আগের স্মৃতিচারণ ফিরে দেখা
এক শীতের সকালে মায়ের হাত ধরে আমি আর বোন কেয়া ভর্তি হলাম আঁতপুর বালিকা বিদ্যালয়ে। আমি ক্লাস ফাইভ-এ আর কেয়া বোধহয় ওয়ান-এ। সবে আমার বাপি বদলি হয়ে এসেছেন দিল্লি থেকে পশ্চিমবঙ্গে। তিনি ছিলেন ডিফেন্সে, বদলির চাকরি, গোটা ভারতবর্ষে তাঁর পোস্টিং হত। প্রাক স্বাধীনতার যুগে তাঁর পোস্টিং কোহাট, পেশাওয়ার রাওয়ালপিন্ডি, পারাচিনারের মত জায়গাতেও হয়েছে। কিন্তু সব জায়গাতেই সাধারণত এক দেড় বছরের বেশি থাকা হয়নি। ফলে আমাদের স্কুলিংটা খুব ব্যহত হয়েছিল। স্থিতুভাবে স্কুলে পড়া শুরু হয়েছে ক্লাস ফাইভ থেকেই। মা আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারে বেশ স্ট্রিক্ট ছিলেন। বাংলা ইংরাজি অঙ্ক এবং হাতের লেখা নিয়ে রোজ দুবেলা মায়ের সামনে বসতে হত। তাঁর হাতের কাছে একটা তালপাতার পাখা এলিয়ে পড়ে থাকত এবং দরকারে সেটির সদ্ব্যবহার করতেও তিনি দ্বিধা করতেন না। ফলে বিষয়গুলি সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল।
আঁতপুরের এই প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়টিতে , সকালে মেয়েরা পড়ত এবং আমাদের ছুটি হয়ে গেলে সেখানে ছেলেদের স্কুল বসত। গেট দিয়ে ঢুকে একটা ছোট মাঠ আর তার একদিকে ইংরাজির E অক্ষরের মত ক্লাশ রুমগুলি সাজানো, সামনে বারান্দা। ছাত টালি দিয়ে ছাওয়া। একপাশে স্কুলের অফিস। পুরোপুরি বাংলা মিডিয়াম, আশেপাশের সাধারণ ঘরের মেয়েরা সেখানে পড়তে আসত। তখন এসব ছোটখাটো স্কুলগুলিতে ইউনিফর্মের বালাই ছিল না, সবাই নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী জামা কাপড় পরে আসত।
এহেন সাধারণ স্কুলে আমাদের ভর্তি করা হল কেন তার পিছনের গল্পটিতে আসি। আগেই বলেছি আমাদের বাবা ডিফেন্সে ছিলেন। বাপি যেখানেই বদলি হয়েছেন আমরা ক্যান্টনমেন্টেই থেকেছি। সেখানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, খেলাধুলার সুন্দর ব্যবস্থা, ছোট বড় সবাই ইংলিশ বা হিন্দি মেলানো হিংলিশে কথা বলতেন। পশ্চিমবঙ্গের এই জায়গাটি শ্যামনগরের কাছাকাছি একটি মিনি ক্যান্টনমেন্টই বলা যায়। চারদিকে বিরাট উঁচু পাঁচিল এবং তার ওপরে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, জায়গায় জায়গায় উঁচু টাওয়ারে সেন্ট্রি মোতায়েন থাকত। এখানে ডিফেন্সের নানা রকমের স্পেয়ার পার্টস তৈরি হত। সামনের বিরাট গেটটিতে বড় বড় করে লেখা ছিল, E S D ( M ) , এখনো হয় তো আছে। গেটটির একেবারে ধার দিয়ে পাতা ছিল ট্রেনের লাইন। ভিতরে দাঁড়ানো মাল গাড়ি মালপত্র নিয়ে ঝুকঝুক করে চলে যেত গঙ্গার ওপরে জেটিতে। আমরা অনেক সময় ঠাকুমা বা কাকুর সঙ্গে সন্ধেবেলায় সেখানে বেড়াতে যেতাম। ইয়াবড়ো গেট-এর একপাশে ছিল একটা ছোট গেট, সামনে টার্ন পাইক। ভিতরে ঢুকে বাঁ পাশে একটা অফিস, সেখানে যারাই বাইরে থেকে আসতেন বা ভেতর থেকে বেরতেন তাঁদের ‘পাস’ চেক করা হত। আমরা যারা রোজ যাওয়া আসা করতাম তারাও বাদ পড়তাম না। টমাসকাকু রোজ গেট দিয়ে বেরুনো এবং ঢোকার সময় অন্যান্যদের মতন আমাদেরও পাস চেক করে সময়, বা কী কারণে বেরিয়েছি সব একটা মোটা রেজিস্টারে লিখে রাখতেন।
অফিস ঘরের ডানপাশ দিয়ে চলে গেছে চওড়া পিচ ঢালা রাস্তা। দু’ধারে সবুজ হেজ এবং তার ধারে ধারে বড় বড় রাধাচূড়ার গাছ। গরমকালের সকালে মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে থাকত হলদে রঙের ফুল। রাস্তার ডানদিকে ছিল অফিসারদের বাড়ি ও বাঁদিকে ছিল বিরাট একটি মাঠ, সেখানে শীতকালে বড়রা ক্রিকেট খেলতেন, স্টেটসম্যান, হিন্দুস্থান টাইমসদের টিম আসত খেলতে। টিমের ক্যাপ্টেন থাকতেন কর্নেল গুপ্তে ও উইকেটকিপার মেজর পালানি ভেলু। একধারে চেয়ারে দর্শকরা বসতেন, মহিলারাও বেশ সেজেগুজে আসতেন, সেখানে মধ্যমণিটি হয়ে বসে থাকতেন আমার ঠাকুমা। তিনি ক্রিকেটের বিরাট ফ্যান ছিলেন। ঠাকুমার কাছে আমরা ছোটবেলায় গল্প শুনিনি কিন্তু তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন পাহাড়ি নদীতে ছোট বড় নুড়ি পাথর দিয়ে বাঁধ দিয়ে কেমন করে গামছা দিয়ে তেচোখা মাছ ধরতে হয় , কেমন করে ঘুড়ি ওড়াতে হয়, ডাংগুলি খেলতে হয়। অসাধারণ মহিলা ছিলেন তিনি।
আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে ছিল লাল সুরকির রাস্তা, সামনে হেজ দিয়ে ঘেরা লন এবং তার সামনে ছিল বাপিদের ক্লাব যেটাকে মেসও বলা হত। এখানে একপাশে ছিল ব্যাচেলার অফিসারদের জন্যে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা ও অন্যপাশে কার্পেট মোড়া হল। এককোনে রাখা ছিল একটা পিয়ানো। মা মাঝে মাঝে এই পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইতেন, ‘ শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে’ বা ‘দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে’। মাঝে মাঝে বাপিও যোগ দিতেন মায়ের সঙ্গে। দুজন মিলে গাইতেন ‘ স্বপন যদি মধুর এমন’ বা ‘আমার রাত পোহাল শারদ প্রাতে’। এই ক্লাবে মাসে দুটো ‘নাইট’ হত, ফ্যামিলি নাইট পুরো ফ্যামিলিদের জন্যে ও ডিনার নাইট শুধু পুরুষ মেম্বারদের জন্যে।
মেস এর পিছন দিকে ছিল একটা বড় ফুলের বাগান , কেয়ারিতে ফুটে থাকত। নানারকমের মরশুমি ফুল,সুইট পি, হলিহক, ফ্লক্স ডায়ানথাস, ডালিয়া, নানা রঙের গোলাপ, আরও কতকি এখন আর নাম মনে নেই। বাপির তদারকিতে গোটা বছর বাগানটা ঝলমল করত। একেবারে দেয়ালের ধার ঘেঁষে ছিল আমাদের সুইমিং পুল। অগভীর দিকটায় পুলের জল ফিলটার হয়ে ঝর্নার মতন পড়তে থাকত আর গভীর দিকটায় ছিল একটা ডাইভিং বোর্ড। এখানেই আমরা সাঁতার শিখেছিলাম ও পরে ডাইভিং , স্ট্রেট ডাইভিং, সামারসল্ট এবং প্রথম দিকে আমার কাকুর ভাষায় ‘হুনুমান ডাইভ’ অর্থাৎ দৌড়ে এসে ঝপাং করে জলে লাফিয়ে পড়া। স্কুল থেকে ফিরে সাঁতারের নেশা আমাদের ভীষণ টানত।
আমাদের বয়সী বাচ্চারা বা একটু বড় পড়ুয়ারা হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করত। কেউ কেউ গঙ্গা পেরিয়ে চন্দননগরে কনভেন্ট স্কুলে পড়ত। এহেন জায়গায় থেকে আমি আর আমার বোন ভর্তি হলাম আঁতপুর বালিকা বিদ্যালয়ে। এর প্রধান কারণ বোধহয় ছিল মায়ের প্রবল ইচ্ছা তাঁর সন্তানদের তাদের মাতৃভাষা বাংলা পড়তে হবে, জানতে হবে এবং ভালবাসতে হবে।
ফিরে আসি স্কুলের কথায়। মনে আছে আমাদের বড় দিদিমণি মানুষটি ছিলেন ছোট্টোখাট্টো। কপালের মাঝখানে একটা বড় টিপ পরতেন সিঁদুরের, ঠিক যেমন আমার মা পরতেন। সাধারণভাবে পরা সাদা শাড়িটির আঁচল কাঁধের ওপর ব্রোচ দিয়ে আটকানো থাকত। মাথায় ঘোমটার আড়ালে দেখা যেত বড় আকারের খোঁপা। খুব স্নেহময়ী ছিলেন তিনি। কিন্তু দরকারে স্ট্রিক্টও ছিলেন খুব। কত কী যে শিখেছি তাঁর কাছে! তিনি বাংলা পড়াতেন আমাদের।
আর মনে আছে অঙ্কের টিচার পাণ্ডে মাস্টারমশাইকে। আমাদের ছোট্ট চোখে তাঁকে বেশ বিশাল মনে হত। খাটো করে পরা ধুতি আর মোটা কাপড়ের হাফ পাঞ্জাবি পরতেন তিনি, মাথায় হৃষ্টপুষ্ট একটি টিকি।
যতদিন সিঁড়িভাঙা, সরল, লসাগু গসাগু শিখছিলাম, অঙ্ক ভালই চলছিল। কাল হল শুভঙ্করী এসে। শুভঙ্করী যে কী ভয়ঙ্করী সেটা যারা এ জিনিসটিকে ‘ফেস’ করে নি তারা বুঝবে না। এ প্রজন্ম বা তার আগের প্রজন্মকেও এ ভয়ঙ্করীর সামনা করতে হয়নি। শুভঙ্করীতে ছোট ছোট ছড়া থাকে, তার মধ্যে থাকে অঙ্ক এর সূত্র, আর সেই সূত্র ধরে অঙ্ক কষে তার সমাধান বের করতে হয়। আমাদের সব চাইতে বড় সমস্যা ছিল, সেই সব শুভঙ্করীর মানে বোঝা। ভীষণ কঠিন ভাষা অন্তত ওই ছোট্ট ছোট্ট মনগুলির কাছে। একটা নমুনা দিই। যতটুকু মনে আছে বলছি ,
“ কুড়োবা কুড়োবা কুড়োবা লিজ্জ্যে, কাঠায় কুড়োবা কাঠায় লিজ্জ্যে।
কাঠায় কাঠায় ধুল পরিমাণ—– তার পরে ভুলে গেছি , প্রায় গত জন্মের ব্যাপার তো!
পাণ্ডে মাস্টারমশাই ছিলেন বেশ রাগী মানুষ ,তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ভয়ে রক্ত জল হয়ে যেত। মানেই বুঝতে পারছি না তো অঙ্ক কষব কী? আবার অঙ্ক না পারলে বা ভুল করলে মাথায় গাঁট্টা, হাতের চেটোয় বেত ও ফাইনালি রামচিমটি থাকত আমাদের কপালে। রামচিমটি যে কী ভয়াবহ জিনিস তা এখনকার বাচ্চারা জানেও না। এখন স্কুলে কোন টিচার একটু উঁচু গলায় কথা বললেই , থানাতে এফ আই আর, প্রিনসিপ্যালকে ঘেরাও আর টিচার বেচারার কথা নাই বললাম! কিন্তু আমাদের সময় পড়া না পারলে, মাথায় গাঁট্টা হাতে বেতের ঘা, রামচিমটি এসব খুব কমন ব্যাপার ছিল। এসব সত্ত্বেও আমরা স্কুল খুব উপভোগ করতাম। টিফিনের সময় চোর চোর , লুকোচুরি বা মাঠের একধারে ঘর কেটে এক্কা দোক্কা খেলা আর ছিল চু কিত কিত। একেবারে একটা আলাদা পরিবেশ।
সে-বছর বড়দিদিমণি আমাদের দিয়ে কালিদাস নাটক করিয়েছিলেন। কল্যাণী সেজেছিল কালিদাস আর আমি রাজকুমারি রত্না। মা এসেছিলেন আমাদের সাজাতে। মার বেনারসি শাড়ি পরে কী আনন্দ আমার। সেই আমার জীবনের প্রথম নাটক। বোন কেয়া খুব ভাল গান গাইত। নাটকের গান ও-ই গেয়েছিল। নাটকের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়।
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আমাদের নানা রকম অ্যাডভেঞ্চার চলত ,সে সব কথা একটু বলি।
আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে লাল সুরকি ঢালা পথটা গিয়ে মিশেছিল পিচ ঢালা রাস্তাটায়, যেটা ডানদিকে মোড় নিয়ে চলে গিয়েছিল অনেক দূরে। বাঁকের বাঁদিকে ছিল বাপির অফিস আর খানিকটা গিয়ে ডানদিকে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। এই এক্সচেঞ্জের একটা ভূতুড়ে গল্প আছে সেটা না হয় পরে বলব। বাপির অফিসের পিছনে দাঁড়িয়েছিল ডালপালা ছড়িয়ে বিরাট একটা পাকুড় গাছ, পাকা পাকা লাল লাল ফল ধরে থাকত তাতে। কতরকম পাখিদের খেলাধুলো চলত এর ডালে ডালে। গাছটার মাঝখান দিয়ে উঠেছিল লম্বা একটা তাল গাছ। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম এই তাল গাছটার দিকে। এর পাশ দিয়ে খানিকটা গেলেই ছিল টলটলে জল ভরা সেই ঝিলটা যেখানে আমরা রোইং করা শিখেছিলাম। ঝিলের ধারে গাছের গোড়ায় বাঁধা থাকত দুটো ডিঙিনৌকো। বিকেলবেলা বড়রা ডিঙি নিয়ে রোইং করতেন। ছুটির দিনে দাভাই আমাদের ঝিলে নিয়ে গিয়ে রোইং শেখাতেন। দিদি বেশ ভাল চালাত কিন্তু আমার দুটো দাঁড় কিছুতেই সমান ভাবে জল কাটত না ,ফলে ডিঙি সামনে না এগিয়ে গোল গোল হয়ে ঘুরত। পরে অবশ্য রপ্ত করে নিয়েছিলাম।
গরমের ছুটির দুপুরে যখন মা ঠাকুমা নিমগ্ন থাকতেন নতুন আসা বইতে, আমি আর আমার বন্ধু রানু চলে যেতাম ঝিলের ধারে। ঝিলের ধারের বড় গাছটার সঙ্গে বাঁধা থাকত ডিঙিদুটো।একটা ডিঙি ঠেলে ঠেলে জলে নামিয়ে নিয়ে আমরা দু’জনে ডিঙিটার দু দিকে দাঁড়িয়ে দুলতে থাকতাম।মাঝে মাঝে জলেও পড়ে যেতাম।
আমরা সন্ধেবেলা সাঁতার কেটে বাড়ি ফেরার সময় শুনতে পেতাম মা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছেন রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, বা অন্য কোন গান, আর বাপি তবলা বাজাচ্ছেন। আমারাও গিয়ে বসে পড়তাম। দিদি আর কেয়া ভাল গান গাইত। দিদি বাপির কাছ থেকে শেখা দাদরা চৈতি (উত্তরপ্রদেশ-এর লোকগীতি) গাইতে বেশি ভালবাসত। কেয়া ওই বয়সেই গানের প্রতিযোগিতায় সবসময় ফার্স্ট হত। বাপির তবলার হাত ছিল অসাধারণ।
আঁতপুর স্কুলের পড়া শেষ করে ভর্তি হলাম ইছাপুর গার্লস হাইস্কুলে। ইছাপুর E.S.D থেকে বেশ দূর তাই আর হাঁটা নয় , পাবলিক বাসে স্কুল যাওয়া আসা।
ক্রমশ