সুমনা সাহার আগের গল্প সম্পর্ক
সুমনা সাহা
বিকেল বেলা রুবাইদের বাড়ির পাশের গলির মুখের সিমেন্ট বাঁধানো চাতালে এক এক করে সবাই এসে জড়ো হয়—দুলু, পিংকি, মোতি, বান্টি, কালু, লালু, ভোলা। শুধু সোনু আসেনি। সবার চোখে একই প্রশ্ন—সোনু কোথায়? তাহলে কি সোনু রুনুর সঙ্গে আছে? কিন্তু এই সময়টা তো ওরা সবাই একসঙ্গে এদিক ওদিক অভিযানে বের হয়। আর সোনু না থাকলে জমবেই না। সোনুর মাথায় নতুন নতুন খেলার ফন্দী আসে। ওর গায়ের জোরও সবার থেকে বেশী। সবাই তাই ওকে ভয়ও পায়। দলে কোনও কারণে বচসা তৈরী হলে তার থেকে মারামারি অবধি গড়ায়, তখন সোনুই সব মিটমাট করে। সোনু যেটা বলবে, সেটা সবাই মেনে নেবে—এটাই অলিখিত নিয়ম। দুলুই বলল, ‘নিশ্চয় রুনুদের বাড়িতে, চল তো দেখি গিয়ে’।
অমনি সব দুলুর পিছনে দৌড় লাগালো। হ্যাঁ, দুলুর কথাই ঠিক। সোনু চুপটি করে বসে আছে। মুখ ভার। ওদের দেখেও মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কালু বলল, ‘কি রে সোনুদা, আজ ১৩ বি-র মাঠে যাবি না? হেব্বি ভীড় ওখানে। জাগৃতি সংঘ আর প্রগতি ময়দানের ম্যাচ আছে, চল, মজা হবে।’ সোনু উদাস দৃষ্টি মেলে একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করল।
বান্টি সোনুর গায়ের কাছে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল, ‘তোমার শরীর খারাপ সোনুদা?’ সোনু রাগী চোখে তাকিয়ে বলল, ‘তোরা যাবি এখান থেকে?’
এবার সবার অবাক হওয়ার পালা। লালু চোখের ইশারায় সবাইকে সরে আসতে বলল।
ওদের দলটা রুনুদের উঠোনের বাইরে এসে আলোচনা করছিল, পিংকি বলল, ‘ব্যাপারটা কি হল বল্ তো? সোনুদার আজ কি হয়েছে?’
লালু মুখ ব্যাজার করে মুখে একটা ঈশারা করে বোঝালো যে, আজ কোন খেলাই জমবে না।
সোনু চুপ করে বসে ভাবছিল।
ওরা চলে গেছে। কি জানি কোথায় গিয়ে ঝামেলা পাকাবে! আমাকে ওরা খুব ভালোবাসে। কিন্তু আমার দুঃখের কথা ওদের কি ভাবে বোঝাব? আজ সকাল থেকেই মন খারাপ। বাপি দা এমন করতে পারলো? জন্মের পর থেকে যে বাপি দা-কে বাপ বলো, মা বলো, ভাই-বন্ধু সকলের চেয়ে আপনার বলে জেনেছি— সে কি না আজ একটা কোথাকার কে না কে বাইরের মেয়ের সামনে গায়ে হাত দেবে? সোনুর কি প্রেস্টিজ বলে কিছু থাকতে নেই? বাপিদা-র চায়ের দোকান ছাড়া পৃথিবীতে আর কোথাও এক রাতও থেকেছি কেউ বলতে পারবে? কেউ বলতে পারবে, সোনু হ্যাংলা? খাওয়ার জন্য কারু কাছে হাত পেতেছি? রুনুর কথা আলাদা। রুনু আমার বন্ধু। ও যখন কিছু দেয়, না বলতে পারি না। কিন্তু জন্মের পর থেকে এই এতগুলো বছর ধরে যে বাপিদা-র দোকান সারা রাত ধরে আগলে রাখি, তার কি কোন দাম নেই? কে ওই মেমসাহেব? কোথায় ছিল সে, যখন জীবন বাজী রেখে সোনু তিনবার বাপিদা-র দোকানের চুরি রুখে দিয়েছে? সোনুর চোখ ফেটে জল আসে। না, এই অপমান নিয়ে মরে যাওয়াও ভালো। কিচ্ছু খাব না, কোথাও যাব না, রুনুদের বাড়ির পাঁচিলের পিছনে সবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে থাকব, মরে গেলে যাব, তবু বাপিদা-র কাছে আর যাব না! প্রবল দুঃখে অভিমানে সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে আড়ি করে হাঁটুতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে সোনু।
একটা পরিচিত শব্দে সোনুর কান দুটো একটু খাড়া হয়ে উঠল, আধখোলা চোখে দেখে নিল, রুনু এলো স্কুল থেকে। নাহ্, আজ রুনুকে দেখেও সোনুর ওর কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে না। গোটা জগতের প্রতি সোনুর বিতৃষ্ণা এসেছে। কিন্তু রুনুও রোজকার মতো এসেই সোনুকে ডাক দিল না। ভারী পায়ে চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেল। ওর আবার কি হল কে জানে?
রুনু ক্লাসের ফার্স্ট বয়। শ্যামল স্যার বোর্ডে যে অংকই দেন, সবার আগে করে দেয় রুনু। মাস্টারমশাইরা খুব ভালোবাসেন রুনুকে। বন্ধুরাও রুনুকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। কারণ রুনু সবার সুখ-সুবিধার দিকে সবসময় খেয়াল রাখে। কে টিফিন আনেনি, কার অসুখ করেছিল, ক’দিন স্কুলে আসেনি, তাই হোমওয়র্ক করতে পারেনি, কার সোশাল স্টাডি প্রোজেক্ট করতে অসুবিধা হচ্ছে, সব কিছু রুনু খোঁজ নেয়, সাধ্যমতো সাহায্যও করে। তাই রুনু সকলের নয়নের মণি। কিন্তু রুনু মনে মনে খুব দমে গেছে, অঙ্কে ওকে কেউ টক্কর দিতে পারে, ও ভাবতেই পারেনি। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল ঐ মেয়েটা—এঞ্জেলা, রুনুর এতদিনকার ‘ম্যাথস মাস্টার’ খেতাবটা বোধ হয় ছিনিয়েই নেবে। আজ শ্যামল স্যার এমন একখানা অংক দিয়েছিলেন বোর্ডে, কেউ সলভ করতে পারেনি, এমনকি রুনুও না। কিন্তু ঐ নতুন মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ও পারবে। বোর্ডে গিয়ে খসখস করে অংকটা কষেও দিল! শ্যামল স্যার খুব প্রশংসা করলেন, আর সকলকে অনুরোধ করলেন যেন সবাই এঞ্জেলাকে সব বিষয়ে সাহায্য করে। ও আমেরিকা থেকে সদ্য ভারতে এসেছে আর এই স্কুলে ভর্তি হয়েছে।
রাত্রে খাবার টেবিলে রুনুর বাবা বলেন, ‘কি ব্যাপার রুনু বাবু? আজ এত চুপচাপ কেন?’
জয়া বলে, ‘আজ স্কুল থেকে আসার পর থেকেই বাবু কথা বলছেন না! কতবার জিজ্ঞেস করছি, কি হয়েছে বল্? তা কিছুতেই বলল না।’
রুনুর গলায় বিরক্তি, ‘বললাম তো তোমাকে, কিছু হয়নি! সেই থেকে এক কথা বলেই যাচ্ছ!’
জয়া আর রণতোষ পরস্পর চোখ চাওয়াচাউয়ি করে। রণতোষ ভ্রু নাচিয়ে নীরবে জয়াকে জিজ্ঞেস করে, ‘কি হল?’ জয়াও নীরবে ঠোঁট উলটায়, ‘জানি না!’
এই সময় পাশের ঘর থেকে ঠাম্মি আসেন, ‘রণজয়! আমার দাদাভাই! আমাকেও বলবে না!’
রুনু নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে।
অনেক রাত্রে বাপি-দার গলা শোনা যায়, ‘সোনু…উ, সোনু রে…এ, আয় বাবা, খাবি আয়!’
রুনুর হঠাৎ মনে পড়ে সোনুর কথা—‘এই যাঃ! আজ সোনুর খোঁজই নেওয়া হয়নি। ছেলেটা কোথায় কোথায় যে ঘুরে বেড়ায় কে জানে? ঐ তো, বাপিদা ডাকছে, তার মানে এখনও ঘরে ঢোকেনি। যত রাজ্যের বখাটে ছেলের সঙ্গে দিনরাত খালি টো টো করে ঘুরে বেড়ানো। আজ স্কুল থেকে ফেরার সময় ওকে দেখলাম না তো! বাপিদার দোকানের সামনেই বসে থাকে। রুনু যখন স্কুলের বাস থেকে নামে, ওর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির গেট পর্যন্ত আসে। মা পছন্দ করে না বলে ওকে ভিতরে ডাকতে পারে না। কিন্তু আজ তো সোনু আসেনি, সত্যি বলতে কি, রুনুরও আজ ওর কথা মনে পড়েনি। এঞ্জেলার জন্য সব বিগড়ে গেছে।
পাঁচদিন হয়ে গেল স্কুলে, এখনও এঞ্জেলা নামে নতুন মেয়েটার তেমন কেউ বন্ধু হয়নি। হবে কি করে? বাংলাই তো ভালো করে বলতে পারে না! যদিও ওদের ক্লাস চলাকালীন কেউ বাংলায় কথা বলতে পারবে না, বললে ফাইন হয়ে যাবে, কিন্তু টিফিন পিরিয়ডে ওরা অল্প স্বল্প বাংলা বলে চুপি চুপি। গোপা মিস জানতে পারলে খুব বকেন। এঞ্জেলা যেমন করে ইংরাজি বলে, সেটাও আমাদের মতো না, তাই ওর কথা কেউ বুঝতে পারে না। ওর ইংরাজি বলাটা একদম অন্যরকম। কথাগুলো একদম পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বলে। সবাই মুখ টিপে হাসে। প্রথম প্রথম ওর অঙ্কের জাদুতে অনেকেই কাঁত হয়ে গিয়েছিল। অর্ণব, স্বপ্নিল, এণাক্ষি আর দেবস্মিতা তো নতুন কাউকে পেলেই দলে টানতে চায়। কিন্তু এঞ্জেলাকে সেভাবে দলে টানতে পারল না। মেয়েটা কেমন মনমরা হয়ে থাকে। টিফিনের সময় জানলার ধারে গিয়ে টিফিন বক্স খুলে চুপচাপ বাইরের দিকে উদাস ভাবে চেয়ে থাকে, একটু খেয়ে, আবার চুপ করে নিজের জায়গায় এসে বসে পড়ে। কারু সাথে কথা বলে না। কিন্তু রুনু মনে মনে খুব দমে গেছে, এঞ্জেলার কাছে অঙ্কে পরাজয়টা মেনে নিতে পারেনি। রুনুর প্রাণের বন্ধুরা ওর মনের দুঃখটা বুঝেছে। প্রাকাশ, যার আসল নাম প্রকাশ মালহোত্রা, ওরা প্রোনাউন্স করে প্রাকাশ, সেদিন বলছিল, ‘রাণাজে (রণজয়), মেয়েটাকে আমরা অ্যায়সা ইরিটেট করব কি ও এই স্কুল ছেড়ে পালাবে, হিঃ হিঃ হিঃ।’ বিজয় কাপুর ওরফে ভিজে বলেছিল, ‘লুক রণো, ইয়োর ইনসাল্ট ইজ আওয়ার ইনসাল্ট, উই উইল নট অ্যালাও হার টু বিট ইউ ইন ম্যাথস! থিংক সাম প্ল্যান!’ রণজয়, ওরফে রুনু একটু আনমনা ভাবে বলে, ‘আরে ছোড় না, আভি ফার্স্ট টার্ম এক্সাম কি বহুত দের হ্যায়, আই শ্যাল প্র্যাকটিস মোর সামস্।’
দুলু আর পিংকি সোনুর গাঁ ঘেঁষে দাঁড়ায়। ঝকঝকে একটা বিকেল। সোনুর জন্য আজও সব আনন্দ মাঠে মারা যাচ্ছে। সোনু সেই যে গোমড়া মুখো হয়েছে, এখনও ওর মুড ঠিক হয়নি। এতদিনে ওরা ব্যাপারটা জেনেছে। পাড়ায় নতুন যে নীল চোখো মেয়েটা এসেছে, তার জন্যই সোনুর গায়ে হাত তুলেছে বাপি-দা। মোতি আর কালু ঠিক করে রেখেছে, ওকে একলা একদিন পেলে মজা দেখাবে। কিন্তু সে নবাবজাদী তো একলা বাইরেই বেরোন না! জানলায় মুখ বাড়িয়ে ভয়ে ভয়ে চেয়ে দেখে। যেমন বিচ্ছিরি খাঁদা নাক তেমন নামটাও কি বিচ্ছিরি—পেসি! এটা কি একটা নাম হল? ওরা জোর জটলা চালায়। আজ পাশের পাড়ায় বিয়ে আছে। কত কি ভালো ভালো খাবার দাবার হচ্ছে, এখন থেকেই গন্ধ ছাড়ছে। সোনুর মনে হয় সেদিকেও ইন্টারেস্ট নেই! কালু সোনুর কাছে ঘন হয়ে এসে চাপা গলায় বলে, ‘মাংসটা হেব্বি জমবে মনে হচ্ছে, গেলে তো দু’চার টুকরো পাবই, যাবে নাকি?’
সোনুর সেই এক উদাস উত্তর, ‘তোরা যা।’
কালু খুব রেগে যায়, ‘কতদিন তুমি এমনি করে গুটিয়ে থাকবে?’
সোনু নিঃশ্বাস ফেলে, চাপা গলায় বলে, ‘রোজ সকাল বেলায় এঞ্জেলার বাবা পেসিকে নিয়ে দোকানে আসে, পাঁউরুটি আর সিগারেট কেনে—ওকে দেখলেই বাপিদা-র মার টা মনে পড়ে, আমার মাথাটা গরম হয়ে যায়। আমি তাই সকাল হলেই দোকান থেকে বেরিয়ে যাই।’
সবাই দুঃখিত হয় সোনুর অপমানে। খানিক পরে ওরা জোর করে সোনুকে টানতে টানতে বিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় লাগায়।
খাবার টেবিলে রণতোষ বলেন, ‘কাল আমাদের ভবেশ কাকুর বাড়িতে নেমন্তন্ন, সন্ধ্যাবেলা রেডি থাকবে, আমি অফিস থেকে ফিরে নিয়ে যাব।’
রুনু মাথা না তুলেই ঘোষণা করে, ‘আমি যাব না। তোমরা যাও, আমি ঠাম্মির কাছে থাকবো।’
‘তোমাকে বিশেষ করে যেতে বলেছেন উনি, তুমি ওনার নাতনীর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ো, ওর জন্মদিন কাল। যাবে না কেন?’
‘আমার অনেক হোম ওয়র্ক আছে, আমি যেতে পারবো না।’
জয়া রেগে যায়, ‘অসভ্যতা করবি না রুনু, বাবা বলছেন, যাবি এক ঘণ্টার জন্য, তাতে কি হয়েছে? পড়া শেষ করে নে না।’
রুনু আর কথা বাড়ায় না, ভাবে, ‘ওই অহংকারী মেয়েটার জন্মদিনে যেতে হবে? ও কেন যে এই স্কুলে এল?’
খাওয়া হয়ে গেলে রুনু হাত ধুতে চলে যায়, রণতোষ খুব মৃদু স্বরে বলেন, ‘ভবেশ কাকু একেবারে ভেঙে পড়েছেন, জানো? কাকিমার নাকি লাস্ট স্টেজ, প্যাংক্রিয়াসের ক্যান্সার…আগে কিচ্ছু বুঝতে পারেননি! উনি দেবাংশুকে বলেছিলেন, মায়ের শেষ সময়ে আসতে। দেবাংশু একেবারে চাকরি টাকরিতে রিজাইন করে চলে এসেছে। ওর মেমসাহেব বৌ নাকি দু’বছর হল ওকে ছেড়ে চলে গেছে ওরই অফিসের এক কলিগের সঙ্গে অন্য সিটিতে। দেবাংশু ভীষণ আপসেট…ওই একরত্তি মেয়েটা! সেদিন দেখা হতে অনেক কথা হল। খুব খারাপ লাগছিল ওর জন্য। এত ব্রিলিয়ান্ট ছেলেটা! লাইফটা এলোমেলো হয়ে গেল! মেয়েটাও, আহা ওই টুকু বাচ্চা, মা হারা! নিজের পরিবেশ ছেড়ে কোথায় চেনা না জানা না, অন্য স্কুলে এসে মানিয়ে নিতে পারছে না! জন্মদিনটা নমো নমো করে করছে, শুনলাম বেশী কাউকে বলেনি।’
বাবা চাপা গলায় কথা বললেও রুনু সব শুনতে পেয়েছে ডাইনিং রুমের করিডোরে দাঁড়িয়ে। ও ধীর পায়ে নিজের ঘরে চলে যায়। সকলের প্রবলেম সলভ করে দেওয়া রুনুর মনটা হঠাৎ এঞ্জেলার জন্য ভারী খারাপ হয়ে যায়।
মা, বাবা, দেবাংশু আঙ্কল, ভবেশ দাদু সবাই যখন গল্প করছিল, এঞ্জেলা রুনুকে নিজের ঘরে ডাকে। ওরা এঞ্জেলার ঘরে বসে গল্প করছিল। রুনুদের স্কুলের আর কেউ আসেনি। শুধু রুনুরা, দেবাংশু কাকুর এক মাসতুতো দাদা-বৌদি আর ভবেশ দাদুর একজন পুরনো বন্ধু এসেছেন। একদম ঘরোয়া আড্ডা। এঞ্জেলা বলল, ‘পাপা বলেছিল, তোমার কোন্ কোন্ বন্ধুকে বলতে চাও? আমি শুধু তোমার কথা বলেছি। তুমি আমাদের কাছেকাছি থাকো, তাই।’
রুনু দেখে, এঞ্জেলার ঘর ভর্তি নানা সাইজের অনেক পুতুল, এমনকি ওর বিছানায়ও প্রায় ওর সাইজের বড় ডল, তাকে নিয়ে ও ঘুমায়। ও আজ রুনুর সঙ্গে কত কথা বলে, ওর আঁকা ছবি দেখায়, কমিক বই-এর কালেকশন দেখায়। ও কমিক পড়তে খুব ভালোবাসে। রুনুর বেশ ভাব হয়ে গেল এঞ্জেলার সঙ্গে। বাবা ডাকেন, ‘রুনু, চলো, এবার যেতে হবে। দশটা বাজলো। কাল আবার অফিস আছে।’ এঞ্জেলা ওর দুধ সাদা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘ফ্রেন্ডস!’ রুনুও গভীর মমতায় এঞ্জেলার হাতে হাত রেখে বলে, ‘ইয়েস, ফ্রেন্ডস!’
এঞ্জেলা চাপা গলায় বলে, ‘আই ওয়ান্ট টু শো ইউ ওয়ান থিং, ওয়ান মিনিট’, ড্রয়ারের মধ্যে হাতড়ে ও বের করে এক মহিলার ছবি, হাসিমুখে তিনি একটি ফুটফুটে বাচ্চাকে কোলে নিচ্ছেন। সলজ্জ মুখে রুনুর দিকে তাকিয়ে এঞ্জেলা জিজ্ঞেস করে, ‘গেস্ হু?’ আবার নিজেই বলে, ‘মি অ্যান্ড মাই মম্!’ তারপর উদাস ভাবে বলে, ‘শি ইজ লস্ট!’
রুনু জানে সত্যিটা, গতকালই জেনেছে, মেয়েটাকে ওর বাবা বলেনি যে, ওর মা ওকে ছেড়ে চলে গেছে। ও শুধু জানে, ওর মা কোথাও হারিয়ে গেছে! রুনুর মনটা ব্যথায় টনটন করে।
সোনু লক্ষ্য করে, কদিন ধরে পেসি আসছে না বাপি-দার দোকানে। ওর মনের কৌতুহলটা বাপি-দাই মিটিয়ে দিল।
এঞ্জেলার বাবার দিকে সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বাপিদা জিজ্ঞেস করেই বসল, ‘স্যার, পেসিরে দেখি না যে কয়দিন?’
‘ওর শরীর খারাপ করেছে। এখানে ওয়েদারটা স্যুট করছে না বোধহয়, খুব ঠাণ্ডা লেগেছে, ডাক্তার দেখিয়েছি। একটু সারুক, আবার নিয়ে বেরোব।’
সোনু বুঝলো, বিদেশিনীর অবস্থা কাহিল। ঠাণ্ডা লেগেছে! আবার ডাক্তার! কতই ঢং আর দেখবো? মনে মনে খুব হাসি পায়।
বিকেলে স্কুলের গাড়ি থেকে নেমে রুনু আর এঞ্জেলা গল্প করতে করতে বাপির দোকানের পাশ দিয়ে যায়, সোনু রুনুকে দেখেই পিছন পিছন আসে। একটু গম্ভীর হয়ে যায়, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে ডাকতে গিয়েও আওয়াজটা গলার ভিতর লুকিয়ে ফেলে, এই মেমসাহেবের সঙ্গে রুনুর ভাব হয়ে গেছে? এঞ্জেলা সোনুকে পিছনে আসতে দেখে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। রুনু বলে, ‘ও আমার বন্ধু, সোনু। সোনু, এদিকে আয়, এই দেখ, আমার বন্ধু এঞ্জেলা।’ সোনু এঞ্জেলার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকায়, অস্বস্তি লুকিয়ে গলা দিয়ে কোনরকম একটা শব্দ বের করে, যার অর্থ ‘হ্যালো’ গোছের কিছু একটা। রুনুর হাসি পায়। সোনুটা একেবারে অভদ্র, এইজন্য মা ওকে পছন্দ করে না।
দুদিন পরে সকাল সকাল এঞ্জেলাদের বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। কালু হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসে বাপি-দার চায়ের দোকানে, ‘সোনুদা, পেসির খুব শরীর খারাপ, ডাক্তার এসেছে, দেখতে যাবে? তোমার বন্ধু রুনু গেছে ওখানে।’ সোনু এক লাফে উঠে দৌড় লাগায়। বন্ধুর বন্ধু তো বন্ধুই। এঞ্জেলার কান্না শোনা যাচ্ছে। রুনুও এসেছে বাবার সঙ্গে। এঞ্জেলার বাবা পেসিকে সাদা চাদর ঢাকা দিয়ে কোলে নিয়ে গাড়িতে ওঠে। ওরা চলে যায়। সোনুদের দলটাও ধীরে ধীরে চলে যায়। এঞ্জেলা ওর দাদুর বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। ভবেশ দাদু এঞ্জেলাকে সান্ত্বনা দেন, ‘কাঁদে না সোনা, ওর নিউমোনিয়া হয়ে গেছে, বুকে খুব কফ বসে গেছে তো, তাই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হল। সেরে যাবে, চলে আসবে বাবার সঙ্গে, আবার তোমার সঙ্গে খেলবে।’ সোনুরা ব্যাপারটা বুঝতে পারে, ধীরে ধীরে ওরা যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।
সেদিন স্কুল ছুটির পর রুনু বলে, ‘এঞ্জেলা, আমাদের বাড়িতে চলো, আমার মা তোমাকে ডেকেছেন।’
দুই ছেলে-মেয়েকে বসিয়ে যত্ন করে খাওয়ায় জয়া। খুব আদর করতে সাধ হয় মা হারা মেয়েটাকে, মেয়েটার চোখ দুটো এমন মায়ামাখা! যাবার সময় এঞ্জেলার হাতে একটা টিফিন বক্স দিয়ে বলে, ‘তোর দাদুকে বলবি, পিঠে বানিয়েছি, খেয়ে বলবেন কেমন হয়েছে। তুই যখন ইচ্ছা আমার কাছে আসবি রুনুর সঙ্গে, কেমন?’
এঞ্জেলা জয়ার মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, ‘আচ্ছা, সব মায়েদের কি অনেকটা এক রকম দেখতে হয়?’ অনেকদিন পরে বুকের মধ্যে দলা পাকিয়ে থাকা মায়ের হারিয়ে যাওয়ার ব্যথাটা মনের মধ্যে হালকা মেঘের মতো ভেসে ভেসে অনেক দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে। কোলাপসিবল গেট ঠেলে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়, হাত নেড়ে রুনুকে ‘বাই’ করে। এতক্ষণ সোনু আর পেসি রুনুদের গেটের সামনে গল্পে একেবারে মজে ছিল। এঞ্জেলাকে দেখে পেসি সোনুকে কি একটা বলল ঈশারায়, ওদের ভাষায়, ‘ঘেয়াও’। অমনি সোনু জবাব দেয়, ‘ঘরর্’ আর লেজ নাড়াতে নাড়াতে রুনুর পিছন পিছন আসে। পাশে পাশে পেসি হাঁটে, খুশিতে ওর কানদুটো লটরপটর করে দোলে। সোনু আর পেসিকে পাশাপাশি হাঁটতে দেখে একটু দূর থেকে মোতি আর কালু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। রুনু বড়দের মতো গলায় বলে, ‘যা সোনু, নীলাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আয়!’