ভোলুকে ভুলিনি
সুপ্তি সরকার
ভোলুকে পেয়েছিলাম, এক স্বাধীনতাদিবসের সকালে হাউজিং-এ পতাকা তোলা হলো ঠিক সকাল সাড়ে ন’টা। তারপর যা হয় আর কি! দু-চারটে কথা, গান ইত্যাদির পরে মিষ্টি আর চকোলেট বিতরণ নিজের ভাগেরটা না নিয়ে চলে আসাটা ঠিক নয় বলে, অপেক্ষা করছিলাম। হাতে পেয়ে মিষ্টিটা চালান করলাম পেটে আর চকলেটটা পকেটে। রসে চ্যাটচ্যাটে হাতটা পাশের বাঁধানো পুকুরঘাটে ধুতে গেলাম। সিঁড়ির যে ধাপটা জলের নীচে অথচ, পরিষ্কার দেখা যায়, সেই পায়ের পাতা ভিজানো জলে সর্বদা একঝাঁক ক্ষুদে মাছ ঘুরে বেড়ায়, ঝাঁঝির আড়ালে ওরা লুকোচুরি খেলে। আজও তাই ছিল। দাঁড়িয়ে দেখলাম কিছুক্ষণ ওদের জলকেলি; কি মনে হতে, আস্তে হাতটা ছুঁয়ে দিলাম জলে। মুহূর্তে সচকিত ছানারা ঝাঁঝির আড়ালে। হাতটা আমি ধুলাম বটে কিন্তু জল থেকে তুলিনি। ছানা মাছেরাও টুকি করে দেখছে অবাক হয়ে। আমার মজা লাগলো, অল্প অল্প করে জলে দোলা দিতে লাগলাম।
হঠাৎ দেখি একটা পুঁচকু মাছ এসে আমার আঙুলটা ছুঁয়ে দিল,যেন বলতে চায় “কী গো? দেখো,আমি কিন্তু ভয় পাইনি।” হাতের নাগালেই ঘুরে যাচ্ছে সে।মতলবটা ভাব জমানো। কি মনে হল, মালা নিয়ে যাবার খালি প্লাস্টিকের প্যাকেটটা টুক করে ডুবিয়ে জল সমেত ওকে তুলেনিলাম। এক কর সাইজের একটা নেংটি মাছ, সোনালি আঁশ, ছোট্ট গোল চোখ, ভারি পছন্দ হল বাড়ির সবার। একটা মাটির বড়ো গামলায় জল দিয়ে,পাথর আর কিছু জলজ উদ্ভিদ সাজানোই থাকত আমাদের বাড়িতে। ওর ঠাঁই হলো সেখানে। কী খেতে দেব,ভেবেই আমার মাথা খারাপ! প্রথম কয়দিন মুড়ি দিলাম তারপর থেকে বিস্কিটের গুঁড়ো, কেকের গুঁড়ো মায় দানাদারের টুকরোও দিতাম। আর একটু বড়ো হলে কেঁচো খাওয়াতাম। নাম দিয়েছিলাম ‘ভোলু’। কয়েক মাসেই কেমন তরতর করে বড়ো হয়ে গেলো। গামলার সামনে গিয়ে – ভোলুউউ বলে ডাকলে,পাতার তলা থেকে বেরিয়ে আসত, খলবল করে জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটত, যেন বলতে চাইত এইত্তো আমি! মাঝেমধ্যে গামলার পাশে জলচৌকি পেতে বসে,আমি ওকে গল্প,গান শোনাতাম। জলে ভাসানো নকল পদ্মের পাতার উপর শুয়ে, চুপটি করে ও সব শুনত। আমার আদরের ছানাপোনা, ভোলু।
হঠাৎ এক বিপদ ঘনাল! এক হুলোর আনাগোনা বেড়ে গেল আমাদের বাড়িতে। কিছুতেই তাকে তাড়ানো যায় না। যে কোনোভাবেই সেই বিড়াল গামলার কাছে চলে আসছে। বাড়িসুদ্ধ লোক ভোলুর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠলাম। চার- পাঁচশো গ্রাম ওজনের পোনা মাছ অ্যাকোরিয়ামেও রাখা যায় না। কী করি!
পরেরদিন দেখলাম, ছেঁড়া পদ্মফুল, জলজ উদ্ভিদের ছেঁড়াপাতা পড়ে আছে গামলার বাইরে। বুঝলাম, হুলোটা ওকে খেয়ে নিয়েছে! আক্ষরিক অর্থেই আমি তখন কাঁদছি গামলা ধরে! হঠাৎ শুনি, ছপাস শব্দ। গামলার একদম নীচে মাটির সাথে মিশে গিয়ে আজ নিজেকে বাঁচাতে পেরেছে ভোলু। আনন্দে কতবার আমার হাত ঠুকরে দিয়ে গেল।
ঠিক করলাম, আর না! একে বাঁচাতে আবার পুকুরে ছেড়ে দেব। নাই বা রইল আমার কাছে, তবু বেঁচে তো থাকবে! সেদিনই বালতি করে নিয়ে গিয়ে,ওর নিজের জায়গায় ফিরিয়ে দিলাম। পুকুরে ছাড়ার আগে,গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললাম, “ভালো থাকিস রে, কারোর সাথে ঝগড়াঝাঁটি করিস নে যেন!” জলে ছেড়ে দেবার পর দেখি, সে চুপটি করে ঘাটের কিনারাতেই রয়ে গেল – মাঝ পুকুরে তো যাচ্ছেই না!! হাত দিয়ে ঠেলে গভীর জলে পাঠিয়ে দিলাম। আর পিছন ফিরে তাকাইনি।
মাঝে মধ্যে যখন ঘাটে গিয়ে দাঁড়াই, জল পা ছুঁয়ে যায়; একটা দুটো মাছ খুব কাছে এসে ঘোরাঘুরি করে। তাদের মধ্যে আমার ভোলু আছে কিনা কে জানে!
অদ্ভুত সুন্দর মায়াবী লেখা। একটা চমৎকার ভালো লাগা অনুভূতি দিয়ে নববর্ষ এলো। লেখিকার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি। শুভেচ্ছা…
LikeLike