো কোনও আলো না দেখে মনে হচ্ছে সবাই ঘুমিয়েই রয়েছে। খুশি হয়ে সে পাঁচিলটা টপকাতেই যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎই মনে হল একবার সামনেটা দেখেই আসা যাক না কেন।
এগিয়ে এসে ফটিক দেখল বাড়িটার সামনের দিকেও বেশ খানিকটা খালি জায়গা। একটা ছোটো গেটও রয়েছে। বাড়ির সদর দরজার ওপরে একটা আলো জ্বলছে, তার নিচে একটা বড়ো সাইন বোর্ড। ফটিক ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে, কষ্ট করে বাংলা পড়তেও পারে। কৌতূহলবশত সাইনবোর্ডে কী লেখা আছে সেটা পড়তে শুরু করল। প্রথম শব্দটা পড়ে সে বুঝল এটা সেই শহরটার নাম। তারপর যেই দ্বিতীয় শব্দটার ‘থ’-এ আকার আর ‘ন’-এ আকার অবধি পড়েছে, আপনা থেকে তার মাথার চুলগুলো সব খাড়া হয়ে গেল। কী সব্বোনাশ! এটা থানা? আরেকটু হলেই সে ভুল করে একদম সিংহের গুহায় ঢুকে পড়ছিল। তার হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করল। কী করবে, কী না করবে কিছু বুঝতে না পেরে সে হাঁ করে থানার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময় হয়তো ভিতর থেকে এত রাতে তাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন পুলিশ বেরিয়ে এসে হাঁক পাড়ল, “এই! কে রে? কে রে ওখানে?”
সেই হাঁক শুনে আর পারল না ফটিক, পড়ি কি মরি করে দৌড়াল সামনে দিকে। এই দৌড়টা যদি সে মাঝরাতে শহরের শুনশান রাস্তায় না দৌড়ে অলিম্পিকে দৌড়ত, ভারতের একটা না একটা মেডেল বাঁধা ছিল। থানার কয়েকশো মিটার দূরে রাস্তায় বেশ কয়েকটা নেড়ি কুকুর শুয়ে বসে গুলতানি করছিল। হঠাৎ করে একটা চিমসেমতো উটকো লোককে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে দেখে তারাও খুব ব্যস্ত হয়ে চিৎকার করে পাড়া মাথায় করে তুলল। দুয়েকটা কুকুর তো আবার তাড়া করে বসল ফটিককে। সেই দেখে ফটিকের দৌড়ের বেগ গেল আরও বেড়ে। প্রাণপণে আরও মিনিট দশেক দৌড়নোর পর যখন ফটিক দেখল যে সে থানা থেকে বেশ অনেকটা দূরে চলে এসেছে, হতচ্ছাড়া কুকুরগুলোও আর পিছনে তাড়া করছে না, তখন সে দৌড় থামিয়ে রাস্তার ধারে বসে জিভ বের করে হ্যা হ্যা করে হাঁপাতে লাগল। তার তখন মনে হচ্ছিল, ‘চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা’ কথাটা যে বলছে তাকে যদি সে এই মুহূর্তে একবার হাতের সামনে পেত, একেবারে থান ইট ছুড়ে মাথা ভেঙে দিত।
এমন সময় সামনে হাত ত্রিশেক দূরে তার চোখে পড়ল বাড়িটা। ছুটতে ছুটতে সে এমন জায়গায় এসে পড়েছিল যেখানে লোকবসতি কিছুটা কম। খালি খালি জায়গাটা, বেশ দূরে দূরে একেকটা করে বাড়ি। তার সামনে একটা বড়ো মাঠের একপাশে সেই ছোটো বাড়িটা। এটাও একতলা। পাঁচিল-টাচিলের কোনও বালাই নেই। আবার মনটা আনচান করে উঠল ফটিকের। শেষপর্যন্ত কি ভগবান তার দিকে মুখ তুলে চাইলেন? তবে সাবধানের মার নেই বাবা। আরেকটু হলেই আগেরবার কী বিপদেই না পড়ছিল সে। এবার তাই সন্তর্পণে সে বাড়িটাকে একবার পাক খেয়ে দেখে নিল। নাহ্, সব তো ঠিকঠাকই মনে হচ্ছে। এবার মনে হয় আর খালি হাতে ফিরতে হবে না। মনে মনে ঠাকুরকে ডাকতে ডাকতে বাড়িটার পিছন দিকের একটা খোলা জানালার শিক কাটতে শুরু করল সে।
বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল শিকটা কাটতে। তারপর দুরুদুরু বুকে নিজের শরীরটা গলিয়ে ভিতরে ঢুকল সে। কিছুক্ষণ সময় নিল অন্ধকারে চোখটা ধাতস্থ করতে। কিছুক্ষণ পর যখন অন্ধকারটা সয়ে এল সব দেখেশুনে সে আন্দাজ করল এটা মনে হয় বাড়িটার রান্নাঘর। দেওয়ালে বেশ কিছু তাক, যদিও একদম খালি। ঘরের কোণে একটা স্টোভ। একপাশে একটা জলের কল। তার তলায় একটা এঁটো থালা রাখা। একপাশে একটা জলের ফিল্টার আর তার নিচে একটা স্টিলের গ্লাস। এছাড়া বাসনকোসন আর কিছু নেই ঘরে। কিছু না পেয়ে বউনি হিসেবে গ্লাসটাকেই ঝোলায় পুরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরটাতে এল ফটিক।
এই ঘরটা বেশ বড়ো। ডানদিকে বাড়িটাতে ঢোকার দরজা। উলটোদিকে দুটো শোবার ঘরে ঢোকার জন্যে আরও দুটো দরজা। ফটিক মনে মনে ভাবল সম্ভবত এটা বসার ঘর। যদিও বসার জন্যে কোনও সরঞ্জাম নেই। অবশ্য শুধু বসার জন্যে কেন, আদতে সাধারণ গৃহস্থবাড়িতে বসার ঘরে যেসব আসবাবপত্র থাকে যেমন সোফাসেট, চেয়ার, টেবিল, টিভি, বইয়ের তাক ইত্যাদি, সেসব কিছুই নেই ঘরটাতে। পুরোপুরি খালি, একদম খা খা করছে। ফটিক বেশ অবাক হল, তবে কি কেউ থাকে না নাকি বাড়িটাতে?
নাহ্, তা তো নয়। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়েই ফটিক দিব্যি শুনতে পেল উলটোদিকের একটা শোবার ঘর থেকে ভয়ংকর নাক ডাকার আওয়াজ ভেসে আসছে। আস্তে আস্তে ওই ঘরটার দিকে এগোল সে। সন্তর্পণে ভেজানো দরজাটা ঠেলল। শোবার ঘরটাও বেশ বড়োই। এককোণে একটা ফোল্ডিং খাট। আর তাতে একটা দশাসই চেহারার দামড়া লোক হাঁ করে ঘুমিয়ে প্রাণপণে নাক ডাকাচ্ছে। নাক ডাকার তালে তালে তার ভুঁড়িটা একবার উঠছে, আবার নামছে। এমন ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে লোকটা যেন গায়ের ওপর দিয়ে একপাল মোষ হেঁটে গেলেও সেই ঘুম ভাঙবে না। এই খাটটা আর লোকটা ছাড়া এই ঘরটাও আগের ঘরটার মতোই এক্কেবারে ফাঁকা। চুরি করার মতো কিছু নেই। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল ফটিকের। ইচ্ছে করছিল রান্নাঘর থেকে জলভরা ফিল্টারটা তুলে এনে সবটা জল হড়হড় করে ঢেলে দেয় লোকটার মাথায়। অনেক কষ্টে ইচ্ছেটা সংবরণ করে ধীরে ধীরে ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসে আলতো করে দরজাটা আবার ভেজিয়ে দিল সে।
খুব ক্লান্ত লাগছিল ফটিকের। এত কষ্ট করে এতদূরে এসেও শেষে কিনা আবার সেই অন্যান্যবারের মতো খালি হাতেই ফিরতে হবে! হতাশ হয়ে পাশের ঘরটার দরজাটার দিকে ফিরল সে। দেখল এই দরজাটা আবার বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগানো। তাহলে কি লোকটা এই ঘরে সব জিনিসপত্র রেখে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছে? তাই হবে হয়তো। নতুন উদ্যমে ছিটকিনিটা খুলে দরজাটা ঠেলে মুখ বাড়াল ফটিক।
কিন্তু না। আবার সে হতাশ হয়ে দেখল এই ঘরটাও খালি, কোনও জিনিস নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে দরজাটা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় হঠাৎ চাঁদটা মনে হয় মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আর খোলা জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে একরাশ জোছনার আলো এসে পড়ল। তখনই ঘরের এককোণে চোখ পড়তেই সে চমকে উঠল। বুকের ভিতরটা যেন ধক করে উঠল। চোখে ভুল দেখছে না তো সে? বার দুই চোখ কচলে ভালো করে ঠাহর করে দেখল যে না, ভুল দেখছে না। যা দেখছে তা সত্যিই। গায়েও রোমগুলো যেন এক পলকে খাড়া হয়ে গেল। হাত-পা কাঁপতে শুরু করল তার। বুকের ভিতরের ঢিপঢিপ শব্দটা যেন বাইরে থেকেই তার কানে বাজছিল। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না সে।
চোখ বন্ধ করে বড়ো বড়ো করে দুয়েকবার শ্বাস নিয়ে নিজের মাথাটা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করল ফটিক। এই অবস্থায় উত্তেজিত হলে সে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবে। এক-দুই মিনিটের মধ্যে মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হলে সে ঠিক করে নিল কী করতে হবে। সবচেয়ে প্রথমে কেউ কিছু টের পাবার আগেই তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িটা থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। তাই কোনও শব্দ না করে দরজাটা আগের মতো বন্ধ করে দিয়ে ছিটকিনিটা লাগিয়ে পা টিপে টিপে রান্নাঘরটার দিকে পা বাড়াল ফটিক।
মিনিট দশেকের মধ্যে রাস্তার সেই নেড়ি কুকুরের দলটা অবাক হয়ে দেখল সেই চিমসেমতো উটকো লোকটা আবার প্রাণপণে দৌড়ে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। তবে এবার আর আগের দিকে নয়, উলটোদিকে।
***
কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে ফটিকের দিকে তাকিয়ে থেকে থানার বড়বাবু নিশিকান্ত সেন প্রশ্ন করলেন, “তা তুই হঠাৎ বাড়িটাতে ঢুকতে গেলি কেন?”
খানিক ইতস্তত করে বড়বাবুর টেবিলের পাশে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফটিক বলল, “আজ্ঞে, চুরি করতে।”
ফটিকের অকপট উত্তর শুনে শুধু বড়বাবু নন, ঘরে উপস্থিত বাকি সব পুলিশেরা আর বড়বাবুর টেবিলের উলটোদিকের চেয়ারে বসা শহরের মস্ত বড়ো কাপড়ের মিলের মালিক অমিতাভ দাশগুপ্ত সবাই চমকে ফটিকের দিকে তাকালেন। শুধু অমিতাভবাবুর কোলে বসা তাঁর নাতি বছর পাঁচেকের আয়ুশের কোনও ভাবান্তর হল না। সে তখন নির্বিকারভাবে ক্যাডবেরি ডেয়ারি মিল্কটা খেতেই ব্যস্ত।
“কী বললি? চুরি করতে ঢুকেছিলি?” নীরবতা ভেঙে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন নিশিকান্ত, “তার মানে তুই একটা চোর?”
এই রে, এবার না তাকে আবার চুরির দায়ে হাজতে যেতে হয়। ভয় পেয়ে তড়িঘড়ি সবকথা খুলে বলল ফটিক। তার নিজের কথা, বাপ-ঠাকুরদার কথা, ঠাকমার কথা, আগের দুয়েকবারের চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার কথা—সব। সবশেষে তার যে চুরি করতে একেবারেই ভালো লাগে না, খালি ঠাকমার ঠেলা-ধাক্কায় তাকে চুরি করতে বেরোতে হয় একথাটাও বারবার করে বলতে ভুলল না।
সবকথা মন দিয়ে শুনলেন নিশিকান্ত। কিছুক্ষণ পা থেকে মাথা অবধি ফটিককে মেপে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “তা বাচ্চাটাকে তুই চিনলি কী করে?”
মাথাটা একটু চুলকে নিয়ে ফটিক বলল, “আজ্ঞে, খবরের কাগজে ছবি দেখে।”
“খবরের কাগজ!” একটু অবাকই হলেন নিশিকান্ত। তারপর অমিতাভবাবুর দিকে ফিরে বললেন, “ও হ্যাঁ, আপনি তো পেপারে অ্যাড দিয়েছিলেন, তাই না?”
সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন অমিতাভ। “হ্যাঁ, পরশু বিকেলে রনি, মানে আয়ুশ কিডন্যাপ হবার পরই আমি কলকাতার আর লোকাল সব নিউজ পেপারে অ্যাড দিয়েছিলাম। র্যানসম কলটা তো কাল বেলা এগারোটা নাগাদ এল। তার আগেই সকালবেলাতেই সব পেপারে অ্যাড বেরিয়ে গিয়েছিল।”
মনে মনে ভাবল ফটিক, ভাগ্যিস বিজ্ঞাপনটা দেওয়া হয়েছিল আর ভাগ্যিস সময় কাটানোর জন্যে চায়ের দোকানে বেঞ্চের ওপর পড়ে থাকা পত্রিকাটা সে পড়ার জন্যে হাতে তুলে নিয়েছিল। সেখানেই তার চোখে পড়েছিল নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপনে আয়ুশের ছবিটা। আয়ুশের নিষ্পাপ মুখটা দেখে ভারি কষ্ট হয়েছিল তার। ভেবেছিল, আহা রে! এত সুন্দর একটা বাচ্চা, ঠিক যেন রাজপুত্তুর। এমন মিষ্টি একটা বাচ্চা মা-বাবাকে ছেড়ে না জানি কোথায় আছে, কত কষ্টই না পাচ্ছে! কিন্তু তাই বলে ছিটকিনি লাগানো ওই ঘরটায় ঢুকে চাঁদের আলোয় হঠাৎ ঘরের এককোণে মেঝেতে কুঁকড়ে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত অবস্থায় বাচ্চাটাকে দেখতে পাবে এমনটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। কোনোমতে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে থানায় এসে খবর দিয়েছে সে। প্রথমে তার কথায় অতটা গা করেনি পুলিশ। কিন্তু শেষপর্যন্ত প্রায় হাতে পায়ে ধরে পুলিশকে তার সঙ্গে যেতে রাজি করায় সে। ভোরের আলো ফোটবার আগেই তার দেখানো সেই বাড়িটায় গিয়ে পুলিশ আয়ুশকে উদ্ধার করে আর দামড়া লোকটাকে গ্রেপ্তার করে। এখন হাজতে পুরে পুলিশ লোকটার মেরামত করছে দলের বাকিদের খবর পাবার জন্যে।
নিশিকান্তর সন্দেহ তখনও পুরোপুরি কাটেনি। তীক্ষ্ণ গলায় ফটিককে আবার জিজ্ঞেস করলেন তিনি, “কিন্তু তুইও যে ওদের দলেরই একজন নোস, সেটা কী করে বুঝব?”
“নিশিকান্তবাবু, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?” ফটিক কোনও উত্তর দেবার আগেই বলে উঠলেন অমিতাভবাবু, “বয়স তো আমার নেহাত কম হল না। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমি কারুর মুখ দেখলেই বুঝতে পারি সে সত্যি বলছে না মিথ্যে। আমার মনে হয় ছেলেটা সত্যি কথাই বলছে। আমার অনুরোধ, আপনি ওকে ছেড়ে দিন।”
কিছুক্ষণ ফটিককে একদৃষ্টিতে দেখে নিয়ে নিশিকান্ত বললেন, “হুম, আমারও তাই মনে হচ্ছে। যা, তাহলে ছেড়েই দিলাম তোকে। তবে খবরদার, আর কোনোদিন যদি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়িস, তাহলে কিন্তু তোর একদিন কি আমার একদিন।”
ব্যস্তসমস্ত হয়ে জিভ কেটে কান মুলে ফটিক কথা দিল আর কখনও সে চুরি করবে না। তার হাবভাব দেখে আয়ুশ খিলখিল করে হেসে উঠল।
নাতিকে দু’হাতে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন অমিতাভবাবু, যেন একটু আলগা করলেই আবার কেউ তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে। দু’বছর আগে তাঁর একমাত্র ছেলে আর বৌমা মানে রনির বাবা-মা কার অ্যাকসিডেন্টে মারা যাবার পর থেকেই তাঁর জীবনে এই রনি ছাড়া আর কেউ নেই। শুধুমাত্র রনির জন্যেই বুড়ো মানুষটা শেষ বয়সে পুত্রশোকের মতো এত বড়ো কষ্ট সহ্য করে বেঁচে আছেন। জলভরা চোখে ফটিকের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বললেন, “শোনো ফটিক, তোমার জন্যেই আমি রনিকে ফিরে পেয়েছি। তুমি নিজেও জানো না, তুমি আমার কতটা বড়ো উপকার করেছ। তুমি আমাকে আমার রনি ফিরিয়ে দিয়েছ। তার জন্যে আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আমার মিলে কাজ করার জন্যে একজন সৎ, বিশ্বস্ত, কর্মঠ লোক প্রয়োজন। তুমি চাইলে এই কাজটা আমি দিতে পারি তোমাকে। বলো, তুমি কি রাজি আছ?”
ফটিক কোনও উত্তর দিতে পারল না। মুখে কিছু না বলে সে হাত বাড়াল রনির দিকে। এইটুকু সময়ের মধ্যেই কী করে জানি তার বেশ মায়া পড়ে গেছে বাচ্চাটার ওপর। রনিও দিব্যি দাদুর কোল থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে ফটিকের কাছে এসে দাঁড়াল। হাঁটু গেঁড়ে বসে রনিকে বুকে জড়িয়ে ধরল সে। বুঝতেই পারল না অজান্তে কখন তারও দু’চোখ জলে ভরে উঠেছে। সবসময় না হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে চুরি বিদ্যা সত্যিই মহাবিদ্যা হয়ে উঠতে পারে সেটা আজ সে বুঝে গেছে।
ছবিঃ মৌসুমী
অসাধারণ গল্প, মন ছুঁয়ে গেল!!আজকের দিনে গভীর তত্ত্বকথা, মেকি দরদ শুনে শুনে একঘেয়ে হয়ে গেছে, সেখানে এরকম একটি সহজ সরল অথচ নিটোল ঠাস বুনোটে লেখা গল্প সত্যিই ভালো লাগলো👍👌👌, গল্পের ঘটনাবিন্যাস খুবই সুন্দর হয়েছে, স্বকীয়তার সম্পূর্ণ উপস্থিতি ছত্রে ছত্রে, লেখকের রসবোধের প্রশংসা করতেই হবে👌👌, সিঁধ কেটে চুরি; সে প্রায় উঠেই গেছে এখন, তাই নতুন প্রজন্মের কাছে বিষয়টা প্রাঞ্জল হতে হয়তো সময় লাগবে একটু, আমি খুবই উপভোগ করলাম লেখাটা, দৃপ্ত বাবুকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই👍👍🙏🙏😊
LikeLike
খুব ভালো লাগল আপনার মন্তব্য পেয়ে দাদা। সুস্থ থাকবেন, সাবধানে থাকবেন।
LikeLike