ছোট্ট বাছুর
সৃজনী সাহা
আমি তখন খুব ছোটো। পিসির সঙ্গে একটি গোয়ালার বাড়িতে দুধ আনতে যেতাম। গোয়ালাজেঠুর বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছেই, হেঁটেই যেতাম। গোয়ালাজেঠুর গরুটার একটা খুবই সুন্দর ও মিষ্টি বাছুর ছিল। শুধু হাম্বা হাম্বা করত আর খেলে বেড়াত। একদিন পিসির সঙ্গে দুধ আনতে গিয়েছি, পিসির হাত ধরে আছি আর পিসির অন্যহাতে একটা দুধের ক্যান। গোয়ালাজেঠুর বাড়ি পৌঁছে দেখলাম জেঠু বাছুরটাকে ওর মায়ের দুধের বোঁটায় মুখ লাগাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর সে বাছুরটার মুখ সরিয়ে দিল। বাছুর ওর মার কাছে যেতে চাইছে, কিন্তু গোয়ালাজেঠু যেতে দিচ্ছে না। সে বাছুরটাকে লাঠি দিয়ে ধাঁই ধাঁই করে মারতে মারতে দড়ি দিয়ে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখল। আমার তখন খুব কষ্ট হল। কেঁদে ফেললাম। গোয়ালাজেঠু আমাদের ক্যানে দুধ ভরে দিল। আমরা চলে এলাম। বাড়ি এসে আমি খুব কান্নাকাটি করছি—কখনও বাবা কোলে নিয়ে আমাকে থামতে বলছে, কখনও মা, কখনও পিসি, আবার কখনও আম্মা।
আমি খুবই কাঁদছি। আমি এতই কাঁদলাম, এতই কাঁদলাম যে আমার জ্বর চলে এল। ‘জেঠু বাছুরকে ওর মার দুধ খেতে দিল না, মারল, ওর খুব লাগল।’ আমি এই একই কথা বারবার বলতে থাকলাম, আর কাঁদতে থাকলাম। জ্বর কমছে না। বাবা ওষুধ আনছে, মা ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছে। সবাই আমার খুব যত্ন করছে। আমার একদমই ভালো লাগছে না। শুধু মনে হচ্ছে সেই বাছুরটার কথা। সবাই আমাকে চিন্তা করতে মানা করছে।
সবাই খুব চিন্তিত। কিছুদিন পরে যখন আমার জ্বর প্রায় সেরে গেল, আমি সুস্থ হওয়ার মুখে, তখন পিসি যাচ্ছিল দুধ আনতে। আমি বললাম, “পিসি পিসি, দাঁড়াও, তোমার সঙ্গে আমি যাব।”
পিসি বলল, “না সোনা, তোমার জ্বর আছে অল্প অল্প, যাওয়া তো ঠিক হবে না।”
আমি বললাম, “চলো না, চলো না পিসি।”
মা বলল, “আচ্ছা যা, কিন্তু সাবধানে যাস।”
পিসি আমাকে কোলে নিল, হাতে ধরল কেটলি। গেলাম গোয়ালাজেঠুর বাড়ি। তার বাড়ি এসে তাকে বললাম, “জেঠু জেঠু, তুমি ওই ছোট্ট সুন্দর মিষ্টি বাছুরটাকে মারলে, ঠিক হয়নি। ওর তো লেগেছে। আর কোনও পশুপাখিকেই মারতে নেই।”
জেঠু অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ গো, আমার অন্যায় হয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি। আর এমন কাজ আমি ভুলেও করব না।”
বাড়িতে ফিরে পিসি এ ঘটনার কথা বলাতে দাদা আমাকে বলল, “গৌরি দিদিভাই, ঠিক বলেছ। মানুষ ভুল করে। কিন্তু এমন করা একদম ঠিক নয়। আমরা সবাই পৃথিবী মায়ের সন্তান। সবাইকে ভালোবাসতে হবে। তবেই পৃথিবী-মা খুশি হবেন।”
অনুভূতিপ্রবণ গল্প
LikeLike