জীবন অনেক সময় ধাঁধার মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেয়। এতদিনের প্র্যাকটিস, পড়াশোনা, জ্ঞান সব তুচ্ছ বলে মনে হয়। এক বিস্ময়ের বলয়ে অবরুদ্ধ হয়ে যায় মানুষ। ঘটনা পরম্পরার খাঁজে লুকিয়ে থাকা প্রতিটা বিষয় অবাক করে। এক আশ্চর্য স্রোতে বয়ে যেতে ইচ্ছে করে অপ্রত্যাশিত পরিণতির দিকে।
আমি দেমিদ ভোরোবিয়ভ। মস্কোর ছেলে। কর্মসূত্রে সোচিতে থাকি। সোচি থেকে কিছুটা দূরে ব্ল্যাক সি-র ধারে খোস্তার বোর্ডিং স্কুলে পড়াই। এটা স্পেশাল চাইল্ডদের স্কুল। সেরিব্রাল পলসি, মেন্টাল রিটার্ডেশন, অটিস্ম, ডিসলেক্সিয়া, ডাউনস সিনড্রোমে আক্রান্ত অসহায় বাচ্চাদের দুনিয়া এই স্কুল। মানসিক এবং বৌদ্ধিকভাবে যারা পিছিয়ে, তাদের সুস্থ জীবনে ফেরানোর চেষ্টা চালাই আমরা। প্রথাগত স্কুলের সঙ্গে এর অনেক তফাত। প্রত্যেককে আলাদা করে যত্ন নিতে হয়। ভীষণ অভিমানী হয় এরা। খুঁটিনাটি বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। স্কুলের কাছে একটা অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া থাকি। একার জীবন বেশ কেটে যাচ্ছে।
ক
অ্যানা নামের একটা মেয়ে আজ স্কুলে অ্যাডমিশন নিয়েছে। সবার কেস হিস্ট্রি আমাদের রাখতে হয়। কারণ, পড়ানোর পাশাপাশি কাউন্সেলিং করতে হয়। বাচ্চাগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানা না থাকলে চিকিৎসার পন্থা ঠিক করা যায় না। অ্যানা অনাথ। মাস ছয়েক আগে কাজানের অনাথ আশ্রম থেকে ওকে দত্তক নিয়েছিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গের এক নিঃসন্তান দম্পতি। তাঁরা রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন। বাচ্চাটা আবার অনাথ হয়ে গিয়েছে। কপাল বটে! মেয়েটার কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অ্যানাকে ওর দূরসম্পর্কের এক কাকা রেখে গিয়েছেন এখানে।
খ
স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি আমি হোস্টেলেরও ইনচার্জ। ফ্লোরা আর ক্যারোলিনা আমাকে হেল্প করে। হোস্টেলে সবমিলিয়ে ষাটটা বাচ্চা। এই স্কুলটার নামডাক আছে। রাশিয়ার দূরদূরান্ত থেকে বাবা-মায়েরা তাদের স্পেশাল চাইল্ডদের এখানে রেখে যান। মাসে একবার করে দেখা করতে আসেন অভিভাবকরা। হোস্টেল হলেও আমরা চেষ্টা করি বাচ্চাগুলোকে হোম ফিলিং দেওয়ার। তাই একটা ঘরে দুটোর বেশি বাচ্চা থাকে না। ঘরগুলো বাচ্চাদের মনোমতো সাজানো হয় যাতে ওদের মনে না হয় বাড়ি থেকে দূরে রয়েছে।
গ
চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে হোস্টেলে মানিয়ে নিয়েছে অ্যানা। মেয়েটা মেন্টাল রিটার্ডেশনে আক্রান্ত। জড়ভরত বলা যেতে পারে। অ্যানার মুখখানা থ্যাবড়া। কপালের মাঝে একটা গর্ত। ধাক্কা লেগে যেন খানিকটা তুবড়ে গিয়েছে। একজোড়া ছোটো অসহায় এলোমেলো চোখ। মাথার অল্প চুলে দুটো ঝুঁটি বাঁধা। ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে অ্যানাকে। দুটো ঝুঁটিতে কামোমিল ফুল গোঁজা। এখানে এই ফুল দুটো এল কী করে কে জানে! পাহাড়ি এলাকা ছাড়া কামোমিল ফুল দেখা যায় না। সোচি সমুদ্রের ধারে। তবে ক্রাসনায়া পলিয়ানার দিকে গেলে কামোমিল পাওয়া যায়। ওর ঘরে ঢুকে দেখলাম, বেডে বসে একমনে ছবি আঁকছে অ্যানা। মেয়েটা একটু চুপচাপ। আমাকে খেয়ালও করেনি।
ঘ
পল নামে একটা বাচ্চা গতকাল থেকে জ্বরে ভুগছিল। আজ সকাল থেকে হেঁচকি তুলছে। খবর পেয়েই দৌড়ে এসেছিলাম স্কুলে। খোস্তায় কিছু ক্লিনিক আছে। কিন্তু হাসপাতাল যেতে হলে সেই সোচি। এখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূর। অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে পল মারা গেল। মামুলি জ্বর। টেম্পারেচারও খুব বেশি ছিল না। এরকম রোগজ্বালা তো কত হয়। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার জানালেন, পলের হার্ট ফেল করেছে। ফ্যামিলি হিস্ট্রির পাশাপাশি বাচ্চাদের শারীরিক নথিও রাখা হয় স্কুলে। পলের হার্ট দুর্বল, জানা ছিল না।
ছেলে মারা গিয়েছে, খবর পেয়ে পলের বাবা-মা এসেছেন। হাসপাতাল থেকে বডি রিলিজ করা পর্যন্ত আমাকে থাকলে হল। পল স্পেশাল চাইল্ড হলেও ওর বুদ্ধিসুদ্ধি অন্যদের তুলনায় একটু বেশি ছিল। ভালোমন্দ বুঝতে পারত। তার এমন হল? বডি হ্যান্ড-ওভার করার সময় দেখলাম, পলের মৃতদেহের বাঁহাতটা তখনও মুঠো করা। অ্যাম্বুলেন্সে আসার সময় ওর বাঁহাতের তালুতে আঁকা একটা ফুলের ছবি দেখেছিলাম। কামোমিল ফুল! কে এঁকেছিল? পল নিজে? তা তো হতে পারে না। পল বাঁহাতে লিখত। ডানহাতে ছবি আঁকা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
ঙ
স্পেশাল চাইল্ডদের কেউ কেউ সুস্থ হয়ে যায়। কারও বৌদ্ধিক বিকাশ খানিকটা হয়। আবার কেউ গোলকধাঁধাতেই আটকে থাকে। একমাস হল অ্যানা এসেছে এই স্কুলে। ওর ইমপ্রুভমেন্ট চোখে পড়ার মতো। মেয়েটার মাথায় এখন ঘন চুল। নতুন জলহাওয়া অনেকসময় বদল আনে।
বাড়ি ফিরে অ্যানাকে নিয়ে ক্যারোলিনার তৈরি মাসিক প্রোগ্রেস রিপোর্টটাতে চোখ বোলাচ্ছিলাম। খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ লিখেছে। একটা জায়গায় চোখ আটকাল। অ্যানা বিকেলে হাঁটতে পছন্দ করে। স্কুলের পিছনে বাগান। সেটা পার করলে উঁচু টিলার মতো পাহাড়। ঘন সবুজ জঙ্গলে ঘেরা। টিলাগুলো সার বেঁধে চলে গিয়েছে ক্রাসনায়া পলিয়ানার দিকে। অ্যানাকে নাকি দু’দিন ওই পাহাড়ের তলায় পাওয়া গিয়েছে। আশ্চর্য! স্কুলটা বিশাল পাঁচিলে ঘেরা। সেটা টপকানো সাড়ে চার বছরের মেয়ের পক্ষে অসম্ভব। ওখানে গেল কী করে অ্যানা? নাহ্, হোস্টেলের ব্যাপারে সিরিয়াস হতে হবে। ক্যারোলিনা আর ফ্লোরার ওপর সব ছেড়ে রাখলে চলবে না। এমনিতে পল মারা যাওয়ার পর হায়ার অথরিটির কাছে আমাকে অনেক জবাবদিহি করতে হয়েছে।
চ
ক্যারোলিনা দু’দিন স্কুলে আসেনি। বছর ছাব্বিশের মেয়েটা কিছুটা উড়নচণ্ডী। এদিক ওদিক প্রায়ই বেড়াতে যায়। কিন্তু যেখানেই যাক না কেন, স্কুল থেকে ছুটি নেয়। এবার একেবারে বেপাত্তা। ফ্লোরার কাছে শোনার পর ফোন করেছিলাম দুপুরে। নট আন্সারিং বলছে। ইরেস্পন্সিবল! একটা খবর দিতে পারত! যাক, বাড়ি ফেরার পথে একবার ওর ওখানে ঢুঁ মেরে আসব। খোস্তা জায়গাটা ছোটো। আমার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে খুব দূরে নয় ক্যারোলিনার বাড়ি।
ছ
বিকেলে সারা হোস্টেলে হুলুস্থুলু। অ্যানাকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিকেলটা খেলাধুলোর সময়। কিছু বড়ো বাচ্চাকে মাঠে নিয়ে গিয়ে রাগবি খেলা শেখাচ্ছিলাম। গেম থেরাপি বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে ভীষণ কাজে লাগে। অ্যানার খবরটা শুনে ক্যারোলিনার রিপোর্টটা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম। স্কুলের পিছনে, টিলাগুলোর দিকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পেলাম না অ্যানাকে। কোথায় গেল মেয়েটা? সারা এলাকা খুঁজে যখন ফিরে এলাম স্কুলে, বাগানে নজর পড়ল। দেখলাম, মেয়েটাকে ঘিরে রয়েছে পেরেনিয়াল, ক্রকাস, মন্তানা, আজালিয়া, লিলি, গোলাপের অসংখ্য ফুলগাছ। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। অ্যানা আমাকে দেখে হাসল। ওকে কোলে তুলে নিলাম। হোস্টেলে আর কোনও ঘটনা ঘটলে আমার চাকরি বাঁচানো মুশকিল।
জ
ক্যারোলিনার বাড়ি কাল আর যাওয়া হয়নি। সকালে একটু আগে বেরোলাম। ওর বাড়ি হয়ে স্কুলে যাব। খোস্তা স্টেশন ছাড়িয়ে বাইপাসটা ধরে একটু এগোলে দুটো যমজ ঝরনা পড়ে। তার একপাশে ক্যারোলিনার বাড়ি। জায়গাটা ছবির মতো। ক্রাসনায়া পলিয়ানার বরফ-সাদা চূড়ায় ধাক্কা খেয়ে ঠাণ্ডা রোদ এসে পড়েছে বাড়িটায়। গোলাপি রংয়ের বাড়িটায় কেউ আছে কি না বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না। ভীষণ নিস্তব্ধ। ছোট্ট গেটটা ঠেলে ভেতরে এসে কলিং বেল বাজালাম। কোনও সাড়া নেই। ক্যারোলিনা কি কোথাও বেড়াতে গিয়েছে? মোবাইলটা বের করে কল করলাম ওকে। রিং হচ্ছে। ভেতর থেকে মোবাইলের রিংটোন ভেসে আসছে। তার মানে ঘরেই আছে ক্যারোলিনা। আমি দু-চারবার ওর নাম ধরে ডাকলাম, দরজা ধাক্কালাম। কোনও সাড়া নেই। আশ্চর্য তো! এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি নাকি? কী করব ভাবছি, তাকিয়ে দেখলাম, একটু দূরে একটা বাড়ির সামনে দুটো অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়ে। ইশারায় তাদের ডেকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। ওরা ক্যারোলিনাকে চেনে। দরজা বাড়ির ভেতর থেকে বন্ধ। মেয়েটা পুলিশের টোল ফ্রি নাম্বারে ডায়াল করল।
ঝ
আমি প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছি। স্কুলে এসে অথরিটিকে পুরো ব্যাপারটা রিপোর্ট করলাম। ক্যারোলিনা মারা গিয়েছে বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার! তিনদিন আগে শেষবার দেখেছি ওকে। প্রাণবন্ত মেয়ে। কোথাও কোনও সমস্যা ছিল না। অথচ হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছে! পুলিশ এসে দরজা ভাঙে। আমরাও ঢুকে দেখেছি, বিছানায় মরে পড়ে রয়েছে ক্যারোলিনা। ওর চোখদুটো বিস্ফারিত। কিছু একটা দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল। সবটা বললাম স্কুলের প্রিন্সিপালকে। একটা ব্যাপার ছাড়া। ক্যারোলিনার ডানহাতে আঁকা কামোমিল ফুলের ছবিটা। বললেও কি আমাকে বিশ্বাস করতেন প্রিন্সিপাল? গুজব ছড়ানোর জন্য পত্রপাঠ চাকরি চলে যাবে। কিন্তু কী করে অস্বীকার করব, ওইরকম ফুলের ছবি যে আমি পলের হাতেও দেখেছি!
ঞ
অ্যানাকে আঁকার ক্লাসে দেখলাম। মেয়েটা অনেক পালটে গিয়েছে। আগের মতো চুপচাপ নয়, খুব হাসিখুশি থাকে। ওর কপালের গর্তটা আর নেই। কীভাবে ঠিক হল জানি না। নাকি আমিই ভুল দেখেছিলাম? ব্যাপারটা খচখচ করছে। অ্যানা আসার পর দু’জন মারা গিয়েছে। এটার সঙ্গে অ্যানার কোনও যোগ থাকার কথা নয়। সাড়ে চার বছরের একটা মেয়ে, যার বুদ্ধির বিকাশই হয়নি, তার পক্ষে কাউকে খুন করা দূরের ব্যাপার, ভয় দেখানোও সম্ভব নয়। তবুও একবার অ্যানার রুমটা ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করল। পল মারা যাওয়ার পর ওই রুমে ও একাই থাকে।
ত
সেন্ট পিটার্সবার্গে নিনেলকে ফোনে ধরলাম। ওর গলায় বিরক্তি। অ্যানার ব্যাপারে কথা বলতে চাইছে না। অ্যানার বাবা-মা মারা যাওয়ার পর নিনেলই ওকে এখানে রেখে গিয়েছিল। আমি নিশ্চিত ও অনেক কিছু জানে। একটু আগে অ্যানার ঘরে তিনটে অদ্ভুত জিনিস দেখেছি। পলের রংপেন্সিল বক্স। পলের সমস্ত জিনিস ওর বাবা-মা নিয়ে গিয়েছেন। লিস্ট মিলিয়ে আমরাই সব গাড়িতে তুলে দিয়েছিলাম। এটা রয়ে গেল কী করে? ক্যারোলিনার হেয়ার ক্লিপই বা এল কী করে? আর অন্যটা হল, অ্যানার ছবি আঁকার খাতা। ড্রইং খাতাটার পাতায় পাতায় শুধু একটাই ছবি, কামোমিল ফুল! অপটু হাতে আঁকা। যেমনটা দেখেছি পল আর ক্যারোলিনার তালুতে। আমি চমকে গিয়েছি। একটা চাপা টেনশন হচ্ছে। অ্যানার ব্যাপারে ভালো করে খোঁজখবর নিতে হবে।
নিনেলকে জিজ্ঞেস করলাম, “অ্যানার বাবা-মা, মানে আপনার দাদা-বৌদি মারা গিয়েছিলেন কীভাবে?”
ও বিরক্ত হয়ে জানাল, “রোড অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা তো স্কুলকে জানানো হয়েছে। নতুন কী বলব!”
তবুও বললাম, “আচ্ছা, ওঁদের হাতের তালুতে কি কামোমিল ফুলের ছবি আঁকা ছিল?”
আমার প্রশ্ন শুনে নিনেল থমকে গেল। পরক্ষণেই সে উত্তেজিত হয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, ছিল। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?”
আমারও কথা আটকে গিয়েছে। তাহলে অ্যানার সঙ্গে যোগ আছে ব্যাপারটার। পল আর ক্যারোলিনার হাতে আঁকা কামোমিল ফুলের ছবিদুটো নেহাতই কাকতালীয় নয়। শুধু নিনেল নয়, আরও গভীরে ঢুকে জানতে হবে সবকিছু। তবেই পুরোটা পরিষ্কার হবে।
কোনওরকমে বললাম, “যে হোম থেকে ওকে আনা হয়েছিল তার নম্বর দিতে পারেন?”
ফোনের ওপারে যেন ঝরঝর করে অসংখ্য কাচ ভেঙে পড়ল। যেন অনেকে একসঙ্গে মরিয়া চেঁচাচ্ছে! নিনেলের কথা সেই চিৎকারে হারিয়ে গেল। তীব্র আওয়াজের জন্য আমি ফোনটা কান থেকে সরাতেই লাইন কেটে গেল।
থ
ভয়। একটা ভয় ক্রমশ আঁকড়ে ধরছে আমাকে। উদভ্রান্ত লাগছে। আমার মন বলছে, আরও কিছু ঘটবে। পায়ে পায়ে অ্যানার ক্লাসে এলাম। এখন ড্রইং ক্লাস চলছে। এইরকম বাচ্চারা মুডি হয়। যে যেমন পারছে আঁকছে, কেউ কেউ চুপ করে বসে আছে। ক্লাস টিচার সোফি তাদের আদর করে আঁকানোর চেষ্টা করছে। ক্লাসে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে অ্যানা। আমি সোফির দিকে তাকালাম। ইশারায় অ্যানার ব্যাপারে জানতে চাইলাম। সোফি আশ্বস্ত করল। তখনই দেখলাম, অ্যানা আমার দিকে তাকিয়ে। সাড়ে চার বছরের মেয়ের চোখে এত রাগ জমতে পারে? ওর মুঠোয় একটা তাজা কামোমিল ফুল। যেন এখনই গাছ থেকে তোলা হয়েছে।
দ
কামোমিল রাশিয়ার জাতীয় ফুল। হলুদ কুসুমের চারপাশে সাদা পাপড়িগুলোকে দেখে প্রজাপতি মনে হয়। এখুনি যেন ডানা মেলে উড়ে যাবে। রাশিয়ার জনজীবনে, বিশ্বাসে, গল্পে জুড়ে আছে কামোমিল। ছোটোখাটো রোগ এই ফুলের রসে সেরে যায়। একমাত্র পাহাড়ি এলাকায় এই ফুল মেলে। কামোমিলের সঙ্গে কীভাবে জড়ালো অ্যানা? নিষ্পাপ একটা ফুলের মতো শিশু। হা ঈশ্বর, আর কত কী দেখতে হবে জীবনে!
স্কুল থেকে ফিরে প্রসেসড ফুড দিয়ে ডিনার সারলাম। তারপর বাথটবে গা এলিয়ে চোখ বুজতেই অ্যানার মুখ ভেসে উঠল। জড়ভরত যারা হয়, তারা দেখতে অন্যরকম হয়। মাস খানেক আগে অ্যানা যখন স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, তেমনই দেখতে ছিল। কিন্তু এখন ওকে সুস্থ বাচ্চাদের মতো লাগে। আগের মুখটা বদলে গেল কী করে?
বাথটব থেকে উঠে গা মুছতে মুছতে চমকে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, আমার পায়ের পাতায় একটা কামোমিল ফুলের ছবি! কে আঁকল? কোনও বাচ্চার সঙ্গে তো আজ খেলা করিনি। ভালো করে দেখেই আঁকার রেখাগুলো চিনতে পারলাম। অ্যানার আঁকার খাতায় এমন ছবি দেখেছি! পল, ক্যারোলিনার হাতের তালুতে দেখেছি! প্রচণ্ড ভয়ে আমার হাত কেঁপে গেল। অজানা আশঙ্কার স্রোত নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে।
ধ
রাত অনেক হয়েছে। স্কুল খুব দূরে নয়। হেঁটে গেলে কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। মন বলছে, আজ রাতে কিছু একটা ঘটবে। এবার আমার পালা। লক্ষ করে দেখেছি, আমার পায়ের পাতায় আঁকা কামোমিলের ফুলের ছবিটা সচল! ওটা এখন হাঁটুতে উঠে এসেছে। জানি, এটা কাউকে বললে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু এটাই বাস্তব। আমি জানি, ওটা আরও উঠবে। একসময় নেমে আসবে আমার কোনও একটা হাতের তালুতে। পল, ক্যারোলিনার মতো। তার আগে অ্যানাকে খুঁজে বের করতে হবে।
একটু আগে নিনেল ফোন করেছিল। কাজানের যে অনাথ আশ্রমে অ্যানা ছিল, সেখানে খোঁজ নিয়েছে ও। অ্যানাকে কাজানের প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় কেউ একজন কুড়িয়ে পেয়েছিল। তখন একতাল মাংসের মতো ছিল মেয়েটা। ওকে সাপের মতো ঘিরে ছিল অসংখ্য কামোমিল ফুল। নিনেল বলেছে, অ্যানা ওখানে যাওয়ার পর অনাথ আশ্রমের চারটে বাচ্চা মারা যায়। তাদের হাতেও আঁকা ছিল কামোমিল ফুল! হোমের কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেছিল, এসবের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে অ্যানার যোগ আছে। নিনেলের দাদা অ্যানাকে দত্তক নিতে চাওয়ায় ওরা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। যেদিন নিনেলের দাদা-বৌদি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান, সেদিন তাঁরা কাজানের অনাথ আশ্রমে যাচ্ছিলেন। অ্যানার অতীত সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে।
নিনেল আরও একটা অদ্ভুত খবর দিল। কাজানের পার্বত্য অঞ্চলে বহু পুরনো উপজাতির বাস। তাদের আরাধ্য দেবতা নাকি কামোমিল ফুল। ওরা বিশ্বাস করে, কামোমিল ফুল থেকে প্রতি শতাব্দীতে একটা বাচ্চা জন্ম নেয়। সেই বাচ্চা নাকি গ্রাস করে অনেক শিশুকে। তাকে থামানো যায় না।
নিনেল যা বলল, সত্যি না মিথ্যে, নাকি কোনও উপজাতির গল্প, আমি জানি না। জানা বা বোঝার মতো মনের অবস্থা আমার নেই।
ন
আমাকে দেখে স্কুলের গেটটা খুলে দিল দারোয়ান। হোস্টেলটা স্কুলের পিছনে। কেয়ারটেকার রোজি রয়েছে নাইট ডিউটিতে। বেচারি রেস্ট নিচ্ছিল। এত রাতে আমাকে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসল। ওকে নিয়ে অ্যানার ঘরে এলাম। দরজাটা ভেজানো। সাদাটে তীব্র আলো ঠিকরে পড়েছে দরজার ফাঁক দিয়ে। দরজাটা খুলতেই দেখলাম, ঘরের দেওয়ালে ফুটে রয়েছে হাজার হাজার কামোমিল ফুল। ভয়ে আমার মুখ সাদা হয়ে গেল। ফুলগুলো নড়ছে তিরতির করে! যেন হাওয়ায় দুলছে।
অ্যানা বেডে নেই। ওর বিছানার ওপর আমার সানগ্লাসটা রাখা। এটা তো টিচার্স রুমে আমার ড্রয়ারে থাকে। এখানে কে নিয়ে এল? পলের রংপেন্সিল বক্স, ক্যারোলিনার হেয়ার ক্লিপের কথা মনে পড়তেই শিউরে উঠলাম। রোজিকে কাঁপা গলায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, “অ্যানা কোথায়?”
রোজিও ভয় পেয়েছে। আমার উদভ্রান্ত চেহারা ওকে আরও ঘাবড়ে দিয়েছে। ঢোঁক গিলে বলল, “জানি না, স্যর। একটু আগেও দেখে গিয়েছি ঘুমোচ্ছিল!”
আমি একটা স্পোর্টস লোয়ার আর টি-শার্ট পরে বেরিয়েছিলাম। গেঞ্জিটা তুলে দেখলাম, কামোমিল ফুলটা চলতে চলতে আমার নাভির কাছে পৌঁছেছে। দ্রুত সময় ফুরিয়ে আসছে আমার।
“রোজি, বাগানে চলো। কুইক!”
হোস্টেল থেকে বেরিয়ে দেখলাম, চাঁদটা অনেকখানি নেমে এসেছে। জোৎস্নার নরম আলোয় আকাশটা ছেয়ে গিয়েছে। স্কুল, হোস্টেল যেন ধুয়ে যাচ্ছে। বাগানের পেরেনিয়াল, ক্রকাস, মন্তানা, আজালিয়া, লিলি, গোলাপ সমস্ত গাছের মাথায় একটা করে মস্ত কামোমিল ফুল ফুটেছে। সেগুলো থেকেও আলো ছড়াচ্ছে।
উদভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে বাগানে এসে দেখলাম, অ্যানা জঙ্গলের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু ওখানে তো স্কুলের বিশাল পাঁচিলটা থাকার কথা। ওটা অদৃশ্য হয়ে গেল কী করে? অ্যানার হাতেও একগুচ্ছ কামোমিল ফুল। সেসব ফুলের মাথায় যেন জ্বলছে একটা করে ছোটো ছোটো চাঁদ। ওর পিছন পিছন হাঁটছে হোস্টেলের সমস্ত বাচ্চা। আমি দেখতে পেলাম, আমার শরীরে চলমান কামোমিল ফুলটা ডানহাতের বাহুতে নেমে এসেছে। ওটা এখন আর আঁকা ছবি নয়। আসল ফুলের মতো উজ্জ্বল। নড়ছে। আলো ঠিকরে পড়ছে। যে আতঙ্ক আমাকে এত রাতে টেনে এনেছে হোস্টেলে, নিজেকে বাঁচানোর যে তাগিদ এতক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, সেসব যেন মুছে গিয়েছে আমার মন থেকে। এখন আমার আর ভয় করছে না। চারদিক শান্ত হয়ে গিয়েছে। এক অসীম নিস্তব্ধতার মধ্যে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে আমার সমস্ত জাগতিক সত্ত্বা।
অ্যানা একবার ঘুরে দেখল আমাকে। ওর মুখে হাসি। বড়ো ভালোলাগা হাসি। ওর হাসিতে কোনও পাপ বোধ নেই। অ্যানার হাসি মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানছে আমাকে। একটা ঘোর। মোহের মতো। আমি অ্যানার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
শীর্ষচিত্রঃ জয়ন্ত বিশ্বাস। ভেতরের ছবিঃ ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
সাংঘাতিক
LikeLike