নাহার তৃণার আগের গল্প ভুলু
রঙিন ঘুড়ির দিন
নাহার তৃণা
“এই আপু, কী করো ওখানে বসে?”
“চুপ! আয়, খাবি একটু?”
চট করে আশপাশটা দেখে নেয় তপু। তারপর এ-কান ও-কান হাসি দিয়ে আপুর সামনে হাত পেতে দাঁড়ায়। ভরদুপুরে বাড়ির সবার ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নিয়ে দু-ভাইবোনে প্রাণপণে চুকুম-চাকাম সহকারে দাদির আচারের বয়াম যতদূর পারা যায় সাবাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বড়োরা ভারি নিয়মের যাঁতাকলে রাখে। এটা করা যাবে না, ওটা খাওয়া যাবে না যখন তখন। হতচ্ছাড়া এতসব নিয়মের চোখ রাঙানি কাঁহাতক সহ্য করা যায়? বেশি বেশি চকোলেট খাওয়া চলবে না দাঁতে কিলবিল লেগে যাবে। যখন তখন আচার খেলে পেট কামড়াবে। যখনই তানিয়া দাদির কাছে বায়না করে, দাদি ঠিক এমনটাই বলেন। কই? পেট তো কামড়ায়নি এখন পর্যন্ত!
“কী রে, তোর পেট কামড়াচ্ছে?”
“উঁহু!” প্রবলবেগে মাথা নাড়ায় তপু। মুখভর্তি আচার। অবশ্য মুখ খালি থাকলেও সে বেশি বাক্য অপচয়ের ঘোর বিরোধী। যতটুকু সম্ভব অঙ্গভঙ্গি দিয়ে কথা সারা পছন্দ তার। ওর কথা বলতে দেরি হচ্ছে দেখে বাড়ির সবাই ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের তো জানা ছিল না, এই ছেলে তার ছোট্ট পেটে টনখানিক বুদ্ধি নিয়ে বসে আছে। কথা সে ঠিক সময়েই বলতে শিখেছে। প্রয়োজনবোধ করেনি বলে বলেনি। কিন্তু যেদিন একমনে খেলতে থাকা ছেলেকে লক্ষ করে মা প্রায় কেঁদে কেঁদে বাবাইয়ের কাছে জানতে চাইল, ‘আমাদের ছেলেটা কি কথা বলবেই না!’ তখন আর কিছু না বলে পারেনি বেচারা। ওর আচমকা কথায় সেদিন গোটা বাড়িতে কেমন খুশির হল্লা বয়ে গিয়েছিল। ছোট্ট হলেও স্বল্পবাক হবার গুরুত্ব আর দশজনের চেয়ে ঢের আগেই বুঝে গেছে সে। ছোটো ফুপিটা যদি বুঝত! যতক্ষণ বাড়ি থাকে এত কথা বলে! হয় ফোন, নয় দাদি, মনাফুপি, মা, বাবাইয়ের সঙ্গে বকবক করতেই থাকে। কখনও কখনও অবশ্য ওদের গল্প পড়ে শোনায়, লুকোচুরি খেলে। তখন ছোটো ফুপিকে ভারি ভালো লাগে তপুর। কিন্তু গল্পের মাঝখানে প্রায়ই উটকো ফোন কল এসে ফুপিকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায়। তখন তপুর ইচ্ছে করে ফোনটা ভেঙে ওর ভেতরে বসে থাকা মানুষটাকে চিমটি কাটতে। সে চেষ্টার ত্রুটি করেনি যদিও। কিন্তু ফোনটা ভেঙে টুকরো করেও কোথাও সে ছোটো ফুপিকে ফোন করা মানুষটির দেখা পায়নি। এজন্য অবশ্য পুরস্কার হিসেবে ওকে মায়ের গুমাগুম কিল, বাবাইয়ের সেইরকমের চোখ রাঙানি কম খেতে হয়নি। কিন্তু আশ্চর্য! ছোটো ফুপি ওর কাণ্ডে হেসে খুন। এখনও মজা করে সেটা নিয়ে। ‘কী রে গুল্লু, ফোনের মানুষ দেখবি?’ ছোটো ফুপি ওকে আদর করে গুল্লু নামে ডাকে। ছোটো ফুপিটা অনেক মজার। বাবাইয়ের পর ছোটো ফুপি তপুর প্রিয় বন্ধু। বন্ধুকে এই মজার জিনিসটার ভাগ দিতে ইচ্ছে করে তপুর। ছোটো ফুপিও ওদের মটো ভাত না খেয়ে এসব খেতে খুব ভালোবাসে কিনা।
প্রায় ফিসফিসিয়ে আপুর অনুমতি প্রার্থনা করে, “ছোটো ফুপিকে এট্টুক ভাগ দেবে?”
মুখে কিছু না বলে বোন কষে ভাইয়ের ফর্সা হাতে একটা চিমটি কেটে আপত্তি জানান দেয়। স্বল্পবাক শিশুটি বোনের এহেন অমানবিক আচরণে উঁহু শব্দে কাঁদতে গিয়েও কী একটা ভেবে চট করে নিজেকে সামলে নেয়। এক পলক লাল হয়ে যাওয়া জায়গাটি দেখে নিয়ে ওর বিশেষ হাসিটা উপহার দেয় আপুকে। ছোটো ফুপি বলে, ওর এই হাসির নাম নাকি ‘কিলার হাসি’। যদিও এর অর্থটা কী সেটা সে জানে না।
“উফ্!”
ভাইয়ের মুখে অস্ফুট শব্দটা শুনে মুখ তুলে তাকায় তানিয়া। “কী রে, পেট খামচে আছিস কেন? কী হল তোর?”
ঠোঁট ফুলিয়ে কান্নার ভান করে তপু জানায় ওর খুব পেট কামড়াচ্ছে। ভয়ে তানিয়ার হাত থেমে যায় চৌর্যবৃত্তি ভুলে। মুখটা শুকিয়ে যায়। শরীরে কেমন একটা শিরশিরানি হয় তানিয়ার। অপেক্ষা করতে থাকে ভাইয়ের মুখ হা করে বাড়ি মাথায় তুলে নেবার বিখ্যাত চিৎকারের। চুরি করে দু’জনে খেলেও দায়ভার যে একাই তার কপালে জুটতে যাচ্ছে, সে দুর্ভাবনায় করণীয় কতর্ব্য ভুলে বোকার মটো তানিয়া বসে থাকে।
আপুর বোকা বনে বসে থাকাটা আড়চোখে দেখে তপু পেট ধরেই উঠে পড়ে। চোখের আড়ালে গিয়ে আপনমনে একটু হেসে নেয়। মুখ মুছে লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘুমন্ত দাদির কানে তাঁর সম্পদ হরণের বিবরণ জানিয়ে আজকের দুপুরের জন্য তার নির্দিষ্ট করে রাখা কর্মটি সারতে আলগোছে বাবাইয়ের অফিস-রুমের টেবিলের তলায় ঢুকে পড়ে।
মায়ের সেলাইয়ের বাক্স থেকে আগেই সে কাঁচিটা সরিয়ে এখানে রেখে গিয়েছিল। ওদের গলির মোড়ে চুল কাটার যে সেলুনটা আছে, বাবাইয়ের সঙ্গে প্রায় সেখানে যায় তপু। সেলুনের লোকটা কাঁচিটা হাতে ধরে কেমন খচাখচ চুল কাটে। ওর কাজটা দেখতে দেখতে পছন্দ হয়ে গেছে তপুর। চুল কেটে বাড়ি ফেরার পথে বাবাইকে একদিন তপু বলেছিল, বড়ো হয়ে সে সেলুনের ওই লোকটার মতো চুল কাটবে মানুষের। শুনে বাবা গলা তুলে এমন হেসেছিলেন, পথচলতি দুয়েকজন মানুষ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তপুর ভারি অভিমান হয়েছিল বাবাইয়ের উপর। বাকি পথটুকু সে গম্ভীর মুখে থেকেছে। বাবাই ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে ওর মান ভাঙাতে বলেছেন, “ঠিক আছে, আগে তো বড়ো হও। কিন্তু জানো তো যেকোনও কাজের জন্য চাই ঠিকঠাক প্র্যাকটিস, অর্থাৎ তালিম।”
তালিমের সুযোগটাই বা সে পায় কোত্থেকে? ও কী করছে না করছে, সব ব্যাপারে মা কিংবা আপুটা এমন নজরদারিতে রাখে যে ওকে সুযোগ পাওয়াই মুশকিল। হুট করেই সুযোগটা পেয়ে যাওয়ায় হাতছাড়া করেনি। মনে মনে একবার সেলুনের লোকটার চুল কাটার ভঙ্গিটা ভেবে নেয়। তারপর কাঁচিটা মাথার উপর তুলতেই পাশের রুম থেকে আপুর কান্নার শব্দ ছিটকে আসে। ছোট্ট কপালে ভাঁজ তুলে কিছু সময় চুপচাপ থাকে সে। তারপর তার নাপিত হওয়ার ব্যাপরটিতে বিলম্ব ঘটে যাচ্ছে দেখে দ্রুত হাতে মাথার মাঝখান বরাবর চোখ বুজে কাঁচি চালিয়ে দেয়।
জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস