স্মৃতিচারণ- দিনগুলি মোর স্বপ্না লাহিড়ী বসন্ত ২০২০

আগের পর্ব দিনগুলি মোর    আগের স্মৃতিচারণ ফিরে দেখা   

আতপুর স্কুলের পড়া শেষ করে ভর্তি হলাম ইছাপুর গার্লস হাইস্কুলে। তখন স্কুলের সেশন আরম্ভ হত জানুয়ারি মাসে। ডিসেম্বর মাসে অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে নতুন বছরে নতুন ক্লাস। আমাদের যখন পরীক্ষা চলছিল তখন শর্বাণী-সান্ত্বনার বাবা বদলি হয়ে এলেন আম্বালা থেকে আর বাণীদি-রানুর বাবা বোসকাকু কোথা থেকে বদলি হয়ে এলেন আমার ঠিক মনে নেই। এরাও আমাদের সঙ্গে ভর্তি হল স্কুলে। বাণীদি ভর্তি হল দিদির স্কুল নবাবগঞ্জ গার্লস হাই স্কুলে আর শর্বাণী–সান্ত্বনা-রানু-শিখা-কেয়া আর আমি ভর্তি হলাম নর্থল্যান্ড ইছাপুর গার্লস হাই স্কুলে। ছোটো বোন জয় তখন বেশ ছোটো। ইছাপুর E.S.D থেকে বেশ দূর, তাই আর হাঁটা পথ নয়, পাবলিক বাসে স্কুল যাওয়া আসা। স্কুলে যাবার সময় আমরা কলরবলর করতে করতে E.S.D-র গেট থেকে বেরিয়ে গিয়ে দাঁড়াতাম বড়ো রাস্তার ধারে। বাস এসে দাঁড়াতেই বাসের পাদানি থেকে ক্লিনার ছেলেটি এক লাফে নেমে বাসের গা চাপড়িয়ে চেঁচাত, “একদম রোককে! জনানা হ্যায়।”

বয়েজ হাই স্কুলের পরে একটা বড়ো মাঠ পেরিয়ে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা আমাদের স্কুল। গেট দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে ক্লাস-রুমের দেয়াল ঘেঁষে ফুল আর সবজির মেলানো মেশানো বাগান। এই জায়গাটা আমাদের ক্লাসগুলোকে ভাগ করে দেয়া হত বাগান করার জন্যে। এখানে কী লাগানো হবে তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের ছিল। বাগানের কম্পিটিশন হত আর প্রাইজ়ও দেয়া হত। আমরা বাগানটাকে যতটা সম্ভব সুন্দর করে তুলতাম, ফলে আমাদের স্কুল রঙে রঙে ঝলমল করে থাকত। স্কুলের মেয়েরা এখানে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখেছিল। আমরা বড়ো হয়েছিলাম প্রাকৃতিক পরিবেশে। স্কুলের বাগানে আমরা মাটি খুঁড়ে গোবরের খাদ মিশিয়ে তাতে বীজ পুঁততাম, জল দিতাম, চারা বেরোলে তার যত্ন করতাম। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কবে ফুল ফুটবে, ফল ধরবে। একেকটা ক্লাসের জন্যে একজন করে দিদিমণি থাকতেন আমাদের গাইডেন্স দেবার জন্যে। অনেক অনেক পরে চিরিমিরিতে আমার গড়া জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি গ্রামের স্কুলের বাচ্চারাও এইরকম বাগান করে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখেছে। ছোটবেলার স্কুলের এই শিক্ষাটা আমার মনের মধ্যে কোথাও হয়তো লুকিয়ে ছিল। একেবারে ছোটো থেকেই বোধ হয় জীবনের গতি নির্ধারিত হয়ে যায়।

স্কুল বাড়িটার মাঝখানে ছিল ছোট্ট একটুকরো মাঠ। তার দু’পাশে সার সার ক্লাস-রুম, সামনে টানা বারান্দা। দুটো উইং-এর মাঝখানে সামনে খোলা একটা হল। সেখানে হয়তো পরে ক্লাস-রুম তৈরি হয়েছিল, আমি দেখিনি। ক্লাস শুরু হবার আগে আমরা লাইন দিয়ে দাঁড়াতাম বারান্দায়। প্রেয়ার গাওয়া হত। চোখ বন্ধ করে তারস্বরে গাইতাম কোনও দিন, ‘বল বল বল সবে শত বীণা বেণু রবে’, কোনও দিন ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী’ নয়তো ‘অন্তর মম বিকশিত কর’। নানা সুরে নানা উচ্চারণে সে এক কলতান। রোজ গানের পরে গাইতাম, ‘যো আত্মদা বলংদা যস্য বিশ্ব উপাসতে প্রশিষং যস্য দেবাঃ, যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যুঃ কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম’। সংস্কৃতের পণ্ডিত মাস্টারমশাই বলেছিলেন এই শ্লোকটা মহানারায়ণোপনিষদ-এ আছে।

ক্লাসের প্রত্যেকটা হাই বেঞ্চে তিনটে গর্ততে ফিক্স করা দোয়াতে জলের মধ্যে কালির বড়ি বা ট্যাবলেট গুলে কালি বানিয়ে ঢেলে দেওয়া হত। আর থাকত ব্লটিং পেপার, খাতা থেকে এক্সট্রা কালি শুষে নেবার জন্যে। সবে পেন্সিল ছেড়ে কালি-কলমে প্রমোটেড হয়েছি, ফাউন্টেন পেন পেয়েছি আরও পরে। পেন্সিলের সমান লম্বা কলম, মাথায় পিতলের নিব, যেটা আমরা আগুনে পুড়িয়ে ঠাণ্ডা জলে ডুবিয়ে টেম্পারিং করে নিতাম। সেই কলম কালিতে ডুবিয়ে লেখা হত। তখনকার ফেমাস সুলেখা কালির ট্যাবলেট দিয়ে বাড়িতেও আমরা কালি বানাতাম।

আমাদের দিদিমণি বা মাস্টারমশাইদের মধ্যে খুব ভালো লাগত পারুলদির কাছে ভূগোল আর বড়দির (হেড মিস্ট্রেস) কাছে ইংলিশ পড়তে। পারুলদি যখন গ্লোব আর বড়ো বড়ো ম্যাপ নিয়ে গল্পের মতো করে ফিজিক্যাল ভূগোল পড়াতেন, মগ্ন হয়ে শুনতাম। কত সোজা হয়ে যেত বিষয়টা। কলেজে যখন জুজিওগ্রাফি পড়েছি, আরও পরে  কলেজে  ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েছি, পারুলদির গলাটা যেন কানের কাছে শুনতে পেতাম আর তাঁর মতো করে বোঝাতে চেষ্টা করতাম। স্কুল-কলেজে যত ভালো ভালো টিচার পেয়েছি, পারুলদি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ম্যাথস-এর জন্যে ছিলেন দু’জন মাস্টারমশাই। যিনি পাটিগণিত (arithmatics) পড়াতেন   তাঁর নাম মনে নেই আর গুহ মাস্টারমশাই পড়াতেন বীজগণিত ও জ্যামিতি (algebra, geometry)। যাদবের পাটিগণিত ও কেপি বোসের বীজগণিতের আয়তন বেশ ভয়ের উদ্রেক করত। মনে মনে ভাবতাম, কেন রে বাবা শামুকের খানিক এগোন, খানিক পিছন বা চৌবাচ্চায় একসঙ্গে জল ভরা আর খালি হওয়া নিয়ে অঙ্ক কেন?

পণ্ডিত মশাই পড়াতেন সংস্কৃত। বয়স্ক মানুষ, আপাদমস্তক শ্বেত শুভ্র। ফর্সা গায়ের রং, মাথাভর্তি ছোটো ছোটো করে কাটা পাকা পাকা চুল, ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি ও চাদর, পায়ে সাদা রঙের কেডস। বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রণীত ব্যাকরণ কৌমুদী থেকে সংস্কৃত গ্রামার পড়াতেন। কোনও কোনও দিন পড়াতে পড়াতে হারিয়ে যেতেন অন্য জগতে। টেক্সট বুক ছেড়ে উদাত্ত স্বরে কালিদাসের মেঘদূতম বলতে শুরু করতেন, ‘কশ্চিৎ কান্তা বিরহগুরুণা’… আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম রামগিরি থেকে মেঘ বার্তা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে উজ্জয়িনীতে। কখনও গীতা নিয়ে আলোচনা করতেন। সংস্কৃত সাহিত্যের সৌন্দর্যর সঙ্গে আমাদের পরিচয় তাঁর কাছ থেকেই।

ক্রমশ

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s