গল্প জ্বর গাছ চুমকি চট্টোপাধ্যায় শরৎ ২০১৯

চুমকি চট্টোপাধ্যায়ের আরো গল্প
আজব মানুষের গজব কাহিনী, ভগবানের বেটা বেটি, শুদ্ধ ভক্তের ঘড়ি

গাড়ি থামার আওয়াজ পেয়েই চেয়ারটা ধাক্কা মেরে সরিয়ে বারান্দায় দৌড়ল গুল্লু। চম্পক কাকু এল মনে হয়।

চম্পক কাকু গুল্লুর বাবার ছোটবেলার বন্ধু। কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক নীতি দপ্তরের বড় আমলা। এখন কেনিয়াতে আছে। কলকাতায় এলেই আধবেলা গুল্লুদের বাড়িতে কাটানো বাধ্যতামূলক। ব্যস্ত মানুষ, তাই আধবেলার বেশি আটকানো যায় না।

গুল্লুর বাবা সুপ্রিয় বলেন, “ তুই আগে ছিলি আমার বন্ধু, এখন হয়েছিস গুল্লুর বন্ধু।”

হ্যাঁ, ব্যাপারটা মিথ্যে নয়। যে পাঁচ- ছ ঘণ্টা গুল্লুদের বাড়িতে থাকেন চম্পক মৈত্র, তার সিংহভাগটাই কাটে গুল্লুর সঙ্গে গল্প করে।

দেশ বিদেশে কাটানো চম্পক কাকুর কাছে নানান ধরনের গল্প শুনে শুনে আশ মেটে না গুল্লুর। চম্পক কাকু আসবে শুনলে গুল্লুর মেজাজটাই কেমন রাজা রাজা হয়ে যায়।

খুশির আরো একখানা কারণ আছে অবশ্য। সেটা হল গিফট। হ্যাঁ, দারুণ দারুণ সব উপহার পায় গুল্লু তার চম্পক কাকুর কাছে থেকে।  গুল্লু তো বেশি বড় নয়, সবে তেরো বছর বয়েস। দু-তিন-চার বছর বয়েস অবধি তো বোধই আসে না। তাই তখন গিফট বলতে বিদেশি চকলেট, পেন্সিল, রঙ পেন্সিল  এইসব এনে দিত চম্পক কাকু।

আট বছর বয়েসে গুল্লু উপহার পেয়েছিল একটা রিমোট চালিত দমকলের গাড়ি। ওহ্! সেকি উত্তেজনা গুল্লুর তখন! রিমোটে গাড়ি চলে, থামে, সাইরেন বাজায়, আবার একজন পুতুল দমকলকর্মী জলও দেয়! যদিও আসলে সেটা সাদা আলো। কিন্তু এমন করে কায়দা করা যাতে জলের মতোই লাগে।

গুল্লুর কাছে আছে ছোট্ট নেপালী কুকরি যার খাপটায় রঙ বেরঙের পাথর বসানো। আছে কাক্কু টেবিল ঘড়ি। প্রতি ঘণ্টায় তো বটেই, অ্যালার্ম দিলে ঘড়ির মাথার কাছের খোলা জায়গা দিয়ে মোরগ বেরিয়ে ডাকাডাকি করে তুলেই ছাড়বে।  একটা ক্যালকুলেটর আছে যেটা কাগজের মতো পাতলা। এমন কত কি! গুল্লু প্রাণের জিনিস এগুলো। কাউকে ধরতে দেয় না। এমন কি ওর প্রিয় বন্ধু, সোমদেবকেও না।

এবারেও কিছু একটা নিশ্চয়ই আনবে চম্পক কাকু। সে আনুক কি না আনুক, চম্পক কাকু এলেই কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব হয় বাড়িতে। জবরদস্ত রান্না হয়। সব চম্পক কাকুর ফেভারিট আইটেম।

এক তো চম্পক কাকু বাবার ক্লাস টু- এর বন্ধু, তার ওপর ক্লাস টেনে পড়ার সময় কাকুর মা মারা যান। তখন ঠাম্মিই চম্পক কাকুর মা হয়ে যায়। তাছাড়া চম্পক কাকিমা নেই। মানে কাকুর বিয়ে হয়নি। তাই এ-বাড়িতে আসলে ঠাম্মি আর মা মিলে ঠেসেঠুসে খাওয়ায় কাকুকে। সে এক হইহই কাণ্ড হয়!

ছুটির দিন হলে সোমদেবকেও ডাকে গুল্লু। কিন্তু কেবল গল্প শুনতে, গিফট তক্ষুনি দেখায় না। অনেক পরে ধীরে সুস্থে দেখায়। ওর লোভ হতেই পারে, তাই সাবধানে ব্যাপারটা সামলায় গুল্লু।

এর আগেরবার চম্পক কাকু গুল্লুর জন্য খুব দামি ট্যাবলেট এনে দিয়েছিল। সোমদেবের জন্যেও একটা মাউথ অরগ্যান এনেছিল। ও ভালো বাজাতে পারে মাউথ অরগ্যান। অনেক ইন্সট্রুমেন্টই বাজাতে পারে। চম্পক কাকু সেটা শুনেছিল আর মনেও রেখেছিল।

সোমদেব তো আনন্দে পাগল পাগল হয়ে গেছিল।  তক্ষুনি ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’ গানটা বাজিয়ে শুনিয়েছিল। গুল্লুর কিন্তু একটু হিংসে হয়েছিল। চম্পক কাকু তো ওর কাকু, সোমদেবকে গিফট দেবার দরকার ছিল না তো!

পরে অবশ্য লজ্জা করেছে গুল্লুর। ছি ছি, এরকম হিংসুটে হওয়া মোটেই ঠিক নয়। ওকে তো অনেক বেশি দামের উপহার দিয়েছে কাকু। আর কখনো এমন বাজে কথা ভাববে না, নিজের কাছেই প্রমিস করে গুল্লু।

বারান্দায় বেরিয়ে গুল্লু দেখল চম্পক কাকুই এসেছে। মনটা কেমন হাওয়ার মতো ফুরফুরে হয়ে গেল ওর। সঙ্গে শরীরটাও। যেভাবে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামল গুল্লু, একমাত্র ঝড়ের সঙ্গেই তার তুলনা চলে।

“চম্পক কাকু-উ-উ,” বলে প্রায় জাপটে ধরতে গিয়ে গুল্লু দেখল, কাকুর হাতে একটা বেশ বড় প্লাস্টিক ব্যাগ। কাকু ডান হাতটা উঁচু করে ব্যাগটাকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে।

“এই যে গুল্লুবাবু, সব খবর ভালো তো?”

“হ্যাঁ, ভালো।  তোমার হাতের ওই প্লাস্টিকে কী আছে কাকু?”

“আগে ওপরে চল, তারপর বলছি। এতটা ট্রাভেল করে এসেছি তো, গায়ে রাজ্যের নোংরা। একটু স্নান করা দরকার।”

ওপরে এলেও কি আর সহজে স্নানে যাওয়া যায়! ঠাম্মি, মা, বাবার হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে দেরিই হয়ে গেল খানিক। এদিকে গুল্লুর তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে প্লাস্টিকের ভেতর কী আছে দেখার জন্য।

স্নান সেরে এসে চা আর ধনে পাতার বড়া নিয়ে জমিয়ে বসল চম্পক কাকু আর বাবা। ডাক পড়ল গুল্লুর।

“গুল্লু মাস্টার, এদিকে আয়।”

লাফিয়ে এল গুল্লু। এই মুহূর্তটার জন্যই তো বসে আছে। তেষ্টা পাওয়া সত্বেও জল খেতেই ভুলে গেছে বেচারা।

“বলো কাকু।”

“বাড়িতে বড় টব আছে?  বা গামলা? প্লাস্টিকের বালতি হলেও আপাতত চলবে।”

গুল্লু দৌড়ে গিয়ে মাকে জপিয়ে একটা মোটামুটি ভালো বালতিই নিয়ে এল।

“এতে হবে কাকু?”

“এখনকার মতো খুব হবে। পরে মাটির বড় গামলা মতো কিনে তাতে বসাতে হবে। মাটি পাওয়া যাবে?  আসার সময় দেখলাম খালপাড়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। ওই মাটি পাওয়া গেলে সবচেয়ে ভালো হত।কেউ আছে রে সুপ্রিয় এনে দেবার মতো?”

বাবা সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির পাশে যে ইস্তিরিখানাটা আছে,  তার মালিক সুখরামের ছেলেটাকে ডেকে একটা বড় প্লাস্টিক বাগ ধরিয়ে আর দশটাকা হাতে দিয়ে মাটি আনতে পাঠাল। গাছ সংক্রান্ত যে কিছু একটা ব্যাপার সেটা খানিকটা আন্দাজ করলেও, পুরোটা ধরতে পারছেনা এখনো। চরম কৌতুহল নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন চম্পক কাকু গিফটটা দেবে।

বালতি হল, মাটি হল, এবার সযত্নে রাখা প্লাস্টিকের ভেতর থেকে গুল্লুর কাঁধ অবধি লম্বা একটা গাছ বের করল চম্পক কাকু। কেমন সবুজে হলুদে মেশানো কান্ডটা, পাতাগুলো পালকের মতো। গুল্লু অবাক হয়ে দেখছিল।

“শোনো গুল্লুবাবু, আমি অফিসের খুব একটা জরুরি কাজে আটকে গেছিলাম। আসার আগে তোমার জন্যে যে পছন্দ করে কিছু একটা আনব, তার সময়েই পাইনি। আমার বাড়িতে যে ছেলেটা রাতদিন থাকে, সেই যোসেফ এই গাছটা এনেছিল আমাদের বাড়ির কম্পাউন্ডে লাগাবে বলে। আমি সেটা নিয়ে চলে এসেছি। এই গাছটার নাম ‘ফিভার ট্রি।’ ”

 “অ্যাঁ? ফিভার ট্রি? জ্বর গাছ?”

“হাহাহাহা, বাংলায় তাই হয় বটে। এই গাছ আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়, বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকাতে। কেনিয়াতেও স্যাঁতসেঁতে, জলা জমিতে এই গাছ প্রচুর।”

“ফিভার ট্রি নাম কেনো গো কাকু? এই  গাছের কী জ্বর হয়?” অপার বিস্ময় গুল্লুর চোখে।

“না রে, গাছের জ্বর হয় না। এই গাছগুলো যে অঞ্চলে হয় তার আশপাশের যারা বাস করে, তাদের প্রায় প্রায়েই জ্বর হত। তারা ভাবত এই গাছের কারণেই তাদের জ্বর হচ্ছে। তাই এই গাছের নাম দেয় ফিভার ট্রি।”

“সত্যি তাই হত কাকু?”

“আরে না রে। আসলে এই গাছগুলো যেখানে জন্মায় সে জায়গাগুলো জলাজমি বলে মশার উৎপাতও বেশি। তার থেকেই ম্যালেরিয়া। আর দোষ গিয়ে পড়ে এই গাছগুলোর ওপর। একবার দিয়ে ফেললে তা আর বদলায় না। কারণ জানা গেলেও, নামটা বদলায়নি।”

বালতিতে মাটি ভর্তি করে চম্পক কাকু যত্ন করে গাছটা লাগিয়ে দিল। বলল, “অন্য মাটি, অন্য পরিবেশে গাছবাবু বাঁচবে কিনা জানি না। একটু কেয়ার নিও গুল্লু। এবারের গিফটটা তোমার মনের মতো হল না হয়ত, কিন্তু জানো তো, গাছের থেকে ভালো বন্ধু কেউ হয় না। এর একটা নাম দিও আর খুব ভালোবেসো। দেখবে, সময়মতো তুমি রিটার্ন পাবে।”

*

একতলা আর দোতলার মাঝখানে যাকে বলে ম্যাজেনাইন ফ্লোর, সেখানে গুল্লুর একটা ঘর আছে। ছোট, কিন্তু আলো হাওয়া খুব। বাড়ি থাকলে এক ঘুমনো ছাড়া, এই ঘরেই থাকে গুল্লু। জ্বর-গাছকে এই ঘরে দক্ষিণের জানলার কাছে রাখল গুল্লু। কি সুন্দর দুলছে পাতাগুলো! যেন খুশি হয়েছে খুব। গুল্লু ওর নাম দিয়েছে ‘অজয়।’

*

মাসখানেক কেটে গেছে। অজয়ের খুবই যত্ন নেয় গুল্লু। মাটি যাতে সব সময় ভিজে থাকে সেটা খেয়াল রাখে। ও যখন অজয়ের শরীরে আলতো করে হাত বোলায়, যেন মনে হয়, অজয় গরম হয়ে উঠছে। উত্তেজনায় মানুষের যেমন হার্টবিট বেড়ে যায়, অজয়েরও কিছু একটা হয় যেটা গুল্লু ধরতে পারেনা। কিন্তু ওর দারুণ লাগে। একটু বড়ও হয়েছে অজয়।

চম্পক কাকু বলে গেছে, বেশি বেড়ে গেলে ডালপালা ছেঁটে দিতে। তাহলে হেলদি থাকবে আর মাপেও ঠিক থাকবে।

দিন দিন যেন দেখতে সুন্দর হচ্ছে অজয়। পাতিলেবুর  রঙের স্টেম মানে ওই কান্ডের গায়ে আবার হলুদ পাওডারের মতো কি লেগে থাকে। পাতাগুলো পালকের মতো আর ছোট ছোট সাদা কাঁটাও আছে। কিন্তু গুল্লু যখন হাত বোলায় তখন একটুও লাগে না ওই কাঁটাতে। নরম নরম কাঁটা।

পড়াশুনো আর ফুটবল খেলা ছাড়া গুল্লুর বেশি সময়টাই এখন কাটে অজয়ের সঙ্গে। যত্ত দু:খ, কষ্ট, আনন্দ, কী কী  ও করতে চায়, কী করতে ভালো লাগে না সবই এখন অজয়কে বলে গুল্লু। সোমদেবের তাই একটু দু:খ। সুমন আগের মতো আর গল্প করে না ওর সঙ্গে। সুমন গুল্লুর ভালো নাম।

“তুই কেমন পালটে গেছিস সুমন। আগে আমরা কত গল্প করতাম। ফিউচার প্ল্যানিং করতাম। এখন আর বেশি কথাই বলিস না।”

“আসলে কী বল তো, অজয় আমাকে খুব টানে। স্কুল ছুটি হলেই, বা খেলা শেষ হলেই মনে হয় বাড়ি যাই। অজয়কে গিয়ে বলি আজ কি কি হল। তুই রাগ করিস না সমু।”

“অজয় তো গাছ! ওকে বলে তোর কী হয়? ও কী উত্তর দেয়? তোর মাথা গেছে। না সাজেশন দেয়?”  অজয়ের চোখে তাচ্ছিল্য।

“কথা বলতে পারেনা ঠিকই কিন্তু সাড়া দেয় জানিস। আনন্দের খবরে বা এক্সাইটেড হলে ও দোলে। যদি আমার কোনো কষ্টের বা দু:খের কথা বলি, তাহলে ওর পাতাগুলো তিরতির করে কাঁপে। গান গাইলে বা চালালে, ওর ডাল গুলো হেলে -দোলে জানিস তো। পুরো রিদম ফলো করে। তুই আসলে দেখাব।”

“সব তোর মনের ভুল। গাছ রাখা ভালো নো ডাউট কিন্তু তাই বলে এরকম কান্ড করে না কোনো গাছ।”

সোমদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু খারাপই লাগে গুল্লুর। চোখদুটোতে কি হিংসে হিংসে ভাব? না, না, সমু খুব ভালো ছেলে।

পরের দিনই সোমদেব চলে এল অজয়ের কীর্তিকলাপ দেখতে। গুল্লু গান চালালেও যেমন ছিল তেমনি রইল অজয়। সমু হেসে বলল, “দেখলি তো পাগলা, সবটাই ইলিউশন। তুই ভাবিস, তাই দেখিস।”

খুব কষ্ট পেল গুল্লু। মিথ্যেবাদী হয়ে যাচ্ছে যে! অজয়ের কাছে গিয়ে ডালে ডালে হাত বুলিয়ে নীচু গলায় বলল, “অজয়, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, দেখো সমুর কাছে আমি মিথ্যেবাদী হয়ে যাচ্ছি। তুমি কি তাই চাও? যদি তা না চাও তবে একটু নেচে দাও প্লিজ।”

সোমদেব চেয়ারে বসে গুল্লুকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। গুল্লু গান চালালো। “ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়…”

সোমদেব অবাক হয়ে  দেখল, অজয় ডালপালা ছন্দে ছন্দে হেলছে দুলছে। গুল্লুর মুখে বিজয়ীর হাসি।

*

গুল্লুর খুব জ্বর। আজ সকালে উঠেই মাথাটা ভার হয়ে চোখ জ্বালা করতে করতে জ্বর এসে গেল। এখন তো প্রায় একশো তিনের ওপর জ্বর। জ্বর বলেই মা- বাবার ঘরে শুয়ে থাকতে হয়েছে ওকে। নিজের ঘরে যেতে দেয়নি কেউ। বিকেলে ডাক্তারবাবু আসবেন।

অজয়ের জন্য মনটা ছটফট করছে গুল্লুর। আজ সকাল থেকে অজয়কে ও দেখেনি। কী করছে ও কে জানে গুল্লুকে না দেখতে পেয়ে। মা ঢুকতেই গুল্লু বলে উঠল, “মা, অজয়?”

“অজয়কে জল দিয়ে এসেছি সকালেই।  ঠিক আছে ও। আগে তোর জ্বর কমুক তারপর ও ঘরে যাবি।”

দুপুরে আরো জ্বর বাড়ল গুল্লুর। বেহুঁশের মতো ঘুমোল। কখন সন্ধে হয়ে গেছে জানে না। যখন তাকালো তখন ঘরে লাইট জ্বলছে, ডাক্তারবাবু বসে আছেন খাটের পাশে চেয়ার নিয়ে।

দেখেটেখে প্রেসক্রিপশন লিখে, ওষুধ বুঝিয়ে চলে গেলেন ডাক্তারবাবু। অজয়ের কথা মনে পড়ল গুল্লুর। কতদিন অজয়কে দেখে না মনে হল। অজয় নিশ্চয়ই কাঁদছে। দুচোখ জলে ভরে এলো ওর।

মাথার কাছে বসে থাকা ঠাম্মির কাছে আবদার করল, “ঠাম্মি, একবার আমার ঘরে যেতে দাও না গো। অজয় কে একটু দেখে আসি।”

ঠাম্মি বলল, “এত জ্বর নিয়ে কী করে যাবে সোনাছেলে। ওষুধ আনতে গেছে, খাও, দেখবে কালকেই ঠিক হয়ে গেছ।”

পরের দিনও গুল্লুর জ্বর একশো তিনের নীচে নামল না। ওর জেদাজেদিতে অজয়কে এই ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। কেমন মিইয়ে গেছে অজয়। সেই হলদে পাউডারের মতো যে জিনিসটা ওর কান্ডে লেগে থাকে, সেটা সাদাটে হয়ে গেছে। গুল্লুর চোখে জল এল। নিশ্চয়ই ওকে না দেখতে পেয়ে অজয়ের কষ্ট হয়েছে আর তাই এরকম হয়ে গেছে।

টয়লেট যাবার সময় অজয়কে আদর করে গুল্লু।।অজয় যেন তিরতির করে কেঁপে ওঠে। গুল্লু বলে, “আমি ভালো হয়ে যাই, তোমাকে খুব আদর করব।”  

স্কুল ফেরত সোমদেব দেখতে এসেছিল। অজয়কে এই ঘরে দেখে বলে উঠল, “অ্যাই সুমন, চম্পক কাকু এই গাছটার নাম জ্বর গাছ বলেছিল না? এই বেটার জন্যই তোর জ্বর হয়েছে, আর কমছেও না। এটাকে হাটা। দেখবি ঠিক হয়ে গেছিস। হে হে হে হে।”

“তুই এখন যা সমু, আমার কথা বললেই মাথা ব্যথা করছে। তাছাড়া, আমার থেকে  তোরও জ্বর হয়ে যেতে পারে।” বলেই গুল্লু অন্য দিকে ফিরে শুলো। অসম্ভব রাগ হচ্ছিল সমুর ওপর। অজয়কে আজেবাজে কথা বললে সহ্য হয় না ওর।

দুপুরে বেঘোরে ঘুমিয়ে গুল্লু  স্বপ্ন দেখল অজয় যেন ওকে কাছে ডাকছে, এদিকে সোমদেব কিছুতেই ওকে যেতে দিচ্ছে না। হাত পা ছুঁড়ছে গুল্লু, বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছে সমুর হাত থেকে। ঘুম ভেঙে গেল গুল্লুর। সোজাসুজি রাখা দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল, পাঁচটা বাজে।

একটু সময় লাগল বুঝতে সকাল না বিকেল। পাশে মা নেই দেখে বুঝল, বিকেল। মা চা করতে যায় এই সময়। মাথা উঁচু করে অজয়ের দিকে তাকাতেই দেখল, দুটো ডাল এমনভাবে রয়েছে যেন দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে গুল্লুকে। শরীরটা বেজায় দুর্বল লাগছে। তাও ওর মনে হল, একবার অজয়ের কাছে যায়। এই সুযোগ, ঘরে কেউ নেই। ওকে একটু আদর করা দরকার। বেচারা মনমরা হয়ে আছে।

আসতে আসতে বিছানা থেকে নেমে অজয়ের কাছে গেল গুল্লু। অজয়ের কাণ্ডতে হলুদ গুঁড়ো আবার ফিরে এসেছে। গুল্লু দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরার মতো ধরল অজয়কে। অজয়ের ডালপালাগুলো যেন সব এসে ঘিরে ধরল গুল্লুকে। আহ্, ঠান্ডা হয়ে গেল শরীরটা! কী আরাম!

গুল্লুও অজয়ের ডালে পাতায় হাত বুলিয়ে বলল, “বিছানায় যাই বুঝলে বন্ধু, মা এসে যাবে এখুনি।” ডালপালার ঘের খুলে স্বাভাবিক হয়ে গেল। গুল্লু এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়। অদ্ভুত একটা রিলিফ হয়েছে মনে হল ওর।

“উঠেছিস গুল্লু, জ্বরটা দেখি তাহলে। ডাক্তারবাবু চার্ট করতে বলেছেন। টাইফয়েড হচ্ছে খুব।”

থার্মোমিটার হাতে নিয়ে খুশি হয়ে গুল্লুর মা বললেন, “আরে, এখন তো টেম্পারেচার নর্মাল। খুব ভালো। কিছু খাবার নিয়ে আসি, তারপর ওষুধ দেব।”

এরপর থেকে আর জ্বর আসেনি গুল্লুর। ডাক্তারবাবু এসে দেখে গেছেন, ফিট সার্টিফিকেটও দিয়ে গেছেন। বলেছেন, এই জ্বর সাধারণত পাঁচ থেকে সাতদিন থাকে। সুমন লাকি যে তিনদিনেই জ্বর পালিয়েছে।

কিন্তু অদ্ভুতভাবে, অজয়ের শরীর দিয়ে যেন ভাপ বেরোচ্ছে। গুল্লুও কাছে যেতে পারছে না। বাড়ির বড়রাও বলছেন, গাছটার পাশ দিয়ে গেলেই যেন তাপ লাগছে। কী হল, কে জানে! মরে যাবে নাতো গাছটা? বিদেশী গাছ, এদেশের মাটি কি আর সহ্য হয়! গুল্লু ভেবে রেখেছে সুযোগমত চম্পক কাকুকে একটা ফোন করবে। 

পরের সপ্তাহ থেকেই ফার্স্ট টার্ম  শুরু হচ্ছে গুল্লুদের। সোমদেব এসেছে গুল্লুর কাছে বাংলার একটা জিনিস বুঝতে। গুল্লু বাংলায় বেশ ভালো। 

গুল্লু এখনও মা বাবার ঘরেই আছে। কারণ অজয় ওখানে আছে। ওকে সরানো যাচ্ছে না। কাছে গেলেই তাপ লাগছে ভালো রকম।

“এই যে ওস্তাদ! একদম তো ঠিক হয়ে গেছিস দেখছি!”

“কেন? আমি বেঠিক থাকলে তোর কিছু সুবিধে হত?”

“ধ্যাত,তাই বলেছি আমি? আগের দিন এসে তোকে দেখে ভয় লাগছিল। পুরো মুখটা লাল  হয়ে ছিল। ও বাবা, তোর অজয়ও তো এখানেই আছে দেখছি। তোর ঘরে কবে যাবি? ওই ঘরটা বেটার লাগে আমার। আচ্ছা, অজ মানে জানিস?” 

“জানি, ছাগল।”

“আমাকে বললি ছাগল?”

“উফ্ সমু, অজ মানে ছাগল।”

“রিয়েলি? হাহাহাহা… অজয় মানে তবে কী? ছাগলায়? হাহা..”

“এরকম কেন বলছিস।  অজয় খুব লাকি গাছ। আমি বুঝি।”

“তাই? তা কী করে বুঝিস? ওর জন্যই তো তোর জ্বর হয়েছিল। এতে লাকির কী হল?”

“ওকে ভালোবাসলে, আদর করলে তবেই ও তোর ভালো করবে। আমার তো মনে হচ্ছে আমার জ্বর অজয় নিজের শরীরে নিয়ে নিয়েছে। আর তাই…”

গুল্লুর কথা শুনতে শুনতে সোমদেব এগিয়ে গেছিল অজয়ের দিকে। “তাই কী?… দেখি আদর করে ছাগলায় কে, আমারও গুড লাক আসে কিনা।”

“কাছে যাস না সমু, তাপ লাগবে।”

– কই, তাপ কিছু লাগছে না তো? 

জড়িয়ে ধরার মতো করে অজয়কে ধরল সোমদেব। অজয়ও ডালপালা দিয়ে যেন ঘিরে ধরল সমুকে। যা কিছু  ‘কিন্তু’ ছিল গুল্লুর মনে, চোখের সামনে দেখে সব কিন্তুর উত্তর পেয়ে গেল ও। অজয় সত্যি সত্যি মানুষের মতো জড়িয়ে ধরে আদর খায়, করেও।

আটটার একটু আগে সোমদেব বাড়ি ফিরে গেল। গুল্লু অজয়ের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে সেই তাপটা আর অনুভব করল না। সারাদিনে অনেকবার অজয়ের কাছে গেছে গুল্লু। তাপ টের পেয়েছে।

আরো একটু এগোলো, আরো একটু… নাহ্, গরমটা আর নেই তো!. .. একেবারে কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করল অজয়কে।

“আমিও ভালো হয়ে গেছি, আমার অজয়ও ভালো হয়ে গেছে। এবার আমরা আমাদের ঘরে চলে যাব। আবার গল্প করব। তবে সামনে পরীক্ষা, পড়াশোনা করতে হবে। তুমিও পড়বে আমার সঙ্গে, কেমন?”

জবাবে অজয় পাতা কাঁপিয়ে খুশি প্রকাশ করল।

গুল্লুদের বাড়ি থেকে ফিরে সেই রাত থেকেই ধুম জ্বরে পড়েছে সোমদেব। জ্বর একশো চার ডিগ্রি। ওর মা ফোন করে গুল্লুকে বলেছে, “তুই একবার আসিস সুমন। কী যে আবলতাবোল বকছে জ্বরের ঘোরে। ‘জ্বর গাছ আনো,  জ্বর গাছ অজয়,’ এই সব উলটোপালটা বলছে। জিগ্যেস করলে বলছে সুমন জানে।”

অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

3 thoughts on “গল্প জ্বর গাছ চুমকি চট্টোপাধ্যায় শরৎ ২০১৯

Leave a comment