আজব খাতা হুমোর ডায়েরি তপোব্রত মুখার্জি বসন্ত ২০১৭

humo01-medium

বললে তো পেত্যয় পাবে না, ওদিকে না বললে যে কী হবে! ও বাবা, থাক- সে কথা বলে কাজ নেই। এখন যা বলার বলি, শোন।

সেই সেবার গেলাম সিকিম, সেই সময়ের কথা। তো গেলাম যখন ওখানে বরফ পড়ে, গাছপালার পাতা ঝরে যায়। লোকজন নেমে আসে। এই লোকজনের নামা ব্যাপারটা আগে জানতাম ঠাণ্ডার জন্য, গিয়ে শুনি সে অন্য ব্যাপার। যারা নামে, তারা চলে আসে হুমোর ভয়ে। অবশ্য হুমোকে তারা কোনদিন দেখেনি। আবার বেশ কিছু লোকজন থেকেও যায়। তারাও নাকি থেকে যায় হুমোর ভয়ে। তারাও আবার হুমোকে দেখেনি। কিন্তু না থেকে গেলে হুমো ঢুকে তাদের দেখতে না পেয়ে সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে যাবে। সে আরেক বিপদ।

আমরা পড়লাম ফ্যাসাদে। গেছি বরফের জায়গায়। এ কি আর আমাদের শহর-মফস্বল যে চাইলাম আর যে কোন জায়গায় মাথা গুঁজে নিলাম? ওখানে বাড়িঘর তো বেশি নেই। তাতেও আবার এসব হুমো-টুমো কীসব বলছে। ঘুরতে গিয়ে শেষে প্রাণ হাতে ফিরব তো? নাকি সে’সব হুমোর পেটে…

যাকগে, দেখা হল এক বুড়োর সাথে। সে তার বুড়িকে সেই গ্যাংটকে রেখে আসছিল। সে বলল যে হুমো আসলে ইয়েতির ঠাকুরদা। তার নাতি-নাতনি সব ইয়েতি। এই শীত পড়লে নাতি-নাতনি বেড়াতে আসে, তাই ঠাকুরদা একটু এদিক-ওদিক থেকে নাকি তাদের উপহার জোগাড়পাতি করে নিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করলাম, “মানুষও নেয়?”… লোকটা আমায় দেখে বলল, “নিতে পারে। নরম মানুষের রোস্ট করে দিলে ইয়েতিরা কিছু বলবে না। বায়না না করে খেয়ে নেবে।”

শুনে কেমন লাগল। একটু টিপে টুপে দেখে নিলাম আমি নরম কিনা। বুঝলাম না ভালো। যাকগে, সে রাতে ঠিকানা হল বুড়োর কুটির। একচালা ঘর। আমি বলে দিয়েছিলাম যাতে বুড়ো ভালো করে দরজা এঁটে শোয়। কে জানে বাপু, কখন কী হবে বলা যায় না তো!

তো, যাই হোক, ঘুমোচ্ছি। গরমজামা গায়েই। বুড়ো এক ধুনি জ্বেলেছিল, তার থেকেও বেশ ওম এসেছে। হঠাৎ পাশ ফিরলাম অভ্যেসমত। এমনিতে তো পাশবালিশ নিয়ে শোয়া অভ্যেস, তো পাশ ফিরতেই প্রথমে মনে হল পাশবালিশ বুঝি। তারপরই মনে হল, না তো! এ তো বরফের দেশ, এখানে পাশবালিশ কে দেবে? আর পাশবালিশও তো বড় বেশি নরমসরম! তবে?

ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠলাম। উঠে দেখি, সব্বোনাশ। কী যেন একটা সাদামতো পাশ ঘেঁষে শুয়ে। দেখেই তো এক্কেবারে প্রাণ-ফান খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়! আকাশ ফাটিয়ে “বাবা রে, মা রে, দাদু রে, হুমো রে” বলে ডাক পাড়তে গিয়ে দেখি গলায় আওয়াজই আসে না!! এবার? কোনোভাবে হাঁচোড়পাঁচোড় করে উঠে বুড়োকে মারলাম রামধাক্কা। সে আবার কুম্ভকর্ণের বংশধর। শেষে তেড়ে উঠে এক রদ্দা মারতে পিটপিটিয়ে জেগে বলল “বাবু, ডাকছেন বুঝি?”

আমি আর কী বলব, শব্দই তো বেরোচ্ছে না! ওই পাশবালিশের দিকে দেখিয়ে দিলাম। বুড়ো একটু উঠে টর্চ জ্বেলে একটু পিটপিট করে চেয়ে বলল, “বুঝছি না।”

তারপর কী ভেবে আবার দেখল। একবার সামনে গিয়ে, তারপর দূর থেকে, আবার পাশে গিয়ে। এরকম হরেক প্রকার দেখা শেষ হলে নিদান দিল, “বুঝলেন বাবু, ইয়েতি ছানা।”

আমার তখন হয়ে গেছে। অন্ধকারে দরজার আগল খুঁজছি। বাকিদের খোঁজটোজ করতেই গেলাম না। ওরা কি আর আছে যে খুঁজব? নিশ্চিত হুমোতে নিয়ে গেছে আর সঙ্গে করে আসা ছানাখানা রয়ে গেছে। একে খুঁজতে এই এল বলে! আমায় দেখলেই রোস্ট বানাবে। আমায় আবার রোস্টের মতই দেখতে! বাবা … আমি পালাব!

ওই হুড়যুদ্ধির মাঝে দেখি আবার কিসের হাউমাউ আওয়াজ! আমি আরও জোরে জোরে আগলের গোড়ায় টান দিচ্ছি। বুড়ো কী বলে যেন চেঁচাচ্ছে, কিন্তু সে এখন শুনবে কে!

যাক… ওই করে তো কিছুক্ষণ কাটল। বেরনো হল না, টানাটানি সার (পরে দেখি আগল নয়, একখান থামের গায়ের থেকে বের হয়ে আসা কাঠের টুকরো ধরে টানছিলাম) কেউ এসে টপ করে একটা লাইট জ্বেলে দিতে সব তুম্বো মুখে চাইলাম।

কেউ কোত্থাও যায়নি…মানে কিছুতে নিয়ে যায়নি কাউকে (অখাদ্য কিনা, কেউ পাতে নেয় না) আমিও ঠিক। মাঝখান থেকে শুধু অতিরিক্ত ওই পাশবালিশ। না, পাশবালিশ না, ওই, ইয়েতি!

আমিই প্রথম বললাম, “ও কী? ও রয়ে গেল যে। কী হবে?”

“ও থাকবে বাবু। ও পালিয়ে এসেচে।”

“অ্যাঁ! ইয়েতির বাচ্চা পালায়? মানে এ কি সত্যি ইয়েতি, মানে…” বিশ্বাস হছিল না। মানুষের বাচ্চা পালায়, ত্যাঁদোড় বাচ্চা। তা বলে ইয়েতি-ও?

যাক গে, বুড়ো বলল যে ইয়েতিও পালায়। তবে মনের দুঃখে বা নায়ক-নায়িকা হবে বলে নয়, সেই উপহার না পেলে। এও পালিয়েছে। পালালে আবার আরেক মুশকিল। কারণ দাদু হুমো এখন খুঁজতে আসবে না। আসবে বছর কয়েক পর। এটাই ওদের নিয়ম। তখন যদি ভালোয় ভালোয় পেয়ে গেল তবে মিটে গেল। নয়তো লঙ্কাকাণ্ড বাধাবে।

আমি বললাম, “ব্যস। তবে এইখানেই রেখে দাও। যখন আসবে, নিয়ে যাবে।” বুড়ো বলে, “না বাবু, সে হবার জো নেই। এখানে থাকতে দেওয়া যাবে না। অনেক হাঙ্গাম।” আবার নাকি বাইরেও রাখা যাবে না। তবে আর রক্ষে নেই। কি বিপদ!

ওদিকে যাকে নিয়ে এই এত্তোসব কথা, সে দেখি টুপটাপ চাইছে শুধু বসে। হু-হা কিচ্ছু বলে না। বেশ গোলগাল সে। নাক বলে কিছু নেই, একখানা নাক মনে করে নিলেই নাক আছে, নয়তো নেই। তার এসবের কিছুতেই কিছু মোহমায়া নেই মনে হচ্ছে।

তা আমরা বললাম, উপায় তবে? বুড়ো বলে, নিয়ে যান বাবু আপনাদের সাথে!

ওই দেখ, আহ্লাদ! এখন একে নিয়ে যাবো? এই বরফ থেকে ওই তাতাপোড়া গরমে ভেপ্সে গেলে? তারপর সে হুমোয় এসে আমাদের শ্রাদ্ধ করুক আর কি! বুড়ো বলল, “না বাবু। অদ্দূর হুমোয় যাবে না”

“তবে?”

“তবে আর কী?  নিয়ে যান!”

পাগল? একে নিয়ে যাব কোথায়? আমরা যারা ছিলাম তারা তক্ষুনি এই কচকচি থামিয়ে ভয়ানক রেগে ভাবলাম এক্ষুনি বেরিয়ে যাব। তাড়া বাঁধছি তাই, বুড়ো চেঁচাচ্ছে, কাকুতি করছে– শুনছি না, এমন সময় দেখি, কীসে আমার পায়ের পাশে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। চেয়ে দেখি, সেই পাশবালিশ… ইয়ে, মানে ইয়েতিছানা। কেলো হল! আমি তাকে হাত দিয়ে সরিয়ে আবার তাড়ার দিকে মন দিয়েছি, আবার সুড়সুড়ি!

এই চলল খানিকক্ষণ। শেষে ঠিক করলাম, ছানা আসবেন। কেউ রাজি ছিল না, কিন্তু আমি তাও বলে বলে রাজি করালাম। তারপর গাড়ি করে নামা হল পাহাড় থেকে, ট্রেন ধরা হল।

তারপর? ও বাবা… তারপর আজ চিঠি পেয়েছি। সেই বুড়োর। সে যে বেঁচে আছে দুঃসংবাদ দেবার জন্য তা কে জানত! সে ছানা এখন পুরোপুরি শহুরে মানুষ হয়ে গেছে, গাল ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় হিল্লি-দিল্লি, ইয়েতি বলে কেউ চিনবে না। কিন্তু সে এই কদিন আগে যেই না সিকিম গেছে, অমনি নাকি তার দাদু হুমো তাকে কোনখান থেকে দেখেছে! তারপরই যত গণ্ডগোল। এখানা লিখে রেখে গেলাম, ছানাকে খুঁজে পেলে যদি সে হুমো আমায়ও ধরতে আসে, যারা পড়বে তবে একটু খোঁজ কোরো কিন্তু… যদি পুরো না মরি, বেঁচে থাকি-টাকি, ফিরিয়ে এনো প্লিজ!!!

humo2-medium

পরের পাতা পরের জয়ঢাকে

অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর

জয়ঢাকের গল্পঘরে সমস্ত গল্প একসাথে পড়ো

1 thought on “আজব খাতা হুমোর ডায়েরি তপোব্রত মুখার্জি বসন্ত ২০১৭

Leave a comment