শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য
চেনা মুখ অচেনা মানুষ
সত্যজিৎ রায় মশায়ের বহু বিখ্যাত ছবিতেই ক্যামেরার পেছনে যে সুযোগ মানুষটি ছিলেন তিনি শ্রী সৌমেন্দু রায়। সম্প্রতি উত্তর কলকাতার এক স্টুডিওর ইতিহাসের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের ফাঁকে, জয়টাকের পাঠকদের জন্য সত্যজিৎ রায়ের নানান ছবির শুটিংয়ের মজার মজার সব গল্প বললেন তিনি। তার থেকে নির্বাচিত কিছু গল্প এবারে তোমাদের শোনাব।
গল্প ১
সেটা ১৯৬৭-৬৮ সাল হবে। গুপি গাইন বাঘা বাইনের শুটিং করতে গেছি রাজস্থানে। যোধপুর থেকে জয়শলমীর যাব। মিটার গেজের ট্রেনে চেপে বসেছে গোটা টিম। ছ’ঘন্টার জার্নি। অতএব সঙ্গে খাবারদাবার। বিশেষ কিছু নেওয়া হয়নি। লাগলে পরে পথে কোনো স্টেশনে কিনে নেওয়া যাবে।
ও হরি, রওনা হবার পরে দেখা গেল, ন্যাড়া ন্যাড়া সব স্টেশন, খাবারের দোকান-টোকানের কোনো চিহ্নও। নেই। তাই দেখে সবার আরও ঘন ঘন খিদে পেতে লাগল। ওদিকে খাবার বলতে সঙ্গে আছে অল্প বিস্কুট আর জল। ওতে হয়? সবাই মিলে কামুকে (অভিনেতা কামু মুখোপাধ্যায়) গিয়ে ধরে পড়লাম, “কিছু উপায়। করো।”
পরের স্টেশন আসতেই, বলা নেই কওয়া নেই, কামু সটান নেমে গেল গাড়ি থেকে। একটু পরে হেলতে দুলতে ট্রেন আবার ছাড়ল বটে, কিন্তু কামু আর উঠল না। অবশ্য ওকে নিয়ে বিশেষ দুশ্চিন্তা কেউ করে না। মানিকদা (সত্যজিৎ রায়) বললেন, ” দ্যাখো গে ঠিক পাশের কোনো কামরায় গিয়ে উঠেছে।”
মিনিট পাঁচশ পরে ট্রেন এসে থামল পরের স্টেশনে। ওমনি কামু কোত্থেকে দৌড়ে এসে একগাদা ভাজাভুজি খাবার জানলা দিয়ে কামরার ভেতরে গলিয়ে দিয়েই আবার দৌড়ে কোথায় চলে গেল। ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়। অমন ন্যাড়া জায়গায় ওরকম ভালো ভালো খাবার ও পেল কোথায়? আবার, খাবার পৌঁছে দিয়ে চলেই বা গেল কোথায়? এইসব ভাবতে ভাবতে আর খাবারের সদগতি করতে করতে পরের স্টেশনে এসে পৌঁছে গেছি আমরা, আর ওমনি কামুও হাতে একগাদা মিষ্টি নিয়ে লাফিয়ে এসে কামরায় উঠেছে।
জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ট্রেন থেকে নেমে খুঁজতে খুঁজতে অন্য একটা কামরায় একটা মারোয়াড়ি বিয়ের পার্টি দেখে সটান তাদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছিল কামু। মনোরঞ্জনের বিদ্যেটা ভালোই জানে, অতএব হাতসাফাই, ছোটোখাটো ম্যাজিক, এইসব দেখিয়ে বকশিশ হিসেবে এতসব খাবার নিয়ে এসেছে।
গল্প ২
জয় বাবা ফেলুনাথের শুটিং চলছিল বেনারসে। ফেলুদা আর তার দুই শাগরেদ মিলে মগনলাল মেঘরাজের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে সেই দৃশ্যটার শুটিং হবে সেদিন। তা মানিকদা বললেন, গলিতে একটা ষাঁড় দেখানো দরকার। অতএব ষাঁড় চাই। ইউনিটের লোকজন ব্যস্তসমস্ত হয়ে ষাড় খুঁজতে বার হল। খানিক পরে দেখি,| আগে আগে কামু আর তার পেছনে মস্ত একটা ষাঁড় বাধ্য ছেলের মতো হেঁটে হেঁটে আসছে। কামুর হাতে একগোছা মুলো, আর তার লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে ষাঁড় ধরে নিয়ে এসেছে। | কাছাকাছি পৌঁছে বলল, “মানিকদা, ষাঁড় কোথায় রাখব বলে দিন।” ঠিক যেখানটায় ষাঁড় দাঁড়ানো দরকার সেই স্পটটা দেখিয়ে দেওয়া হল। কামু সেখানে মুলোর গোছাটা রেখে সরে আসতে ষাঁড়বাবাজিও ঠিক সেখানটায় হাজির। ক্যামেরা চালু হল, মনের মতো শট পেয়ে। সবাই বেজায় খুশি।
গল্প ৩
বেনারসে আর একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল ওই জয় বাবা ফেলুনাথের শুটিং করতে গিয়ে। ছবির শেষদিকে লালমোহন বাবু আর তোপসে সেই যে সাধু সেজে গঙ্গার ঘাটে বসে ছিল, সেই দৃশ্যটার শুটিং হবে দ্বারভাঙা ঘাটে। বিকেলবেলা। সন্তোষবাবু (সন্তোষ দত্ত) আর সিদ্ধার্থর সাধুর মেক আপ নিয়ে স্পটে ঢোকবার কথা, তা ঢোকে আর না। মানিকদা ব্যস্ত হয়ে ডাকছেন “কী হল, সন্তোষ, সিদ্ধার্থ, তাড়াতাড়ি এসো।” আর এসো! ওদের কাছে গিয়ে দেখা গেল একদল বুড়োবুড়ি দু’জনকে খাটি সাধু ভেবে হুড়োহুড়ি করে প্রণাম করতে ব্যস্ত। তবেই বোঝো, মেক আপটা কী জম্পেশ হয়েছিল!
পুণর্মুদ্রণঃ জয়ঢাক * শীত ১৪১১ – ২৭
ছবি : শম্ভু ভট্টাচার্য ও কুলদীপ