মূল কাহিনিঃ অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ইজিপশিয়ান টুম্ব
আমার বন্ধু এরক্যুল পোয়্যারোর কল্যাণে আমার বেশ কয়েকটি রোমহর্ষক ও নাটকীয় অভিজ্ঞতা হয়েছে। এদের মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা হয় মিশরীয় রাজা মেন-হার-রা-এর সমাধির অনুসন্ধান এবং তার পরবর্তী একের পর এক মৃত্যুর মিছিলকে কেন্দ্র করে। লর্ড কারনাভন ফারাও তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কার করবার পর, ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ স্যার জন উইলার্ড এবং নিউইয়র্কের ধনকুবের মিঃ ব্লেইবনার কাইরোর কাছেই, গিজের পিরামিডের অদূরে পুরাতাত্ত্বিক খনন চালাতে গিয়ে একদম অপ্রত্যাশিতভাবেই হঠাৎ বেশ কয়েকটি সমাধি খুঁজে পেয়ে যান। এই আবিষ্কার চারদিকে রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয়। এর মধ্যে প্রধান সমাধিটি ছিল রাজা মেন-হার-রা-এর। মেন-হার-রা ছিলেন অষ্টম মিশরীয় রাজবংশের এক রাজা যিনি এমন এক সময় রাজত্ব করেছেন যখন মিশরের শাসন ব্যাবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ছে। এঁর এবং এঁর রাজত্বকাল সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না। কিন্তু এই সমাধিগুলির আবিষ্কারের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ প্রায় সব খবরের কাগজেরই শিরোনামে এসে গিয়েছিল।
এই আবিষ্কারের কিছুকালের মধ্যেই এমন এক ঘটনা পরম্পরা শুরু হয়, যার জন্য এই আবিষ্কার বহুদিন ধরে মানুষের মন থেকে হারিয়ে যেতে পারেনি। এই ঘটনা পরম্পরার সূত্রপাত স্যার জন উইলার্ডের আকস্মিক হৃদরোগে মৃত্যুর হাত ধরে। যেসব খবরের কাগজ একটু বেশি নাটুকে, তারা সাততাড়াতাড়ি প্রাচীন মিশরীয় গুপ্তধনের সঙ্গে জড়িত সব অভিশাপের গল্প ফেঁদে নানান মুখরোচক চর্চা আরম্ভ করে দিল। আর অমনি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা অভিশপ্ত মমির বিষয়ে নতুন উদ্যমে সর্বত্র আলোচনা শুরু হয়ে গেল।
এর দু’সপ্তাহের মধ্যেই হঠাৎ মিঃ ব্লেইবনার মারা গেলেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হল রক্তে বিষক্রিয়া। আর তার কিছুদিনের মধ্যেই মিঃ ব্লেইবনারের ভাইপো নিউইয়র্কে নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করে বসলেন। ব্যস, আর যায় কোথায়! মেন-হার-রা-এর অভিশাপের গল্প এবার রীতিমতো সবার মুখে মুখে ফিরতে লাগল। আর সেই সঙ্গে প্রাচীন মিশরের বিস্মৃত ও হারিয়ে যাওয়া সব জাদুবিদ্যার আলোচনাও নতুন উৎসাহে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠল।
ঠিক এই সময়েই একদিন পোয়্যারো লেডি উইলার্ডের কাছ থেকে এক ছোট্ট চিঠি পেল। লেডি উইলার্ড তাঁর চিঠিতে পোয়্যারোকে একটু সময় বের করে তাঁর সঙ্গে তাঁর কেন্সিংটন স্কোয়ারের বাড়িতে দেখা করবার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পোয়্যারোর সঙ্গে আমিও গেলাম সেখানে। লেডি উইলার্ড একজন দীর্ঘাঙ্গী, শীর্ণকায়া ভদ্রমহিলা। শোকের পোশাকে আর বিবর্ণ মুখে তাঁর সদ্য প্রিয়জন বিয়োগের ব্যথার চিহ্ন স্পষ্ট। তিনি পোয়্যারোকে দেখে বললেন, “আপনি যে আমার অনুরোধ রাখতে এত তাড়াতাড়ি এসেছেন, এর জন্য আমি আপনার কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ, মসিয়েঁ পোয়্যারো।”
“আমি আপনাকে সবরকম সাহায্য করতে প্রস্তুত, লেডি উইলার্ড। বলুন কী বিষয়ে আলোচনা করতে আপনি আমাকে ডেকেছেন।”
“আপনি তো একজন গোয়েন্দা। কিন্তু আমি শুধু সেজন্য আপনাকে ডাকিনি। আমি জানি আপনি এমন একজন মানুষ যাঁর নিজস্ব মতামত আছে, কল্পনাশক্তি আছে, আর পৃথিবীর বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতাও আছে। সত্যি করে বলুন তো মসিয়েঁ পোয়্যারো, অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা সম্পর্কে আপনার কী মতামত।”
পোয়্যারো ইতস্ততভাবে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বেশ খানিক ভেবেচিন্তে অবশেষে বলল, “দেখুন লেডি উইলার্ড, আমাদের মধ্যে কোনও পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি থাকা উচিত নয়, কথাবার্তা খোলাখুলি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আপনি আমাকে যেকোনও সাধারণ অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার বিষয়ে ঠিক জিজ্ঞেস করছেন না, এখানে আপনার ব্যক্তিগত জীবনও কোনোভাবে জড়িত, তাই না? আপনি সম্ভবত আপনার প্রয়াত স্বামীর মৃত্যুর ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করতে চাইছেন যদিও সেটা ঠিক সরাসরি নয়। কী, ঠিক বলছি তো?”
“একদম ঠিক।”
“আপনি চান আমি আপনার স্বামীর মৃত্যুর বিষয়ে তদন্ত করি?”
“আমি চাই যে আপনি এই ঘটনাগুলির ঠিক কতটা বাস্তব ভিত্তি আছে আর কতটা খবরের কাগজগুলোর উর্বর কল্পনাশক্তির ফসল, তা যাচাই করুন। ইতিমধ্যে তিনটি মৃত্যু ঘটে গিয়েছে। আলাদা করে দেখলে প্রত্যেকটির নিজস্ব কারণ পাওয়া যাবে। কিন্তু একসঙ্গে বিচার করলে মনে হয়, এ কী অদ্ভুত কাকতালীয় যোগাযোগ! আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, প্রত্যেকটি মৃত্যুই ঘটেছে মেন-হার-রা-এর সমাধি খুঁড়ে বের করবার একমাসের মধ্যে। হয়তো আমি কুসংস্কারাক্রান্তের মতো কথা বলছি, কিন্তু এ তো হতেই পারে যে প্রাচীন যুগের কোনও সুপ্ত অভিশাপ জেগে উঠেছে, যার ব্যাখ্যা আমাদের আধুনিক বিজ্ঞানের আওতার বাইরে? তিনটি মৃত্যুকে তো আর আমরা অস্বীকার করতে পারি না! আমি ভীষণ ভয়ে দিন কাটাচ্ছি, মসিয়েঁ পোয়্যারো, মারাত্মক ভয়ে! কেবলই মনে হচ্ছে, এর শেষ এখনও হয়নি!”
“আপনি ঠিক কার জন্য ভয় পাচ্ছেন, লেডি উইলার্ড?”
“আমার ছেলের জন্য, মসিয়েঁ পোয়্যারো। ওর বাবার মৃত্যুসংবাদ যখন আসে, আমি তখন খুব অসুস্থ । ও ওই সময়েই অক্সফোর্ড থেকে বাড়ি এসেছিল। খবর পেয়ে ও-ই গিয়ে ওর বাবার মৃতদেহ নিয়ে আসে। কিন্তু আমার অনেক অনুরোধ উপরোধ সত্ত্বেও ও আবার চলে গেছে। ঐ কাজের ব্যাপারে ওর এত উৎসাহ যে ও ওর বাবার কাজ সম্পূর্ণ করে আসতে চায় আর সেইজন্য যাবতীয় খোঁড়াখুঁড়িও চালিয়ে যেতে চায়। আপনি হয়তো আমাকে একজন মূর্খ, অন্ধবিশ্বাসপ্রবণ মহিলা ভাববেন মসিয়েঁ পোয়্যারো, কিন্তু আমার স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই যে আমি সাংঘাতিক ভয়ে আছি। যদি মৃত রাজার আত্মা এখনও সন্তুষ্ট না হয়ে থাকে! আপনার হয়তো মনে হচ্ছে আমি অর্থহীন কথা বলে চলেছি…”
“না লেডি উইলার্ড,” পোয়্যারো প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই উত্তর দিল, “আমিও কুসংস্কারের শক্তিতে বিশ্বাস রাখি। সত্যি বলতে কী, আমাদের জানা পৃথিবীর সবচেয়ে জোরালো শক্তিগুলির মধ্যেই এটি পড়ে।”
আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম পোয়্যারোর দিকে। আমার এই বন্ধুটিকে আমি কোনোদিন, কোনোদিক থেকেই কুসংস্কারপ্রবণ বলতে পারব না। কিন্তু পোয়্যারো তো এখন একদম আন্তরিকভাবেই কথাগুলো বলছে! “তাহলে আপনি চান যে আমি আপনার ছেলেকে রক্ষা করি, তাই তো? আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি লেডি উইলার্ড, আমি যতদূর সম্ভব চেষ্টা করব যাতে আপনার ছেলের কোনও বিপদ না হয়।”
“হ্যাঁ, স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক সব বিপদ থেকে আপনি যে ওকে রক্ষা করবেন তা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু অতিপ্রাকৃতিক প্রভাবের খাত থেকে?”
“দেখুন লেডি উইলার্ড, মধ্যযুগীয় অনেক বইতেই কালো জাদুর প্রভাব নষ্ট করবার উপায় বাতলানো আছে। আমরা আমাদের গর্বস্ফীত বিজ্ঞানের ধারণা দিয়ে যতটুকু জানতে পেরেছি, সেই সময়ের মানুষরা হয়তো তার চেয়ে অনেক বেশি জানত! এবার আমাকে কয়েকটা কথা বলুন তো। আপনার স্বামী তো প্রথম থেকেই একজন একনিষ্ঠ মিশর বিশারদ ছিলেন, তাই না?”
“হ্যাঁ, অনেক অল্প বয়েস থেকেই ওঁর এই বিষয়ে উৎসাহ। উনি সমকালীন বিশ্বে মিশরের বিষয়ে শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একজন ছিলেন।”
“কিন্তু মিঃ ব্লেইবনার তো নিতান্তই শখের জন্য মিশর-চর্চা শুরু করেন, তাই না?”
“হ্যাঁ, তা তো বটেই। মিঃ ব্লেইবনার ছিলেন বিরাট বড়লোক, তাই খেয়াল-খুশিমতো যেকোনও বিষয়েই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ, যখন যা খেয়াল চাপত, তার পিছনেই ঢালার মতো অনেক টাকা ছিল তাঁর হাতে। আমার স্বামী তাঁকে মিশরের বিষয়ে উৎসাহিত করতে পেরেছিলেন এবং সেইজন্য ওঁর কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পেয়ে তবেই এই অভিযানে যেতে পেরেছিলেন।”
“আর মিঃ ব্লেইবনারের ভাইপো? তাঁর মিশর নিয়ে উৎসাহ কেমন ছিল? তিনিও কি ঐ দলে ছিলেন?”
“আমার তা মনে হয় না। সত্যি বলতে কী, খবরের কাগজে ওঁর মৃত্যুসংবাদ পড়বার আগে পর্যন্ত আমি জানতামই না যে মিঃ ব্লেইবনারের কোনও ভাইপো আছেন। আমার তো মনে হয় মিঃ ব্লেইবনারের সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না, কারণ মিঃ ব্লেইবনারকে আমি কোনোদিন তাঁর কোনও আত্মীয়ের কথা উল্লেখ পর্যন্ত করতে শুনিনি।”
“ওই দলে আর কারা কারা ছিলেন?”
“ওই দলে ছিলেন ডঃ টসউইল, যিনি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের একজন নিম্নপদস্থ অফিসার, নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামের মিঃ স্নাইডার, একজন অল্পবয়স্ক আমেরিকান সেক্রেটারি, ডঃ অ্যামেস, যিনি এক পেশাদার চিকিৎসক হিসেবে এই দলের সঙ্গে গিয়েছিলেন, আর ছিল হাসান, আমার স্বামীর অত্যন্ত অনুগত এক স্থানীয় ভৃত্য।”
“ওই আমেরিকান সেক্রেটারিটির নাম কি আপনার মনে আছে?”
“যতদূর মনে পড়ে, ওর নাম হার্পার। কিন্তু আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মিঃ ব্লেইবনারের সঙ্গে ওর তখনও খুব বেশিদিন হয়নি। ও খুব ভালো স্বভাবের ছেলে ছিল।”
“অনেক ধন্যবাদ, লেডি উইলার্ড।”
“এ ব্যাপারে আর কিছু…”
“আপাতত আর কিছু নয়। এবার এই ব্যাপারটা আমার হাতেই ছেড়ে দিন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন লেডি উইলার্ড, আপনার ছেলেকে রক্ষা করবার জন্য একজন মানুষের পক্ষে যা যা করা সম্ভব, আমি সবই করব।”
পোয়্যারোর এই শেষের কথাগুলো লেডি উইলার্ডকে খুব একটা আশ্বস্ত করল বলে আমার মনে হল না, কারণ একথা শুনেও তিনি কেমন যেন গুটিয়ে রইলেন। কিন্তু পোয়্যারো যে তাঁর ভয়কে একেবারে উড়িয়ে দেয়নি, এতেই মনে হল তিনি যেন কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন।
পোয়্যারোর মধ্যে যে কোনোরকম কুসংস্কার থাকতে পারে, এ আমি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। ফেরার পথে আমি তো ওকে রীতিমতো চেপেই ধরলাম। ও কিন্তু গম্ভীর হয়েই রইল। বেশ আন্তরিকতার সঙ্গেই উত্তর দিল, “হ্যাঁ হেস্টিংস, আমি এইসব জিনিসে বিশ্বাস করি, কুসংস্কারের শক্তিকে কখনও ছোটো করে দেখা উচিত না।”
“তা আমরা এই বিষয়ে এবার ঠিক কী করতে চলেছি?”
“আমাদের বাস্তববুদ্ধি যা বলে, আমার প্রিয় হেস্টিংস। চল তাহলে, এবার আমরা প্রথমে নিউইয়র্কে একটা তার করে মিঃ ব্লেইবনারের ভাইপোর মৃত্যু সম্পর্কে আর একটু বিশদে খবরাখবর নিই।”
সেইমতো তার করা হল এবং খুব দ্রুতই তার সম্পূর্ণ এবং যথাযথ উত্তরও এসে গেল। মিঃ ব্লেইবনারের ভাইপো, রুপার্ট ব্লেইবনার, বিগত অনেক বছর ধরেই বেশ খারাপ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল। সে দীর্ঘদিন বিভিন্ন সমুদ্রের তীরে তীরে প্রায় যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে এবং বাড়ি থেকে পাঠানো টাকার ভরসায় দক্ষিণ সাগরীয় বিভিন্ন দ্বীপে ভবঘুরের জীবন কাটিয়েছে। দু’বছর আগে সে নিউইয়র্কে ফিরে আসে এবং সেখানে তার অবস্থার ক্রমশ আরও অবনতি ঘটে। আমার যে ব্যাপারটা সবথেকে বেশি চোখে পড়ল, তা হল, এই রুপার্ট ব্লেইবনার সম্প্রতি কারও কাছ থেকে এক বিরাট অঙ্কের টাকা ধার করে মিশরে গিয়ে পৌঁছায়। চেনা-পরিচিতদের সে বলেছিল যে, মিশরে নাকি তার কোনও এক বন্ধু আছেন, যিনি তাকে অনেক টাকা ধার দিতে পারেন। কিন্তু তার এই পরিকল্পনাটিতেই এক মহা ভুল হয়ে গিয়েছিল। সে কিছুকালের মধ্যেই তার কোনও এক হাড়-কঞ্জুস কাকাকে গালাগালি দিতে দিতে নিউইয়র্কে ফিরে আসে। তার মতে তার এই কাকাটি নিজের রক্তের সম্পর্কের চেয়ে কোন আদ্যিকালে মরে ভূত হয়ে যাওয়া রাজাদের হাড়গোড় নিয়ে বেশি চিন্তিত। রুপার্টের এই সংক্ষিপ্ত মিশর ভ্রমণের সময়েই স্যার জন উইলার্ডের মৃত্যু হয়। নিউইয়র্কে ফিরে আবার রুপার্ট তার অপচয়ে ভরা জীবনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর তারপর হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়েই একদিন আত্মহত্যা করে বসে। সে একটা চিঠিতে খুব অদ্ভুত এবং কৌতূহলোদ্দীপক কিছু কথা লিখে যায়। দেখে মনে হয় সে কোনও এক মুহূর্তে অনেক অনুশোচনা থেকে কথাগুলো লিখেছে। সে নিজেকে এক কুষ্ঠরোগী এবং ব্রাত্য বলে বর্ণনা করেছে এবং লিখেছে, এমন অবস্থায় বেঁচে থাকার চেয়ে মরণও শ্রেয়।
আমার মাথায় এক অলীক তত্ত্ব এল। আমি কখনোই এক বহু শতাব্দীপ্রাচীন মৃত মিশরীয় রাজার প্রতিহিংসার গল্পে বিশ্বাস করিনি। আমি এক্ষেত্রে আরও আধুনিক এক অপরাধের ছায়া দেখতে পেলাম। ধরে নেওয়া যাক, রুপার্ট তার কাকাকে পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দেবার জন্য বিষপ্রয়োগের কথা ভাবল। ভুল করে সেই বিষ এক মারাত্মক মাত্রায় সেবন করে ফেললেন স্যার জন। রুপার্ট তার কৃত অপরাধের জন্য অনুতাপে দগ্ধ হয়ে নিউইয়র্ক ফিরে গেল। সেখানে সে তার কাকার মৃত্যুসংবাদ পেল এবং অনুভব করল তার অপরাধটি কত অপ্রয়োজনীয় ছিল। আমি আমার এই তত্ত্বটি পোয়্যারোকে খুলে বললাম। সে বেশ উৎসাহিত হয়ে বলল, “তোমার এই তত্ত্বটাতে সত্যিই বেশ উদ্ভাবনী শক্তির প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তুমি তো সমাধির অভিশাপের ব্যাপারটা পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিলে!”
আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, “তুমি এখনও মনে কর যে সমাধির অভিশাপের সঙ্গে এই ঘটনার কোনও সম্পর্ক আছে?”
উত্তরে পোয়্যারো বলল, “অবশ্যই আছে বন্ধু এবং এতটাই বেশি আছে, যে আমরা আগামীকাল মিশর রওনা হচ্ছি।”
“কী!” আমি প্রচণ্ড অবাক হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।
“আমি ঠিক এটাই বলেছি।” পোয়্যারোর সারা মুখে এক সচেতন বীরত্বের ভাব ছড়িয়ে পড়ল। তারপরেই খুব ব্যথিত মুখ করে বেশ দুঃখের সঙ্গে সে বলল, “কিন্তু ওফ্, আবার সেই বিরক্তিকর সমুদ্রযাত্রা!”
এর প্রায় এক সপ্তাহ পরের কথা। আমরা তখন মিশরীয় মরুভূমির সোনালি বালির ওপর দিয়ে চলেছি। সূর্যদেব প্রবল বিক্রমে আমাদের মাথায় উত্তাপ বর্ষে চলেছেন। বেচারা পোয়্যারো পথশ্রমে প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে আমার পাশে পাশে চলল। আমার এই বন্ধুটির বেশি ঘোরাঘুরি কোনও কালেই বিশেষ সহ্য হয় না। মার্সেই থেকে আমাদের চারদিনের সমুদ্রযাত্রা এমনিতেই ওকে বেশ কাবু করে ফেলেছিল। আলেক্সান্দ্রিয়াতে পৌঁছেই ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, যেন আমার বন্ধু পোয়্যারো নয়, তার প্রেতাত্মা এসে পৌঁছেছে। এমনকি যে পরিচ্ছন্নতা তার রীতিমতো স্বভাবগত, তাও যেন তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমরা কাইরো পৌঁছেই প্রায় পিরামিডের ছায়ায় ঘেরা মেনা হাউস হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
মিশরের সৌন্দর্য ইতিমধ্যেই আমার মন জুড়ে বসেছিল। কিন্তু পোয়্যারোর বেলায় তা হয়নি। সে লন্ডনে যা পরে, একদম তেমন পোশাক পরেই পকেটে একটা ছোটো কাপড় ঝাড়বার ব্রাশ নিয়ে ক্রমাগত তার কালো পোশাকের ওপর জমতে থাকা ধুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে চলল। প্রায় বিলাপ করেই সে বলল, “আমার বুটগুলোর অবস্থা শুধু দেখো হেস্টিংস! আমার এমন ঝকঝকে তকতকে ভালো চামড়ার বুট, তার ভেতরে বালি ঢুকে আমার পায়ে যন্ত্রণা ধরিয়ে দিল, আর জুতোর বাইরে বালি জমতে দেখা তো চোখের ওপর রীতিমতো অত্যাচার। এই মারাত্মক গরমে তো আমার গোঁফগুলো পর্যন্ত পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে!”
“স্ফিংক্সের দিকে দেখো।” আমি বললাম, “আমার মনে হচ্ছে যেন ওর নিঃশ্বাস থেকে একই সঙ্গে রহস্য আর সৌন্দর্য ঝরে ঝরে পড়ছে।”
পোয়্যারো বেশ অসন্তুষ্টভাবে সেদিকে তাকিয়ে বলল, “ও মোটেই খুশি নয়। কী করেই বা থাকবে! এমন বিদঘুটেভাবে বালিতে অর্ধেক গাঁথা অবস্থায় রয়েছে, তাও আবার এই অভিশপ্ত বালিতে!”
আমাদের নক-সার-মেরে, যাকে গাইডবুকে বলে লা-ডিউন-ইম্পেকেবলস, সেখানে এক ছুটি কাটানোর অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে আমি ওকে স্মরণ করালাম, “দেখো ভাই, বেলজিয়ামেও অনেক বালি আছে।”
“ব্রাসেলসে তো নেই।” বলে উঠল পোয়্যারো। তারপর বেশ ভাবুকের মতো পিরামিডগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “এই পিরামিডগুলোর অন্তত একটা শক্তপোক্ত এবং জ্যামিতিক আকার আছে। কিন্তু ওদের গায়ে ওই ঢেউ খেলানো ভাবটা দেখতে মোটেই সুখকর নয়। আর ওই পামগাছগুলো, ওগুলোকে আমার একেবারে পছন্দ নয়! তার মধ্যে আবার ওগুলোকে ঠিকঠাক সার বেঁধে বসানোও হয়নি!”
আমি পোয়্যারোর বিলাপ মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বললাম যে এবার আমাদের তাঁবুর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করা উচিত। তাঁবুতে আমাদের উটে চড়ে যেতে হত ছবির মতো বেশ কিছু ছেলের এবং এক বড়সড় চেহারার পথপ্রদর্শকের তত্ত্বাবধানে, সেই প্রাণীগুলো বেশ ধৈর্যের সঙ্গে আমাদের জন্য হাঁটু গেড়ে অপেক্ষা করছিল।
আমি উটের পিঠে আসীন পোয়্যারোর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবার সময় ওর দিকে দেখলাম। সে এক দেখার মতো দৃশ্য বটে! সে গোঙানি এবং বিলাপ দিয়ে শুরু করে তারপর চিৎকার, বিভিন্ন রকমের অঙ্গভঙ্গী এবং শেষপর্যন্ত ভার্জিন মেরী আর ক্যালেন্ডারে লেখা সব সাধুসন্তদের ডাকাডাকি করতে লাগল। অবশেষে অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে সে উট থেকে নেমে এসে ছোটোখাটো একটা গাধার পিঠে বাকি পথটুকু পেরোল। লাফাতে লাফাতে চলা উটের পিঠে চড়া যে আনাড়ি লোকেদের পক্ষে আদৌ সহজ ব্যাপার নয়, একথা আমি অস্বীকার করব না। কারণ ঐ উটে চড়বার পর বেশ কয়েকদিন ধরে আমারও গা-হাত-পায়ে কেমন একটা আড়ষ্ট ভাব থেকে গিয়েছিল।
অবশেষে আমরা পুরাতাত্ত্বিক খনন যেখানে চলছে সেখানে পৌঁছলাম। সাদা জামাকাপড় ও হেলমেট পড়া, রৌদ্রদগ্ধ, সাদা দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক আমাদের নিতে এলেন। “মসিয়েঁ পোয়্যারো আর ক্যাপ্টেন হেস্টিংস নিশ্চয়ই? আমরা আপনাদের তার পেয়েছিলাম। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে কাইরোতে আপনাদের নিতে কেউ আসতে পারেনি। আসলে এমন একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল যে আমাদের সব পরিকল্পনাই এদিক ওদিক হয়ে গেল।”
পোয়্যারোর মুখ শুকিয়ে গেল। তার যে হাতটা ইতিমধ্যে তার কাপড় ঝাড়বার ব্রাশটার ওপর চলে গিয়েছিল, সেটা সেখানেই থমকে গেল।
“আরেকটি মৃত্যু নয় নিশ্চয়ই?” সে শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, তাই।”
“স্যার গাই উইলার্ড?” আমি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম।
“না, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। আমার আমেরিকান সহকর্মী, মিঃ স্নাইডার।”
“আর মৃত্যুর কারণটা?” পোয়্যারো জানতে চাইল।
“ধনুষ্টঙ্কার।”
আমি ভয়ে সাদা হয়ে গেলাম। আমার চারপাশের পুরো পরিবেশটাতেই কেমন যেন শয়তানের উপস্থিতি অনুভব করতে লাগলাম। সে উপস্থিতি সূক্ষ্ম এবং ভয়াবহ। একটা ভয়ানক চিন্তা আমার মাথায় খেলে গেল। যদি এরপর আমার পালা হয়?
“হে ভগবান!” অনুচ্চ স্বরে বলল পোয়্যারো, “আমি এর কিছুই বুঝতে পারছি না। এ তো সাংঘাতিক! আমাকে একটা কথা বলুন মসিয়েঁ, ধনুষ্টঙ্কারই যে এই মৃত্যুর কারণ, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই?”
“আমার তো মনে হয় নেই। তবে এ বিষয়ে আপনাকে ডঃ অ্যামেস আমার থেকে ভালো বলতে পারবেন।”
“ও হ্যাঁ, অবশ্যই, আপনি তাহলে ডাক্তার নন।”
“আমার নাম টসউইল।”
ইনিই তাহলে সেই ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ যাঁকে লেডি উইলার্ড ব্রিটিশ মিউজিয়ামের এক নিম্নপদস্থ কর্মচারী বলে বর্ণিত করেছিলেন। ওঁর মধ্যে একই সঙ্গে একটা গম্ভীর এবং দৃঢ় ব্যাপার ছিল যেটা আমার মনে ওঁর সম্পর্কে সম্ভ্রমের উদ্রেক করল।
“আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।” বলে চললেন ডঃ টসউইল, “আপনাদের স্যার গাই উইলার্ডের কাছে নিয়ে যাই। উনি আপনাদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন; আপনারা এলেই সঙ্গে সঙ্গে খবর দিতে বলেছেন।”
আমরা শিবিরের মধ্যে দিয়ে একটা বড়ো তাঁবুর সামনে এসে পৌঁছলাম। ডঃ টসউইল তার পর্দা সরাতে আমরা ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে তিনজন লোক বসে ছিল।
“মসিয়েঁ পোয়্যারো আর ক্যাপ্টেন হেস্টিংস এসে গেছেন, স্যার গাই।” বললেন ডঃ টসউইল।
তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়স্ক ছেলেটি প্রায় লাফিয়ে উঠে আমাদের স্বাগত জানাতে এগিয়ে এল। তার মধ্যে একটা বিশেষ আবেগপ্রবণতা ছিল যা আমাকে তার মায়ের কথা মনে করিয়ে দিল। তার চামড়ায় রৌদ্রের দহনের ছাপ বাকিদের তুলনায় অনেক কম। এর সঙ্গে তার চোখের চারপাশের একটা কৃশ ভাব যোগ হয়ে তাকে বাইশ বছরের তুলনায় অনেক বয়স্ক দেখাচ্ছিল। স্পষ্টতই সে একটা প্রচণ্ড মানসিক চাপের সঙ্গে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছিল।
সে তার বাকি দু’জন সঙ্গীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ডঃ অ্যামেস একজন ত্রিশ বছরের আশেপাশে বয়সের ভদ্রলোক, যাকে দেখে বেশ যোগ্য বলে মনে হয়, তাঁর কপালের দু’পাশের চুলে সামান্য সাদার আভাস। মিঃ হার্পার একজন হাসিখুশি পাতলা চেহারার যুবক, জাতীয় পরিচয় চিহ্নস্বরূপ একটা হর্ন-রিমড চশমা পরে থাকেন।
কিছুক্ষণ এলোমেলো কথাবার্তা বলার পর মিঃ হার্পার বেরিয়ে গেলেন, আর ডঃ টসউইলও তার পিছন পিছন গেলেন। আমাদের সঙ্গে রয়ে গেলেন শুধু স্যার গাই আর ডঃ অ্যামেস।
“দয়া করে যা প্রশ্ন আছে জিজ্ঞেস করুন, মসিয়েঁ পোয়্যারো।” বলল উইলার্ড, “এই একের পর এক বিপর্যয়ে আমরা প্রবলভাবে হতবাক হয়ে গেছি। কিন্তু এটা কোনোভাবেই কাকতালীয় যোগাযোগ ছাড়া কিছু নয়–আর কিছু হতেই পারে না।”
তার ধরনধারণে একটা স্নায়বিক দৌর্বল্য প্রকাশ পাচ্ছিল যেটা তার কথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছিল। দেখলাম, পোয়্যারো গভীর মনযোগের সঙ্গে তাকে লক্ষ করে চলেছে।
“আপনি কি সত্যিই মন থেকে একাজ করতে চান, স্যার গাই?”
“অবশ্যই। যেকোনও ঘটনাই ঘটুক আর তার জন্য যা কিছুই হয়ে যাক না কেন, কাজ চলতে থেকেছে। তাই এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন।”
পোয়্যারো এবার অন্যজনের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। “এ বিষয়ে আপনার কী বক্তব্য, ডাক্তারবাবু?”
“দেখুন,” বেশ বীরের ভঙ্গীতে বললেন ডাক্তার, “আমি পিছিয়ে আসতে রাজি নই।”
পোয়্যারো তার এক বিশেষ গূঢ় অর্থপূর্ণ মুখবিকৃতি করল। “তাহলে আমাদের ভেবে বের করা দরকার যে আমরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। মিঃ স্নাইডার কবে মারা গেছেন?”
“তিনদিন আগে।”
“আপনি নিশ্চিত যে তাঁর ধনুষ্টঙ্কার হয়েছিল?”
“ভীষণভাবে।”
“এটা কি কোনোভাবেই, যেমন ধরুন, স্ট্রিকনিন বিষপ্রয়োগের ফলে হতে পারে না?”
“না মসিয়েঁ পোয়্যারো, আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাইছেন। কিন্তু এটা পুরোপুরিই ধনুষ্টঙ্কারের ঘটনা।”
“আপনি কি অ্যান্টি-সেরাম ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন?”
“অবশ্যই দিয়েছিলাম। যা কিছু করণীয় থাকতে পারে, সবকিছুই চেষ্টা করে দেখা হয়েছিল।”
“অ্যান্টি-সেরামটা কি আপনার কাছেই ছিল?”
“না। আমরা কাইরো থেকে আনিয়েছিলাম।”
“আপনাদের এই শিবিরে কি এমন ধনুষ্টঙ্কারের ঘটনা আরও ঘটেছে?”
“না, আর একটাও ঘটেনি।”
“আপনি কি নিশ্চিত যে মিঃ ব্লেইবনারের মৃত্যু কোনোভাবেই ধনুষ্টঙ্কারের ফলে হয়নি?”
“একদম সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত। ওঁর হাতের বুড়ো আঙুলটা একটু ছড়ে গিয়েছিল, সেটাই বিষিয়ে গিয়ে সেপ্টিসেমিয়া শুরু হয়ে যায়। যেকোনও সাধারণ লোকের কাছে দুটো জিনিস একইরকম শোনাবে আমি জানি, কিন্তু দুটো জিনিস সম্পূর্ণ আলাদা।”
“তাহলে আমাদের সামনে চারটি মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে আর তারা পরস্পরের থেকে পুরোপুরিভাবে আলাদা—একটা হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে, একটা রক্তে বিষক্রিয়ার জন্য, একটা আত্মহত্যা, আর একটা ধনুষ্টঙ্কার।”
“ঠিক তাই, মসিয়েঁ পোয়্যারো।”
“আপনি কি নিশ্চিত যে এই চারটি ঘটনার মধ্যে কোনও সাধারণ যোগসূত্র নেই?”
“আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“বেশ, আমি তাহলে খুব সোজাভাবেই বলি। এই চারজন কি এমন কোনও কাজ করেছিলেন, যাতে মেন-হার-রা-এর আত্মার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ পায়?”
ডাক্তার খুব অবাক হয়ে পোয়্যারোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
“আপনি নিশ্চয়ই কথাগুলো মজা করে বলছেন, মসিয়েঁ পোয়্যারো। আপনি নিশ্চয়ই এইসব বোকা বোকা কথাগুলোতে বিশ্বাস করেন না?”
পোয়্যারো খুব শান্তভাবে অনড় হয়ে রইল। তার সবুজ, বেড়ালের মতো চোখগুলোতে খুব সামান্য পলক পড়ছিল।
“তাহলে আপনি এই কথাগুলোতে বিশ্বাস করেন না, ডাক্তারবাবু?”
“না মশায়, একেবারেই করি না।” বেশ জোরের সঙ্গে বলে চললেন ডাক্তার, “আমি একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ এবং বিজ্ঞান যেটুকু শেখায়, আমি শুধু সেইটুকুতেই বিশ্বাস করি।”
“তাহলে কি বলতে চাইছেন প্রাচীন মিশরে কোনও বিজ্ঞান ছিল না?” পোয়্যারো খুব মৃদুভাবে জিজ্ঞেস করল। সে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না, আর সত্যি বলতে কী, ডঃ অ্যামেসকে দেখে এই মূহূর্তে বেশ কিংকর্তব্যবিমূঢ় মনে হচ্ছিল। “না না, আপনার উত্তর দেবার দরকার নেই, কিন্তু শুধু এটুক বলুন যে এখানকার স্থানীয় শ্রমিকরা কী মনে করে?”
“আমি মনে করি,” বললেন ডাক্তার, “যেখানে শ্বেতাঙ্গদের মাথা খারাপ হয়ে যায়, সেখানে স্থানীয় লোকেরা বিশেষ পিছিয়ে থাকবে না। আমি স্বীকার করছি যে তারা খুব ভয় পেয়েছে, কিন্তু তাদের ভয় পাবার কোনও কারণ নেই।”
“কী জানি!” পোয়্যারো যেন একটু অবিশ্বাসের সঙ্গেই বলল।
স্যার গাই সামনের দিকে ঝুঁকে অবিশ্বাসের সঙ্গে চিৎকার করে বলল, “সত্যিই, আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করতে পারেন না, কিন্তু ওহ্, সে তো অযৌক্তিক! আপনি ওভাবে ভাবলে প্রাচীন মিশর সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবেন না।”
উত্তরস্বরূপ পোয়্যারো তার পকেট থেকে একটা পুরনো, ছেঁড়াখোঁড়া, ছোট্ট বই বের করল। সে যখন ওটা সামনে বাড়িয়ে ধরল, আমি তখন তার নামটা দেখতে পেলাম, ‘মিশরীয় ও চাল্ডিয় জাদু’। তারপর পিছন ঘুরে সে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল। ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
“তা ওঁর ছোট্ট ভাবনাটি ঠিক কী?”
পোয়্যারোর মুখ থেকে এতবার এই কথাটা শুনে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি, যে অন্য কারুর মুখ থেকে শুনে আমার হাসি পেয়ে গেল।
“আমি ঠিক জানি না।” স্বীকার করলাম আমি, “আমার মনে হয়, ও অশুভ আত্মাদের জাদু দিয়ে তাড়াবার কোনও পরিকল্পনা করছে।”
আমি পোয়্যারোকে খুঁজতে গেলাম এবং দেখলাম সে মিঃ ব্লেইবনারের সেক্রেটারি, সেই ক্ষীণকায় যুবকটির সঙ্গে কথা বলছে।
“না।” হার্পার বলছিল, “আমি এই অভিযানে সামিল হয়েছি মাত্র ছ’মাস আগে। হ্যাঁ, আমি মিঃ ব্লেইবনারের কাজকর্মের বিষয়ে বেশ ভালোভাবেই জানতাম।”
“আপনি কি ওঁর ভাইপোর বিষয়ে আমাকে বিস্তারিত কিছু বলতে পারবেন?”
“উনি একদিন হঠাৎ এখানে এসে উপস্থিত হলেন। মোটামুটি সুদর্শন চেহারা। আমি ওঁকে আগে কোনোদিন দেখিনি, কিন্তু এখানে কেউ কেউ ওঁকে আগে চিনতেন—আমার মনে হয়, অ্যামেস আর স্নাইডার। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি ওঁকে দেখে একেবারেই খুশি হননি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয়ানক ঠোকাঠুকি শুরু হয়ে গেল। ‘একটি পয়সাও নয়!’ চিৎকার করে বললেন বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি, ‘একটি পয়সাও নয়—না এখন, না আমার মৃত্যুর পরে। আমি চাই আমার সব পয়সা আমার জীবৎকালে করে যাওয়া কাজগুলোকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে লাগুক। আমি এই নিয়ে আজকেই মিঃ স্নাইডারের সঙ্গে কথা বলেছি।’ এইভাবেই আরও কিছুক্ষণ চলল। যুবক ব্লেইবনার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই কাইরো রওনা দিলেন।”
“তখন কি তাঁর স্বাস্থ্য সম্পূর্ণ ঠিক ছিল?”
“বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির?”
“না, যুবকটির।”
“আমার মনে হয় উনি বলছিলেন যে ওঁর কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু সেটা তেমন গুরুতর কিছু নয়। তেমন হলে আমার মনে থাকত।”
“আরেকটা কথা, মিঃ ব্লেইবনার কি কোনও উইল করে গিয়েছেন?”
“আমরা যতদূর জানি, করেননি।”
“আপনি কি অভিযানে থেকে যেতে চান, মিঃ হার্পার?”
“না স্যার, আমি চাই না। এখানে কাজগুলো গুছিয়ে আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিউইয়র্ক ফিরে যেতে চাই। আপনি হাসতে চাইলে হাসতে পারেন, কিন্তু আমি এই অভিশপ্ত মেন-হার-রা-এর পরবর্তী শিকার হতে চাই না। আমি যদি এখানে থেকে যাই, তাহলে এরপর আমারই পালা।”
যুবকটি তার কপাল থেকে ঘাম মুছল।
পোয়্যারো পিছন ফিরে চলে আসবার সময় তার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে এক অদ্ভুত হাসি হেসে বলল, “মনে রাখবেন, তার একজন শিকার কিন্তু নিউইয়র্কে ছিলেন।”
“নারকীয়!” বেশ জোরের সঙ্গে বলল হার্পার।
“যুবকটি বেশ ঘাবড়ে গেছে।” চিন্তিতভাবে বলল পোয়্যারো, “ও একেবারে শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে।”
আমি কৌতূহলী হয়ে তাকালাম পোয়্যারোর দিকে, কিন্তু ওর প্রহেলিকাময় হাসি থেকে কিছুই উদ্ধার করতে পারলাম না। স্যার গাই উইলার্ড এবং ডঃ টসউইলের সঙ্গে আমরা পুরাতাত্ত্বিক খননের জায়গাটা ঘুরে দেখলাম। খনন করে পাওয়া প্রধান সামগ্রীগুলি ইতিমধ্যেই কাইরোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু সমাধির কিছু কিছু আসবাবপত্র বেশ আকর্ষণীয়। বোঝাই যায়, এই নিম্নস্তরের ব্যারনটি কেন এত উৎসাহী এইসব খননের বিষয়ে। কিন্তু আমার মনে হল তার মধ্যে কোথায় যেন একটা স্নায়বিক দুর্বলতা কাজ করছে, যেন সে চারপাশে কোনও অশুভ কিছুর ছায়া দেখতে পাচ্ছে। আমরা যখন সান্ধ্যভোজনের আগে একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিতে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট তাঁবুতে ঢুকতে গেলাম, এক সাদা পোশাক পরা দীর্ঘ ও কৃষ্ণকায় লোক, বেশ সম্ভ্রান্ত ভঙ্গীতে মৃদুস্বরে আরবিতে আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। পোয়্যারো দাঁড়িয়ে পড়ল।
“তুমিই হাসান, স্বর্গীয় স্যার জন উইলার্ডের পরিচারক?”
“আমি আমার প্রভু স্যার জনের সেবা করেছি, এখন তাঁর পুত্রের সেবা করছি।” এই বলে সে আমাদের দিকে এক পা এগিয়ে এসে গলা নামিয়ে বলল, “ওরা বলে আপনি জ্ঞানী মানুষ, অশুভ আত্মাদের আটকাতে পারেন। আমার তরুণ প্রভুকে এখান থেকে পাঠিয়ে দিন দয়া করে। আমাদের চারপাশের হাওয়াতে শয়তানের নিঃশ্বাস।”
তারপর আমাদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই হঠাৎ সে হাঁটা দিল।
“হাওয়াতে শয়তানের নিঃশ্বাস!” বলল পোয়্যারো, “হ্যাঁ, আমিও অনুভব করছি বটে।”
আমাদের খাওয়া খুব একটা প্রফুল্ল চিত্তে হল না। ডঃ টসউইল তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি প্রাচীন মিশরের পুরাকীর্তি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করলেন।
ঠিক যে সময়ে আমরা বিশ্রাম নিতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি, স্যার গাই পোয়্যারোর হাত ধরে টেনে একদিকে নির্দেশ করলেন। তাঁবুগুলির মাঝখান দিয়ে এক ছায়ামূর্তি চলেফিরে বেড়াচ্ছিল। সে কোনও মানুষের মূর্তি নয়, আমি সমাধির পাথরের দেওয়ালে আঁকা কুকুরের মুখবিশিষ্ট আকৃতিটি তখনই চিনতে পারলাম। এই দৃশ্য দেখে তো আমার রক্ত জল হয়ে গেল!
“হায় ভগবান!” বিড়বিড় করে বলল পোয়্যারো। “আনুবিস, মৃত আত্মাদের শেয়ালমুখো দেবতা।”
“কেউ আমাদের ধোঁকা দিচ্ছে।” বেশ রাগতভাবে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন ডঃ টসউইল।
“ও তোমার তাঁবুতে গেল, হার্পার।” ভয়ানক ম্লান মুখে বললেন স্যার গাই।
“না।” মাথা নেড়ে বলল পোয়্যারো, “ডঃ অ্যামেসের তাঁবুতে গেল।”
ডাক্তার অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ডঃ টসউইলের কথার প্রতিধ্বনি করে বললেন, “কেউ আমাদের ধোঁকা দিচ্ছে। আসুন, আমরা সবাই মিলে খুঁজলে তাকে তাড়াতাড়ি ধরে ফেলতে পারব।”
তিনি খুব উদ্যমের সঙ্গে ঐ ছায়ামূর্তির আবির্ভাবের অনুসন্ধানে লেগে পড়লেন। আমি ওঁর পিছন পিছন গেলাম, কিন্তু অনেক খুঁজেও ঐ পথে গেছে এমন কারুর সন্ধান পেলাম না। কিছুটা বিব্রতভাবেই ফিরে এসে দেখলাম, পোয়্যারো খুব উৎসাহের সঙ্গে তার নিজের মতো করে নিজের সুরক্ষার জন্য সব ব্যবস্থা নিচ্ছে। অত্যন্ত ব্যস্ততার সঙ্গে সে আমাদের তাঁবুর চারপাশের বালিতে নানারকম আকার-আকৃতি এঁকে চলেছে আর বিভিন্ন মন্ত্র লিখে চলেছে। আমি একটা পাঁচমুখী তারা আর একটা পঞ্চভুজের ক্রমিক পুনরাবৃত্তি লক্ষ করলাম। পোয়্যারো তার অভ্যাসমতো এর সঙ্গে-সঙ্গেই ডাকিনীবিদ্যা আর সাধারণ জাদুবিদ্যা, সাদা জাদু আর কালো জাদুর পার্থক্য সম্পর্কে ‘মৃতদের বই’-এর বিশেষ উল্লেখ সহকারে তাৎক্ষণিক বক্তৃতা দিয়ে চলেছিল।
মনে হল এতে ডঃ টসউইলের মনেই সবচেয়ে বেশি ঘৃণার সঞ্চার হয়েছে। তিনি রাগে প্রায় ফুঁসতে ফুঁসতে আমাকে একধারে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। “প্রলাপ, মশায়!” রাগতস্বরে বললেন তিনি, “একেবারে প্রলাপ! লোকটা একদম জোচ্চোর। ও প্রাচীন মিশরীয় বিশ্বাস আর মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের তফাত জানে না। এমন অজ্ঞতা আর বিশ্বাসের জগাখিচুড়ি আমি কখনও দেখিনি।”
আমি কোনোরকমে তাঁকে শান্ত করে তাঁবুতে এসে পোয়্যারোর সঙ্গে দেখা করলাম। আমার বন্ধুটি বেশ খুশি খুশি মেজাজেই বসে ছিল। “আমরা এবার নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি।” বেশ খোশমেজাজে ঘোষণা করল সে। “আর আমার একটু ঘুম বিশেষ করে দরকার। আমার মাথাটা বিচ্ছিরিভাবে ধরেছে। আহা, যদি একটু চা পাওয়া যেত!”
যেন তারই প্রার্থনারই উত্তরে হঠাৎ তাঁবুর পর্দা সরিয়ে হাসান প্রবেশ করল ধূমায়িত কাপ নিয়ে। সেটা সে পোয়্যারোকে দিল। দেখা গেল ঐ কাপে ক্যামোমাইল পাতার চা রয়েছে, যেটা পোয়্যারোর বিশেষ প্রিয় পানীয়। হাসানকে ধন্যবাদ জানাবার এবং আমার জন্য আরেক কাপ আনবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবার পর সে চলে গেল। আবার একা আমরা দু’জন রয়ে গেলাম। আমি পোশাক বদলাবার কিছুক্ষণ পর তাঁবুর দরজায় দাঁড়িয়ে মরুভূমির দিকে চেয়ে রইলাম।
“অপূর্ব সুন্দর জায়গা!” আমি জোরে জোরে বললাম, “আর কাজগুলোও কী অপূর্ব! আমি এর মুগ্ধতা বেশ অনুভব করছি। এই মরুভূমির জীবন, এই এক হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার অনুসন্ধান! পোয়্যারো, তুমিও নিশ্চয়ই এর জাদু টের পাচ্ছ?”
কোনও উত্তর না পেয়ে আমি বেশ একটু বিরক্তভাবেই পিছন ফিরলাম। কিন্তু আমার বিরক্তি সঙ্গে-সঙ্গেই উদ্বেগে পরিণত হল। পোয়্যারো তার শক্ত বিছানার ওপর শুয়ে রয়েছে, তার মুখচোখ ভীষণভাবে কুঁচকে গিয়েছে। তার পাশে খালি কাপটি পড়ে রয়েছে। আমি তার পাশে ছুটে গেলাম, আর তারপরেই দৌড়ে চলে গেলাম ডঃ অ্যামেসের তাঁবুতে।
“ডঃ অ্যামেস!” চিৎকার করে ডাকলাম আমি, “শীগগিরই আসুন।”
“কী হয়েছে?” পায়জামা পরে তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসতে-আসতেই জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তার।
“আমার বন্ধুটি খুব অসুস্থ, মৃত্যুর মুখোমুখি। ওই ক্যামোমাইল পাতার চা! হাসানকে কোনোভাবেই শিবির ছেড়ে যেতে দেওয়া চলবে না।”
বিদুৎগতিতে ডাক্তার আমাদের তাঁবুতে চলে এলেন। পোয়্যারোকে আমি যেমন অবস্থায় রেখে গিয়েছিলাম, সে সেভাবেই শুয়ে ছিল।
“বিস্ময়কর!” চিৎকার করে বললেন ডাক্তার, “দেখে মনে হচ্ছে সারা শরীরে ভয়ানক টান ধরেছে, অথবা… আচ্ছা, উনি কী একটা পান করেছেন, সেই বিষয়ে আপনি কী বলছিলেন?”
“ব্যাপারটা হল, যে আমি পান করিনি!” খুব শান্ত একটা কন্ঠস্বর শোনা গেল। আমরা অবাক বিস্ময়ে ফিরে তাকালাম। পোয়্যারো হাসিমুখে তার খাটে উঠে বসেছে। “না।” বেশ বিনীতভাবে বলে চলল সে, “আমি ওটা পান করিনি। যখন আমার বন্ধু হেস্টিংস মহাকাশ পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সুযোগে আমি পানীয়টা ঢেলে দিলাম। না, আমার গলায় নয়, একটা বোতলে। ঐ ছোট্ট বোতলটা রসায়নবিদের পরীক্ষাগারে যাবে। না—” যেই ডাক্তার হঠাৎ নড়বার চেষ্টা করলেন, “একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কোনও বলপ্রয়োগেই কোনও ফল হবে না। হেস্টিংসের আপনাকে ডেকে আনবার সময় তার অনুপস্থিতির সুযোগে আমি বোতলটিকে অত্যন্ত নিরাপদ জায়গায় রেখে দিয়েছি। আরে, তাড়াতাড়ি করো হেস্টিংস, ওঁকে ধরো!”
আমি পোয়্যারোর উদ্বেগকে ভুল বুঝেছিলাম। বন্ধুকে বাঁচাবার তাগিদে আমি তার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ডাক্তারের অত্যন্ত দ্রুত গতিবিধির একটা অন্য উদ্দেশ্য ছিল। তাঁর হাতটা তাঁর মুখে চলে গেল, তিক্ত বাদামের গন্ধে ঘর ভরে উঠল। একটু সামনের দিকে হেলে গিয়ে তিনি পড়ে গেলেন।
“আরও একজন শিকার।” বিষণ্ণ গলায় বলল পোয়্যারো, “কিন্তু এই শেষ। বোধহয় এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারত না। তিনটি মৃত্যুর দায় রয়েছে এর মাথার ওপর।”
“ডঃ অ্যামেস?” আমি বোকা বনে গিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, “কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম যে তুমি কোনও অতিলৌকিক প্রভাবে বিশ্বাস কর!”
“তুমি আমাকে ভুল বুঝেছিলে, হেস্টিংস। আমি বলতে চেয়েছিলাম যে আমি কুসংস্কারের প্রবল শক্তিতে বিশ্বাস করি। একবার যদি লোকের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পার যে পরের পর মৃত্যুগুলি ঘটেছে কোনও অতিপ্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে, তাহলে কাউকে তুমি প্রকাশ্য দিবালোকে ছোরা মারলেও সেটা ঐ অভিশাপের ফল বলে গণ্য হবে, মানবজাতির মনে অতিপ্রাকৃতিকের শিকড় এমনই গেঁথে আছে। আমি প্রথম থেকেই সন্দেহ করেছিলাম যে কোনও লোক মানুষের এই প্রবৃত্তির সুযোগ নিচ্ছে। স্যার জন উইলার্ডের মৃত্যুর সঙ্গেই সম্ভবত তার মাথায় এই পরিকল্পনা আসে। সঙ্গে-সঙ্গেই একেবারে কুসংস্কারের প্রকোপ শুরু হয়ে যায়। আমি যতদূর দেখতে পাচ্ছিলাম, স্যার জনের মৃত্যু থেকে কারুরই বিশেষ কোনও লাভ হত না। কিন্তু মিঃ ব্লেইবনারের ব্যাপারটা আলাদা। তিনি এক বিশাল ধনী ব্যক্তি ছিলেন। নিউইয়র্ক থেকে যা খবর পেয়েছিলাম, তাতে বেশ কয়েকটা ইঙ্গিতপূর্ণ তথ্য ছিল। প্রথমত, শোনা যাচ্ছে যে ভাইপো ব্লেইবনার দাবি করেছিলেন মিশরে তাঁর কোনও এক ভালো বন্ধু আছেন, যার কাছ থেকে তিনি টাকা ধার নিতে পারেন। এ থেকে সবাই ধরেই নিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর কাকার কথা বলছেন, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যে কাকা হলে তাঁর কথা তিনি সরাসরি বলতেন। তিনি যেভাবে কথাটা বলেছিলেন তাতে মনে হয় তিনি তাঁর কোনও বন্ধুর কথাই বলতে চেয়েছেন। আরেকটা ব্যাপার হল, তিনি কোনোরকমে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে মিশরে এসে পৌঁছলেন, তাঁর কাকা তাঁকে একটিও পয়সা না দিয়েই বিদায় করলেন, অথচ তা সত্ত্বেও তিনি নিউইয়র্ক ফেরবার পয়সা কোথা থেকেও যোগাড় করে ফেললেন। কেউ নিশ্চয়ই তাঁকে ধার দিয়েছিল।”
“এগুলো তেমন জোরালো যুক্তি নয়।” আপত্তি জানিয়ে বললাম আমি।
“কিন্তু আরও অনেক ব্যাপার আছে, হেস্টিংস। অনেক সময় অনেক কথা রূপকের মাধ্যমে বলা হলেও লোকে তাকে আক্ষরিক অর্থে নেয়, আবার বেশ কিছু সময় এর উলটোটাও ঘটে। এক্ষেত্রে যে কথা আক্ষরিক অর্থে বলা হয়েছিল, তা ধরে নেওয়া হয়েছিল রূপক হিসেবে। ভাইপো ব্লেইবনার লিখেছিলেন যে তিনি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। কিন্তু কেউ ভাবেনি যে তিনি নিজেকে গুলি করেছেন, কারণ তিনি সত্যিই বিশ্বাস করতেন যে তিনি ঐ ভয়াবহ রোগের শিকার।”
“কী?” চিৎকার করে উঠলাম আমি।
“এ এক শয়তান মাথার এক অত্যন্ত ধূর্ত কেরামতি। ভাইপো ব্লেইবনারের কোনও এক ছোটোখাটো চর্মরোগ হয়েছিল। তিনি দক্ষিণ সাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে থেকেছিলেন, যেখানে এটি একটি অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। অ্যামেস তাঁর পুরনো বন্ধু, তার ওপর আবার নামকরা চিকিৎসক, অ্যামেসের কথায় সন্দেহ করবার কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। এখানে আসবার পর আমার হার্পার এবং ডঃ অ্যামেস, এই দু’জনের ওপর সন্দেহ হয়। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই আমি বুঝতে পারলাম যে কেবলমাত্র ডাক্তারের পক্ষেই এই অপরাধ সংঘটিত করা এবং তা গোপন করা সম্ভব এবং হার্পারের থেকে আমি জানতে পারলাম যে ভাইপো ব্লেইবনারের সঙ্গে ডাক্তারের পূর্বপরিচয় ছিল। নিঃসন্দেহে ভাইপো ব্লেইবনার কোনও সময় ডাক্তারের নামে তাঁর সম্পত্তি উইল করে থাকবেন। ডাক্তার দেখল যে তার সম্পত্তি লাভের সুযোগ উপস্থিত, তার পক্ষে ভাইপো ব্লেইবনারের শরীরে ঐ ভয়াবহ জীবাণু ঢুকিয়ে দেওয়া খুব সহজ ছিল। বন্ধুর কাছ থেকে সাংঘাতিক খবরটি শুনে শ্রীমান ভাইপো নিজেকে গুলি করে বসলেন। খুড়ো ব্লেইবনারের মনে যাই থাকুক না কেন, তিনি কোনও উইল করেননি, কাজেই সম্পত্তি প্রথমে স্বাভাবিকভাবেই ভাইপোর কাছে আর সেখান থেকে ডাক্তারের কাছে সোজা চলে আসত।”
“আর মিঃ স্নাইডার?”
“আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। মনে রেখ, তিনিও যুবক ব্লেইবনারকে চিনতেন এবং হয়তো কিছু সন্দেহ করে থাকবেন, অথবা আরও একটি উদ্দেশ্যহীন ও নিরর্থক মৃত্যু কুসংস্কারের জটকে আরও ভালোভাবে পাকাবে। তার ওপর তোমাকে একটা জবর মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা বলি হেস্টিংস। একজন খুনির সবসময় তার সফল অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাবার তীব্র ইচ্ছা হতে থাকে, অপরাধের সাফল্য তার মাথায় চড়ে বসে। সেইজন্যই আমি যুবক উইলার্ডের জন্য ভয় পাচ্ছিলাম। আজকে তোমরা আনুবিসের যে মূর্তি দেখেছ, সে আসলে ছদ্মবেশী হাসান, আমারই নির্দেশে সে এমন করেছিল। আমি দেখতে চাইছিলাম ডাক্তার ভয় পায় কি না। কিন্তু তাকে ভয় দেখাবার জন্য অতিপ্রাকৃতিকের চেয়েও বেশি কিছু দরকার। আমি দেখলাম যে সে আমার অতিলৌকিকে আস্থার ভানকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেনি। আমার ছোট্ট হাস্যকর অভিনয়টা দিয়ে তাকে বিন্দুমাত্র ঠকানো যায়নি। আমি সন্দেহ করলাম, যে সে এবার আমাকে তার পরবর্তী নিশানা বানাবার চেষ্টা করবে। এই জঘন্য গরম এবং বিরক্তিকর বালি সত্ত্বেও আমার ছোট্ট ধূসর কোষগুলো কিন্তু কাজ করেছে!”
পোয়্যারোর যুক্তি সম্পূর্ণ সঠিক ছিল। কয়েক বছর আগে, নেশার ঘোরে মজা করে যুবক ব্লেইবনার একটা উইল করে যান, ‘আমার সিগারেটের বাক্স যেটা তোমার এত পছন্দের এবং আমার মৃত্যুর সময় আমার মালিকানাধীন যা কিছু থাকবে, যা প্রধানত আমার নেওয়া বিভিন্ন ঋণ হবে, সেইসব কিছু আমি আমার প্রিয় বন্ধু রবার্ট অ্যামেসকে দান করে যাচ্ছি, কারণ সে আমাকে একবার ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল।’
এই ঘটনাটি যতদূর সম্ভব ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয় এবং এখনও পর্যন্ত লোকে মেন-হার-রা-এর সমাধির সঙ্গে যুক্ত পরের পর মৃত্যুর মিছিলকে এক অতীত রাজার তাঁর সমাধি অপবিত্রকারীদের ওপর সমুচিত প্রতিশোধের এক সার্থক প্রমাণ বলে মনে করে, যা পোয়্যারোর মতে মিশরীয় ভাবনা ও বিশ্বাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে