পুরনো কলকাতার গপ্পো
জয়তী দাস
১১/১ সরকার বাড়ি লেন, বাগবাজার, কলকাতা-৩
হোস্টেল থেকে এই ঠিকানাতেই বাড়িতে চিঠি লিখতাম।
পুরনো কলকাতার বাগবাজারে ছিল আমাদের বাড়ি আর মামার বাড়িটাও ছিল সেখান থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে, শ্যামবাজারে। মোটামুটি উত্তর-দক্ষিণ এই দুই ভাগে নতুন-পুরনোর সমন্বয়ে নানান বৈচিত্র্যে ভরা এই কলকাতা শহরটি। দক্ষিণের চকচকে চেহারার তুলনায় আমাদের উত্তর কলকাতার চেহারা বেশ মলিন। তবে সেই সময়কার সব বিশাল ব্যক্তিত্বদের কর্মভূমি কিন্তু এই পুরনো কলকাতাই।
বাগবাজারের আমাদের এই বাড়িটা কে যে কবে তৈরি করেছিলেন তা সঠিক জানা নেই। শুনেছিলাম তখনকার কর্ণপুর এখনকার চুঁচুড়াতে আমাদের জমিদারি ছিল একসময়। সূর্যাস্ত আইনে জমিদারি উচ্ছেদ হওয়ার পরে ভাগ্য অন্বেষণে আমাদের কোনও পূর্বপুরুষ নাকি নদীপথে কলকাতায় এই বাগবাজারে আসেন, তারপরে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের জমিদারিতে কাজ শুরু করেন। পরে তাঁরই অনুগ্রহে এই জমিটুকু আমাদের পাওয়া। বাবা-কাকাদের মিলিয়ে আমাদের বাড়িটা চিৎপুর রোড থেকে সেই গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত চলে গেছে। বাড়ির ছাদে উঠলেই গঙ্গা দেখতে পেতাম। দুই বাড়ির মাঝের নিচু পাঁচিল টপকাতে টপকাতে ছাদ ধরে ধরে প্রথম বাড়ি থেকে সেই শেষ বাড়িটা পর্যন্ত চলে যাওয়া যেত।
আমরা বরাবর কলকাতার বাইরেই থাকতাম। স্কুলের ছুটি হলেই মস্ত ট্রাঙ্ক আর বেডিং গুছিয়ে চলে আসতাম কলকাতায়। প্রথমটায় উঠতাম কিন্তু সেই মামার বাড়িতে। আমার বাগবাজারের বাড়িতে থাকতেন আমার ছোড়দাদু আর মাম্মা। ছোড়দাদু বেশ মানুষ ছিলেন। মাথায় অনুপম খেরের মতো চকচকে একটা টাক, তবে বিধাতা একেবারে বঞ্চিত না করে কানের দু’পাশে দু’গাছা করে চুল দিয়েছিলেন। দাদু তাকে যত্ন করে আঁচড়িয়ে দু’আঙুলে একটা বড়ির মতো ছোট্ট খোপা করে রাখতেন মাথার পেছনে। দাদু বৈষ্ণব ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। গলায় কন্ঠি, কপালে রসকলি, খাটো ধুতির উপরে হাত কাটা ফতুয়া, পায়ে খড়ম, হুঁকো খেতেন আর ছিল লম্বা সাদা দাড়ি। এক্কেবারে হ য ব র ল-র উদো-বুধোর চরিত্র। দাদুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেই বলতেন, ‘দিদিভাই, মামার বাড়িতে কেন, আমাদের কাছে এসে থাকবে না?’ আমি বলতাম, ‘না দাদু। তোমার এখানে বেসিন নেই, আমার হাত ধুতে গেলে ফ্রক ভিজে যায়।’
মামার বাড়িটাও একইরকম পুরনো ছিল, কিন্তু শুধু ওই একটা বেসিনের জন্য আমার বাগবাজারের বাড়িটা মামার বাড়ির কাছে বারবার কম্পিটিশনে হেরে যেত। মামার বাড়িতে আমার দিদার ঘরে ছিল দেওয়াল জোড়া বিশাল এক আয়না। দিদা এগারো বছর বয়সে বউ হয়ে এসেছিলেন এই বাড়িতে; দাদু চাকরি করতেন মিলিটারিতে। তাই বাড়ির বাইরে থাকতে হত। ছুটিতে যখন আসতেন তখন তাঁর ছোট্ট বালিকাবধূকে অনেক কিছুর লোভ দেখিয়েও কাছে টানতে পারতেন না। একবার দাদু নাকি দিদাকে জিজ্ঞেসা করেছিলেন, ‘বলো কী চাই তোমার আমার কাছ থেকে?’ দিদা নাকি বলেছিলেন, ‘আমাকে একটা মস্ত আয়না দেবে, যেটাতে সেজে দাঁড়ালে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখা যাবে।’ বালিকা বধূর সেই আবদার রাখতে দাদু তাঁদের শোবার ঘরে লাগিয়ে দিয়েছেন একটা মস্ত বেলজিয়াম কাচের আয়না। ভীষণ সুন্দর নকশা করা কালো ফ্রেমে বিশাল আয়নাটা চেইন দিয়ে দিদার ঘরে টাঙানো ছিল। আমরা যতদিন পর্যন্ত দেখেছি, আয়নাটা একইরকম ঝকঝকে ছিল, কোথাও তার এতটুকু দাগ ধরেনি।
একবার কোনও একটা কারণে আমার এক বান্ধবীর ননদের বাড়িতে গেছি আমাদের মামার বাড়ির ঠিক উলটোদিকে। সেটিও পুরনো বাড়ি। কলিং বেল বাজিয়ে গলিতে দাঁড়িয়ে আছি দরজা খোলার অপেক্ষায়। ওপর থেকে একটা গলার আওয়াজ পেয়ে তাকিয়ে দেখলাম, মাসিমা আমাকে ভেতরে আসতে বলছেন। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলাম দরজায় একটা দড়ি বাঁধা খিল রয়েছে। দড়ি বরাবর চোখটা ঘুরিয়ে দেখলাম দড়িটা চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে একতলা দু’তলা হয়ে সেই তিনতলায় মাসিমার হাতে আটকে আছে। বুঝলাম বাড়িতে মাসিমা একা রয়েছেন, তাই এই ব্যবস্থা। Necessity is the mother of invention কথাটার মানে সেদিন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলাম।
বাবার রিটায়ারমেন্টের পরে আমরা পাকাপাকিভাবে বাগবাজার বাড়িতে থাকতে লাগলাম। তখনকার বাড়িগুলো গঠন সৌকর্যে প্রায় একইরকম হত। বাড়ির সব কাজকর্মে তখন উঠোনের একটা মস্ত ভূমিকা থাকত, তাই ঘরগুলো নিচের তলা থেকে ওপরপর্যন্ত ঐ উঠোনটাকে ঘিরে ঘিরে তৈরি হত।
থাকতে থাকতে আবিষ্কার করলাম বাড়িটার আনাচে-কানাচে কত কোণ, কত পুরনো সব জিনিস। সব ঘরে কাচ দেওয়া দেওয়াল আলমারি, দাদুর ঘরে কুলুঙ্গি, সেখানে সিঁদুর মাখা ঠাকুর, কড়ি। যেখানেই হাত দিতাম পেয়ে যেতাম আশ্চর্য একটা কিছু। কয়েক জেনারেশনের সংগ্রহ করা সব জিনিসপত্রে বাড়িটা ঠাসা ছিল। শোবার ঘরের আলমারিটার ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত সব তাকেই পোর্সেলিনের জিনিস দিয়ে সাজানো ছিল। উপরের তাকে ছিল শিব, দুর্গা, গণেশ সব ঠাকুরের মূর্তি, নিচের তাকে অদ্ভুত সব সুন্দর সুন্দর সাহেব-মেম পুতুল, ভিক্টোরিয়ান পোশাক পরা কী অপূর্ব যে সব পুতুলগুলো ছিল কী বলব! মাঝের একটা তাকে পেয়ে গেলাম বেতের এক ঝুড়িভর্তি খেলনাবাটি। সেগুলো কিন্তু হয় পোর্সেলিন, নয় কালো পাথরের তৈরি। যেটা খুব আশ্চর্যজনক ব্যাপার, এইসব বাসনগুলো কিন্তু ছিল আসল বাসনপত্রের স্কেল মডেল, তাই কোনও বাসনেই কোনোরকম অসামঞ্জস্য ছিল না। আমি সেগুলো নিয়ে জমিয়ে সংসার করতাম। একদিন এইভাবেই দাদুর ঘরের কুলুঙ্গি থেকে পেলাম এক আঙুলের মতো লম্বা হাতির দাঁতের তৈরি দুটো সরু কাঠির মতো জিনিস। পরে জেনেছিলাম ওগুলো পাশা খেলার বাট, যে দুটো জিনিস দু’হাতের তালুতে নিয়ে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে দান ফেলে ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে শকুনি পাণ্ডবদের খেলায় হারিয়ে রাজ্যচ্যুত করেছিলেন, সেইরকম।
চিৎপুর থেকে আমাদের সরকার বাড়ি লেন দিয়ে টুক করে গঙ্গার ধারে চলে যাওয়া যেত। বাগবাজারের ঐ অঞ্চলের আশেপাশেই ছিল ঠাকুরের শিষ্য বলরাম বসু, নাট্যাচার্য গিরীশ ঘোষ, সারদা মায়ের বাড়ি। শুনেছি আমাদের ঐ সরকার বাড়ি লেনে নাকি ঠাকুর-মায়েরও পায়ের ধুলো পড়েছিল কখনও।
দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল। বাগবাজার সর্বজনীন, কুমারটুলি, শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো, এসব জায়গায় ঠাকুর দেখে আমাদের পুজোটা বেশ আনন্দে কাটত। বাগবাজার সর্বজনীনের ঐতিহ্যশালী ডাকের সাজে ঝলমল করা প্রতিমা দেখে দেখে আশ মিটত না আমাদের। শুনেছিলাম সুভাষচন্দ্র বসু নাকি কখনও এই পুজোর প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
পুজোর চারদিন আনন্দে কাটানোর পরে এসে যেত বিজয়া দশমী। এবারে প্রতিমা বিসর্জনের পালা। সেদিন ঠিক বিকেল চারটের সময় আমরা বাড়ির সামনের বিশাল ভারী সদর দরজাটা কয়েকজন মিলে ঠেলে খুলে সামনে গিয়ে রাস্তায় ওপরে দাঁড়াতাম। সবথেকে আগে ভাসান হবে শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুর। দেখতাম সবার আগে একজন পেয়াদা গোছের লোক হেঁটে আসত। তার হাতে একটা লাঠির ওপরে বসে থাকত একটি নীলকন্ঠ পাখি। ওই পাখিকে আগে আকাশে উড়য়ে দেওয়া হত। সে নাকি কৈলাসে গিয়ে শিবঠাকুরকে মার ফিরে আসার আগাম খবর দিত। তারপরে রাজবাড়ির সব সদস্যরা ঠাকুরের সঙ্গে খালি পায়ে রাস্তায় হেঁটে ঠাকুর নিয়ে যেতেন গঙ্গায় বির্সজন দিতে। এরপরে ওই অঞ্চলের অন্যান্য ঠাকুরের বিসর্জন হত। এমনই ছিল রীতি। তারপরে লক্ষ্মীপুজোর পরপরই কালীপুজো এসে যেত হুড়মুড়িয়ে।
কালীপুজোর দিন মাকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম সেদিন মোড়ের মাথায় কালী মন্দিরে পুজো দিতে। আমাদের গলিতেও প্যান্ডেল বেঁধে পাড়ার ছেলেরা পুজো করেছে দেখলাম। সন্ধ্যা হয় হয়। বাড়ি ফিরছি। গলির মুখে পাড়ার ছেলে পল্টু কাছে এসে বলল, “মাসিমা, কেমন ডেকরেশন করেছি দেখেছেন?”
আমাদের বাড়ির সামনের অংশটা আমার দুই কাকা অনেকদিন ছেড়ে চলে গেছেন। দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে বাড়িটা বটগাছ আর নানান আগাছায় ভরে গিয়ে একটা ভৌতিক রূপ নিয়েছিল। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি ওরা সেখানে বেশ কয়েকটা সাদা সাদা কাগজের কঙ্কাল ঝুলিয়ে দিয়েছে। আমার মায়ের মুখটা একটু মলিন হতে দেখলাম। চোখে কি একটু জল চিকচিক করে উঠল? মার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললাম, “চলো মা, বাড়ি চলো।”
বাড়ি এসে দরজার খিল লাগাতে লাগাতে শুনি পাড়ার প্যান্ডেলে উমরাও জান সিনেমার গান বাজছে—
ইয়ে ক্যায়া জগহ হৈ দোস্তোঁ, ইয়ে কৌন সা দয়ার হৈ
হদ-এ-নিগাহ তক জহাঁ গুবার হী গুবার হৈ…
আমার বুকটাও কি একটু মোচড় দিয়ে উঠল?
দারুণ লাগলো ।
LikeLike