সেই চোখদুটো
শরণ্যা মুখোপাধ্যায়
অনেকদিন আগের কাহিনি। তখনও বিয়েবাড়িতে ভিয়েন নামের জিনিসটা বসত বাড়ির ছাদে। বড়োরা মোটা কালো ফ্রেমের চশমা আর মালকোঁচা মারা ধুতি পরে, চারিদিকে গম্ভীর মুখে ছোটাছুটি করতেন। ছোটোরা পান্তুয়ার লোভে ছাদে ভিড় করত। কলাপাতায় পাত পড়ত উৎসব বাড়িতে। শেষে থাকত দই। এমনই একটি উৎসব-বাড়িতে সম্ভবত কোন এক বৈশাখের সকালে রওনা দিয়েছিলাম আমরা। মা-বাবা, দাদা-দিদি সমেত পুরো ব্যাটেলিয়ান। গন্তব্য পিসেমশায়ের বাড়ি, উপলক্ষ্য পিসতুতো দিদির বিয়ে। পিসের বাড়ি বহরমপুর। তো কু-ঝিকঝিক লালগোলা না কী যেন চড়ে আমরা রওনা দিলুম। আমার বয়স তখন মেরেকেটে সাত বা আট। জীবনে প্রথম ট্রেনে চড়ে এতদূর যাওয়া। খুব উৎসাহের সঙ্গে পিসের বাড়ি পৌঁছলাম। ক্লাসে ফার্স্ট হলে তখন একটা আলাদা সম্মান ছিল এ’সব বাড়িতে। তো, আমিও ভি-আই-পি কোটাতেই পড়তুম।
যেতেই কাঁসার গেলাসে দুধ আর খেজুর চলে এল আমার জন্য। দিদির নিতকনে হিসাবে লাল চেলী, কমিক্সের বই, পাউডার, পমেটম থেকে শুরু করে সোনার মাকড়ি পর্যন্ত পেয়ে আমি তো খুব খুশি। এমন সময় আসল ঘটনাটা ঘটল।
পিসেমশাই ছিলেন পুলিসের ডিএসপি। তাঁর দুই আর্দালি বিয়েবাড়িতে মজুত থাকত সবসময়। সে-সময় ওখানে হনুমানের খুব উৎপাত ছিল। পিসেমশায়ের বাড়ির ছাদে প্যাণ্ডেলের ধারে ধারে তারা বসে থাকত। পিসের হাতে বিস্কুট খেত। আমি খুব ভয় পেতাম সেই বীর হনুমাগুলোকে, সেটা দেখে দুই আর্দালিকাকুই খুব হাসত।
আইবুড়োভাতের দিন দুপুরবেলা দিদির খাওয়া দাওয়ার পর, আমাদের ভাইবোনেদের একটা মজলিশ বসেছিল, এটাতে বহুকষ্টে আমিও এন্ট্রি পেয়েছিলাম। সবাই হইচই করছি এমন সময় একটা অপার্থিব চিৎকার আর ভারী কিছু পড়ার শব্দ পশ্চিমে বড়ো-বারান্দার দিকে। শুনেই ত আমরা একছুটে সেখানে। হয়েছে কি, এক আর্দালিকাকু বারান্দায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ দেখে মোটা খয়েরি দড়ির মত কী ঝুলে আছে উপর থেকে। দেখেই সে সেটা ধরে মেরেছে এক রামটান। ফলস্বরূপ খয়েরি দড়ির মালিকসহ সজোরে ভূতলে পতন ও মূর্চ্ছা।
ব্যাপারটা হলো, সেটা ছিল একটা হনুমানের লেজ। মাটিতে পড়ে সে বেচারী জ্ঞান হারিয়ে ছিল। সবাই হইহই করে উঠল দেখে, বাবা, দাদা আর পিসেমশাই ছুটে গেলেন হনুমানটাকে দেখতে, পারলেন না। মুহুর্তের মধ্যে খানদশেক হনুমান জড়ো হয়ে গেল। তাদের চোখের দৃষ্টি ভয়ঙ্কর, আর কী করে তারা বুঝল সেই আর্দালিকাকু এই কাজটা করেছে, সেটা আজও জানি না। কিন্তু তিন-চারটে হনুমান যখন ঠিক তাকে তাক করেই তেড়ে এল, আর্দালিকাকু একছুট্টে বসার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো বাকি হনুমানগুলো উঠোনের পাতকুয়াতে রাখা বালতিতে করে এনে জল ঢালছিল সেই হনুমানটার মাথায়। একজন তার মাথা কোলে নিয়ে বসেছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যে হনুমানটা উঠে বসল। কপালের কোণে একটু রক্ত লেগে আছে। আমরা সবাই জাল-দেওয়া বারান্দার আড়ালে দাঁড়িয়েই সবটা দেখলাম। এখানেই শেষ নয়। তার পরের দিন বিয়ে। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ভুলে গেলাম। কিন্তু তারা ভোলেনি। সেটা টের পেলাম বিয়ের দিন সকালে, আর্দালিকাকুকে কি একটা কাজে পিসেমশাই বাইরে পাঠিয়েছিলেন। বাইরে যাবার দু’মিনিটের মাথায় সাংঘাতিক ছুটে সে ফিরে এল। আমি তখন সেখানেই দাঁড়িয়েছিলুম। বাড়ির গেটের মুখে চার-পাঁচটা হনুমান! বেরোতে দেবে না। এইভাবে টানা সাতদিন চলল। কাকুর চওড়া গালপাট্টা শুকিয়ে গেছিল। সে-সময়ে দেখতাম পিসেকে, চায়ের সময় টেবিলের ধারের জানালা দিয়ে বাড়ানো লোমশ হাতটায় রোজ দুখানা বিস্কুট দিতে। সেই আমার কাছ থেকে হনুমানকে দেখা। পশুপাখিদের ভালোবাসতে শেখা। পিসে বলতেন কাছের সব জঙ্গল কেটে দিয়েছে, তাই বেচারারা খাবারের খোঁজে ছুটে আসে। আটদিনের দিন হনুমানরা গেট ছাড়ল, যেদিন দিদি অষ্টমঙ্গলায় ফিরল। স্বস্তি পেলাম সবাই। পরেরদিন সকালে দেখি আবার আমার চেয়ারের পাশে সেই লোমশ হাত, ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু পিসের ইশারায় সাহস করে দুটো বিস্কুট দিয়েছিলাম, কপালের কাটা দাগটা নজর এড়ায়নি। সেই শুরু, সেই হনুমানটা তারপর থেকে প্রায় রোজ আসত। কোনদিন দুটো বিস্কুটের বেশি কিছুই দিইনি। কিন্তু কেমন একটা টান পড়ে গিয়েছিল। হঠাৎ একদিন দেখলাম সে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। ভারী দুঃখ পেয়েছিলাম।
পিসের ছাদের ফুলগাছগুলোয় জল দিতে যেতাম পিসিমণির সঙ্গে।ছোটোবেলা থেকেই গাছপালার সঙ্গে আমার ভারী বন্ধুত্ব।একটু একাল ষেঁড়ে হবার জন্য আমার মানুষবন্ধুর সংখ্যা সেই তখন থেকেই বেশ কম। তো, রাগ বা দুঃখ হলে শহরে আর গোঁসাঘর কোথায় পাব? চলে যেতাম আমার বাড়ির ছাদে, চাঁদ, ফুল আর হ্যাঁ, আমার পাড়ার পুষিম্যাওয়ের কাছে যার নাম আমি দিয়েছিলাম বিধুসুন্দরী!
টানা দু’মাস পিসের বাড়ি। মাঝে মাঝে এদের জন্য মন কেমন করলেও, ভাব জমে গেছিল এই ফুলগাছগুলোর সঙ্গে। কিন্তু যেটা ভুলতে পারছিলাম না সেটা হলো সেই হনুমানটার কথা। এতদিন, এতগুলো হরলিক্স বিস্কুট খেয়ে বেমালুম ভুলে গেল আমায়? ব্যাটা মানুষদের থেকে কিছু কম যায় না দেখছি! পেটের মধ্যে গুড়গুড় করছিল একটা ব্রহ্মশাপ। সেটা দেব দেব করছি, এমন সময় ঘটনাটা ঘটল।এক বিকালে ছাদে দাঁড়িয়ে পিসের গাছের মিষ্টি আম খাচ্ছি, হঠাৎ একপাল হনুমানের দল ছাদে এসে আক্রমণ করল ফুলগাছগুলোকে। তখন পিসি ছাদে নেই, আমি একাই ছিলাম। তিন-চারটে বড়ো হনুমান দেখে দারুণ ভয় পেয়ে গেছি। একজন আবার ছাদের দরজাটার কাছেই বসে আছে। আরেকজন আমার প্রিয় হলুদ গোলাপটার কুঁড়ি ছিঁড়ছে। খুব ভয় পেয়ে আমি চিৎকারের কথাও ভুলে গেছি। এমন সময় দেখলাম কোথা থেকে আরেকটা হনুমান এসে এক ধাক্কা দিল ওই হনুমানটাকে। ওর মারমুখি মূর্তি দেখে বাকি দুটোও সরে গেল দেখলাম। তাড়াতাড়ি দরজার কাছে যেতে গিয়ে দেখি ওই হনুমানটার কোলে আর একটা ছোট্ট হনুমান। মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই চোখে পড়ল কপালের কাটা দাগটা। বাড়িয়ে দেওয়া হাতটায় তুলে দিলাম না খাওয়া আমটা। নিজে খেলো না। বাচ্চাটার মুখে দিল। অরণ্য কমে আসছে। ওদের খাবার কমে আসছে।
ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি-বাইশ আগেকার। এখন আর রাগ হয় না তেমন, ফুল গাছ আজো আছে। হনুমানের দলও আসে।
তবে সেই করুণাপ্রার্থী চোখ দু’খানা মনে পড়ে আজো। মনে পড়ে ওদের বন্ধুত্বের টান, যেটা মানুষদের মধ্যে ক্রমহ্রাসমান।