ইচ্ছেপূরণের গোলকধাঁধায়
Incredible 2
আলোচনা করলেন রুমেলা দাশ
মায়ের হাত ধরে রাস্তার পাশের ফুটপাথে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল বুবলিন। অনেকক্ষণ হয়ে গেল এখনো রাস্তাটা পেরোতে পারেনি ওরা। মনে মনে খুব রাগ হচ্ছিল বুবলিনের। কিছুতেই যে রাস্তা পেরোনোর সবুজ লাইটটা জ্বলছে না। আর ওটা না জ্বলা পর্যন্ত একটার পর একটা গাড়ি সাঁই সাঁই করে বুবলিন আর ওর মায়ের সামনে দিয়ে ছুটে যাবে, কিছুতেই থামবে না। ইশ, এই সময়টায় যদি সুপার হিরোদের মত, রাস্তা, গাড়ি, দোকানপাট, ঘরবাড়ির উপর দিয়ে ভেসে ভেসে উড়ে যেতে পারত ওর ছোট্ট শরীরটা নিয়ে। তাহলে কী মজাই না হত! বুবলিনের চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল একটা মজার দুনিয়া, যেখানে ও ইচ্ছে করলেই স্কুল বাড়ির ছাদ থেকে বাড়ি ফিরে আসতে পারে, আবার মায়ের হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে নয়, খুশিমত পৌঁছেও যেতে পারে ওর বন্ধুদের কাছে! ওর চেনা জগতটা নিমেষে বদলে রংবেরঙের হয়ে উঠছে আসতে আসতে। একদমই তাই!
বুবলিনের মত ছোটদের কথা মাথায় রেখেই “দ্য ইনক্রেডিবল”( ২০০৪)-এর দীর্ঘ ১৪ বছর পরপর হই হই করতে করতে এসে গিয়েছে “ইনক্রেডিবল ২”( Incredible 2)। লেখক ও পরিচালক ব্রাড বার্ড (Brad Bird) অনেকটা যেন ছোটদের ছোট্ট ছোট্ট আকাঙ্খাগুলো তাঁর ঝুড়ি ভর্তি করে দেখিয়েছেন আমাদের সবাইকে। ভরপুর মজা, অনমনীয় উদ্দীপনা দিয়ে যেকোনো সৎ উদ্দেশ্য সফল করা যেতে পারে। তারই সুন্দর বাস্তব উদাহরণ ‘পার’ পরিবার ( Parr Family)। নীল আকাশের বুকে চিরে ফুরফুরে পাতলা হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো, আবার ওই যে দুষ্টু লোক যারা ছিনতাই করছে ব্যাঙ্ক, কারো পার্স, শহরের লোকজনকে এসবের হাত থেকে বাঁচাতে শহরের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় আমাদেরই মধ্যের এমন কয়েকজন। যাদের আমরা, আমাদেরই একজন বলে চিনি। জানি। কিন্তু ছোটরা জানো কি? আমাদের সবাইকেই যে একটা নিয়ম মেনে চলতে হয়!
তোমরা কি ভাবো শুধু স্কুলেই বুঝি নিয়ম আছে! তা নয়, এই সমাজ যেখানে আমরা, আমাদের পরিবার নিয়ে থাকি, সেখানের জন্য কতগুলি নিয়ম আছে। সবার মাঝে থাকতে গেলে, সবার মত করেই থাকতে হবে নাহলেই বিপদ। ধরো মিঃ ববের (Mr. Incredible) মত খারাপ লোকের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে যদি ২০তলা বাড়ি ভেঙে যায়! বা দুস্টু লোকেরা কোনো উপায়ে ওই সুপারহিরোর দুর্দান্ত শক্তিকে কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে, বা ‘ড্যাস’ মিঃ ববের ছোট্ট ছেলে স্কুলের প্রতিযোগিতায় নিজের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সবার আগে সবসময় এগিয়ে জিতে যায় তবে? বাকিদের মন খারাপ করবে না বুঝি! তাইতো ওদের সবার মাঝে মিশে থাকতে হয় সবার মত করে! কিন্তু তাতেও যে বেজায় মুশকিল! সরকারের নিয়মকানুন মেনে ওরা চুপ করে ঘরে বসেই বা থাকে কী করে! মানুষের সাহায্য করতে না পারলে ওদের যে ভালোই লাগে না। ঘটে যায় সর্বনাশ! ‘উইনস্টন ডিএভরে’র (Winston Devor) ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে মিঃ ববের স্ত্রী ‘হেলেন’। অর্থাৎ আমাদের অতি পরিচিত ‘ইলাস্টিক গার্ল’। শরীরকে প্রয়োজনমত ছোট, বড়, মাঝারি, চৌকো, গোল, বেঁটে, মোটা, প্যারাসুটের মত করতে পারার শক্তি যার মধ্যে আছে, সেই সরল মনের মানুষটা জড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ কিছু চক্রান্তে। মানুষকে সাহায্য করাই যার লক্ষ, সেই সরল মানসিকতার সুযোগ নিয়ে স্ক্রিনস্লেভরের জালে আটকে পড়ে সে। কিন্তু দুস্টু লোকেরা কি অত সহজে পরিত্রাণ পায়! কখনোই নয়! মিঃ বব, তার তিন-তিনটি কচিকাঁচার সঙ্গে ঘরে থাকলেও, সজাগ ছিলেন সবসময়। সজাগ ছিল ‘ভিওলেট’ ছোট্ট মেয়েটিও, যেকোনো সময় অদৃশ্য হয়ে যাওয়া কিংবা স্বচ্ছ বলয় তৈরি করে তার মধ্যে নিজেকে আবৃত করে রাখা যাতে কেউ তার কোনো ক্ষতি করতে না পারে! ‘ড্যাস’ দৌড়ে যে সবার আগে, হাওয়ার আগেও যার গতি! আর একজনের কথা তো বলিই নি! ‘বেবি জ্যাক জ্যাক’ ওমা সে তো আরো চমকে দেওয়ার মত ক্ষমতা রাখে। একটা, দুটো, তিনটে কিংবা আরো বেশি সংখ্যায় নিজের আকার ধারণ করে মাথা গুলিয়ে দেয় সব্বার, রেগে গেলে জন্তুর মত ভয়াবহ হয়ে ওঠে, হ্যাঁ এসবে ঘরে থেকে নাজেহাল হতে হয়েছে বটে মিঃ ববকে। কিন্তু স্যুট তৈরি হয়ে যেতেই ‘বেবি জ্যাক জ্যাক’ মোকাবিলা করতে পারে সবকিছুর! তবে পদে পদে ভয়ঙ্কর সব ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে ওদের! খুব একটা সহজ কাজ তাতো নয়! কী সেই বিপদ? কীকরেই বা ভিওলেট, ড্যাস, জ্যাক জ্যাক আর মিঃ বব তাদের প্রাণপ্রিয় মানুষ হেলেনকে উদ্ধার করল? কেন দুস্টু লোকেরা এমন ফাঁদ পেতেছিল বলোতো? সুপার হিরো তো সকলের ভালোই করে! ওদের সঙ্গে তো কারুর লড়াই, ঝগড়া মারামারি নেই! তবে? নাহ আর এর থেকে বেশি কিছু তো আমি বলব না। এসব জানতে গেলে তোমাদের দেখতেই হবে
‘ইনক্রেডিবল ২'(incredible 2)
১১৮ মিনিট চুপচাপ বসে বুঝে নিতে হবে গোটা ব্যাপারটা! তবেই না! তবে সবকিছুর মাঝে একটা কথা বলেই রাখি, আমাদের সবার মনে ইচ্ছেগুলো হরেক রঙের। তাতে নানান রং। কেউ পাখি হয়ে উড়তে চায়। কেউ হিরোদের মত অসম্ভব বলশালী হতে চায়। কেউ আবার ভাবে হয়ত যদি নিজেকে চট করে লুকিয়ে ফেলা যেত! ইচ্ছেগুলো ডানা মেলতে ভালোবাসে রামধনুর মত কিন্তু তাতেই তো আমাদের ছোট বড় কঠিন পথগুলো, সোজা সরল হয়ে যাবে তাতো নয়! কঠিন পথ পেরিয়ে তবেই সোজা পথের সন্ধান পাওয়া যাবে। তবেই তো আসল সফলতা! সুপার ক্ষমতার অধিকারী হয়েও ‘পার পরিবারের’ ঘটনাগুলো তোমাদের কাছে সেজে উঠেছে সেই ঢালু, সমতল পথের বাঁকে বাঁকে। সেগুলো শুধু ঠিকমত খুঁজে নেওয়া, বুঝে নেওয়ার অপেক্ষা।
পরিবারের সবাই মিলে দেখা এ গল্পের মজা, আধুনিকতা, ফ্যান্টাসির সঙ্গে মিলেমিশে থাকা বাস্তব বোধের নানান দিক ‘ন্যাশনাল বোর্ড অফ রিভিউ’ দ্বারা ‘বেস্ট অ্যানিমেটেড মুভি’ পুরস্কার পেয়েছিল ২০১৮সালে। মনোনয়ন পেয়েছিল ৭৬তম ‘গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড’ এও! ‘পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিও’ পরিবেশিত এই চলচ্চিত্রে ‘ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্স’ উজাড় করে দিয়েছেন ছোট থেকে বড় মনের কল্পনার অলিগলি। মিঃ ববের কণ্ঠস্বরে ‘ক্রেইগ টি নেলসন’ (Craig T Nelson), হেলেনের কণ্ঠস্বরে ‘হোলি হান্টার’ (Holly Hunter), ভিওলেটের ও ড্যাসের হয়ে কন্ঠস্বরে ‘সরাহ আর মিলনার’ (Sarah Vowell & Milner) আর শিশু জ্যাক জ্যাকের কন্ঠস্বরে ‘ইলি ফুসিল’ (Eli Fucile) অসম্ভব দক্ষতা দেখিয়েছেন। অসাধারণ হয়েও কিভাবে সাধারণ হয়ে, সাধারণের পাশে থাকা যায় তার গল্প এটি। গল্প শক্তিধরের জীবনেও আসা কিছু জটিল মুহূর্ত, আর হাসি মজায় ভরপুর একটি গল্প, যা জীবনের সহজ বোধে আদ্যন্ত পূর্ণ। তাই আর দেরি কেন? দেখে ফেলো চটপট। জানিয়ে দাও জয়ঢাকের ‘সিনেমা হলে’! কেমন দেখলে আর ঠিক কতটা ভালো লাগল তোমাদের! আর হ্যাঁ, তোমাদের সেইসব ভাবনাগুলো লিখতে ভুলোনা যা তোমাদের মনের কোণে লুকিয়ে আছে, যা করতে পারলে তোমাদের চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না। কে বলতে পারে, এমন সব ইচ্ছেগুলো একদিন হঠাৎ করেই পূর্ণ হতে দেখবে। যেকোনো দিন, যেকোনো সময়! আমি কিন্তু সবসময় তোমাদের পাশে থাকব!!