সন্ধ্যা ভট্টাচার্য সাহিত্য প্রতিযোগিতা ২০২০ সপ্তম স্থান-ম্যাজিক খাতা বিজন চক্রবর্তী বসন্ত ২০২০

সন্ধ্যা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য প্রতিযোগিতা’২০১৯। সপ্তম স্থান

ম্যাজিক খাতা

বিজন চক্রবর্তী

(১)

আকাশের বয়স চোদ্দ বছর পূর্ণ হল। জন্মদিনে তার বাবা অরুণ ছেলেকে একটা দুর্লভ আঁকার খাতা উপহার দিয়েছে। অরুণ যে লাইব্রেরিতে করণিকের কাজ করে, খাতাটা সে সেখানেই পেয়েছে। প্রতিবছর মার্চের শেষে লাইব্রেরির অডিট করা হয়। আর অডিটের ঠিক পরেই পুরাতন, ছেঁড়া, অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব পুড়িয়ে ফেলা হয়। এবছর অরুণের কাঁধে এই দায়িত্ব পড়ে। প্রায় দু’বস্তা এরকম কাগজ, খাতা, বই বার হয় যার মূল্য কর্তৃপক্ষের কাছে বর্তমানে শূন্য। কিন্তু সেই ছাই ঘেঁটেই এক অমূল্য রত্ন আবিষ্কার করে ফেলল অরুণ৷ একটি ড্রয়িং খাতা। খাতাটির প্রথম কয়েকটি পেজে আঁকিবুকি টানা। কিন্তু ভিতরের একটা পেজে অসম্ভব সুন্দর একটি ছবি আঁকা, যেখানে যিশু খ্রিস্টের ক্রুশ বিদ্ধের মুহূর্তটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। নিচে একটা নাম সই—আর্নল্ড রেবন, (সাল ১৫৩৬)।

আকাশ আঁকতে খুব ভালোবাসে। তার বয়স যখন তিন, সবে অক্ষরগুলো লিখতে শিখছে, তখন থেকেই আঁকার প্রতি আকাশের ভালোবাসা অরুণের চোখে ধরা পড়ে। খাতা-পেন্সিল হাতে ধরিয়ে দিলে হিজিবিজি কত কী আঁকতে থাকত সে। সেই সময় থেকেই একজন আঁকার মাস্টারকে দিয়ে ওর শিক্ষা শুরু হয়ে যায়। আজ সে রীতিমতো একজন ভালো আর্টিস্ট। সবরকম আঁকায় পারদর্শী। দু’বার না ভেবে খাতাটা বাড়িতে নিয়ে চলে আসে অরুণ। ছেলের চোদ্দ বছরের জন্মদিনে সেটাই তাকে উপহার দেবে।

আকাশের কাছে এটা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত উপহার। সে জানে, তার বাবার মূল্যবান উপহার দেওয়ার সামর্থ্য নেই। এই দুর্লভ উপহারটি পেয়ে আকাশও খুব উচ্ছ্বসিত, আহ্লাদিত। খাতাটি পেয়েই আকাশ নিজের ঘরে ছুটে যায়। একটা সাদা পেজ খুঁজে নিয়ে ছবি আঁকতে বসে যায়। একটা নামী রেস্তোরাঁ, চারপাশে টেবিল-চেয়ার পাতা, বিভিন্ন রঙের রোশনাই আলো জ্বলছে। তাদের মধ্যে একটা টেবিলে তিনজন গোল করে বসে আছে। টেবিলের উপর বিভিন্ন খাবারের উপকরণ সাজানো। একটা জন্মদিনের কেক এবং কিছু মোমবাতিও সাজানো রয়েছে টেবিলে। সে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। এইভাবে জন্মদিন সেলিব্রেট করা তার এত বছরের জীবনে কখনও ঘটেনি। তার স্কুলের অনেক বন্ধুদের মুখ থেকে শুনেছে এমন অভিজ্ঞতা, সেটাই সে খাতায় এঁকে ফেলেছিল কী মনে করে।

আঁকা শেষে খাতাটা বন্ধ করে সবে বিছানায় গিয়ে বসেছে আকাশ। বাবা এসে বলল, “আজ আমি অফিসে ছুটি নিয়েছি। আজ রাতে আমরা সকলে মিলে রেস্তোরাঁয় খেতে যাব। অনেকদিন তোদের বাইরে কিছু খাওয়ানো হয়নি। আজকে তুই যা খেতে চাইবি তাই খাওয়াব আমি।”

কথাটা শুনেই তার সদ্য আঁকা ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল আকাশের। কিন্তু আনন্দের জৌলুসে সে তৎক্ষণাৎ ভুলে গেল সেসব। অপ্রত্যাশিত আনন্দে বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠেছিল আকাশ। রাতে সত্যিই অরুণ, স্ত্রী প্রমীলা আর ছেলে আকাশকে নিয়ে একটা বড়ো রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে গেল। কত রকমারি খাবার! মন ভরে গেল আকাশের। সে এরকমটাই চেয়েছিল।

(২)

বেশ কিছুদিন হল আকাশের চরিত্রের মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে অরুণ। বিশেষ করে ড্রয়িং খাতাটা আসার পর থেকেই। অরুণ জানে বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের আচরণে পরিবর্তন আসে৷ কিন্তু সেই পরিবর্তন আর তার ছেলের মধ্যে ঘটে চলা পরিবর্তনের মধ্যে বিস্তর ফারাক৷ আকাশের মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে অদ্ভুত ক্ষমতা এসে হাজির হয়েছে৷ অন্তত সে সবাইকে তাই বলেছে৷ খাতায় কল্পনার রং মিশিয়ে সে যা ছবি আঁকে বাস্তবে তাই নাকি সত্যি হয়ে যায়। সে একথা তার বাবা-মাকে বারবার বোঝাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু এমন অদ্ভুত কথা কি আর সহজে কাউকে বিশ্বাস করানো যায়? স্বভাবতই তারা বিশ্বাস করেনি।

সে যে সত্যি কথা বলে, কোনও মিথ্যে কল্পনার আশ্রয় নিয়ে মনে মনে ছবি আঁকে না, তা প্রমাণ করার জন্য একদিন রাতে খাওয়ার শেষে বাবা-মাকে ঘরে ডেকে আনল আকাশ৷ তাদের সামনে সে ড্রয়িং খাতা, পেন্সিল নিয়ে একটা ছবি আঁকল। মোবাইল ফোনের ছবি, বেশ দামি টাচ ফোন। তাদের পরিবারে এত দামি মোবাইল সত্যিই বিলাসিতা। কিন্তু পরেরদিন সকালে দেখা গেল খাতার আঁকা মোবাইলটার মতো হুবহু একটা নতুন দামি মোবাইল টেবিলে রাখা। আকাশের আনন্দের সীমা রইল না। কখন সবার অজান্তেই ফোনটার আবির্ভাব ঘটে গেছে তাদের তিনজনের মাঝে। আকাশের বাবা-মা দু’জনেই বেশ অবাক হয়ে গেল। যদিও তাদের মনের মধ্যে একটা খটকা রয়েই গেল৷ এ যে একদম আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ! হাত ঘষলেই প্রদীপ থেকে বেরিয়ে এল জিন আর প্রদীপের মালিক যা প্রার্থনা করল জিন তাই যোগান দিল নিমেষে, এটা কি এ যুগেও সম্ভব!

পরপর বেশ কয়েকদিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল৷ তবে সমস্ত পরীক্ষানিরীক্ষাগুলো চলছিল ছোটো ছোটো ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তাও যেন অরুণ আর প্রমীলা মন থেকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না৷

একদিন অফিস ফেরত অরুণ এসে বলল, “আকাশ, তোর ড্রয়িং খাতা, পেন্সিলটা বের কর একটা বাইকের ছবি আঁকতে হবে। আর ভিড় বাসে অফিস যেতে ইচ্ছে করে না।”

আকাশ তাড়াতাড়ি খাতাটা বার করে খুব সুন্দর একটা লাল মটর সাইকেলের ছবি এঁকে ফেলল তাতে। আশ্চর্যজনকভাবে পরেরদিন অরুণ অফিস থেকে বাড়ি ফিরল একইরকম দেখতে একটা লাল মটর বাইকে করে। প্রমীলা আশ্চর্য হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে অরুণ হাসি হাসি মুখে উওর দিল, “অফিস থেকে দিয়েছে। বাসে যেতে আমার অসুবিধা হয় কিনা।”

এরপর তাদের মনে আর কোনোরকম সন্দেহ রইল না যে, এসবই ওই ম্যাজিক ড্রয়িং খাতাটির জন্য।

একদিন এক মজার ঘটনা ঘটে গেল৷ আকাশ স্কুলের সিলেবাসে দেওয়া একটা অঙ্ক অনেকক্ষণ ধরে সমাধান করার চেষ্টা করছিল৷ কিন্তু কোন পদ্ধতিতে গেলে তার সঠিক সমাধান হবে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ কী মনে করে ড্রয়িং খাতা, পেন্সিলটা বের করে আনল সে৷ তারপরই আঁকা শুরু একটা মানুষের মূর্তি৷ আকাশ স্তম্ভিত হয়ে দেখে অঙ্কের স্যার প্রমথবাবুকে এঁকে ফেলেছে সে, একটি ঘরে চেয়ার-টেবিলে বসে একটা ছেলেকে পড়াচ্ছেন। আকাশের বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অঙ্কের শিক্ষক এই প্রমথবাবু৷ সম্প্রতি তিনি ইহলোক ছেড়ে পরলোক গমন করেছেন৷ আকাশের বুকটা দুরদুর করে উঠল। জীবিত অবস্থায় প্রমথ স্যার তাকে খুবই ভালোবাসতেন৷ এমনকি অঙ্ক না পারলেও কিছু বলতেন না, বরং আদর করে কাছে বসিয়ে অঙ্কটা বুঝিয়ে দিতেন। হুঁশ ফিরে পেল আকাশ। মনের মধ্যে একটা খটকা রয়েই গিয়েছিল, মৃত্যুর পর পরপারে গিয়ে স্যারের আচরণ পরিবর্তন হয়ে যায়নি তো!

রাতে ডিনার শেষে আকাশ সবে আলোটা নিভিয়ে ঘুমাতে গেছে৷ সঙ্গে সঙ্গে ঘরে একটা গলা পরিষ্কার করার শব্দ শোনা গেল। আকাশ ভয়ে লাফিয়ে উঠল৷ বিছানায় উঠে বসে আলোটা জ্বালিয়ে দেখল, সেই প্রমথ স্যার৷ এতটুকু পরিবর্তন হয়নি স্যারের মধ্যে। শুধু আগের মতো মুখের হাসিটা আর নেই৷ তিনি কঠোর মুখ নিয়ে আকাশকে বললেন, “এই তো সবে রাত এগারোটা। এখুনি শুতে যাওয়ার তোড়জোড়? এইজন্যই তুই অঙ্কে বরাবর কম নম্বর পেয়ে এসেছিস৷ নেমে আয়, চেয়ারে বস৷ অঙ্কটা একটু ভালো করে শিখে নে৷ অঙ্ক না জানলে কোথাও গিয়ে মুখ দেখাতে পারবি না৷”

স্যারের মুখ দেখে একটু ভয় লাগলেও স্যারকে আর না রাগিয়ে সুড়সুড় করে নেমে চেয়ারে বসে পড়ল আকাশ।

“নে, বইখাতা বের কর৷ আজ তোর অঙ্ক রাত, সারারাত অঙ্ক করবি।”

আকাশ ঝটপট খাতা, পেন বার করে পড়তে বসে পড়ল৷ কী কঠোর মুখ করে স্যার একটার পর একটা অঙ্ক করিয়ে যেতে লাগলেন! আর না পারলেই মাথায় গাট্টা৷ আকাশ তার না পারা অঙ্ক করতে পেরে খুশি হলেও সারারাত স্যারের এই গাট্টা খাওয়ার ইচ্ছে তার ছিল না। মনে মনে ফন্দি আঁটতে লাগল কীভাবে আজ রাতের মধ্যেই স্যারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়৷ না হলে অঙ্ক করিয়ে করিয়েই তার ডানহাতটাকে পঙ্গু বানিয়ে দেবেন স্যার, আর মাথাটা এই বড়ো আলু। কিন্তু কিছুই তার মাথায় এল না৷ সে তো ছবি এঁকে জিনিস আদায় করতেই শিখেছে, কিন্তু কীভাবে তার পরিশোধ করতে হয় তা সে শেখেনি৷

হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়৷ সে যদি ড্রয়িংয়ের পৃষ্ঠাটা নষ্ট করে দেয় হয়তো স্যার আবার তাঁর নিজের স্থানে ফিরে যাবেন৷ যেই না ভাবা অমনি কাজ৷ টয়লেটে যাওয়ার অজুহাতে ড্রয়িং খাতাটা নিয়ে বেরিয়ে গেল আকাশ। টয়লেটে গিয়েই স্যারকে নিয়ে আঁকা ড্রইং পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে ফেলল সে৷ তারপর টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিল কমোডে আর ফ্ল্যাশটা অন করে দিতেই এক নিমেষে সব অতল গভীরে অদৃশ্য হয়ে গেল৷

ভালো করে মুখ চোখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল আকাশ। ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল সে৷ চেয়ার, টেবিল, খাতায় এতক্ষণ ধরে করে যাওয়া সব অঙ্ক রয়ে গেছে, শুধু প্রমথ স্যার অদৃশ্য। খুব আনন্দ হল তার। তবে এই মাঝরাতে ঘটে যাওয়া বিষয়টা নিয়ে সে তার বাবা-মাকে কিছুই বলল না৷ এরকম অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা প্রায় রোজই ঘটতে লাগল এই ছোট্টো বাড়িটিতে৷

(৩)

কিশোর মন ফুলের গন্ধের মতো। যার সুবাস সবার কাছেই পৌঁছায় কোনও ভেদাভেদ ছাড়াই৷ কোনও কিছু ঢাকা দিলেও সেই সুবাসকে চাপা দেওয়া যায় না। এই অলৌকিক ঘটনার কথাও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল৷ বিশেষ করে স্কুলের বন্ধুমহলে৷ সবার মনে কৌতূহল, প্রশ্ন৷ কিন্তু কেউ যেন মন থেকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না। সবাই বাড়িতে এসে পরীক্ষা করে দেখতে চাইল৷ যদিও আকাশ তার বাবা-মাকে জানত৷ সে কথা দিল, একদিন স্কুলে নিয়ে যাবে খাতাটা৷ তার আগেই ঘটে গেল আরেক বিপত্তি৷ স্কুলের বন্ধু কিশলয় কথাটা শুনে বাড়ি ফিরে তার বাবাকে পুরোটা বলল৷ তার বাবা এ অঞ্চলের কাউন্সিলার। পরেরদিন সকালেই মাননীয় কাউন্সিলার মশাই আকাশের বাড়ি এসে হাজির। হাতে এক প্যাকেট মিষ্টি। যতই হোক সম্মানীয় ব্যক্তি। একটু খাতির করে অরুণ আর প্রমীলা ওঁকে ঘরে বসালে। প্রাথমিক বাক্যালাপের পরই তিনি সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার ছেলে আকাশ কীসব ছবি আঁকছে, আর তাই সত্যি হয়ে যাচ্ছে শুনলাম। তাই নিজের চোখের একবার দেখতে এলাম। কই, ডাকুন একবার আকাশকে।”

শিয়রে বিপদ বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারল আকাশের বাবা ও মা। এই ঘটনা যে রটনামাত্র, কোনও বাস্তবতা নেই, তা প্রমাণ করতে কোনও কসুর করল না। শেষপর্যন্ত ড্রয়িং খাতা বদলে অপর এক খাতায় আকাশকে দিয়ে ছবি আঁকিযে প্রমাণ করে ছাড়ল যে এই ঘটনা সম্পূর্ণ অবাস্তব, কিশোর বয়সের কল্পনা। এরপরই আকাশকে ঘরবন্দি করে ফেলল তার বাবা ও মা৷ তাকে আর বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করতে দিল। এমনকি স্কুলে যাওয়া বা টিউশনি যাওয়া সব বন্ধ করে দিল।

আকাশের বাবা-মাযের লোভের মাত্রা দিনের পর দিন বাড়তে লাগল৷ আজ গয়না তো কাল ফ্ল্যাট। চাহিদার আর শেষ নেই৷ ক্রমে অরুণ তার নিজের সার্ভিস থেকে রিজাইন দিয়ে ঘরে বসে রইল৷ যখন যা প্রয়োজন ছেলেকে বলে খাতায় আঁকাত আর সব চাহিদা পূরণ হয়ে যেত সহজেই।

ধীরে ধীরে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে লাগল৷ পৃথিবীর সবথেকে লোভী প্রাণী হল মানুষ যার আকাশছোঁয়া চাহিদা মেটাতে স্বয়ং ঈশ্বরও বোধহয় অপারগ। কিন্তু এসবের মধ্যে পড়ে আকাশের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকল৷ সে আর আগের মতো হাসে না, চোখের কোণে কালি৷ তার শরীর যেন দিন দিন ভেঙে পড়তে লাগল। সে এখন আর মনের ইচ্ছেয় নয়, বাবা-মার চাহিদা মেটাতেই আঁকে৷ আর যত চাহিদা বৃদ্ধি ততই যেন আকাশের স্বাস্থ্য, মনোবল ভেঙে পড়তে লাগল৷ সে অনুভব করতে লাগল, যে আঁকা সে মনের ইচ্ছেয় নয়, চাহিদা পূরণে আঁকে তা তার শারীরিক অবনতির কারণ৷ কিন্তু তবুও তার নিস্তার নেই৷

কিছুদিনের মধ্যেই শয্যাশায়ী হয়ে গেল আকাশ। বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটাই চিন্তা দিনরাত তার মনে লাঙল চালাতে লাগল, আগের জীবনটাই বোধহয় তার ভালো ছিল। সেখানে তাদের সংসারে টানাটানি ছিল, কিন্তু ভালোবাসার অভাব ছিল না। এখন সবটাই যেন স্বার্থপরতা, চাহিদা আর চাহিদা পূরণের মাঝে পড়ে মানুষের মনগুলোই আস্তে আস্তে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আজকাল তার বাবা-মা চাহিদা মেটানো ছাড়া আর তার ঘরে আসে না। শরীর খারাপ হলে তার খোঁজ রাখে না। আর সবথেকে বিরক্তিকর বিষয় হল তাকে বাইরেও বের হতে দেওয়া হয় না, কারও সাথে মিশতেও দেওয়া হয় না। আকাশের ইহকালের জীবনটা পুরোটাই যেন বাঁধা পড়ে গেছে লোহার শেকলে৷

নির্জন রাতগুলোতে বড়ো একা লাগে আকাশের। আগে যখনই রাতে একা লাগত ভয় পেত আকাশ। ছুটে চলে যেত বাবা-মার কাছে। এখন আর ইচ্ছে করে না। তাই একা রাতগুলোকে ভরিয়ে তুলতে রোজ কোনও না কোনও ছবি আঁকতে লাগল সে। একদিন ছবি থেকে বেরিয়ে এলেন জাতির নায়ক সুভাষচন্দ্র। সারারাত ধরে তিনি বিপ্লবী মন্ত্রে দিক্ষিত করতে লাগলেন আকাশকে। ‘আকাশ, আজকের এই ভারতবর্ষ আমরা কেউ চাইনি। আমাদের স্বপ্ন ছিল অনেক, অনেক বৃহত্তর। কয়েকজন বুর্জোয়া সাধারণ মানুষের গ্রাস ছিনিয়ে নিচ্ছে। তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। এর বিরুদ্ধে কোনও অনুনয় বিনয় নয়। রুখে দাঁড়াতে হবে তোমাদের মতো যুবাদের। তোমরাই পারবে ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে এক নতুন ভারতবর্ষ গড়তে।’

নেতাজীর মুখে কথাগুলো শুনে বেশ চনমনে হয়ে উঠেছিল আকাশের মন। তার মনে হল, বাবা-মায়ের এই অন্যায় লোভের বিরুদ্ধে, সমাজের তথা দেশের লোভীদের বিরুদ্ধে তাকে প্রতিবাদী হতেই হবে। সে পারবে বিপ্লবের খড়গ হযে শুধু পরিবারে নয়, দেশকেও রক্ষা করতে।

আবার পরেরদিনই খাতায় পেন্সিল দিয়ে ফুটিয়ে তুলল জাতির জনক গান্ধীজীর ছবি। পরেরদিন সারাটা রাত মহাত্মার আদর্শে আদর্শিত হয়ে উঠল আকাশের মন। ‘ভারতবর্ষে অশান্তির সূচনা সভ্যতার প্রাকলগ্ন থেকেই। আমি দেখেছি এখানকার মানুষেরা কী অসহায়। সেই অসহায়তার সুযোগ নিয়েই একদল নেকড়ে এদেশ শোষণ করেছে। আমি খড়গ দিয়ে নয়, গোলাপ দিয়েই তাদের মন জয় করেছি। আমি জানতাম আমি যদি খড়গ হাতে তুলে নিতাম, আমার দেখাদেখি ওই খেটে খাওয়া মানুষগুলোও তাই করত। আর এই ভারতবর্ষ দিয়ে পবিত্র গঙ্গা বইত না, শুধু রক্তের নদী প্রবাহিত হত।’

গান্ধীজীর কথায় কিশোর মন আশ্বস্ত হল। সত্যিই তো। কোনও হিংসার মাধ্যমে কি এই মানুষের লোভ, লালসা, কামনা বধ করা সম্ভব! সেও স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে মানুষের মন থেকে লোভ, হিংসা দূর করবে।

পরেরদিন আবার স্বামী বিবেকানন্দ। চেয়ারে বসে তাঁর শিকাগো যাত্রার বর্ণনা থেকে শুরু করে বক্তব্যের সারাংশ বলতে লাগলেন আকাশকে। আকাশও মন দিয়ে শুনতে লাগল। সে ভাবতে লাগল সেও যদি সন্ন্যাসী হয়ে দেশে দেশে ঘুরে মানুষের মনের মৃত্যু রোধ করতে পারে, সাধনার দ্বারা মানুষকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে তার থেকে বড়ো কাজ বোধহয় আর কিছু নেই।

কিশোর মন বিশুদ্ধ ইস্পাতের ন্যায়। বাইরে থেকে শক্ত দেখায়, কিন্তু সহজেই হাতুড়ি পিটিয়ে অন্য আকার দেওয়া যায়। আকাশের মন এত আদর্শের কথা ভাবতে ভাবতে রোজ ঘড়ির কাঁটার মতো পরিবর্তিত হতে লাগল। রোজ যেন একটা অজানা হাত এসে তাকে দম দিয়ে যায়, আর যতক্ষণ দম থাকে লক্ষ্যে পৌঁছাবার উদ্দেশ্যে ঘুরতেই থাকে, বিরাম নেই। সে আসলে কী যে চায় সেটা আকাশ এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। মাঝখান থেকে ড্রয়িং খাতার পাতা একটার পর একটা শেষ হয়ে যেতে লাগল।

হঠাৎ একদিন রাতে আকাশের বাবা-মা তার ঘরে এসে উপস্থিত। তখন সে সবে খাতাটা খুলেছে আঁকবে বলে। আজ সে কবিগুরুর আরাধনা করবে। কিন্তু সাধনায় বাধ সাধল তার বাবা এবং মা। অরুণ খাতাটা কেড়ে নিল আকাশের কাছ থেকে। খাতাটা খুলে দেখে অবাক। একটিমাত্র পাতা অবশিষ্ট আছে। রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল অরুণ। খাতাটা পাশে সরিয়ে রেখে প্রচণ্ড প্রহার করতে শুরু করল আকাশকে। মাও তাকে বাবার হাত থেকে বাঁচাবার পরিবর্তে আরও ইন্ধন যোগাতে লাগল। একসময় থামল অরুণ। সে নিজেও বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছে। শান্ত অথচ কঠিন স্বরে অরুণ বলল, “আজ রাতে তুমি আমার ছবি আঁকবে। আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই এই দেশের। তুমি সেইভাবেই ছবিতে আঁকবে। এটার অন্যথা হলে মেরে ওই কড়িকাঠে তোমায় ঝুলিয়ে দেব।”

অরুণ ও প্রমীলা ঘর থেকে খুব রেগেই বেরিয়ে গেল।

আকাশ ঘটনার আচম্বিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল। এত মার খেয়েও তার চোখ দিয়ে একফোঁটা জল বের হয়নি। যে বাবা-মা তাকে চোখ দেখালেই ভয়ে কেঁদে ফেলত সে, তাদের প্রহারে চোখ থেকে এতটুকু জল বের হয়নি কেন আকাশ বুঝতে পারল না। তার শরীরে শুধু যন্ত্রণার বিকার ফুটে উঠছিল। সারারাত ধরে শেষ পাতাটি নিয়ে বসে রইল সে। শেষে ভোরের দিকে পেন্সিল হাতে তুলে নিল। খাতায় ফুটে উঠল তিনটি মানুষের মূর্তি। একজন পুরুষ, একজন স্ত্রীলোক আর তাদের মাঝে এক অল্পবয়স্ক ছেলে। তিনজনে হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবার মুখেই সকালের একরাশ হাসিমাখা সূর্য।

অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

1 thought on “সন্ধ্যা ভট্টাচার্য সাহিত্য প্রতিযোগিতা ২০২০ সপ্তম স্থান-ম্যাজিক খাতা বিজন চক্রবর্তী বসন্ত ২০২০

  1. ইস, এরকম ড্রয়িং খাতা যদি আমাদের সকলেরই থাকতো, আর আমরা ঠিক এই ভাবে যদি আমাদের শৈশবের ছবি আঁকতে পারতাম!

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s