সন্ধ্যা ভট্টাচার্য সাহিত্য প্রতিযোগিতা ২০১৯ তৃতীয় স্থান- দাবা কিংবা একটি না বলা গল্প বিভাবসু দে শীত ২০১৯

দাবা কিংবা একটি না-বলা গল্প

বিভাবসু দে

চারপাশে নর্দমার থকথকে কাদার মতো লেপটে আছে অন্ধকারটা। চোখ তুলে চাইতেও ইচ্ছে করছে না আর। কীই বা দেখার আছে এই অন্ধকুঠুরির ভেতর? চারটে নিশ্ছিদ্র কালো দেয়াল আর একটা লোহার গরাদ—যা হয়তো অনন্তকালের জন্যে বন্ধ হয়ে গেছে! চারপাশে কোত্থাও কেউ নেই—শুধুই এক গুমোট নিস্তব্ধতা। হাওয়া নেই, প্রাণ নেই, জীবনের ক্ষুদ্রতম সাড়াটুকুও নেই! সারাটা ঘর জুড়ে অসহ্য ভ্যাপসা গরম।

মাত্র ক’টা দিনেই যে সবকিছু এভাবে পালটে যেতে পারে, কখনও ভাবিনি। চোখের সামনে যেন এখনও ছবির মতো ভাসছে সেই মুহূর্তগুলো, সেই সকালবেলা—আমার জীবনে এই ভীষণ অন্ধকার-উদয়ের সকালবেলা!

সেদিন দোসরা মে, শনিবার—সবে ভোরের আলো ফুটেছে। ঘড়িতে তখন বোধহয় পাঁচটা। আমি নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছিলাম, হঠাৎ বোনের ডাকাডাকিতে হকচকিয়ে উঠি। কিন্তু উঠেই যা দেখতে পেলাম, তার জন্যে মোটেই তৈরি ছিলাম না আমি। আমার ছোট্ট ঘরটা চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে সশস্ত্র পুলিশবাহিনী। পুলিশ সুপার ক্রেগানের রিভলবার ঠিক আমার বুকের দিকে তাক করা।

মজঃফরপুরের খবরটা তার আগের দিনই জানতে পেরেছিলাম টেলিগ্রাম মারফত, কিন্তু তখন কি আর জানতাম যে এই ঘটনায় পুলিশের সন্দেহ তালিকায় আমার নামই শীর্ষে! অভিযোগ, আমার এই বাড়িতে নাকি বোমা-পিস্তল লুকোনো আছে। তন্নতন্ন করে পুরো বাড়ি সার্চ করা হয়েছিল, কিন্তু কিছুই পায়নি পুলিশ। তবুও গ্রেপ্তার হলাম। পরোয়ানা ওরা নিয়েই এসেছিল। ক্রেগান সাহেবের নির্দেশে আমাকে হাতকড়া পরিয়ে তোলা হল গাড়িতে। সেখান থেকে প্রথমে লোকাল থানায় কয়েকঘণ্টা বসিয়ে রেখে তারপর লালবাজার। সেখানে তিনদিন ছিলাম। শুধু আমি নই, এই মামলায় ধরা পড়া অনুশীলন দলের আরও অনেকেই। অধিকাংশকে আমার মতোই শুধু সন্দেহের ভিত্তিতেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আস্তে আস্তে অনেক কিছুই খোলসা হয়ে আসছিল, কিন্তু তখনও আঁচ করতে পারিনি ব্যাপারটা ঠিক কতদূর গড়াতে পারে। লালবাজার থেকে আজ সকালেই আমাকে ও আরও বেশ কয়েকজনকে নিয়ে আসা হল আলিপুর ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। তারপর সেখান থেকে বিচারধীন বন্দী হিসেবে সোজা এই আলিপুর জেলে। এখানে এসে একটা মজার ব্যাপার জানতে পারলাম, আমি নাকি খুব দুর্ধর্ষ একজন রাষ্ট্রদ্রোহী, অতএব আমাকে সবার থেকে আলাদা করে রাখবার হুকুম হয়েছে।

ঘণ্টা দেড়েক আগে এক সান্ত্রী প্রায় ধাক্কা মারতে মারতে এই সলিটারি সেলে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল আমাকে। নির্জন, নিস্তব্ধ, অন্ধকার একটা খাঁচা। আমার বিশেষ খাঁচা।

“কী ব্যাপার অরবিন্দ, খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে?”

“ক-ক্কে? কে ওখানে?” বাজ পড়ার মতো চমকে উঠেছিলাম হঠাৎ। এক মুহূর্তের জন্যে তো মনে হয়েছিল যেন জমাটবাঁধা অন্ধকারটাই কথা বলে উঠল! কিন্তু ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, না, একটা মানুষ। ক্ষয়াটে জ্যোৎস্নায় একটা হালকা নীলচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে লোকটার সারা শরীরে। আলো-আঁধারির মধ্যে বসে থাকা এক আবছা অবয়ব। আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে গেলাম। “আপনি কে? এখানে কী করে এলেন?”

লোকটা সেলের ওপাশের দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে। তার পাতলা ঠোঁটদুটোতে একফালি স্থির হাসির রেখা। “আমি এখানেই ছিলাম। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি।”

সরু চোখে একবার মেপে নিলাম লোকটাকে। বয়েস খুব একটা কম হবে না। হয়তো সত্তরের একটু ওপরের দিকেই। কাছ থেকে এখন বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। লোকটার পিঠ অবধি নেমে এসেছে ধবধবে সাদা চুল, আর থুতুনির নিচে বুক অবধি সাদা দাড়ি। চওড়া কপাল, টিকালো নাক আর নাকের দু’পাশ দিয়ে গভীর খাতের মতো দুটো বলিরেখা। হঠাৎ দেখলে যেন বেশ একটা বৈষ্ণব-গোসাঁইজি গোছের কেউ বলেই মনে হয়।

একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু এটা তো সলিটারি সেল! আমাকে এখানে একাই রাখার কথা। আর আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?”

লোকটার মুখে হাসির রেখাটা আরেকটু চওড়া হয়ে উঠল। “অনুশীলন সমিতির বিখ্যাত নেতা কিংবা ব্রিটিশ পুলিশের নজরে কুখ্যাত বিদ্রোহী শ্রীমান অরবিন্দ ঘোষকে কে না চেনে! মানিকতলায় তোমার ভাইয়ের বাগানবাড়ি থেকে বোমা উদ্ধার আর তোমার গ্রেপ্তারির খবর তো এখন লোকের মুখে মুখে।”

লোকটা একটু থামল। বোধহয় দম নেবার জন্যেই। “আর সলিটারি সেলের কথা বলছিলে? পুলিশের লোকজন রোজ গণ্ডায় গণ্ডায় ছেলেছোকরাকে স্বদেশী করাবার দায়ে পাকড়াও করছে, কিন্তু সলিটারি সেল আর ক’খানা আছে? গিয়ে দেখো, এমন ন’ফুট বাই ছ’ফুটের কত সলিটারি সেলে তিন-তিনটে মানুষকেও ঠুসে রেখেছে!”

“হুম।”

আমি এতক্ষণ লোকটার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। জানি না কেন, চোখদুটো বড্ড চেনা চেনা ঠেকছিল। কোথাও যেন দেখেছি। “তা আপনার নামটা?”

“নাম? জেলে ওসব নাম-টাম বেশিদিন টেকে না। এখানে কয়েদি নম্বরই লোকের পরিচয়। এই যে,” জামায় লাগানো ধাতব পাতটা আমার দিকে দেখিয়ে বলল, “কয়েদি নম্বর পনেরো। ধরে নাও এখন এটাই আমার নাম।”

“বেশ। তা কদ্দিন আছেন? আপনার বয়েস তো নেহাত কম মনে হয় না।”

“সেসব হিসেব কি আর রেখেছি ভাই? যাবজ্জীবন। বছর গুনে আর কী হবে?” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ গরাদের বাইরে তাকিয়ে রইল লোকটা। বাইরে এখন হালকা হালকা হাওয়া দিচ্ছে। “আসলে ভেতরে বাইরে সবই তো সলিটারি সেল, তাই গরাদের এপারে থাকো বা ওপারে, বন্দী সবাই-ই!”

বুঝলাম, লোকটাকে দেখতেই শুধু সাধুসন্ন্যাসীর মতো নয়, কথাগুলোও বেশ দার্শনিক ধরনের। হয়তো অনেক পুরনো কিছু দুঃখকষ্টও থাকতে পারে, তাই আর বেশি ঘাঁটালাম না। চুপ করে বসে রইলাম বাইরের একচিলতে উঠোনটার দিকে তাকিয়ে।

লোকটাও চুপ করে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ আমাকে প্রায় চমকে দিয়ে বলে উঠল, “একহাত দাবা চলবে নাকি?”

“দাবা! এখানে? কোথায় পাবেন?”

“আছে আছে, আমার কাছেই আছে।” বলতে-বলতেই পেছন থেকে একটা সাজানো দাবার বোর্ড খুব সাবধানে দু’হাতে ধরে এনে আমার সামনে রাখল লোকটা। “আসলে অনেক বছর আছি তো, তাই সান্ত্রীদের বলে-কয়ে জোগাড় করে ফেলেছি একটা।”

প্রস্তাবটা মন্দ লাগল না আমারও। অন্ধকারে আর গরমে একা একা বসে মশার কামড় খাবার চেয়ে এই বুড়ো লোকটার সঙ্গে দাবা খেলে রাত কাটানো বরং অনেক ভালো। বোর্ডটাও বেশ সুন্দর, কাঠের। দু’পাশে সার দিয়ে সাজানো সাদা আর কালো ঘুঁটি। গরাদের ঠিক সামনাটায়, যেখানে হালকা জ্যোৎস্না পড়ছে, সেখানেই বোর্ডটাকে রাখল লোকটা। তারপর কী যেন একটু ভেবে মুচকি হেসে বলল, “নাও, তুমি দেশের স্বাধীনতার জন্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছ, সুতরাং সাদা তুমিই নাও।”

হাসলাম। এই বয়েসেও লোকটার রসিকতা বোধ মরেনি।

জেলের জ্যোৎস্নাভেজা মেঝের ওপর বসে শুরু হল আমাদের দাবা খেলা। যেহেতু আমার সাদা, প্রথম দান আমারই। আস্তে করে একটা বোড়ে সামনে ঠেলে দিলাম। “নিন, এবার আপনা…”

কিন্তু মুখের কথাটা শেষ করবার আগেই এক তীব্র আতঙ্কে ধড়াস করে কেঁপে উঠল বুকের ভেতরটা। এসব কী! এ যে অসম্ভব! কী দেখছি এসব আমি! আমার চারপাশে কোনও দেয়াল নেই, লোহার গরাদ নেই, দাবার বোর্ড আর এমনকি সেই বুড়ো লোকটাও নেই। চারপাশে ধূ ধূ করছে খোলা প্রান্তর। আর আমি… নিজের দিকে তাকাতেই ঝিনঝিন করে উঠল মাথার ভেতরটা। আমার গায়ে আলখাল্লার মতো ঢলঢলে একটা সাদা পোশাক, মাথায় সাদা টুপি, হাতে বর্শা। আমার গায়ের রঙও সাদা! আমি কি কোনও স্বপ্ন দেখছি? চিমটি কাটলাম নিজেকে—না, স্বপ্ন তো নয়। কিন্তু এ যে বাস্তবও হতে পারে না! হ্যালুসিনেশন? নাকি কোনও জাদুকরের ভেলকি? এক অজানা ভয়ে থিরথির করে কাঁপছে আমার সারাটা শরীর। অবশ হয়ে আসছে চিন্তাশক্তিও। মাথা যেন আর কাজ করছে না।

বেশ কিছুটা সময় লাগল ধাক্কাটা সামলে উঠতে। আস্তে আস্তে একটু ধাতস্থ হয়ে নিয়ে তাকালাম নিজের চারপাশটায়। দূরদূরান্ত অবধি কোনও গাছপালা নেই, কালো দিগন্তে এসে মিশেছে কালো আকাশ। এখন কি রাত? জানি না। আকাশে যদিও চাঁদ-তারা কিছুই নেই, তবুও কোনও এক অদৃশ্য উৎস থেকে ছড়িয়ে পড়ছে এক অপার্থিব নীলাভ আলো। তাতেই সারাটা মাঠ উজ্জ্বল হয়ে আছে। কিন্তু এ কেমন মাঠ? ঘাস নেই, মাটি নেই, পুরোটা জুড়ে কেউ যেন একটা সাদা-কালো ছককাটা শতরঞ্চি বিছিয়ে দিয়েছে। অনেকটা দাবার বোর্ড যেমন দেখতে হয়। দাবার বোর্ড? কী একটা যেন চিড়িক করে উঠল আমার মাথার ভেতর। পেছন ফিরে তাকালাম। আমার থেকে প্রায় দুই মানুষ দূরত্বে আমার মতোই আরও অনেক সাদা লোক বর্শা হাতে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা বোড়ে! আমিও কি তা-ই? সেই বোড়েদের সারির পেছনে আরও উঁচু উঁচু অনেক সাদা মাথা—নৌকো, হাতি, ঘোড়া, মন্ত্রী আর সবার ওপরে, সবচেয়ে উঁচু আসনে সাদা মখমলের ঝলমলে পোশাক আর রুপোলি মুকুট পরে বসে আছে সাদা রাজা।

একটা শিরশিরে ভয় যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল আমার ভেতর ভেতর। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। ভয় পেলে কি আর আরামের জীবন ছেড়ে অস্ত্র হাতে কোনওদিন ঝাঁপিয়ে পড়তাম ইংরেজের বিরুদ্ধে? কিন্তু অজানা, অলৌকিক যখন চোখের সামনে এমন উৎকটভাবে জীবন্ত হয়ে এসে দাঁড়ায় তখন যেকোনও মানুষের মনেই এক অকারণ ভয় সহজাত প্রবৃত্তির মতোই চাগাড় দিয়ে ওঠে। একে ঠেকাবার সাধ্য কারও নেই।

এটা যদি সত্যিই একটা দাবার ময়দান হয় তবে নিশ্চয়ই ওপারেও… সামনে তাকালাম। বেশ অনেকটা দূরে কালো প্রাচীরের মতো ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে কালো রাজার সৈন্যদল। অবিশ্বাস্য! হয় আমি জেলখানায় একদিন থেকেই পাগল হয়ে গেছি, নাহয় আমার খাবারে কোনও নেশা ধরানো ওষুধ মিশিয়েছে ওই শয়তান পুলিশগুলো।

মানতে পারছি না, তবুও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার চারপাশে এক জীবন্ত দাবার আসর শুরু হয়ে গেছে। বেশ কিছু সাদা বোড়ে আর ওদিক থেকেও বেশ কয়েকটা কালো সৈন্য নেমে পড়েছে যুদ্ধের ময়দানে। ভাবলাম ছুটে পালিয়ে যাই, কিন্তু তখনই বুঝতে পারলাম সে সাধ্য আমার নেই। আমার মাথা আর হাতদুটো ছাড়া বাকি সারাটা শরীর যেন পাথরের মূর্তির মতো জমাট বেঁধে গেছে। পিছোবার, পালাবার পথ নেই। বোড়েরা পিছোতে জানে না। পিছোবার ব্যাপারটায় শুধু বড়ো ঘুঁটিদেরই এক্তিয়ার।

আচ্ছা, সেই বুড়ো লোকটাও কি এখানে আছে? এদিক ওদিক নজর চালিয়ে দেখলাম, কিন্তু কোথাও চোখে পড়ল না। সাদা দলে তো নেই, হয়তো কালো দলে থাকতে পারে।

“ঘোড়া, ঘোড়া! ঘোড়া নেমেছে।”

হঠাৎ আমার চারপাশের বেশ কিছু সাদা সেপাইয়ের চিৎকারে চমকে উঠলাম। ওদের আতঙ্কিত দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে সামনে কোথাও। তাকিয়ে দেখলাম, বেশ খানিকটা দূরে একটা বিশাল কালো ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক যেন ঝড়ের আগের জমাটবাঁধা কালো মেঘ। এত বড়ো ঘোড়া আমি জন্মে দেখিনি। ঘোড়াটার চোখদুটো যেন আগুনের মতো দপদপ করছে। নিখুঁত ঝকঝকে শরীর, যেন পালিশ করা কষ্টিপাথর। রাজার আদেশের অপেক্ষায় বারবার দুই পা তুলে লাফিয়ে উঠছে ঘোড়াটা। যেন একবার আদেশ পেলেই ছুটে এসে তছনছ করে দেবে সাদাদের সাম্রাজ্য।

ঘোড়া এক লাফে আড়াই ঘর চলে। এটাই দাবার নিয়ম। কথাটা মনে পড়তেই আমি শিউরে উঠলাম। ছককাটা ঘরের হিসেবে আমার থেকে ঠিক আড়াই ঘর দূরেই তো দাঁড়িয়ে আছে ওই কালো ঘোড়া। তার লাল চোখদুটোও যেন এখন আমার দিকেই। বোড়ের সাধ্য নেই আড়াই ঘর দূরের ঘোড়াকে মারবার, কিন্তু ঘোড়ার আছে। তবে কি এই দাবার রাজ্যে একটা বোড়ে হয়েই মরতে হবে আমাকে!

এই অলীক স্বপ্নের মতো ঘটে চলা দৃশ্যগুলো আস্তে আস্তে কেমন যেন বাস্তব হয়ে উঠছিল আমার কাছে। ভুলে যাচ্ছিলাম যে এসবের কোনও লৌকিক বা যৌক্তিক ব্যাখ্যা আমি জানি না। আমার থেকে আড়াই ঘর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আসন্ন মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে যখন এসব ভাবছি, তখনই হঠাৎ যেন মাটিটা দুলে উঠল। ভূমিকম্প? নাহ্‌। পেছন ফিরে দেখলাম আড়াআড়িভাবে আমার ঠিক পেছনটায় এসে দাঁড়িয়েছে পাহাড়ের মতো বিরাট এক সাদা হাতি। শুঁড় তুলে উদ্ধত মুদ্রায় সোজা তাকিয়ে আছে কালো ঘোড়ার দিকে। ঘোড়াটা একবার হাতির দিকে তাকাল, আরেকবার আমার দিকে। যেন সেই আগুন-ঝরানো চাউনিতে একবার মেপে নিল আমাদের। তারপর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ভীষণ একটা লাফ দিয়ে অন্যদিকে সরে গেল, আড়াই ঘর। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

‘ধুস! ফসকে গেল।’ শুঁড় দিয়ে ফোঁস করে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাদা হাতিটা।

ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন? কী হল? ঘোড়াটা তো চলেই গেছে। আমাকে বাঁচিয়ে দিলে তুমি।”

হাতিটা মাথা নুইয়ে একবার ভীষণ অবাক চোখে তাকাল আমার দিকে। ফ্যাঁসফেসে গলায় বলল, “এমন বেআক্কেলে কথা কখনও শুনিনি বাপু। বোড়ে বাঁচাতে কেউ হাতি চালে না। ভেবেছিলাম তোমাকে টোপ করে ওই ব্যাটা কালো ঘোড়াকে পিষে মারব, কিন্তু ঘোড়াটা বেজায় সেয়ানা।”

সত্যিই তো। ভুলেই গেছিলাম যে আমি, চরমপন্থী অনুশীলন দলের সদস্য অরবিন্দ ঘোষ, যাকে তিনদিন আগে রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এখন শুধুই একটা বোড়ে! আর এই ছককাটা পৃথিবীতে একটা বোড়ের কীই বা দাম! বিপক্ষের ঘোড়াকে মারবার জন্যে হাসিমুখে একটা সামান্য সেপাই ব্যয় করা যেতেই পারে। এটাই তো দাবার অলিখিত নিয়ম।

একটু একটু করে খেলাটা বেশ জমে উঠেছে। দু’পক্ষেরই বড়ো বড়ো যোদ্ধারা নেমে পড়েছে ময়দানে। হাতি, ঘোড়া, মন্ত্রী, নৌকো সবাই। কিছুক্ষণ পর পরই এ ওর ওপর হামলে পড়ছে। আমি শুধু অবাক হয়ে দেখছিলাম এই দাবার দুনিয়া। অচেনার ভয়টা কখন যে আপনা থেকেই কেটে গেছে, বুঝতেই পারিনি। আসলে এই জগতটা বোধহয় কোনওকালেই আমার খুব বেশি অচেনা ছিল না। এখানে সবকিছুই তো দাবার নিয়ম মেনে চলে।

বর্শা হাতে মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো ভাবছিলাম, এমন সময় হঠাৎ কোনও এক অদৃশ্য হাতের ঠেলায় যেন চিন্তার সুতোটা ছিঁড়ে গেল। নড়ে উঠল আমার অচল শরীরটা। এক ঘর এগিয়ে গেলাম আমি। আর সঙ্গে সঙ্গে, “হেঁইয়ো!”

থতমত খেয়ে সামনে তাকাতেই দেখি এক কালো বোড়ে কোনাকুনিভাবে দাঁড়িয়ে আছে আমার দিকে বর্শা তাক করে। চোখে একটা ভীষণ রণংদেহি চাউনি। কেন জানি না হঠাৎ একে দেখে পুলিশ সুপার ক্রেগানের সেই রিভলবার তাক করা মুখটা মনে পড়ে গেল।

আমি বেশ ভালোভাবেই জানি, এখন কালো পক্ষের দান। হয়তো আর এক মুহূর্ত পরেই ওই কালো বোড়েটা তীব্র আক্রোশে লাফিয়ে পড়ে শেষ করে দেবে আমাকে। আমার হাতেও বর্শা আছে, কিন্তু আমি প্রতিরোধ করতে পারব না, লড়তেও পারব না। কী অদ্ভুত না এই দাবার দেশ! কিন্তু তখনই ঘটনাটা অন্যদিকে মোড় নিল। ময়দানের একেবারে ওপাশে তখন অন্য খেলা চলছে। কালো দলের মন্ত্রীকে কখন যে তিনদিক থেকে সাদা নৌকো, হাতি আর ঘোড়া মিলে ঘিরে ফেলেছে কালো-বাদশা খেয়ালই করেনি। এখন টনক নড়তেই তড়িঘড়ি মন্ত্রীকে পেছনে সরিয়ে নিল। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই কালো বোড়েটার চোখদুটোও যেন সেদিকেই স্থির হয়ে আটকে গেছে। অবাক লাগল, ওর চোখে আর সেই উগ্র দৃষ্টি নেই, বর্শাটাও নুয়ে পড়েছে মাটিতে। চোখের কোণে যেন ছলছল করছে একগাদা প্রশ্ন। আমার চেনা পৃথিবীটাকেই যেন আরেকবার দেখতে পেলাম এই দাবার দেশে। সাম্যবাদ, গণতন্ত্র, সমানাধিকারের স্বপ্ন নিয়ে ভারত স্বাধীন করার যুদ্ধে নেমেছি আমরা, তবুও নেপথ্যে সবসময়ই মন্ত্রীর দাম বোড়ের চেয়ে বেশি।

মনটা বড়ো খারাপ হয়ে এল ওর জন্যে। ইচ্ছে হল সান্ত্বনা দিয়ে কিছু একটা বলি, কিন্তু পারলাম না। তখনই আবার সেই অদৃশ্য হাতের ঠেলা। আমি না চাইলেও আমি যে করতে বাধ্য। আমি তো এখন শুধুই একটা ঘুঁটি। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হল ওই কালো বোড়ের ওপর। আমার বর্শায় এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেল ওর বুক। হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ওর রক্তাক্ত লাশটা। আমি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে চাইলাম, যদি সেই অদৃশ্য হাতের দেখা পাই। কে বলতে পারে, সাদা পক্ষ আর কালো পক্ষকে যে হাতদুটো চালায়, তারা একই শরীরের দু’পাশে জুড়ে নেই!

খেলা এখন তরতর করে এগোচ্ছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে যা বুঝতে পারলাম, আমাদের দল জিতছে। কালো দলের মন্ত্রী, নৌকা, ঘোড়া প্রায় সবই খাওয়া গেছে। এখন শুধু কালো রাজা, একটা কালো হাতি আর গুটিকয়েক বোড়েই টিকে আছে। ওই তো ওই তো, কালো রাজাকে আমাদের দল ঘিরে ফেলেছে। উত্তেজনায় যেন কাঁটা দিয়ে উঠল আমার গায়ে। আমার চারপাশের এই অলৌকিক অতিজাগতিক দৃশ্যগুলোর সঙ্গে কখন যে এত গাঢ়ভাবে মিশে গেছি, টেরই পাইনি। আলিপুর জেলের সেই অন্ধকার কুঠুরি, দাবার বোর্ড, সেই বুড়ো লোকটা আর আমার চিরপরিচিত সেই অরবিন্দ ঘোষ—এখন যেন এগুলোই স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। এই দাবার রাজ্যই হয়তো সত্যিকারের বাস্তব।

খেলার প্রায় শেষমুহূর্তে। হঠাৎ বোধহয় আবার আমার কথা মনে পড়ল সেই অদৃশ্য হাতের। আমাকে ঠেলে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল একেবারে কালো রাজার মুখোমুখি। রাজার সামনে বোড়ে! বুকটা একটু যেন ধুকপুক করে উঠল।

রাজার হাতে ঝলসে উঠেছে তলোয়ার। এই বোধহয় আমার শেষ। তবুও রাজার সঙ্গে লড়ে মরব, কম গর্বের কথা তো নয়। গর্বিত মৃত্যু! বুক চিতিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু ঠিক তখনই চারদিক কাঁপিয়ে কে যেন গর্জন করে উঠল, “কিস্তিমাত!”

থমকে গেল কালো রাজা। আমিও তাকিয়ে দেখলাম, রাজা সত্যিই ফেঁসে গেছে। সে ডানে কিংবা বাঁয়ে এগোলেই হাতি কিংবা মন্ত্রীর হাতে মরবে, সোজা এগোলে ঘোড়ার হাতে আর যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলে আমার হাতে। আমাকে মারলেও নিস্তার নেই, পেছনে সোজাসুজিভাবে খানিকটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে সাদা নৌকো।

আমার বুকের ভেতরটা তীব্র রোমাঞ্চে শিরশির করে উঠল। কালো রাজা দু’হাত তুলে আস্তে আস্তে ঝুঁকে যাচ্ছে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে। তলোয়ার খসে পড়েছে তার হাত থেকে। চারপাশ থেকে গগনভেদী ধ্বনি উঠল, “জয়, শ্বেতসাম্রাজ্যের জয়। জয়, সাদা রাজার জয়।”

আমিও মুঠো হাত আকাশের দিকে তুলে চিৎকার করে উঠলাম, “বন্দেমাতরম!”

আমার অজান্তেই কখন যেন এই দাবার দেশ আর আমার ভারতবর্ষ মিলেমিশে এক হয়ে গেছিল।

জয়ের আনন্দে মেতে উঠেছে সবাই। আমিও। কিন্তু তখনই হঠাৎ একটা জিনিস চোখে পড়ল। কালো রাজার মুখের আদলটা… ভুল দেখছি না তো? তিরতির করে একটা হিমেল স্রোত যেন নেমে গেল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। কালো রাজার মুখটা যে হুবহু সাদা রাজার মতোই! শুধু রঙটুকু আলাদা। তার চোখে পরাজয়ের বিষাদ, তবুও যেন ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে একটুকরো বাঁকা হাসি।

দেশ জুড়ে এখন বিজয় উৎসব। সবাই স্বাধীন। আমার শরীরটাও আর আগের মতো পাথর হয়ে নেই, ইচ্ছেমতো নড়তে চড়তে পারছি। এমন সময় হঠাৎ দেখতে পেলাম সেই বুড়ো লোকটাকে, ময়দানের একেবারে প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে সেই স্থির প্রশান্ত হাসি। দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম তার সামনে। লোকটার পরনে এখন আর কয়েদির পোশাক নেই, সাদা ধুতি আর ধুতির মতোই আরেকটা সাদা কাপড় তেরছাভাবে গায়ে জড়ানো। ওর চেহারার সঙ্গে বেশ মানিয়েছে সাজটা।

“আপনি এতক্ষণ ছিলেন কোথায়? আর এসব… মানে… আমরা তো সেলে বসে দাবা খেলছিলাম!”

লোকটাকে দেখে যেন আচমকাই আমার মনে পড়ে গেল, আমি সাদা বোড়ে নই, অরবিন্দ ঘোষ!

লোকটা হাসল, কিন্তু কোনও জবাব দিল না। শুধু আঙুলের ইশারায় পেছন ফিরতে বলল আমাকে। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, ময়দান জুড়ে এখন শুধুই সাদাদের ভিড়। এমনকি পায়ের তলায় কালো ছকগুলোও সাদা হয়ে গেছে! সবাই খুশি, সবাই স্বাধীন। এখন এই পুরো রাজ্য শুধুই ওদের। একদিন হয়তো ভারতবাসীও এভাবেই এক স্বাধীন ভারতের বুকে দাঁড়িয়ে হাসবে। নিজের অজান্তেই আমার চোখের কোণে যেন এক ফোঁটা আনন্দ চিকচিক করে উঠেছিল।

কিন্তু তখনই কে যেন হাতুড়ির ঘা মারল বুকের ভেতর। এ আমি কী দেখছি! ওরা এভাবে… না, এ হতে পারে না! স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, সাদা পোশাকের ভেতর ওই আনন্দে খুশিতে ভরা মুখগুলো, মানুষগুলো একটু একটু করে কালো হয়ে যাচ্ছে! কালো পোশাক পরা কালোর বুকে তো বর্শা বিঁধিয়েছিলাম, কিন্তু সাদা পোশাক পরা কালোকে কীভাবে চিনব?

তবে কি এটাই ভবিষ্যৎ? এক অজানা ব্যথায় যেন চিনচিন করে উঠল বুকের ভেতরটা। পেছন ফিরলাম। শান্ত স্নিগ্ধ এক আলো জ্যোৎস্নার মতো ছড়িয়ে পড়েছে বুড়ো লোকটার চারপাশে।

“তোমার লড়াইটা অনেক বড়ো, অরবিন্দ। কিস্তিমাতের পরের লড়াই। প্রস্তুত হও।”

ওই অপার্থিব আলোয় আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে লাগল সেই বৃদ্ধ। যেন এক নিস্তরঙ্গ আলোর সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে তার শরীরটা। আর তার চোখদুটো… এবার আর চিনতে অসুবিধে হল না। ওই চোখ আমি বহুবার দেখেছি—আয়নার ওপারে!

কেন জানি না, নিজের সামনে নিজেরই কোনও এক অনাগত ভবিষ্যৎ-মূর্তিকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও আর ভয়, বিস্ময় কিছুই জাগল না। শুধু এক অদ্ভুত অবসন্নতা ছড়িয়ে পড়তে লাগল সারাটা শরীর জুড়ে, যেন অদূর ভবিষ্যতের এক কালো ছায়া! মাঠের ওপর বসে পড়লাম। ওদিকে বোধহয় এখনও বিজয় উৎসব চলছে। হয়তো আরও বেশি কালো হয়ে গেছে সাদা পোশাক পরা মানুষগুলো।

কিন্তু ফিরে তাকাতেই চমক ভাঙল। কেউ কোত্থাও নেই! আমার সামনে শুধু একটা কালচে দেয়াল, ডানপাশে লোহার গরাদ আর পায়ের কাছে একটা দাবার বোর্ড। আমার সলিটারি সেলে একা বসে আছি আমি। বাইরে অন্ধকার ফিকে হয়ে এসেছে। আকাশে ভোরের রঙ ছড়িয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে। অনেকদূর থেকে বাতাসে ভেসে আসছে পাখির ডাক।

দাবার বোর্ডে এখনও সাদা বোড়েটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কালো রাজার সামনে। কিস্তিমাত! কিন্তু তার পরে? একটুকরো দমকা হাওয়া যেন দীর্ঘশ্বাসের মতো ছড়িয়ে পড়ল আমার নয় ফুট বাই ছয় ফুটের নির্জন কুঠুরিটার ভেতর।

অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s