আগের পর্ব দিনগুলি মোর(১), দিনগুলি মোর (২), দিনগুলি মোর(৩) আগের স্মৃতিচারণ ফিরে দেখা
দিনগুলি মোর
স্বপ্না লাহিড়ী
আমাদের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে, আসছে বছর আমার ক্লাস টেন হবে। এত বছর টানা এক জায়গায় এর আগে আমরা কোথাও থাকিনি। মা ঠাকুমা এই নিয়ে প্রায়ই উদ্বেগ প্রকাশ করতেন। বাপি একদিন অফিস থেকে এসে বললেন “এবার তল্পি তল্পা গোটাবার সময় এলো বলে, বদলির লিস্ট আসছে।” মনটা হুহু করে উঠল। আমাদের প্রিয় বন্ধু E.S.D-কে ছেড়ে চলে যেতে হবে!
দৌড়ে চলে গেলাম ঝিলের ধারে সেই গাছটার নিচে যেখানে দুটো ডিঙি নৌকো উপুড় হয়ে রোদ্দুরে শুয়ে আছে। ধপ করে বসে পড়লাম গাছটার নীচে, চোখের জল ঝিলের হাল্কা ঢেউ তোলা জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কিন্তু এ তো জানাই ছিল, জীবন তো চলতে থাকবে। সন্ধে হয়ে আসছে, ফিরে এলাম বাড়ি। মা আমার চোখ মুখ দেখে বুঝতে পেরেছিলেন নিশ্চয়, শুধু জিজ্ঞেস করলেন “ঝিলের ধারে গিয়েছিলি?”
E.S.D র কথা আর একটু বলে, আবার চলব সামনের পথে।
E.S.D তে আমাদের ছোটবেলাটা বড় বৈচিত্রপূর্ণ ছিল। সেখানে যেমন swimming pool, rowing club ছিল তেমনই ছিল লাল সুরকির রাস্তা ঘেরা আমবাগান, জামবাগান। গরমের ছুটি কাটত হয় ঝিলের ধারে নয় আমবাগানে গাছে চড়ে কচি কচি আম নুন লঙ্কা দিয়ে খাওয়ার আনন্দ নিয়ে। গ্রামের স্নিগ্ধতার সঙ্গে আধুনিকতার এক অদ্ভুত মিশেল ছিল সেখানে। শীতকালে যখন সন্ধে পেরিয়ে রাত নেমে আসত তখন আমরা কাকুর সঙ্গে গলা ছেড়ে গান গাইতাম, কিম্বা দাদামনির সঙ্গে মাঠে বসে ঝকঝকে তারাভরা আকাশ দেখতাম। দা’মনি বলতেন “আকাশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত যে সাদা আলোর পথটা চলে গেছে, ওটা হল ছায়াপথ যেটাকে ইংরাজিতে বলে milky way। এই ছায়াপথেরই কোন এক জায়গায় আমাদের পৃথিবীর অবস্থান।”
আমরা ভাবতাম ওই যে জোনাকির মত তারা ভরা আকাশ, হাত বাড়ালেই মনে হয় তারাগুলো ছোঁয়া যাবে সেখানেই আমাদের বাস? দা’মনি বলতেন “ওই দেখ যে তারাগুলো ব্লিঙ্ক করছে ওরা নক্ষত্র আর স্থির উজ্জ্বল তারাগুলো গ্রহ। দেখাতেন ভেনাস, জুপিটার, লাল গ্রহ মঙ্গল, হাতে তিরধনুক পায়ের কাছে কুকুর লুব্ধককে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাতের কালপুরুষ, সপ্তর্ষি ক্যাসিওপিয়া আরও কত তারা ও তারামণ্ডল। আকাশের রহস্য আরও ঘনীভূত হত আমাদের কাছে।
এখানেই হয়েছিল আমাদের রাতের দুনিয়াটাকে ভালবাসার প্রথম হাতেখড়ি। আমার ছোটবেলার পথ ধরে কালের নৌকোয় পাড়ি দিয়ে অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে এসেছি, এখনও আমাকে রাতের আকাশ মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে।
স্মৃতির রাস্তার আবছা আলো ধরে আবার খানিকটা পিছিয়ে যাই, যাই সেই মাঠটার কাছে যার সঙ্গে আমাদের বিশেষ একটা বন্ধুত্ত ছিল। এখানেই ভর দুপুরে বন্ধুরা মিলে চু-কিতকিত খেলা, চোর চোর খেলা, লুকোচুরি খেলায় আমরা মত্ত থাকতাম। কখনো কখনো তারার আলোয় মাঝ রাত্তিরেও দিদিদের দল আর আমাদের দল মিলে চু-কিতকিত খেলতাম। কত গল্প, কত নাচগান, ঝগড়াঝাঁটির সাক্ষি আমাদের এই মাঠ।
ততদিনে উঁচু ক্লাসে উঠেছি। তখন সেভেন কি এইট হবে, সবে একটু একটু গরম পড়ছে, মর্নিং স্কুল তখনও শুরু হয়নি, বিকেলে খেলার পরে মাঠে বসে আমরা গল্প করছি, একসময় রানু বলল, “এবার বোশেখ মাসে আমি পুজো করব। মা বলেছেন বোশেখ মাসে ছোট ছোট মেয়েদের পুজো করতে হয়।” ছোটবোন কেয়া বলে উঠল, “বোশেখ মাসে আবার কী পুজো? অন্য মাসে হয় না?”
রানু বলল, “না রে অন্য মাসে হয় না।”
কেয়া জিজ্ঞেস করল, “এটা কী পুজো?”
রানু মাঠের নরম ঘাসে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “এটা ব্রতকথা, পুণ্যিপুকুর, দশ পুত্তুল, আর গঙ্গামাটি দিয়ে শিবঠাকুর গড়ে তার পুজো।”
কেয়া ছটফটে মেয়ে, এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে ফ্রক থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “এ আবার কী পুজো রে? দুর্গাপুজো, কালীপুজোর নাম শুনেছি, এ-পুজোর তো নামই শুনিনি! আর এখানে শিবের মন্দিরই বা পাবো কোথায় আর ব্রতকথাই বা কী?”
রানু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “ব্রতকথাও একটা পুজো আর এসব পুজো নিজে করতে হয়।”
সান্ত্বনা ঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তা পুজোর মন্ত্র পাবো কোথায়?”
রানু বিজ্ঞের মত বলল, “আমি তোদের শিখিয়েপড়িয়ে নেব না হয়।”
সেদিনের মত আর কথা এগোল না, সন্ধে হয়ে আসছে, দূর থেকে ভেসে আসছে ফ্ল্যাগ মাস্ট থেকে ফ্ল্যাগ নামানোর bugle ধ্বনি last post-এর, আমরা যে যার বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
ফটোগ্রাফ:লেখক
ক্রমশ