শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য
সম্পাদক সত্যজিৎ রায়
রাহুল মজুমদার

(একাধিক অপেশাদার শিশুকিশোর ম্যাগাজিনের সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনাকালে দেখেছি তাঁদের সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত সন্দেশ দেখবার বা তাঁর সম্পাদনার পদ্ধতিগত দিকটা জানবার সৌভাগ্য হয়নি। তাঁর সম্পাদনাকে ঘনিষ্টভাবে দেখেছেন এমন একজন হলেন শিল্পী শ্রী রাহুল মজুমদার। বিষয়টি নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত ও মনোজ্ঞ লেখা তিনি তৈরি করে দিয়েছেন। বাহুল্যবর্জিত এই লেখায় একটি অবাণিজ্যিক শিশুকিশোর পত্রিকার সম্পাদকের টিমওয়ার্ক, এরিয়া অব এক্সপার্টাইজ ও কমিটমেন্ট কী হওয়া বাঞ্ছনীয় তা সত্যজিৎ রায়ের উদাহরণ দিয়ে প্রাঞ্জল করে দেখানো হয়েছে। সঙ্গের ছবিগুলোও বলাবাহুল্য নিছক ইলাসট্রেশন নয়। কীভাবে গোটা প্রক্রিয়াটার ওপরে তাঁর গভীর নজর ও দখল ছিল তার প্রমাণ হিসেবে ছবিগুলো জুগিয়ছেন লেখক। আশা করি এটি কাজে আসবে। — সম্পাদক, জয়ঢাক )
নানান ছোটদের পত্রিকার সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে যুক্ত থাকার সুবাদে ছোটদের পত্রিকা সম্পাদনা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। অধিকাংশ সম্পাদকের সাহিত্যবোধ আর পত্রিকার চরিত্র সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। তবে, শুধু উপযুক্ত সুসাহিত্যই কোনও পত্রিকার মান নির্ধারণ করে না। পত্রিকার, বিশেষত ছোটদের পত্রিকার ক্ষেত্রে তার আকার, অক্ষরবিন্যাস, অলঙ্করণ ,মুদ্রণ সব দিকেই সচেতন নজর দিতে হয়। এই সমস্ত ব্যাপারে সমান দক্ষতা একজনের মধ্যে থাকা একরকম অসম্ভব। অন্যান্য ভাষা বা দেশের কথা বলতে পারব না, বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ছোটদের পত্রিকার সম্পাদকদের মধ্যে এই সব ক-টি গুণ ছিল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী,সুকুমার রায় আর সত্যজিৎ রায়ের। প্রথম দু’জনকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। সত্যজিৎ রায়কে সন্দেশ সম্পাদনা করতে দেখেছি।
সন্দেশে সেই সময় তিনজন সম্পাদক ছিলেন– সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার আর নলিনী দাশ। লেখা নির্বাচনের প্রাথমিক দায়িত্ব নিয়েছিলেন নলিনীদি। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর লেখার সাহিত্যরসের বিচার করতেন লীলাদি। যে বাছাই লেখাগুলো এই ছাঁকনির মধ্যে দিয়ে ছেঁকে আসত,সেগুলো চূড়ান্ত নির্বাচনের জন্য সত্যজিৎবাবুর টেবিলে পৌঁছত।উনি লেখার সাহিত্যরসের সঙ্গে বাস্তবিকতার দিকটাও খতিয়ে দেখতেন। লীলাদির হাতে দারুণ নম্বর পাওয়া লেখাও ওই নিরিখে কখনও কখনও বাতিল হয়ে যেত। নলিনীদির কাছে ফেরত পাঠানোর সময় লেখাটি সম্পর্কে তাঁর মতামত, যুক্তি জানিয়ে চিরকুট পাঠাতেন।
এখানেই কিন্তু তাঁর কাজ শেষ হতো না। কোন লেখায় কী ধরনের টাইপ ব্যবহৃত হবে, পয়েন্ট সাইজই বা কী হবে,কোন লেখার ছবি কোন শিল্পী আঁকবেন, সে ছবির ব্লকের সাইজ কী হবে সবই ছিল তাঁর নখদর্পণে।

এখানেই শেষ নয়, গোটা পত্রিকার লে-আউটও উনি নিজের হাতে করতেন। প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদও উনিই আঁকতেন।
অর্থনৈতিক কারণে বছরে একটি বা দুটির বেশি প্রচ্ছদ করা সম্ভব হতো না— তবে প্রতিটি সংখ্যায় তার রং বদলে যেত।ব্লকের যুগে এর জন্য কেমন দূরদর্শিতা আর দক্ষতার দরকার, সেটা গুণীজন বিলক্ষণ বুঝবেন।
লেখা নিয়ে লেখকদের সঙ্গে, অলঙ্করণ নিয়ে শিল্পীদের সঙ্গে, ছাপা নিয়ে মুদ্রাকরের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনাতেও তাঁর ক্লান্তি ছিল না। সবসময় যে তিনি সন্তুষ্ট হতেন, তা হয়তো নয়।খানিকটা আপস করে নিতে হতো।
সবসময় খেয়াল রাখতেন, ছোটদের পত্রিকা সন্দেশে যেন ছোটদের উপযুক্ত লেখা, ছবি, বিজ্ঞাপনই প্রকাশিত হয়— এ ব্যাপারে কোনোরকম আপস করতে রাজি ছিলেন না উনি। একজন আদর্শ ছোটদের পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে একটা নামই আমার মনে আসে– সত্যজিৎ রায়।
শীর্ষচিত্রঃ রাহুল মজুমদার
—————————————–
সম্পাদকীয় সংযোজনঃ এই লেখায় যে ফন্টগুলোর কথা সত্যজিৎ রায়ের চিঠিতে রয়েছে সেই ফন্টফেসগুলোর ছবি জোগাড় করা গিয়েছে। ইস্টার্ন টাইপ ফাউন্ড্রির ফন্ট অ্যালবাম থেকে ছবিগুলো সংগ্রহ করে দিয়েছেন “শিলালিপি প্রেস” -এর কর্ণধার এবং জয়ঢাকের প্আরিন্রট যুগের এক প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক শ্রী বাসব চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গে সেগুলো দেয়া হল। সন্দেশের সঙ্গে যাঁদের ছেলেবেলা কেটেছে তাঁরা হয়ত এই ফন্টগুলোর ছবি দেখে শৈশবের সন্দেশের চেনা পরিচিত ছাপাইয়ের সুবাস পাবেন এই আশা।