ভূতের বাড়ি
ক্ষিতিকা বিশ্বাস (সপ্তম শ্রেণী)
“ভূতের বাড়ি! আমি যাব না।“আমি বললাম। পারিজাত গল্পের বই পড়ছিল, মুখ তুলে বলল “ভিতুর ডিম একটা, সবাই মিলে যাব, কত মজা হবে!” মুদ্রা পাশেই দাঁড়িয়েছিল, আমার ডানহাতটাতে টান দিয়ে বলল “এই মেঘা, চল না!”
অবশেষে আমি রাজি হলাম। আমরা সবাই জানতাম যে মায়েরা আমাদের ভূত চতুর্দশীতে ভূতের বাড়ি যেতে দেবে না কিছুতেই, তাই ঠিক করা হল – কাউকে না বলেই আমরা যাব।
মুদ্রা বলল “চল তোর দুষ্টুকে নিয়ে যাই, আমি শুনেছি ভূত থাকলে কুকুররা খুব সহজেই বুঝতে পারে। তাই হল; পারিজাত, মুদ্রা, আমি আর দুষ্টু সন্ধে হতেই খেলার পরে কাউকে না জানিয়ে রওনা দিলাম। যেখানে যাব, সেই জায়গাটার নাম সংকটনগর – আমাদের হাউজিং কমপ্লেক্স থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা। মুদ্রার হাতে একটা টর্চ, পারিজাত একটা ছুরিও কোথা থেকে জোগাড় করেছে! আমার হাতে দুষ্টুর চেন, আমি আর মুদ্রা হাঁটছি পারিজাতের পেছনে – ও রাস্তা চেনে।
একটা বাজার, একটা কবরস্থান আর অনেক গলি পেরিয়ে গেলাম – পারিজাতের উপর একটু রাগই হচ্ছে, কিন্তু এছাড়া উপায় নেই! আরও কিছুক্ষণ পরে একটা মাঠ পেরিয়ে সেই বাড়িটার সামনে এলাম। কোন আলো নেই – আশেপাশে কোন বাড়ি নেই, প্রচুর বড় ছোট গাছ মিলে একটা জঙ্গল মতন প্রায় তৈরি হয়েছে। টর্চের আলোয় দেখলাম – বিশাল দোতলা বাড়ি, একদম ভাঙাচোরা অবস্থা। দেওয়াল থেকে ইট খসে পড়ে আছে, কোথাও কোথাও শ্যাওলা – এমনকি কোথাও কোথাও ছোট ছোট গাছ বেরিয়েছে দেওয়াল থেকে! গা ছমছম করছে সবারই – দুষ্টু এতখানি রাস্তা লাফাতে লাফাতে এসেছে; এখন কিন্তু লেজটা নীচের দিকে, আর মাঝে মাঝেই চেন-এ টান দিচ্ছে।
আমরা বাড়িটার ভেতরে ঢুকব বলে ঠিক করলাম। লোহার গেটের একটা পাল্লা খুলতেই এমন একটা ক্যাঁচ আওয়াজ হল যে ভয় লেগে গেল। কিন্তু এত কাছে এসে ভূত না দেখে কি ফেরা যায়! ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে উঠে দেখলাম একতলায় অনেক কটা ঘর, কোনটারই দরজা নেই – কারা যেন খুলে নিয়ে চলে গেছে পাল্লাগুলো! চৌকো বাড়িটার মাঝখানে অনেকটা খোলা জায়গা – তার মধ্যেও জঙ্গল তৈরি হয়ে গেছে।
আমরা ঘরগুলোর সামনের বারান্দা দিয়ে পা টিপে টিপে হাঁটছি – কোন ঘরে ঢুকতে ঠিক সাহস হচ্ছে না।
হঠাৎ একটা শব্দ হল, আমরা সবাই চমকে উঠলাম! দুষ্টু কুঁইকুঁই করে উঠল! মনে হল কাচ ভাঙার আওয়াজ। উল্টোদিকের কোন একটা ঘর থেকে এল। পারিজাত ওদিকে টর্চ ফেলল – সেরকম কিছু বোঝা গেল না কী ভাঙল। আমরা চারজন ওদিকে পা বাড়ালাম। যে ঘরটা থেকে আওয়াজ আসছিল, সেটা দেখলাম একটা স্টাডি রুম। একটা দিকে আলমারিতে বই ঠাসা, উল্টোদিকে দেওয়ালে অনেক ক’টা ছবি। পারিজাতের হাত থেকে টর্চটা নিয়ে আমি ওদিকে ফেললাম। দুষ্টুর কুঁইকুঁই বেড়েই চলেছে – ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানছে।
ছবিগুলো অনেক দিন আগেকার – সবকটার তলায় নাম লেখা আছে, আর লেখা জন্ম আর মৃত্যু দিন। হঠাৎ মুদ্রা বলল “তাহলে কি যে কাচ ভাঙার আওয়াজটা পেলাম, সেটা কি এরকম কোন ছবির?” ঠিকই হয়ত বলছে ও। টর্চের আলো ফেললাম নিচের দিকে। দুষ্টু আরও কুঁইকুঁই করছে – ওকে আর ধরে রাখা যাচ্ছে না! পারিজাতের চোখ পড়ল ঘরের উল্টোদিকের কোণায়। সেখানে একটা বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ও গিয়ে ছবিটা তুলল মেঝে থেকে, আমরা ওর দিকে টর্চটা ফেললাম। ছবিটা দেখার সাথে সাথে ওর হাত থেকে ছবিটা পড়ে গেল। আমি আর মুদ্রা দুজনাই একসাথে জিজ্ঞেস করলাম “কী হল?” ও কিছু না বলে ছবিটা আমাদের দিকে ঘুরিয়ে ধরল, আমরা দেখলাম – আমাদের চারজনের ছবি! তলায় অন্য ছবিগুলোর মতন আমাদের নাম আর জন্মদিনগুলো একে একে লেখা! আর মৃত্যুদিনের পাশে লেখা আজকের তারিখ…