আগের পর্ব দিনগুলি মোর(১), দিনগুলি মোর (২), আগের স্মৃতিচারণ ফিরে দেখা
দিনগুলি মোর
স্বপ্না লাহিড়ী
রবিবারটা আমাদের খুব মজার দিন হত। না, রবিবার মানে দেদার খাওয়াদাওয়া বা বাইরে রেস্তোরাঁতে গিয়ে খাওয়া—তা ছিল না। রেস্তোরাঁ ব্যাপারটা আমরা তখন জানতামই না। মাঝে মাঝে বাপি পাঁঠার মাংস রাঁধতেন বা কিমার গ্যেটো বা পাই। সেদিন এক হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার হত।
সকাল সকাল পড়াশোনা সেরে বাড়ির ছোটোরা দৌড়তাম সুইমিং পুলে। ছুটির দিন সকালবেলাটা সুইমিং পুল থাকত আমাদের মানে ছোটোদের এক্তিয়ারে, কয়েকজন বড়োও অবশ্য থাকতেন আমাদের ওপর নজরদারি করতে। ছোটো বোন জয় তখন বেশ ছোটো। সে আসত কাকুর সঙ্গে। কাকু সাঁতার কাটতেন আর সে তাঁর পিঠে চেপে থাকত। পরে অবশ্য সেও সাঁতার শিখে গিয়েছিল। সেদিন কোনও অনুশীলন নয়, শুধু মজা। আমারা জল তোলপাড় করে পুলের এপার থেকে ওপার সাঁতার কাটতাম, ডগস ক্রল, বাটারফ্লাই বা সাইড রোল। মাঝে মাঝে ডুবসাঁতার দিয়ে কোথাও জলের ওপর ভুস করে ভেসে ওঠা। ক্লান্ত হয়ে গেলে চিত সাঁতার। কেয়া খুব ভালো জলের ওপর ভাসতে পারত, হাত-পা না নাড়িয়ে শুধু ভেসে থাকা। আমি কোনোদিনও সেটা রপ্ত করতে পারিনি।
বিকেলবেলা একটু গানবাজনা, তারপর পড়তে বসা। মজা হত পিসিমণিরা এলে। বাপিরা ভাইবোনেরা বড়ো হয়েছিলেন কুমায়ুনের কাছে নাগপানি বলে একটা জায়গায়। কুমায়ুনি ভাষাটা প্রায় ওঁদের মাতৃভাষার মতোই ছিল। পিসিরা এলে ওঁরা কুমায়ুনি ভাষাতেই কথা বলতেন, তিন ভাইবোন মিলে রুমাল আর আঁচল দুলিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচতেন আর ‘ডোটিয়ালি’ গান গাইতেন ‘আরে ভসাই রে ভস্য এ ভস্য’। কী অনাবিল আনন্দ তাঁদের মনে। কখনও গাইতেন ‘ছানা বিলোরি ঝন দিয়ো বইজু লাগলো বিলোরি কা ঘামা, নাখে কা নাথুলি নাখে মে রউলি লাগলো বিলোরি কা ঘামা’, বা ‘বেড়ু পাকো বারো মাস্যা’।
রাতেরবেলা বসত বাপির কাছে গল্প শোনার আসর। আমাদের বাড়ির সামনের টানা বারান্দায় মা, বাপি, ঠাকুমা বসতেন আরাম চেয়ারে আর আমরা মাটিতে। বাপির গল্প মানে তাঁর অসামান্য ঘটনাবহুল জীবনের টুকরো টুকরো কথা। বাপি আরম্ভ করতেন, “আমার পোস্টিং তখন নাগপানিতে। একবার দিল্লি থেকে কাজ সেরে ফিরছি, বেরিলিতে নেমে কাঠগোদামের ট্রেন ধরতে হবে। কাঠগোদাম শেষ স্টেশন, তারপরে আর রেললাইন নেই, গাড়িতে যেতে হয়। দিল্লিতে দু-দিনের কাজ ছিল বলে গাড়িটা স্টেশনেই রেখে এসেছিলাম। দিল্লি স্টেশনে বিছানা-বাক্স নিয়ে ইন্টার ক্লাসে চেপে বসলাম। শীতের রাত, কনকনে ঠাণ্ডা পড়েছে। কাঠের জানালা খুলে কাচের জানালাটা বন্ধ করে রেখেছিলাম যাতে স্টেশনের নাম দেখতে পাই, মাঝরাতে বেরিলি পৌঁছব। অত ঠাণ্ডা সত্ত্বেও বিছানা খুলিনি যদি ঘুমিয়ে পড়ি! কিন্তু ক্লান্ত ছিলাম, বসে-বসেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই হাতঘড়িতে দেখলাম রাত দুটো বাজে। সর্বনাশ! যা ভয় পেয়েছিলাম তাই হল হয়তো, বেরিলি পেরিয়ে গিয়েছি নিশ্চয়ই। কামরা প্রায় ফাঁকা, দুয়েকজন যাত্রী কম্বল মুড়ি দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। রাতের ট্রেনে লোকজন কমই থাকে। একে ডিসেম্বরের কনকনে ঠাণ্ডা তার ওপর সুলতানা ডাকুর ভয়।”
ছোট্ট জয় ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “সুলতানা ডাকু কে, বাপি?”
বাপি হেসে বললেন, “তার গল্প আরেকদিন বলব।”
বাকি সবাই সমস্বরে বলে উঠল, “তারপরে কী হল?”
বাপি বলতে থাকলেন, “সামনের বসা ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, বেরিলি পেরিয়ে গেছে কি না জানেন আপনি? তিনি বললেন, বেরিলি তো পেরিয়ে গেছে তা প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হয়ে গেছে, এ ট্রেন লখনউ যাচ্ছে। আমার তো মাথায় হাত, এখন কী করি? ভাবতে ভাবতে ট্রেনের গতি কমে এল। আমি তাড়াতাড়ি বাক্স-বিছানা নিয়ে দরজার কাছে এসে পৌঁছতে ট্রেনটা থেমে গেল। আমি নেমে পড়তেই ট্রেন ছেড়ে দিল। একটা ছোট্ট ফ্ল্যাগ স্টেশন, চারদিকে ঘন জঙ্গল, তার মাঝে স্টেশন মাস্টারের ঘর। টিমটিম করে একটা গ্যাস বাতি জ্বলছে একপাশে। স্টেশন মাস্টার সবুজ ঝাণ্ডা নাড়িয়ে ট্রেন ছেড়ে দিতেই তিনি ও তাঁর কুলিটি দরজায় তালা লাগিয়ে বাড়ির পথে পা দিলেন। আমি দৌড়ে গিয়ে তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা দু’জনেই কি চলে যাবেন? কুলিটি বলল, সাব, পরশু দিনের বেলাতেই বাঘ একটা কুলিকে তুলে নিয়ে গেছে, আমরা এখানে থাকব না। আমি বললাম, ঘরটা অন্তত খুলে রেখে যাও। স্টেশন মাস্টার বললেন নিয়ম নেই। বললাম, আমি কোথায় থাকব? জবাব না দিয়ে তারা একটা লন্ঠন নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল আমাকে একা রেখে। অগত্যা স্টেশনের একমাত্র বেঞ্চটাতে ধুপ করে বসে পড়লাম। ওদের লন্ঠনের আলোটা মিলিয়ে যেতেই নিকষ কালো অন্ধকার আর চারদিকের ঘন জঙ্গল আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুধু কুয়াশার মধ্যে আবছা আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল গ্যাস বাতিটা। প্রচণ্ড ভয় লেগেছিল সেদিন। কিন্তু ভয় পেলে তো মরার আগেই মরে যাব। কী আর করি, বেঞ্চের ওপর বেডরোলটা বিছিয়ে ভগবানের নাম নিয়ে শুয়ে পড়লাম। মাথার ওপর দিয়ে কর্কশ স্বরে ডাকতে ডাকতে নিশাচর পাখি উড়ে গেল। দূরে হায়নার ডাক শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু বাঘের ডাক শোনা যায়নি। হয়তো পেট ভরা তাই ঘুমোচ্ছে কোথাও। সকালবেলা কুলিটা ধাক্কা দিয়ে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বলল, উঠিয়ে সাব, আপকা ট্রেন আনেওয়ালা হ্যায়।”
ঠাকুমা সগর্বে বললেন, “জানিস মকাইয়ের (বাপির ডাক নাম) বয়স তখন মাত্র কুড়ি বছর।”
ক্রমশ