ভূতের ডাক->ছবিঃ উজান রায়, লেখাঃ শুভশ্রী ভট্টাচার্য
বাড়িটায় এসে অবধি শিবুর সবকিছু কেমন যেন চেনা চেনা লাগছিল। রিকশা থেকে নেমে বিশাল সিংহ-দরজার দুদিকে থাবা গেড়ে বসে থাকা সিংহদুটো থেকে শুরু। তারা যে ভঙ্গিতে হাসি হাসি মুখ করে একটা থাবা তুলে বসে আছে, সেটা যেন আগে কোথায় দেখেছে বলে মনে হল।
সত্যিই আগে এসেছে কিনা দেখার জন্য শিবু ভাবল যে দেখি তো রান্নাঘরের পেছনে একটা আতা গাছ আছে কিনা। সেটাও মিলে গেল। সবই কেমন চেনা চেনা লাগছে।
বর্ধমানে এসে হঠাৎ এই জমিদারবাড়িটা খুব কম ভাড়ায় পাওয়া গেল। বিশাল বাড়ি। একেকটা ঘরে আজকালকার চার-পাঁচটা ঘর ঢুকে যাবে। একতলার বেশিরভাগ ঘরই তালাবন্ধ। এই বাড়ির মালিক কোলকাতা থেকে এলে হয়তো ব্যবহার হয়। বাড়ির ছাদে কয়েকটা পরি পাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ছাদে যাওয়া বারণ। কেন কে জানে? বাগানের আউট হাউসে থাকে মালি শালিক বুড়ো। সে-ই বাড়িটার দেখাশোনা করে।
শিবু আর ওর দাদা সোম একটা ঘরে থাকত। আর তার পাশের ঘরে থাকত ওদের বাবা, মা, দিদি আর বোন। একটা বিশাল উঠোনের ওপারে রান্নাঘর, বাথরুম এসব ছিল।
শিবু একদিন ছাদে ওঠার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গিয়ে দেখল যে ছাদের দরজা তালা দিয়ে বন্ধ।
একদিন পূর্ণিমার রাতে শিবু আর সোম শুয়ে আছে। সোম নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু শিবুর কিছুতেই ঘুম আসছে না। কী রকম একটা অস্বস্তি হচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চারদিকে অনেক রকম শব্দ। পেঁচা ডাকছে। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। দূরে কোথাও একটা গান হচ্ছে। গানটা যেন খুব চেনা। শিবুর মনে হল পাশের ঘরে হয়তো মা রেডিও শুনছে। কিন্তু সারাদিন খাটা-খাটুনির পর বালিশে মাথা দেওয়া মাত্র তো মা ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে আজকে হল কী? সুরটা যেন ঠিক পাশের ঘর থেকে আসছেও না, অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে।
হঠাৎ শিবুর বাথরুম পেল। উঠোন পেরিয়ে বাথরুমে যেতে হত। শিবু বাইরে এসে দেখল চাঁদের আলোয় চারদিক ঝলমল করছে। বাথরুমে ঢুকেও শিবুর মনে হল কেউ ওর দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে। বাড়িটার দিকে চোখ পড়াতে শিবু হঠাৎ যা দেখল তাতে তার লোম খাড়া হয়ে গেল।
সে দেখতে পেল ছাদের ওপরে একটা কে যেন দাঁড়িয়ে আছেন। পরিগুলো একটা আরেকটার থেকে সমান দূরত্বে থাকার কথা। কিন্তু চার নম্বর আর পাঁচ নম্বর পরির মাঝখানে ছাদের আলসেতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন পরির মতই সুন্দরী এক ভদ্রমহিলা, শিবুর দিকেই সোজা তাকিয়ে।
শিবু ভয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে দেখল ভদ্রমহিলা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। কয়েক মুহূর্ত শিবু যেন অবশ হয়ে গেল। ও বুঝতে পারছিল পালানো উচিত, কিন্তু পা সরছিল না। এমনকি চোখও সরাতে পারছিল না ওনার দিক থেকে।
কে উনি? কীভাবে ছাদে উঠলেন? এইসব প্রশ্ন তখন মাথায় এল না শিবুর। অন্ধের মত ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল সে। অন্ধকারে সিঁড়িতে একটু বাদেই ভাগ্যিস হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। পড়ে গিয়ে ওর হুঁশ ফিরল। অবাক হয়ে দেখল সে অত রাতে ছাদের দিকে চলেছে। ছাদের দরজায় তালা দেওয়া, ছাদে ওঠা বারণ– জানা সত্ত্বেও। তখনি প্রচণ্ড ভয়ে দৌড়ে এসে কোনমতে দাদার পাশে বিছানায় লেপের তলায় ঢুকে ঠক-ঠক করে কাঁপতে লাগল।
দাদা জিজ্ঞেস করল, “কীরে? বাথরুম গেছিলি বুঝি?” শিবুর দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছিল, কোনমতে বলল, “হ্যাঁ।”
পরদিন সকালে শিবু দাদাকে সব বলল। কিন্তু কাউকে বলতে বারণ করল। সোম বলল, “শালিকদাদুকে জিজ্ঞেস করি চল।” শালিকদাদু সব শোনার পর কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলল, “তুমি তাহলে আমাদের রানিমাকে দেখেছ। যেমন সুন্দর দেখতে ছিলেন তেমন গানের গলা। একটা ছেলেও হয়েছিল কোল আলো করে। কিন্তু এমনি কপাল ছেলেটা মাত্র পাঁচ বছর বয়সে টাইফয়েড হয়ে মারা গেল। তারপর রানিমা ছেলের শোকে পাগল হয়ে গেলেন। এক পূর্ণিমার রাত্তিরে হঠাৎ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা গেলেন। এখনো মাঝে মাঝে পূর্ণিমার রাতে তাঁকে ছাদে গান গাইতে দেখা যায়।”
তারপর শালিকবুড়ো বলল, “চলো তোমাদের একটা জিনিস দেখাই। প্রথম দিনই তোমাকে দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম।” একটা ঘরের তালা খুলে একটা পুরনো ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে পুরনো ছবির অ্যালবাম বার করল সে। তার প্রথম পাতাটা খুলে বলল যে, এটা রানিমার ছেলের ছবি। শিবু চমকে উঠল। ছেলেটা হুবহু শিবু্র মত দেখতে!