আবীর গুপ্তর আগের গল্প মহাসঙ্কটে সুনন্দ
এক
অশোক পাহাড়ের মাথায় হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে যেদিক থেকে উঠে এসেছে সেদিকে তাকিয়ে লোকগুলোকে দেখতে পেল। দ্রুত ঢাল বেয়ে উঠে আসছে। এদিকটা একেবারেই স্টিফ নয়, ঢাল কম থাকায় বেশ দ্রুতগতিতেই উঠছে। তাছাড়া ওরা এখানকারই মানুষ, তাই পাহাড়ের ঢালে দৌড়নো বা ঢাল বেয়ে ওঠা ওদের কাছে খুবই সোজা। অশোক পাহাড়টার চূড়ায় উঠে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে দম নিয়ে নিল। তারপর লোকগুলো যেদিক দিয়ে পাহাড়ে উঠছে তার উলটোদিকের ঢালে তাকাল। এদিকে পাহাড়ের ঢাল অত্যন্ত বেশি। প্রায় সত্তর-আশি ডিগ্রি খাড়া নেমে গেছে। বহু নিচে খাদের মধ্য দিয়ে একটা সরু নদী বয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের ঢালে যেসব পাথর বেরিয়ে আছে তা ধরে ধরে খুব সাবধানে নিচে নামা সম্ভব। কম করে ফুট পঞ্চাশেক নিচে একটা সরু পাথরের চাতাল দেখতে পেল। ঐ চাতালে নামতে পারলে হয়তো প্রাণে বেঁচে যাবে। ঐ লোকগুলো ওকে ধরতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলবে। ও সেটা বুঝতে পারছে। তাই এই পথেই ওকে নামার চেষ্টা করতে হবে। একবার স্লিপ করলে একদম নিচে গড়িয়ে পড়ে ছাতু হয়ে যাবে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও মরতে হবে। ও ইতস্তত করে নামা শুরু করল।
ঢালের পাথর ধরে ধরে নিচের দিকে নামতে-নামতেই লোকগুলোর গলার আওয়াজ পেল। ওকে অত্যন্ত সাবধানে ধীরে ধীরে নামতে হচ্ছিল। লোকগুলোর কথা শুনে মনে হচ্ছে ওরা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে গেছে। মাথা ঘুরিয়ে ওপর দিকে তাকাতে ভয় করছিল, যদি হাত ফসকে যায় তাহলে অবধারিত মৃত্যু। অত্যন্ত সাবধানে মাথাটা তুলে ওপরের দিকে তাকাল। দুটো লোক পাহাড়ের চূড়ায় ঝুঁকে ওকে দেখছে। ওকে তাকাতে দেখেই চিৎকার করে উঠল। দেখল, লোকদুটো ওদের সঙ্গীদের ডাকছে। অশোক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিচের দিকে নামা শুরু করল। হঠাৎ একটা আওয়াজ। ওর পাশ দিয়ে একটা পাথর গড়িয়ে পড়ল। ওকে মারার জন্য ওরা ওপর থেকে পাথর ফেলছে। ও ওপর দিকে তাকিয়ে দেখল একটা বড়ো পাথর ওকে লক্ষ করে ঢালে গড়িয়ে দিচ্ছে। ও দ্রুত সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই পা ফসকে গেল। কোনও সাপোর্ট ছাড়াই পা ফেলেছে। ঘষটাতে ঘষটাতে ঢাল বেয়ে পড়তে থাকল নিচের দিকে।
দুই
অশোক তলাপাত্র পেশায় জুলজিস্ট অর্থাৎ প্রাণীবিজ্ঞানী। সরকারি চাকরি করে, কলকাতায় পোস্টেড। ও ওয়াইল্ড লাইফ ভালোবাসে। তাই চাকরি সূত্রে যখন ওকে নানারকম প্রাণীর সন্ধানে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় তখন মনে মনে খুশি হয়। এমনকি যদি কখনও ওকে কোথাও পাঠানো না হয় তাহলে নিজে যেচে ট্যুর নিয়ে নেয়। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়স, বিয়ে করেনি, সংসারে আপনজন বলতে শুধু ওর মা। মাকে সংসারের কাজে সাহায্য করার জন্য একজন বুড়ি দাসী আছে, সর্বক্ষণ বাড়িতেই থাকে। তাই চটজলদি বেরিয়ে পড়তে ওর কোনও অসুবিধা হয় না।
শকুন ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। আগে কলকাতায় প্রচুর শকুন দেখা যেত। এখন সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত হয়ে গেছে। পশ্চিমবাংলার সর্বত্র প্রায় একই অবস্থা। তাই কৃত্রিম উপায়ে ব্রিড করিয়ে এদেরকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু পশ্চিমবাংলাই নয়, প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ড আর বিহারেও একই অবস্থা। তাই যখন অশোককে ডেকে ওর বস জানাল ওকে ঝাড়খণ্ডের বিশেষ কয়েকটা জেলায় শকুনের খোঁজে যেতে হবে তখন ও মনে মনে খুশিই হল। যে জায়গাগুলোতে ওকে শকুন খুঁজতে হবে সেই জায়গাগুলো ছোটো ছোটো পাহাড়ে ঢাকা। ওর হবি বার্ড ওয়াচিং। এধরনের অভিযানই ও পছন্দ করে। তাই অফিস থেকে ট্যুরের টাকা অ্যাডভানস তুলে বেরিয়ে পড়ল শকুনের খোঁজে।
ঝাড়খণ্ডের যে জায়গায় অশোক গেল সেটা হাজারিবাগ জেলার মধ্যে পড়ছে। ওকে পাহাড়ে আর জঙ্গলে শকুনের খোঁজে ঘুরে বেড়াতে হবে, যেখানে কোনও শহর নেই। কাজেই থাকার জায়গার সমস্যা। ও ম্যাপে দেখেছিল, এই অঞ্চলে ছোট্ট একটা গ্রাম আছে, নাম বেড়াডিহি। ঐ গ্রামে কোনও গাড়ি যেতে পারবে না, কারণ রাস্তা বলে কিছু নেই। যা রাস্তা আছে তা গরুর গাড়ি চলার জন্য। ও তাই হাজারিবাগ শহর থেকে একটা ফোর হুইলার জিপ ভাড়া করে রওনা দিল। টোপোশিট আর ম্যাপ দেখে বহুকষ্টে বেড়াডিহি গ্রামে পৌঁছল। সোজা গিয়ে দেখা করল মোড়লের সঙ্গে। ও দিন কুড়ি ঐ গ্রামে থাকতে চায় বলাতে মোড়লই তাঁর বাড়িতে টাকার বিনিময়ে অশোকের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে আগে থেকেই কথা বলা ছিল। ড্রাইভারও গাড়ি সমেত ঐ গ্রামে থাকার ব্যবস্থা করে নিল।
তিন
গ্রামের মানুষ উপজাতি সম্প্রদায়ের, ভীষণই সরল সোজা। গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে অশোকের বেশ ভালো লাগল। ওরা যে ভাষায় কথা বলে সেটা ঠিক হিন্দি নয়, একটু আলাদা। তবে ওরা হিন্দি বোঝে। ওদের হিন্দি বুঝতে অশোকের কষ্ট হচ্ছিল না, তাই কথাবার্তা চালাতে কোনও অসুবিধা হল না। অশোক ওদের শকুন দেখেছে কি না জিজ্ঞেস করাতে ওরা জানাল, আগে এই অঞ্চলে নাকি অনেক শকুন ছিল, তবে এখন আর তাদের দেখা মেলে না। অশোকেরও কেন জানি না মনে হচ্ছিল, ওর এবারের অভিযান ব্যর্থ হবে, শকুন খুঁজে পাবে না।
গলায় বাইনোকুলার ঝুলিয়ে হ্যাভারস্যাকে জলের বোতল আর দুপুরের লাঞ্চ প্যাক করে নিয়ে পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়ল শকুনের খোঁজে। গ্রাম থেকেই একজনকে নিয়ে নিল মালপত্র বইবার জন্য, আর পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। সঙ্গের লোকটির নাম ব্রিজমোহন। গ্রামের গরু আর ছাগল চরাতে নিয়ে যায় বলে পথঘাট ওর চেনা। ও প্রতিদিন গরু চরিয়ে যা রোজগার করে তার থেকে অনেকগুণ বেশি টাকা পাবে শুনে সানন্দে রাজী হয়ে গেল। অশোকের লোকটির সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল। ব্রিজমোহনকে নিয়ে এগিয়ে চলল সামনের পাহাড়টার দিকে। ঠিক করল, পাহাড়চূড়ায় উঠে চারদিক বাইনোকুলার দিয়ে নজর করে দেখবে। এমনিতে কোথাও কোনও শকুন ও দেখতে পায়নি। এ কারণে উঁচুতে উঠে দেখতে চায়। ভাগ্য ভালো হলে এভাবেই শকুনের সন্ধান পেয়ে যাবে।
পাহাড়ে ওঠা সহজ, নামা কঠিন। ওঠার সময় অসুবিধা হয় না, কিন্তু নামার সময় লুজ ছোটো ছোটো পাথরের টুকরোয় পা স্লিপ করে গেলেই মুশকিল। এরকম পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা ওর আছে বলেই এটা জানে। অল্পসময়ের মধ্যেই পাহাড়ে উঠে পড়ল। বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে বহুদূরে একটা পাহাড়ের ঢালে গাছের মাথায় একটা বড়ো পাখি দেখতে পেল। বাইনোকুলার দিয়ে দেখে ওটাকে শকুন বলেই মনে হল।
চার
সারাদিন পাহাড়ের চূড়ায় অশোক কাটিয়ে বিকালের দিকে নেমে গ্রামে ফিরে এল। পাখিটা পরে যখন গাছ থেকে উড়ে অন্য জায়গায় চলে গেল, তখন ওটাকে শুধু শকুন নয়, শকুনের একটি প্রজাতি বেঙ্গল ভালচার বলে মনে হল। ঠিক করে ফেলল, পরদিন ঐ পাহাড়ে যাবে। মনে হচ্ছে শকুনের দেখা ওখানেই পাবে।
যে পাহাড়টায় অশোক যাবে বলে ঠিক করেছিল, সেটা গ্রাম থেকে পাঁচ-ছয় মাইল দূরে। অশোক ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে গলায় বাইনোকুলার ঝুলিয়ে ড্রাইভারকে বলল, ওকে পাহাড়ের কাছে সুবিধামতো জায়গায় ছেড়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতে। ও বিকালে পাহাড় থেকে নেমে যাতে গাড়ি পায়। এই পাহাড়টা এই অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়, অন্তত চারপাশ দেখে অশোকের তাই মনে হয়েছে।
পাহাড়টার যেদিকে ঢাল কম আর গাছপালা ভর্তি জঙ্গল, সেইদিকে পাহাড়ের কাছে একজায়গায় ড্রাইভার গাড়িটাকে রাখল। এবার এখান থেকে ওকে হেঁটেই ওপরে উঠতে হবে। ও ওঠা শুরু করল। আজ ব্রিজমোহন অসুস্থতার জন্য আসতে পারেনি; ও একাই এসেছে। পাহাড়টা বেশ উঁচু। সবে মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছেছে, এমন সময় মানুষের গলার আওয়াজ পেল। জঙ্গলের মধ্যে যেদিক থেকে আওয়াজ আসছে, সেদিকে তাকাল। বেশ খানিকটা দূরে তিন-চারজন মানুষ কী যেন করছে। বাইনোকুলারটা চোখে লাগাল, লোকগুলোর সামনে একটা গুহার মতন দেখা যাচ্ছে। চার-পাঁচজন লোক গুহা থেকে ধরাধরি করে একটা বড়ো বাক্সের মতন বার করছে। ওর কৌতূহল হল। কী বার করছে দেখার জন্য আরও খানিকটা এগিয়ে গেল। ততক্ষণে লোকগুলো বাক্সের ডালা খুলে ফেলেছে। বাইনোকুলার দিয়ে দেখল, ভিতরটায় ঠাসা রয়েছে নানারকমের অদ্ভুতদর্শন বন্দুক। ও আঁতকে উঠল। হয় এরা চোরাকারবারি, নয়তো সন্ত্রাসবাদী।
হঠাৎ লোকগুলোকে ওর দিকে তাকাতে দেখল। ওরা ওকে দেখতে পেয়েছে। চিৎকার করে একটা লোক কী যেন বলল। অশোক দেখল, লোকগুলো রিভলভার হাতে ওর দিকে তেড়ে আসছে। হাতের রিভলভারগুলো বিদঘুটে দেখতে। ও ভয় পেয়ে দৌড় শুরু করল। নিচের দিকে নেমে লাভ নেই, ওকে গুলি করা সোজা হয়ে যাবে ভেবে ওপরে ওঠা শুরু করল। গাছপালার মধ্য দিয়ে প্রাণপণে তাড়াতাড়ি যাবার চেষ্টা করছিল। দেখল, লোকগুলোও তেড়ে আসছে। ও পাহাড়ের চূড়ায় প্রায় পৌঁছে পিছন ফিরে তাকিয়ে দূরে লোকগুলোকে আসতে দেখল।
পাঁচ
অশোক পাহাড়ের ঢাল বেয়ে প্রথমে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে ধীরে ধীরে পড়ছিল। ক্রমে পড়ার গতি বেড়ে গেল। ঢালে এমন কিছু নেই যা ধরে ও নিজের গড়িয়ে পড়াটা আটকাতে পারে। বেশ দ্রুতগতিতে ঘষটাতে ঘষটাতে পড়ছিল। ও ততক্ষণে বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছে। ভয়ে আতঙ্কে প্রায় জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা। হঠাৎ কীসের আকর্ষণে ওর শরীরটা পাহাড়ের ঢালের মধ্যে একটা গর্তে ঢুকে গেল। অবাক বিস্ময়ে দেখল, ঐ সরু গর্তের মুখ আপনা থেকেই পাথর সরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর তারপরই খেয়াল করল, ও একটা সরু গুহার মধ্যে রয়েছে। গুহার মধ্যে কোথা থেকে হালকা নীল আলো আসছে। সেই আলোতেই গুহার সবকিছু দেখা যাচ্ছে। আলোটা কোথা থেকে আসছে সেটা ও বুঝতে পারল না।
অশোক গুহার মেঝেতে আস্তে আস্তে উঠে বসল। ভেবেছিল গা-হাত-পা ঘষা খেয়ে যেরকম ছড়ে গেছে তাতে সেখানে জ্বালাযন্ত্রণা করবে। কিন্তু কোনও জ্বালাযন্ত্রণা তো নেই! ও নিজের হাত-পায়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। কোথাও কেটে ছড়ে যাওয়ার কোনও লক্ষণ দেখতে পেল না। বেশ অবাক হয়েই নিজের শরীর থেকে চোখ সরিয়ে গুহাটার দিকে মন দিল। ও যেখানে বসে আছে সেখানে গুহাটা সরু। হাইট বেশি নয়, সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে মাথায় ঠেকে যাবে। খানিকটা এরকম গিয়ে তারপর গুহাটা চওড়া আর উঁচু হয়ে গেছে। ও হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চওড়া জায়গায় গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। গুহার মেঝেটা এত মসৃণ যে চলতে গেলে পা স্লিপ করে যাচ্ছে। সাবধানে এগোতেই দেখতে পেল, গুহাটা ইংরেজি ‘টি’-এর মতো দু’দিকে ভাগ হয়ে গেছে। ও ঠিক দুটো ভাগের মাঝামাঝি জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে তাকাল। মৃদু নীল আলোয় গুহার দু’দিকের অংশই অল্পস্বল্প দেখা যাচ্ছে। বাঁদিকের অংশে ওর মনে হল কীসব জিনিস রাখা আছে। ডানদিকের অংশ এগিয়ে গিয়ে ওর মনে হল বাঁদিকে বাঁক নিয়েছে। ও বাঁদিকের অংশে ঢুকে একটু এগোতেই পৌঁছে গেল জিনিসগুলোর সামনে। এগুলো কী!
ছয়
জিনিসগুলোকে দেখে অশোকের মনে হল নানারকম যন্ত্র। কিন্তু সেগুলো কী যন্ত্র তা ও বুঝতে পারল না। এধরনের যন্ত্র ও জীবনে দেখেনি। প্রতিটি যন্ত্র অপারেট করার জন্য বোতাম রয়েছে। প্রতিটি বোতামের পাশে সম্ভবত কোন বোতাম কী কাজে আসে তা লেখা আছে। কিন্তু যে ভাষায় লেখা সেটা অশোকের চেনা কোনও ভাষা নয়। যন্ত্রগুলো ধাতুর তৈরি, কিন্তু কী ধাতু দিয়ে তৈরি তা ও বুঝতে পারল না। হাত দিয়ে তোলার চেষ্টা করে দেখল সহজেই তুলতে পারছে, বেশ হালকা। সবগুলো যন্ত্রই ঘুরে ঘুরে দেখল। গুনে দেখল মোট দশটা যন্ত্র গুহার এই অংশে রাখা আছে। যন্ত্রগুলো সবই হেক্সাগনাল, এটা বেশ অদ্ভুত লাগল ওর কাছে। যন্ত্রগুলোর বোতাম টেপাটেপি করতে ভরসা হল না। গুহার এই অংশের উলটোদিকের অংশে অর্থাৎ গুহার ‘টি’ আকৃতির ডানদিকের অংশে যাওয়ার জন্য রওনা দিল। ওর মন বলছিল কোনও অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাবে। এ কারণে যেতে ইতস্তত করছিল। তারপর মন ঠেকে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে হাঁটা দিল।
এই অংশে কিছুই নেই। পাথরের দেওয়াল, মেঝে সবই ঝকঝকে তকতকে, একফোঁটা ধুলো অবধি নেই। হালকা নীল আলোয় গুহার ভিতর সবই দেখা যাচ্ছে। গুহার শেষপ্রান্তে ওর দেখে মনে হল একটা দরজা রয়েছে। অল্প আলোয় ভালোমতন বোঝা যাচ্ছে না বলে ও সামনে এগিয়ে গেল। দরজার মতোই লাগছে। হাত দিয়ে ঠেলা দিল, দরজা খুলল না। বেশ কয়েকবার নানাভাবে চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। ও যখন দরজার সামনে থেকে চলে আসছে, তখন ইংরেজিতে একটা মেটালিক ভয়েস শুনে থমকে গেল, ‘দরজার মাঝামাঝি জায়গায় একটা সুইচ আছে। ওটা টিপলেই দরজা খুলে যাবে।’ ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে সুইচটা টিপল। সুইচ টেপামাত্র ঘড়ঘড় শব্দ করে ওর সামনের দরজাটা সরে খুলে গেল। সামনে বিরাট বড়ো হলঘরের মতো একটা গুহা, ভিতরে হালকা লাল আলো জ্বলছে। ও গুহার ভিতরে ঢুকে পড়ল।
সাত
হলঘরের মতো বিরাট গুহাটায় ঢোকামাত্র একটা মিষ্টি, মেয়ের গলা শুনতে পেল। “ওয়েলকাম টু মাই সুইট হোম।”
অশোক অবাক হয়ে যেদিক থেকে আওয়াজটা এসেছে সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেল মেয়েটিকে। একটা অদ্ভুতদর্শন সোফার ওপর আধশোয়া অবস্থায় বসে রয়েছে। অশোককে মেয়েটি বলল, “প্লিজ, সিট ডাউন।”
অশোক মেয়েটির সামনে রাখা সোফা কাম চেয়ারে বসে পড়ল। সোফাগুলো অদ্ভুত, ভিতরটা বেশ নরম আর বাইরে কাঠের জায়গায় কোনও ধাতু ব্যবহার করা হয়েছে। দেখতেও ঠিক চেয়ার বা সোফার মতন নয়, অনেকটা ইজিচেয়ারের মতো। অশোক একটু ইতস্তত করে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কে? এখানে এই গুহায় কী করছেন?”
“ঠিকই। আমার পরিচয় আপনাকে দেওয়া হয়নি। আপনাকে যখন এখানেই থাকতে হবে তখন পরিচয় দেওয়াটা জরুরি। আমি লীনা দত্ত। আমার এই গোপন জায়গার খবর আপনি ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ জানে না। আমি এখানে নির্জনে শান্তিতে গবেষণা করছি।”
“গবেষণা! কী নিয়ে?”
“আছে একটা কিছু, আপনাকে পরে জানাব। আপনার নিশ্চয়ই চা খেতে আপত্তি নেই? চা খেতে খেতে গল্প করা যাক।”
অশোক খেয়াল করল, বসা অবস্থাতেই লীনা একটা পাশে রাখা যন্ত্রের সুইচ টিপল। একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ, আর তারপরই যন্ত্রের ভিতর থেকে একটা কাপ বেরিয়ে এল। কাপ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। লীনা কাপটা তুলে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার ল্যাবে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা চা। খেয়ে দেখুন, কোনও পার্থক্য বার করতে পারবেন না।”
অশোক চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে খেয়াল করল, ভুরভুর করে চায়ের গন্ধ বেরোচ্ছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দেখল স্বাদও বেশ ভালো। ও চা-টা শেষ করে লীনাকে নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি এখানে এভাবে গবেষণা করছেন! ভাবাই যায় না। সবকিছু জানতে ইচ্ছা করছে।”
আট
লীনা একটু ইতস্তত করে বলতে শুরু করল, “আমার জন্ম এক অখ্যাত জায়গায়। জায়গাটার নাম বলছি না। আমার বাবার ছিল বদলির চাকরি, কোল ইন্ডিয়াতে চাকরি করতেন। আমরা ছিলাম তিন ভাইবোন। আমি সবার ছোটো। অভাব-অনটনের মধ্যে বড়ো হচ্ছিলাম কারণ, আমার বাবা খুব ভালো চাকরি করতেন না। বাবাকে ট্রান্সফার করা হল ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ জেলার এক কোল ফিল্ডে। ওখানে বাচ্চা চুরি যেত, অনেক টাকা চাইত, টাকা না পেলে বাচ্চাটাকে মেরে ফেরত দিত। আমার বাবা অতসব জানতেন না, তাই সাবধানতাও নেননি। আমাকেও চুরি করা হল, নিয়ে এসে রাখা হল পাহাড়ের এই গুহায়। আপনি এই গুহার একটা মুখ দেখেছেন, অন্য মুখটা পাহাড়ের অন্য ঢালে। সেখান দিয়ে সহজেই গুহায় ঢোকা যায়। আমাকে এখানে আটকে রাখা হল। গুহার এই মুখটা অবধি যে আমাকে নিয়ে এসেছিল সম্ভবত সে কোনোদিন যায়নি অথবা যখন এসেছিল তখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। গুহার এই মুখে ভিনগ্রহী এক প্রাণী আশ্রয় নিয়েছিল। ওর স্পেস শিপ নামতে গিয়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে নষ্ট হয়ে যায়। তাই ও বাধ্য হয়েছিল এখানে আশ্রয় নিতে। ওদের বিজ্ঞান আমাদের থেকে অনেক উন্নত। কিছু যন্ত্র ঐ ভিনগ্রহী স্পেস শিপ থেকে নিয়ে এসে এখানে রেখেছিল। ওরা ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। তাই আমার খবর আগেই জেনেছিল। ঐ ভিনগ্রহীর কল্যাণে আমি মুক্ত হলাম। লোকগুলো মারা পড়ল ঠিকই, আমার কিন্তু আর পরিবারে ফেরা হল না। এখানেই ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠলাম। ভিনগ্রহীদের যন্ত্রের কল্যাণে সমস্ত রোগ অসুখ থেকে মুক্ত ছিলাম। গুহার দু’দিকের মুখই ঐ ভিনগ্রহী অটোম্যাটিক দরজার সাহায্যে বন্ধ করে দিল। এই দরজা ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে খুলতে হয়। আমাকে শিক্ষাদানও করা হল। শিখলাম বিজ্ঞানের নানান শাখা। ওদের মৃত্যু নেই। ওরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর ইচ্ছামৃত্যু বরণ করে। ওদের যন্ত্রের কল্যাণে আমিও অমর হয়ে গেলাম। ভিনগ্রহী প্রাণীটি মারা যাওয়ার পর একাকীত্ব ঘোচানোর জন্য গবেষণা শুরু করলাম। এমন গবেষণা যা মানব কল্যাণে আসে। এই চা তৈরির যন্ত্র আমার আবিষ্কার। এখানে থাকলে যন্ত্রের কল্যাণে খিদে তেষ্টা পায় না। আপনি নিশ্চয়ই সেটা খেয়াল করেছেন। এটাও নিশ্চয়ই দেখেছেন, পাহাড় থেকে ঘষটে নামার পরও আপনার দেহে কোনও ক্ষত নেই। এই গুহা থেকে আমি কখনও বাইরে যাইনি। এই গুহাই আমার দুনিয়া।”
অশোক লীনাকে থামিয়ে বলল, “সে কি! বিশ্বাসই হচ্ছে না। চলুন আমি আপনাকে বাইরের পৃথিবী দেখাব।”
নয়
লীনা দত্ত ম্লান হেসে বললেন, “এতদিন যখন ইচ্ছা দমন করে থাকতে পেরেছি, তখন এখন আর যাব না। আপনাদের পরস্পরের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ থেকে দূরে আমি ভালো আছি। পঞ্চাশটা বছর তো কাটিয়ে দিলাম।”
“কী? পঞ্চাশ বছর! অথচ আপনাকে দেখে…”
“আমার বয়স এখন ষাট। দশ বছর বয়সে এখানে এসেছিলাম। ভিনগ্রহীদের বিজ্ঞানের দৌলতে এই গুহায় বয়স বাড়ে না। একটা যন্ত্র আছে যেটা বয়স বাড়তে না দিয়ে আটকে রাখে। আমার বয়স বাইশ বছরে আটকে আছে। বাইশ অবধি বাড়তে দেওয়া হয়েছিল।”
“অবিশ্বাস্য! ভাবা যায় না।”
“এটা সত্যি। আপনার বয়সও এই গুহায় থাকলে বাড়বে না। দেখবেন আপনার খিদে তেষ্টাও চলে গেছে। প্রথম প্রথম অসুবিধা হবে, পরে অভ্যাস হয়ে যাবে।”
“আপনি বললেন যে গুহার বাইরে আপনি যান না। তাহলে গবেষণার জিনিসপত্র কীভাবে পান?”
“সে নানাভাবে ব্যবস্থা হয়ে যায়। ও নিয়ে আমি ভাবি না।”
“আপনার সঙ্গে বাইরের বিশ্বের কোনও যোগাযোগ না থাকলে আপনি জিনিসপত্র পান কীভাবে! এটা মাথায় ঢুকছে না।”
“ও নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।”
“আপনি কী নিয়ে গবেষণা করছেন?”
“মানব কল্যাণে ব্যবহার করা যায় এমন জিনিস আবিষ্কার করার চেষ্টা করছি।”
“যেমন? একটা উদাহরণ দিন।”
“এই যে চা বানানোর মেশিন দেখলেন। এরকম আরও অজস্র আছে। ধরুন, একটা যন্ত্র আছে যেটা চালু করলেই মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাবে। ওর থেকে একটা ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ওয়েভ বেরিয়ে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। অপারেশনের সময় অজ্ঞান করার জন্য এই যন্ত্রটা ব্যবহার করা যেতে পারে। এইসব যন্ত্র বানানো আমার একটা হবির মতো হয়ে গেছে।”
“আমার শুনতে খুব ভালো লাগছে। আপনার নিশ্চয়ই খুব ভালো একটা ল্যাব আছে?”
“তা আছে।”
“সেটা কি আমি দেখতে পারি?”
“হ্যাঁ, আপনাকে সেখানে নিয়ে যাব। একটা এক্সপেরিমেন্টে আপনার সাহায্য দরকার।”
দশ
লীনা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর এগিয়ে গেলেন গুহার শেষদিকে। অশোক দেখল, পাথরের দেওয়ালে পথ বন্ধ। বিস্মিত হয়ে দেখল, লীনা ঐ দেওয়ালে আঙুল ছোঁয়াতেই পাথরের দেওয়াল ঘড়ঘড় আওয়াজ করে সরে গেল। এখানে এক বিরাট বড়ো গুহা। মাথার ওপরে ছাদও অনেক উঁচুতে। গুহার ভিতরে থরে থরে নানান জিনিস সাজানো যার একটাও অশোকের চেনা নয়। এখানে যে দুটো জিনিস ওর কিছুটা পরিচিত তা হল একটা বসার জন্য চেয়ারের মতো দেখতে একটা জিনিস, আর একটা বিদঘুটে দেখতে পায়া লাগানো টেবিল। টেবিলটা রয়েছে চেয়ারের সামনে। টেবিলের ওপর ছোট্ট একটা বাক্সের মতন কী রাখা।
লীনা অশোককে বললেন, “এই আমার ল্যাব। এখানেই গবেষণা করি। আমার প্রয়োজনীয় সবকিছু এখানেই আছে। তাই কোথাও যাওয়ার দরকার হয় না। আমি নতুন যে বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করছি, সেটা একজায়গায় এসে আটকে গেছে। যে কারণেই আপনার সাহায্য দরকার।”
অশোক লীনা কী বলছেন তা খুব একটা মন দিয়ে শুনছিল না। ঘুরে ঘুরে পুরোটা ল্যাব দেখছিল। সব যন্ত্রই বিদঘুটে দেখতে। তবে যেটা দেখে আশ্চর্য হল, সেটা হল প্রতিটি যন্ত্রের সুইচের পাশে তার কী কার্যকারিতা তা ইংরেজিতে দুয়েক কথায় লেখা আছে। ওর যেটা আশ্চর্য লাগছিল সেটা হল, এখানকার অধিকাংশ যন্ত্রই গ্যাস অথবা জীবাণু সম্পর্কিত। লীনা কি তাহলে নানারকম অসুখের প্রতিকারের উপায় বার করার চেষ্টা করছেন? ঘুরে লীনার দিকে তাকাল। দেখল, লীনা টেবিলের ওপর রাখা চ্যাপটা বাক্সটার ঢাকনা খুলে ফেলেছে। ওটা সম্ভবত ল্যাপটপ জাতীয় কিছু যা অশোক জীবনে কখনও দেখেনি।
লীনার আঙুল ঐ ল্যাপটপ জাতীয় যন্ত্রটায় কোনও কিছু সম্ভবত টাইপ করছিল। কাজ করতে-করতেই লীনা বললেন, “এখানে কোনও যন্ত্রের সুইচে কিন্তু হাত দেবেন না। একেকটা যন্ত্রের কাজ একেকরকম। কোনটা থেকে কী হয়ে যায়, ভুল করে কিছু একটা টিপে দিলেই সর্বনাশ।”
লীনার কথা অশোক কিন্তু শুনছিল না। তন্ময় হয়ে একটা যন্ত্র দেখছিল। এই যন্ত্রটা ঠিক অন্য যন্ত্রের মতো নয়।
এগারো
অশোকের যন্ত্রটা দেখে মনে হচ্ছিল এই যন্ত্রের সাহায্যে কোনও কিছুকে কন্ট্রোল করা হচ্ছে। কন্ট্রোল প্যানেল বলে একটা সুইচও আছে। রিমোট কন্ট্রোলে কোনও কিছু কি কন্ট্রোল করা হচ্ছে? ও ভালো করে যন্ত্রটা দেখতে লাগল। লীনাকে জিজ্ঞাসা করল, “এই যন্ত্রটার সাহায্যে কি কোনও কিছুকে কন্ট্রোল করা হচ্ছে?”
লীনা একথা শুনেই চেঁচিয়ে উঠলেন, “চলে আসুন, এদিকে চলে আসুন। ওটায় হাত দেবেন না।”
অশোক লীনার এই ব্যবহারে বেশ হতভম্ব হয়ে ওখান থেকে সরে এল। ও বুঝে উঠতে পারছিল না, লীনা হঠাৎ এত স্ট্রংলি রি-অ্যাক্ট করলেন কেন। লীনার কাছে আসতেই বললেন, “আপনাকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে আপনার দেহে কী কী ভাইরাস আছে। ঐ ভাইরাস তাড়ানো দরকার।”
“কেন! একটু আগে আপনিই তো বললেন, এই গুহায় কোনও অসুখ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।”
“তা বলেছি। তবে যন্ত্রও তো অনেক সময় ভুল করে। আপনার কোনও অসুবিধা হবে না। এটা অনেকটা কম্পিউটারে ভাইরাস চেকিং করার মতো। ক্ষতিকারক ভাইরাসকে খতম করে দেবে। ভাইরাস আমাদের বন্ধু, আবার শত্রুও।”
“আমায় কী করতে হবে?”
“কিছুই নয়, ধৈর্য ধরে মিনিট পাঁচেক এই চেয়ারে বসে থাকতে হবে। তাহলেই হয়ে যাবে।”
অশোক চেয়ারে বসতে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা খটকা লাগায় দাঁড়িয়ে গেল। এখানে যে যে যন্ত্র তার দুটো দিক হতে পারে। প্রথমটা অবশ্যই মানুষের কল্যাণে ব্যবহার। আর যদি তা না হয়ে উলটোটা হয়? এগুলো সব কেমিক্যাল আর বায়োলজিক্যাল ওয়েপনও তো হয়ে পারে। তখন কী হবে? যন্ত্রগুলোর কাছ থেকে লীনা ওকে সরিয়ে আনলেন কেন? ওরকম আঁতকেই বা উঠলেন কেন? যতক্ষণ না এ বিষয়টা পরিষ্কার হচ্ছে ততক্ষণ এই চেয়ারে বসাটা ঠিক হবে না। তাছাড়া লীনা একথাটা বললেন কেন, ভাইরাস আমাদের বন্ধু, আবার শত্রুও? ওকে ইতস্তত করতে দেখে লীনা খেঁকিয়ে উঠলেন, “কী হল! চেয়ারে বসুন।”
অশোক জোর দিয়ে বলল, “আমার মনে কয়েকটা প্রশ্ন জেগেছে। সেগুলোর উত্তর না পেলে চেয়ারে বসব না।”
বারো
অশোকের কথা শুনে লীনা হঠাৎ রেগে উঠলেন। কোমর থেকে ফস করে একটা ভীষণদর্শন রিভলভার বার করে বললেন, “এখুনি চেয়ারটায় গিয়ে বসুন, তা না হলে গুলি চালাতে বাধ্য হব। এটা আপনাদের রিভলভারের মতো অর্ডিনারি রিভলভার নয়। এর গুলি দেহের ভিতরে ঢুকে ফেটে যায়। তাই মৃত্যু অনিবার্য শুধু নয়, মৃত্যুটা অত্যন্ত কষ্টকরও।”
অশোক একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল, “আমি চেয়ারে না বসলে গুলি করতে চাইছেন, কিন্তু কেন? এত জোরাজুরি করছেন কেন? নিশ্চয়ই অন্য কারণ আছে।”
“কারণ যাই হোক, আপনাকে চেয়ারে বসতেই হবে। এটাই আমার অর্ডার। না হলে আপনাকে মেরে ফেলতে বাধ্য হব। এতদিনকার এত প্ল্যানিং নষ্ট হয়ে যেতে কিছুতেই দেব না।”
“প্ল্যানিং! কীসের প্ল্যানিং?”
“আপনার তাতে কী প্রয়োজন? আপনি না বসলে গুলি চালাতে বাধ্য হব। আমাকে প্লিজ বাধ্য করবেন না।”
অশোক ইতস্তত করে এগিয়ে গেল। চেয়ারে না বসে উপায় নেই। এটুকু বুঝেছে, লীনা ওকে মিথ্যা বলেছেন। ওকে চেয়ারে বসানোর উদ্দেশ্য ভাইরাস স্ক্যানিং নয়, অন্য কিছু। কিন্তু সেটা কী? এক্ষেত্রে ভেবেও কোনও লাভ নেই। পরিষ্কার বুঝতে পারছিল, চেয়ারে ওকে বসতেই হবে। তা না হলে লীনা গুলি চালাবেন, তিনি মিথ্যা ভয় দেখাচ্ছেন না। ও সোজা গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। লীনা এগিয়ে গিয়ে চেয়ারের পিছনে রাখা একটা যন্ত্রের সুইচ টিপে দিলেন।
একটা শীত শীত ভাব, কীরকম অদ্ভুত একটা অনুভূতি। মিনিট পাঁচেক সহ্য করতে হল কারণ, লীনা মিনিট পাঁচেক বাদে সুইচটা বন্ধ করলেন। অশোক খেয়াল করল, লীনা হাসছেন। অশোক ওঁর হাসির কারণ বুঝতে পারল না। লীনা স্বগতোক্তি করলেন, “ওহ্, কী যে আনন্দ হচ্ছে! এতদিন বাদে আমার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। ধীরে ধীরে পুরো পৃথিবীর দখল চলে আসবে আমার হাতে। আমাদের রাজত্ব শুরু হবে।”
অশোক এই কথাগুলো শুনে চমকে উঠল।
তেরো
অশোক লীনার কথা শুনতে শুনতে দ্রুত কী করবে তা ভেবে নিচ্ছিল। লীনা হঠাৎ ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখানে কেউ এলে তাকে এই গুহার বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। কিন্তু আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আপনি মুক্ত।”
অশোকের একটা অন্যরকম সন্দেহ হচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করল, “আপনি একটু আগে বললেন, এখান থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। অথচ এখন আমায় মুক্তি দিচ্ছেন। কারণ কী?”
“কারণ কিছু নেই। আমার মনে হল তাই। এই ল্যাব থেকে সোজা বেরিয়ে যাওয়ার পথ আছে, সেই পথেই যাবেন। গুহার আগের অংশে যেতে পারবেন না।”
লীনা দেওয়ালে একটা বোতাম টিপতেই ঘড়ঘড় করে ল্যাব থেকে বাইরে যাওয়ার সরু সুড়ঙ্গের মুখ খুলে গেল। লীনা রিভলভারটা উঁচিয়ে ওকে ঐ পথে বেরিয়ে যেতে বলল। অশোক গুহা থেকে সরু সুড়ঙ্গ-পথে যেতে শুরু করল। সুড়ঙ্গটা এত সরু যে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হচ্ছিল। অবশেষে সুড়ঙ্গের বাইরে এসে পড়ল। পাহাড়ের এক ঢালে এসে সুড়ঙ্গটা শেষ হয়েছে। এই অংশে সুড়ঙ্গের মুখটা বেশ চওড়া, গুহার মতো।
সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে বাইরে পৃথিবীর আলো ওর কাছে দারুণ ভালো লাগছিল। এই জায়গাটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। হঠাৎ ওর মনে পড়ল সবকিছু। দূর থেকে এই গুহার সামনেই লোকগুলোকে বাক্সের ডালা খুলে অস্ত্র নাড়ানাড়ি করতে দেখেছিল। একটা কুটিল সন্দেহ ওর মধ্যে চলে এলーলীনা ওকে মিথ্যা কথা বলেছেন। যে লোকগুলোর হাত থেকে ও পালাচ্ছিল সেই লোকগুলো সম্ভবত লীনারই দলের। এই সুড়ঙ্গ মারফতই বাইরের জগতের সঙ্গে লীনার যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু ওকে ছেড়ে দিলেন কেন? ও তো বাইরে এসে সবাইকে এই গুহার কথা জানিয়ে দেবে। তাহলে? লীনা নিশ্চয়ই কনফার্মড যে ও বাইরের কাউকে ওঁদের এই গুহার কথা জানাতে পারবে না। হ্যাঁ, এ বিষয়ে ও নিশ্চিত। কিন্তু কীসে কনফার্মড হলেন? হঠাৎ ওর একটা কথা মনে হওয়াতে ভয়ে আতঙ্কে ঘেমে উঠল। ওর শরীরে একটা অস্বস্তি হচ্ছে। লীনা কোনও অসুখের ভাইরাস ওর দেহে ঢুকিয়ে দেননি তো? ও লোকালয়ে গেলেই অসুখটা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়বে। তাহলে এখন ও কী করবে?
চৌদ্দ
অশোক দ্রুত ভেবে যাচ্ছিল। ওর শরীরে অস্বস্তি ক্রমশ বাড়ছে। ও বুঝতে পারছে, ওর দেহে কোনও অসুখের ভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ভাইরাসের থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায় হল যেকোনওভাবেই হোক ঐ গুহার মধ্যে ঢুকে যে যন্ত্রটা দেহ থেকে সমস্ত অসুখ তাড়িয়ে দেয় তার সামনে দাঁড়ানো। কিন্তু লীনা কি তা হতে দেবেন? তার আগেই ওকে মেরে ফেলবেন। দুটো উপায় আছে। একটা হল এখনই ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করা। আর অন্য উপায়টা হল, এখানে ঐ লোকগুলোর জন্য অপেক্ষা করা। ওরা নিশ্চয়ই লীনার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য এখানে আসবে। তখন কায়দা করে ওদের সঙ্গে ভিতরে ঢুকে পড়তে হবে। অনেক ভেবে ঠিক করল, প্রথমে নিজে ঢোকার চেষ্টা করবে, ব্যর্থ হলে তখন ঐ লোকগুলোর জন্য অপেক্ষা করবে।
অশোকের শরীর এত খারাপ লাগছে যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। গা-হাত-পা চিবোচ্ছে। কোনওরকমে হামাগুড়ি দিয়ে গুহার ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলল। অবশেষে শেষ মাথায় পৌঁছল। সামনে একটা পাথরের দেওয়াল যাওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এই পাথরের দেওয়ালটা আসলে দরজা। এখান দিয়েই লীনার ল্যাবে ঢুকতে হবে। দেওয়ালে হয়তো কোনও লুকোনো বোতাম জাতীয় কিছু আছে যেটা টিপলে দরজা খুলে যাবে। এই ভেবে দেওয়াল হাতড়াতে শুরু করল। মসৃণ পাথরের দেওয়াল, কোথাও কোনও খাঁজ অবধি নেই। ব্যর্থ হয়ে ঐ পাথরের দেওয়ালের সামনে গুহার একধারে শুয়ে পড়ল। ওর শরীরের যা অবস্থা তাতে ওর পক্ষে গুহার বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়।
চোখ বুজে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তা ওর খেয়ালই নেই। হঠাৎ ঘড়ঘড় শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখল, সামনের দেওয়ালের দরজাটা খুলে যাচ্ছে। দেওয়ালের সামনে পাঁচজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। লোকগুলোর চোখের দৃষ্টি কেমন অদ্ভুত, যেন ঘোরের মধ্যে আছে। ওকে দেখতে পেয়েও কেন কিছু বলল না ভেবে আশ্চর্য হল। শেষ লোকটা ঢোকার আগেই ও হামাগুড়ি দিয়ে কোনওরকমে ভিতরে ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
পনেরো
অশোক ল্যাবে ঢুকে লীনাকে কোথাও দেখতে পেল না। ল্যাব আর বড়ো হলঘরের মাঝের দরজাটা বন্ধ। ও বহুকষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খোলার বোতামটা টিপে দিল। দরজা খুলতেই ও ঢুকে পড়ল হলঘরে। ওর সন্দেহ হচ্ছিল, লীনা এই ঘরেই ভিতর দিকে আছেন। সবরকমের রোগ দূর করার যন্ত্রটা এই ঘরেই আছে। ঘরে থাকলেই ফল পাওয়া যাবে, এই আশায় দরজার একটু দূরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। খেয়াল করল, গায়ের ব্যথাবেদনা হঠাৎ যেন বেড়ে যাচ্ছে। তারপরই একদম চলে গেল। কোনও কষ্ট নেই। শরীরও বেশ ঝরঝরে তাজা লাগছে। মনে হচ্ছে ও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে।
ও উঠে দাঁড়াল। নিজেকে এতটা সুস্থ আর তরতাজা লাগছে যে ও ভুলেই গেল কিছুক্ষণ আগে কী পরিস্থিতি ছিল। নিঃশব্দে এগিয়ে গেল গুহার ভিতর দিকে। দেখল, লীনা একটা যন্ত্রের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে কী যেন করছেন। হঠাৎ লীনা ওর দিকে ফিরলেন। দেখল, লীনার হাতে রিভলভার। ওর দিকে তাক করা। লীনা হেসে বললেন, “আপনার সবকিছুই ক্লোজ সার্কিট টিভিতে দেখতে পেয়ে আপনারই অপেক্ষায় ছিলাম। আপনার বুদ্ধিকে আন্ডার-এস্টিমেট করা ঠিক হয়নি।”
“আপনি কী করছেন?”
“নেক্সট যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছি। পৃথিবী দখল করাটা আমার কাছে একটা যুদ্ধ। প্রথম মিশন ব্যর্থ হয়েছে। তাতে কী হয়েছে, সেকেন্ড মিশন তো আছে। আপনাকে হত্যা করে তারপর সেকেন্ড মিশনে যাব। এবারে ভাইরাস ক্যারি করে নিয়ে যাবে আমার অনুগত কয়েকজন মানুষ।”
“ঐ বাইরে ল্যাবে যারা রয়েছে? ওরা তো সম্মোহিত অবস্থায় আছে। সম্মোহন কেটে গেলেই ওরা আপনার বিরুদ্ধে যাবে।”
“সম্মোহন কাটবে না। ওরাই আমার সৈনিক। এবারে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকুন।”
হঠাৎ অশোক ওর বাঁদিকে একটা যন্ত্রের ওপর থাকা ছোট্ট চা তৈরির মেশিনটা তুলে সর্বশক্তি দিয়ে লীনার দিকে ছুড়ে মারল। এত দ্রুত এটা ঘটল যে লীনা সরতে পারল না। যন্ত্রটা গিয়ে ওর হাতে লাগল। রিভলভারটা খসে পড়ল।
ষোলো
লীনার হাত থেকে খসে পড়া রিভলভারের দিকে তাক করে অশোক সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাল। ঐ অদ্ভুত দেখতে রিভলভারটা লীনার চেষ্টা সত্ত্বেও ওর হাতে এসে গেল। ওটাকে লীনার দিকে তাক করে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। দেখল, লীনার দু’চোখে যেন আগুন ঝরে পড়ছে। তারপরই দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে এল। লীনার গলা শুনতে পেল। “সরি, আপনাকে আমি মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনি আমি দু’জনে একসঙ্গে যে কাজটা শুরু করেছি সেটা শেষ করতে পারি। আমার একজন সঙ্গীর দরকার, একা একা থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠেছি। আমায় বিয়ে করবেন? ঠকাব না, কথা দিচ্ছি। আপনি বুদ্ধিমান আর বিচক্ষণ মানুষ। আপনার মতো সঙ্গী কোথায় পাব?”
অশোক দ্রুত ভেবে নিচ্ছিল কী করবে। হাতের রিভলভারটা মাটিতে নামিয়ে রেখে বলল, “ওকে, ম্যাডাম। আমি রাজী। আপনি কথা দিয়েছেন, আমার কোনও ক্ষতি করবেন না।”
অশোক দেখল, লীনা এগিয়ে এসে অদ্ভুত দেখতে রিভলভারটা তুলে নিয়ে কোমরে গুঁজল। তারপর বলল, “আসুন, চা খেতে খেতে গল্প করা যাক।”
চা খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল। লীনা ওর পৃথিবী জয়ের প্ল্যান বলল। অশোক মাঝে মাঝে দুয়েকটা মন্তব্য করলেও চুপচাপ ও যা বলে শুনছিল। অশোক লীনাকে বাইরের পৃথিবী যখন দেখার কথা বলল, লীনা রাজী হল না। এই গুহা ছেড়ে কোথাও যেতে রাজী নয়।
সাত-সাতটা দিন কেটে গেছে। এই সাতদিনে লীনাকে ধরে ও সমস্ত যন্ত্রের কার্যকারিতা জেনে নিয়েছে। ও এখন নিজেই সমস্ত যন্ত্র অপারেট করতে পারে। প্রতিটি যন্ত্রই একেকটি ভয়ংকর বায়োকেমিক্যাল ওয়েপন। এগুলি ব্যবহার করা শুরু করলে পৃথিবীবাসীর কী হবে ভেবে ও শিউরে উঠল। আপাতত ওর কিছু করণীয় নেই।
সতেরো
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। অশোকের মনে হচ্ছে লীনা নিজেকে আমূল বদলে ফেলেছে। একসঙ্গে থাকার জন্য অনেক কিছু জেনে ফেলেছে। বাইরের কুড়ি-বাইশটি লোককে কীভাবে সম্মোহিত করে রেখেছে সেটাও জেনে ফেলেছে। এদের দিয়েই লীনা সমস্ত কাজ করিয়ে নেয়। এছাড়াও কিছু মানুষ আছে যারা অন্যদের মতো সম্মোহিত নয়, শুধুমাত্র অস্ত্রশস্ত্র ও টাকার জন্য লীনার কাজ করে। এরাই পাহাড়ের ওপর অশোককে তাড়া করেছিল। অশোকের কেন জানি না মনে হয়েছে, এরা কোনও সন্ত্রাসবাদী বা জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। কয়েকদিন ভালোমতন অবজার্ভ করে এর সত্যতা বুঝতে পারল। লীনা ওদেরকে ভয়ংকর সব অস্ত্রশস্ত্র সাপ্লাই করছে। এ সমস্ত অস্ত্র তৈরি হচ্ছে লীনার গবেষণাগারে। লোকগুলির সঙ্গে অশোকেরও ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আজকাল সমস্ত অস্ত্রের চালানের কাজটা অশোকই করে। প্রতিদিন একবার সকালের দিকে গুহার বাইরে যায়, ঘণ্টা খানেক বা ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে তারপর গুহায় ফেরে। লীনা কিন্তু ভুলেও কখনও গুহার বাইরে যায় না। একদিন খুব জোরাজুরি করাতে জানাল, যে যন্ত্রের প্রভাবে ও বয়সকে ধরে রেখেছে সেই যন্ত্রের প্রভাব গুহার বাইরে কাজ করবে না। ফলে ওর মৃত্যু অবধারিত। অশোক সেকথা শুনে ওকে আরেকটি ঐ যন্ত্র বানাতে বলাতে লীনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, সেই চেষ্টা করে ও ব্যর্থ হয়েছে। এই যন্ত্রটা নাকি ভিনগ্রহীটির বানানো, যার ডুপ্লিকেট বানানো সম্ভব নয়।
লীনার সঙ্গে সম্পর্ক সহজ হয়ে গেলেও লীনার পাগলামি ক্রমশ বাড়ছিল। পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন ওকে প্রায় উন্মাদ করে তুলেছিল। ওর বিরুদ্ধাচরণ ও সহ্য করতে পারত না। তাই অশোক ওর বিরোধিতা তো করতই না, উলটে পাগলামিকে প্রশ্রয় দিত।
প্রায় মাস খানেক বাদে একদিন লীনা ঘোষণা করল, আয়োজন সম্পূর্ণ হয়েছে, ও প্রস্তুত, এবারে পৃথিবী জয়ের জন্য ঝাঁপানো যেতে পারে। অশোক মনে মনে আতঙ্কে শিউরে উঠল।
আঠারো
লীনা মরিয়া হয়ে উঠেছে। অশোক ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়েও ঠেকাতে পারছে না। লীনা অশোকের ওপর চটে যাচ্ছে। অশোক জানে ও বিশ্বজয়ের প্ল্যান অনুযায়ী এগোলে বহু নির্দোষ মানুষের মৃত্যু হবে। ও একটা প্ল্যান ভেবেছে। সেটাকেই কাজে লাগাতে হবে।
অশোক কথাপ্রসঙ্গে জেনে নিয়েছে, ভিনগ্রহীর বানানো বা ভিনগ্রহ থেকে আনা সমস্ত যন্ত্র বুলেট প্রুফ আর শক প্রুফ। অর্থাৎ কোনও যন্ত্রকে গুলি করে আছড়ে ফেলে নষ্ট করা যাবে না। ও আজকাল সর্ব রোগ তাড়ানোর মেশিনটা নিয়ে বসে থাকে আর কলকব্জাগুলো বোঝার চেষ্টা করে।
লীনা ল্যাব-সংলগ্ন একটা ঘরে শোয়। এই ঘরেই নাকি ভিনগ্রহী থাকত। অশোকের জায়গা হয়েছে ল্যাবের বাইরে একটা ঘরে, টি-আকৃতির গুহার বাঁদিকের উইংয়ের শেষে। লীনা এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বিয়ের কথা তুলেছিল। ও জানিয়েছে, বিয়েটা করবে পৃথিবী বিজয়ের পর। লীনা তাতে সম্মতি দিয়েছে। লীনা বেশ খোশমেজাজে আছে। পৃথিবী বিজয়ের প্রস্তুতি সম্ভবত শেষের দিকে। মুখ ফসকে সেকথা অশোককে বলেও দিয়েছে। যত দিন যাচ্ছে অশোক তত শঙ্কিত হয়ে উঠছে। ও শেষরক্ষা করতে পারবে তো?
সর্ব রোগ তাড়ানোর মেশিনটা দীর্ঘদিন ধরে ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা তথ্য ও আবিষ্কার করেছে। সেটা হল, এই মেশিনের মাধ্যমে যেমন সবধরনের অসুখ সারানো যায়, তেমনই মানুষকে নানারকম অসুখে আক্রান্তও করে তোলা যায়। সেক্ষেত্রে এটি একটি বায়োলজিক্যাল ওয়েপন হিসাবে কাজ করে। কীভাবে মানুষকে কোনও নির্দিষ্ট অসুখে অসুস্থ করে তোলা যায় সেটাও ও মেশিন ঘাঁটতে ঘাঁটতে বিভিন্নরকম পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে জেনে ফেলেছে। ও যে জেনে ফেলেছে তা লীনা অবশ্য জানে না। ও ইচ্ছে করেই বিষয়টা গোপন রেখেছে।
উনিশ
লীনার গুহা ও ল্যাবে যত যন্ত্র আছে তার প্রায় সবই ভিনগ্রহীর বানানো। দুয়েকটি অবশ্য পরে লীনা বানিয়েছে। লীনার সঙ্গে আলোচনা করে বুঝেছে, এসব যন্ত্রের প্রতিটিতে একটি করে মস্তিষ্ক আছে। আমাদের কম্পিউটার বা যেকোনও ইলেক্ট্রনিক্স গুডসের মস্তিষ্ক মনে হয় সি.পি.ইউ অথবা সার্কিট বোর্ড। ভিনগ্রহীর বানানো যন্ত্রের মস্তিষ্ক নাকি একেবারেই মানুষ বা অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্কের মতন। শুধু তাই নয়, লীনার বক্তব্য অনুযায়ী ভিনগ্রহীর বানানো যন্ত্রমানব একেবারেই মানুষের মতন। তফাত বোঝার কোনও উপায় নেই।
অশোক তৈরি। ওর প্ল্যান কাজ করবে কি না তা অবশ্য ও জানে না। তবে দিন ঠিক করে ফেলেছে। ঠিক দু’দিন বাদে রবিবারে সকাল আটটার সময় ও কাজে নামবে। লীনা রাত তিনটে অবধি কাজ করে সকালে প্রায় দশটা অবধি ঘুমায়। কাজেই সকাল আটটাই সঠিক সময়। সর্ব রোগ তাড়ানোর মেশিনটাকে ও সেভাবেই সেট করল। এই সেটটা করল শনিবার সকাল আটটার সময়। ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা বাদে যন্ত্র তার কাজ শুরু করবে। এরপর প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায় পরের চব্বিশ ঘণ্টা কাটাল। শনিবার রাতে ভালো মতন ঘুমাতেও পারল না।
ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। দ্রুত উঠে পড়ল, অনেক কাজ বাকি আছে। নিঃশব্দে এগিয়ে গেল ল্যাবের দিকে। ল্যাবের দরজা খোলা। ভিতরে লীনার শোবার ঘরের দরজা অবশ্য বন্ধ। সমস্ত যন্ত্রগুলো একবার দেখে নিল। সর্ব রোগ তাড়ানোর যন্ত্রটা খুঁটিয়ে দেখল। ও যে সেটিং সেট করেছিল তা ঠিকই আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক সাতটা ঊনষাট মিনিটে গুহা থেকে বেরোনোর সুইচটা টিপল। দরজা আস্তে আস্তে খুলে গেল। আর তারপর ঠিক ত্রিশ সেকেন্ড বাদে আটটা বাজল। পুরো গুহা জুড়ে এক অদ্ভুত শিসের শব্দ আর আলোর খেলা ঠিক একমিনিট ধরে চলল। তারপর গুহার ভিতরে নেমে এল শ্মশানের নিস্তব্ধতা।
কুড়ি
অশোক বুঝে উঠতে পারছিল না ওর প্ল্যান কতটা কাজ করেছে। দ্রুত যন্ত্রগুলোকে দেখল, সমস্ত যন্ত্রই অকেজো হয়ে গেছে, অর্থাৎ মৃত। সর্ব রোগ নিরোধক মেশিনটাও মৃত। কোনও কাজ করছে না। এই গুহার সমস্ত যন্ত্রই অক্কা পেয়েছে। ওর নিজস্ব ধারণা, এগুলোকে আর কোনোদিন ঠিক করা যাবে না। একটু ইতস্তত করে ল্যাবে ঢুকল। সেখানেও যন্ত্রগুলোর একই হাল। কিন্তু লীনার ঘরের দরজা খোলা কেন? ওটা তো বন্ধ ছিল! সম্ভবত সমস্ত যন্ত্র অকেজো হয়ে যাওয়ায় ঘরের দরজা খুলে গাছে।
ভিতরে ঢুকে আঁতকে উঠল অশোক। লীনা সম্ভবত চেয়ারে বসে কোনও কাজ করছিল। দেহটা বিসদৃশভাবে একদিকে হেলে পড়ে আছে। ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। লীনার কী হয়েছে? তারপর এগিয়ে গিয়ে ঠেলা দিতেই দেহটা গড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে। কবজিতে আঙুল দিয়ে পালস দেখল, খুব ধীরে চলছে। হঠাৎই ওর কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল। লীনা যে অবস্থায় রয়েছে তাতে ওর থেকে কোনোদিন ভয়ের কোনও আশঙ্কা নেই।
খুশি মনে শিস দিতে দিতে গুহা ছেড়ে বেরিয়ে এল বাইরে, সূর্যের আলোয়। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে হাঁটা লাগাল। এ পাহাড় থেকে নিচে নামাই এখন ওর প্রধান কাজ।
অশোক ঠিক কী করেছিল যার জন্য গুহার ভিতর এরকম অবস্থা হল? সর্ব রোগ তাড়ানোর মেশিনটায় যেমন সমস্ত অসুখ তাড়ানো যায়, তেমন মানুষের দেহে রোগও ইঞ্জেক্ট করা যায়। মেশিন ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা অপশন দেখেছিল মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটানো। এতে আবার দুটো অপশন ছিল, প্রাণীর মস্তিষ্কের মৃত্যু আর প্রাণীর মস্তিষ্কের সদৃশ যন্ত্রের মস্তিষ্কের মৃত্যু। ও মস্তিষ্কের মৃত্যু সিলেক্ট করে তার থেকে দ্বিতীয় অপশনটা বেছে সময় সিলেক্ট করেছিল রবিবার সকাল আটটা। তাই রবিবার সকাল আটটার সময় প্রাণীসদৃশ যন্ত্রের মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটেছে। এমনকি সর্ব রোগ তাড়ানোর মেশিনটা সবাইকে অকেজো করে নিজেও মৃত্যুবরণ করেছে। বাকি রইল লীনা। অশোক লীনার দেহ দেখে বুঝে গেছিল, লীনাও ছিল যন্ত্রমানবী, ভিনগ্রহীর সৃষ্টি। তাই লীনার মস্তিষ্কেরও মৃত্যু ঘটেছে। মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটা সত্ত্বেও সম্ভবত হার্ট জাতীয় যে যন্ত্রটা ওর দেহে রয়েছে তা তখনও চালু থাকায় মৃদু পালস পেয়েছে যা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে। অতএব, পৃথিবী অশোকের জন্য এক ভয়ংকর বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেল।
অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর
অসম্ভব ভালো লাগলো,এরকম মহাসঙ্কট থেকে বর্তমান পৃথিবীকে যদি রক্ষা করা যেত? 🙏🙏
LikeLike