সন্ধ্যা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য প্রতিযোগিতা’২০১৯। ষষ্ঠ স্থান
তৃষার একদিন
বৈশাখী গুপ্ত
দেখতে দেখতে গাড়িটা রাস্তার বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল। তৃষা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিল। দারোয়ান শম্ভু বড়ো লোহার গেটটা বন্ধ করতেই সে আবার ছুট লাগাল নিজের ঘরের ব্যালকনিতে। ওখান থেকে গাড়িটাকে আবার দেখা যাবে। তখন সেটা খেলনা গাড়ির মতো দেখাবে।
ছোটো থেকেই এই দৃশ্যটা দেখতে তৃষা ভীষণ ভালোবাসে। পাহাড়ি রাস্তা ধরে গাড়ি নিচে নামবে আর বাড়ির এ-জানালা ও-জানালা দিয়ে সেটা দেখবে। অনেকটা লুকোচুরি খেলার মতো। গাড়িগুলো পাহাড়ের ভাঁজে লুকোয়, আবার দেখা দেয়। বেশ মজা লাগে। একা একা গোটা পাহাড়টার সঙ্গে খেলা যায়। সময়ে, অসময়ে।
কিন্তু আজ এতক্ষণ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থেকেও কোনও লাভ হল না। গাড়িটাকে দেখতে পেল না তৃষা। কী জানি, হয়তো সময়ের আন্দাজে ভুল হয়ে গেছে। প্রায় মাস ছয় বাদে কলেজের ছুটিতে ফিরল তৃষা। হস্টেলে থাকার সময় পাহাড়টাকে সবচেয়ে বেশি মিস করে। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে খেলাটায় কেমন অনভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছোট্ট একটা মনখারাপ কোথা দিয়ে যেন উঁকি মারল। অমনি প্যাঁচার মতো মুখ করে ব্যালকনির কোনায় রাখা বেতের চেয়ারটায় বসে পড়ল।
অনেকদিন পর নিজের জন্য এরকম অলস অবসরের সময় বেচে নিয়েছে তৃষা। বাবার অফিসের এসব গেট টুগেদার পার্টি, মা অনেক করে বলেছিল সাথে যেতে, কিন্তু খানিকটা ইচ্ছে করেই গেল না। ছোটোবেলায় অনেকবার গেছে, এখন ওর মোটেই ভালো লাগে না। বড্ড মেকি ব্যাপার-স্যাপার। জোর করে হাসো, কথা বলো, যেন মুখোশ পরে থাকা। তার চেয়ে এই ভালো। সারাদিন বাড়িতে একার রাজত্ব। পছন্দের গান শুনবে, খাবে, ঘুমোবে আর বেশি করে পাহাড় দেখবে।
বেলা বাড়ছে। ঘড়িতে প্রায় পৌনে একটা। শম্ভু গেটের সামনে বসে রেডিও শুনছে। এই ওর এক অভ্যাস। সারাদিন খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, স্নান করছে, কিন্তু কানের কাছে রেডিওটা ঠিক চালিয়ে রাখে। কীসব জগঝম্প সুরের গান শোনে। মাঝে মাঝে খেলার মাঠের মতো চিৎকার ভেসে আসে। সোজাসাপটা মানুষ শম্ভু। সাতেপাঁচে নেই। একবেলা রাঁধে, দু’বেলা খায়। তৃষাদের বাড়িতে ভালোমন্দ কিছু রান্না হলেই ওর জন্য আগাম একবাটি তোলা থাকে। সমতলের এক দেহাতে শম্ভুর বাড়ি। মাস দুয়েক ছাড়া সে দেশে যায়। বউ, তিনটে ছেলেমেয়ে, বুড়ো বাপ-মা, এক ভাই নিয়ে ভরা সংসার। এ-বাড়িতে প্রায় বছর দশেক আছে, কিন্তু একটুও পরিবর্তন নেই।
সামনের ছোটো টেবিলটার ওপর পাদুটো তুলে দিল তৃষা। সারা শরীরে অলসতা। চুলগুলো পাখির বাসা, যেন ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সেই কখন থেকে দেখে চলেছে পাহাড়টাকে। আজ মেঘলা। আলোও কম। থোকা থোকা ছাইরঙা মেঘ জমা হচ্ছে পাহাড়ের চুড়োর দিকে। সবুজ ঢেকে যাচ্ছে। বৃষ্টি হবে হয়তো। খিদে পাচ্ছে। আজ সকালে খাবার ইচ্ছে ছিল না, ব্রেকফাস্টে তাই একটাই স্যান্ডউইচ খেয়েছে। ডাইনিং টেবিলে বাটিতে ঢাকা দেওয়া খাবার সাজানো। তৃষার মা সব রান্না করে গেছে। ঢাকা খুলে খাবার নিতে নিতে মনে পড়ল ফ্রিজে মাংস রান্না করা আছে।
মাইক্রোওভেনে টাইমার সেট করে দাঁড়িয়ে আছে তৃষা। ভেতরে বাটি ঘুরছে, সময় উলটোদিকে এগোচ্ছে। ওর লাল আলোটার দিকে বারবার চোখ আটকে যাচ্ছে। হঠাৎ কোথা থেকে একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগল তৃষার পিঠের ওপর। শরীরটা শিরশির করে উঠল। হাওয়াটা অনেকটা ঠাণ্ডা নিঃশ্বাসের মতো। অথচ ঘরের সব কাচের জানালা বন্ধ, হাওয়া ঢুকবে কোথা দিয়ে? তৃষা জানালাগুলো খুলে দিল। বাইরেটা ঠাণ্ডা, কিন্তু হাওয়া নেই। মেঘ জমছে পরতে পরতে। হয়তো বৃষ্টি হবে।
জানালার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসে তৃষা খায়। এটা ওর বরাবরের অভ্যাস। প্লেটের ভাত প্রায় শেষের মুখে, মাংস পড়ে আছে বেশ কিছুটা। হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য মনে হল কেউ যেন চেয়ারের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা মেয়েলি গলা যেন কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলছে, “আরেকটু ভাত দেব?”
সঙ্গে সঙ্গে শরীরটা শক্ত হয়ে উঠল। জলের গ্লাসে মনে হল কারোর ছায়া ভাসছে। কিন্তু পিছন ঘুরে দেখবার সাহস হল না।
ভয়টা আপনা থেকেই ঢিলে হয়ে গেল। শরীর নরম হতেই পিছন ফিরল তৃষা। কই, কোথাও কেউ নেই। সারা বাড়ি জুড়ে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। দ্বিতীয় কেউ তো দূরের কথা, হাওয়ার অস্তিত্বটুকুও নেই। হাসি পেল। কীসব উটকো ভাবনা! থ্রিলার, সাসপেন্স, প্যারানর্মাল সিনেমা দেখতে দেখতে কখন সেগুলো মাথায় বাসা বানিয়ে ফেলেছে।
টানটান করে পাতা বিছানার চাদর, সাজিয়ে রাখা বালিশ দেখলেই ঘুমোতে ইচ্ছে করে। হালকা ভলিউমে মিউজিক চালিয়ে শুয়ে পড়ল তৃষা। বাড়ির বিছানায় ঘুম আসে তাড়াতাড়ি। টিউনটা মাথার ভেতর সুড়সুড়ি দিচ্ছে। আহ্, কী আরাম! চোখের পাতা ভারী হয়ে এল। মনে হল, একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে তৃষা। প্রথমে আবছা, তারপর ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে। দেখছে, ও ঘুমোচ্ছে কারও কোলে মাথা রেখে। সে তৃষার চুলের ভেতর ঠাণ্ডা বরফের মতো নরম আঙুল চালিয়ে দিচ্ছে। উষ্ণ শরীরটা আরও অবশ হয়ে যাচ্ছে।
ঘুমটা হঠাৎ পাতলা হল। কিন্তু চোখ খুলল না তৃষা। স্পষ্ট বুঝল, এটা স্বপ্ন নয়। সত্যিই সে কারও কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। মিউজিকটা বাজছে, তবে অন্য সুরে। সুরটা চেনা, কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে করতে পারছে না।
মনে জোর এনে চোখ খুলে ফেলল তৃষা। ঘর খালি। খাটের একধারে চুলগুলো মাটিতে লুটোচ্ছে। মিউজিকও বদলায়নি। কিন্তু আর কোনও ভ্রম নয়। যে ছিল তার স্পর্শটা এখনও লেগে আছে। চোখ পড়ল ব্যালকনির দিকে। দরজা বন্ধ। স্পষ্ট মনে আছে ওটা খোলা রেখেই শুয়েছিল। তবে কি কেউ ঢুকেছে বাড়ির ভেতরে? কথাটা মনে হতেই ছুটে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সদরের দিকে। পাশের জানালা দিয়ে শম্ভুর ঘরটা চোখে পড়ছে। থালা পেতে খেতে বসেছে সে। পাশে রেডিও চলছে। বাড়িতে কেউ ঢুকলে ওর নজরে ঠিক পড়ত।
নিজের ঘরে ফিরে আবার খাটে বসে পড়ল তৃষা। চারপাশ জুড়ে না জানি কীসের ঝিম ধরা ভয়। ঘরের ভেতরটা অস্বস্তিকর গুমোট ঠেকছে। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে যেন কেউ নজরে নজরে রাখছে। অথচ শত খুঁজেও তাকে ধরা যাচ্ছে না। খোলা কাচের জানালা দিয়ে বাইরের একফালি দেখা যাচ্ছে। মেঘ জমে পুরো পাহাড়টাকে ঢেকে দিয়েছে। মনে হয় বৃষ্টি নামবে।
নিজের ঘরের কাবার্ডে অনেকদিন হাত দেয়নি তৃষা। ওটা খুলতেই একটা পুরনো গন্ধ ঝাঁপিয়ে পড়ল। চার-পাঁচটা তাক জুড়ে স্কুলের খাতা, গল্পের বই, পেন্সিল বক্স, রং-তুলি, আঁকার খাতা, আরও কত কী। মাঝে মাঝে ‘পুরনো নিজেকে’ আবিষ্কার করতে বেশ ভালো লাগে। তবে এ-মুহূর্তে শুধু ভালো লাগা নয়, মাথার ভেতরে চলতে থাকা এই অস্বস্তিটা যেমন করেই হোক কাটাতে হবে।
পুরনো ড্রয়িং খাতা খুলতেই একঝলক হাসি ছড়িয়ে গেল তৃষার মুখে। খাতা জুড়ে অপটু হাতের আঁকিবুকি, ট্যাঁরা-বাঁকা ঘরবাড়ি, কমলালেবু, মানুষ, গাছ, বেড়াল, হাতি, রং-তুলির এবড়ো-খেবড়ো টান, আরও কত কী। কিন্তু অস্বস্তিটা চলে যাওয়ার বদলে উলটে খানিক বেড়ে গেল। যাকে দেখা যাচ্ছে না, মনে হল সে যেন পাশে এসে বসেছে। খাতাপত্র হাতড়ে তৃষার ছেলেবেলার স্মৃতি দেখছে। তার ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস গায়ে এসে লাগছে।
নাহ্, আর কোনও ভুল নয়, স্বপ্ন নয়, সিনেমা এফেক্টও নয়। গা শিঊরে উঠছে বারবার। কাঁদতে ইচ্ছে করল। গলা ফাটিয়ে তৃষা ডাকল, “শম্ভুদা… শম্ভুদা…”
আওয়াজটা যেন ঘরের মধ্যেই আটকে গেল। তৃষা দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরোবার চেষ্টা করল। কিন্তু দরজা-জানালা কোনোটাই খোলা যাচ্ছে না। নিজের ঘরেই বন্দি হয়ে গেল।
“ভয় পাচ্ছ কেন, মামণি? আমিই তো!” কথাটা স্পষ্ট কানে এল।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামতে শুরু করেছে। পাহাড়ের গায়ে অন্য বাড়িগুলোয় আলো জ্বলে উঠেছে। কিন্তু এ বাড়িতে লোডশেডিং। এদিক ওদিক উঁকিঝুঁকি মেরেও শম্ভুর দেখা পাওয়া গেল না। ওর ঘর অন্ধকার। অন্য সময় আলো নিভলে বেশ এনজয় করে তৃষা। আজ দমবন্ধ হয়ে আসছে। মেঘের গুমগুমে শব্দ আসছে। বৃষ্টি নামল বলে।
তৃষা ছুটে বেড়াচ্ছে এ ঘরে, সে ঘরে। আওয়াজটাও দৌড়চ্ছে। আলো-আঁধারি কোনার দিকে তাকালে মনে হচ্ছে পর্দাগুলোর আড়ালে কে যেন দাঁড়িয়ে।
“কে তুমি?” চিৎকার করে উঠল তৃষা।
অন্ধকারের ভেতর থেক উত্তর এল, “চিনতে পারছিস না?”
“না।” তৃষার গলাটা কেঁপে উঠল।
“সত্যি পারছিস না?”
তৃষা উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। ভয় কাটছে। গলাটা বেশ চেনা। কোথায় যেন শুনেছে। ঠিক মনে পড়ছে না। এবার একটু একটু… এখন পুরোটা।
“গুবলিপিসি!” নামটা আপনা থেকেই মুখ থেকে বেরোল তৃষার।
মনে হল খুব দূর থেকে কেউ চাপা ফ্যাসফ্যাসে হেসে উত্তর দিল, “চিনতে পেরেছিস তাহলে?”
এতক্ষণে সবটা মনে পড়ে গেছে। ছোটোবেলায় গুবলিপিসি থাকত এ বাড়িতে। তখন তৃষা অনেক ছোটো। ওকে খাওয়ানো, চান করানো, ঘুম পাড়ানো সবকিছু করত। মা-বাবা না থাকলে বুকে আগলে রাখত। জ্বর-জ্বালা হলে সারারাত মাথার কাছে জেগে বসে জলপটি দিত। এ বাড়িতে গুবলিপিসির সঙ্গে কত স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু…
ভাবনার কোথাও ছেদ পড়ল। অনেকদিন আগের কথা। সাতদিনের জ্বরে মারা গিয়েছিল গুবলিপিসি। এক বুড়ো বাবা ছাড়া ওর বাড়ির লোকজন তেমন কেউ ছিল না। সে এসে বডি নিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে খুব একা হয়ে পড়েছিল তৃষা। গুবলিপিসির জন্য মন কেমন করত। তারপর স্কুল, কলেজ, সময়ের সাথে সাথে স্মৃতিগুলো আবছা থেকে আরও আবছা হয়ে গেছে।
বৃষ্টি নামল হুড়মুড়িয়ে। সঙ্গে কান ফাটানো বাজের আওয়াজ। ভয় নেই, আর একটুও ভয় নেই। আলো আসেনি এখনও। মোমবাতি জ্বলছে সারা বাড়িতে। তৃষা ডাইনিং টেবিলে নিজের প্রিয় চেয়ারটায় বসে গল্প করছে। তবে কার সাথে জানি না। তাকে দেখা যায় না, শুধু শোনা যায়। মাঝে মাঝে দু’জনের হাসির খিলখিল শব্দ কানে আসছে। তৃষা হাসলেই উলটোদিকের ফাঁকা চেয়ারটা নড়ে উঠছে অল্প অল্প।
অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস