গল্প ভেম্পিগড়ের রূপকথা বিভাবসু দে বর্ষা ২০১৯

বিভাবসু দে-র আগের গল্পঃ পাতালপুরীর দরজা, ছায়ার কায়া

ভেম্পিগড়ের রূপকথা

বিভাবসু দে

(১)

এক যে ছিল দেশ। নাম তার ভেম্পিগড়। সাত সমুদ্র, তেরো নদী, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে যে অচিনপুর, সেই অচিনপুর পেরোলে তবে গিয়ে ভেম্পিগড়। দেশের নামটা এমন কেন তাই ভাবছ তো ? আসলে সেখানে সব ভ্যাম্পায়াররা থাকে। হরেকরকম ভ্যাম্পায়ারের বাস সেই ভেম্পিগড়ে। কেউ ছোট, কেউ মোটা, কেউ শিড়িঙে মতন ঢ্যাঙঢেঙে লম্বা আবার কেউ বা ইয়া পালোয়ান। তাদের পোশাক-আশাকেও রকমারি সাজ। কেউ সবুজ কোট পরে তো কেউ নীল, কারও বা পছন্দ কটকটে লাল, আবার কেউ হয়তো ভ্যাম্পায়ারদের সেই সাবেকি কালো কোটেই অভ্যস্ত। হ্যাঁ, তবে রঙের বাহার থাকলেও কোটটা সবাই পরে। ওটা ভ্যাম্পায়ারদের বড্ড প্রিয় পোশাক। ওদের বাড়িগুলোও খুব সুন্দর। যেমন রঙিন কোট তেমনি হরেক রঙের বাড়ি।     

ভারী সুন্দর সেই দেশটা। সেখানে মাঠে মাঠে সবুজ ঘাস। ঘাসের ওপর রং-বেরঙের ফুল ফুটে থাকে, আর তার গায়ে গায়ে মধু খেয়ে বেড়ায় মৌমাছিগুলো। গাছগুলো সব গাঢ় সবুজ পাতায় ভরা, রস-টুসটুসে সব ফল ঝুলে থাকে তাতে। বিকেলের সোনালী সূর্য যখন একটু একটু করে পশ্চিমে ঢলে পড়ে তখন সেই পড়ন্ত বেলার আলোয় মাঠে মাঠে যেন সোনার ঢেউ খেলে যায়। পাখিরা সার বেঁধে বাড়ির পথে ডানা মেলে।

দেশের দু’পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কম্পি আর ঝম্পি নদী। কম্পি নদীতে বয় লাল জল আর ঝম্পি নদীতে নীল জল। বইতে বইতে দুই নদী গিয়ে মিশেছে ভেম্পিগড়ের দক্ষিণে বেগুনী-সাগরে। আর উত্তরে ? ভেম্পিগড়ের উত্তরে আছে এক বিশাল উঁচু পাহাড়। এতটাই উঁচু যে সেই পাহাড়ের মাথা গিয়ে ঠেকেছে মেঘেদের দেশে। আর সেই পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু চূড়ায় থাকেন ভেম্পিগড়ের রাজা, ভেম্পিনারায়ণ। সেখানে তাঁর এক পেল্লাই প্রাসাদ আছে। সেই প্রাসাদের কথা আর কী বলি ! নীলপরীদের দেশের স্ফটিকে গড়া তার দেয়াল, গায়ে গায়ে হীরে, পান্না, জহরত বসানো। সকালবেলা যখন সূর্যের আলো এসে পড়ে সেই প্রাসাদের গায়ে, পুরো ভেম্পিগড় ঝলমল করে ওঠে। মনে হয় যেন আরেকখানা সূর্য উঠেছে উত্তরে !

 রাজা ভেম্পিনারায়ণ বড় ভালো ভ্যাম্পায়ার। তাঁর শাসনে দেশের কারও ঘরে কোনও অভাব নেই। ‘আমার সন্তান যেন থাকে রক্তে-মাংসে’; মধ্যবিত্ত ছাপোষা ভ্যাম্পায়ারের এই সামান্য চাহিদাটুকু পুরনে রাজা সদাই তৎপর। তাঁর সুশাসনে দেশের কোনও ভ্যাম্পায়ারের ঘরে কোনওদিন রক্তের বোতল খালি হয় না। একেকদিন একেক স্বাদের রক্ত। দেশবাসী তো যারপরনাই খুশি রাজা ভেম্পিনারায়ণের রাজত্বে। ভেম্পিগড়ের চারদিকে শুধু আনন্দের ঢেউ। রাজা যখন দরবারে বসেন প্রজারা দু’হাত তুলে তাঁর জয়গান করে। রাজার মনটাও ভরে ওঠে প্রজাদের হাসিখুশি মুখগুলি দেখে।

এভাবেই বেশ সুন্দরভাবে সব চলছিল ভেম্পিগড়ে। কিন্তু হঠাৎ একদিন রাজসভা থেকে ফিরে রাজা অন্তঃপুরে গিয়ে দেখলেন মহারানি ভ্যাম্পাবতী মুখ কালো করে বসে আছেন। চোখদুটোও যেন একটু ছলছল করছে তাঁর। 

“কী ব্যাপার মহারানি ? তোমায় অমন দেখাচ্ছে কেন ?” চিন্তিত গলায় জিগ্যেস করলেন মহারাজ ভেম্পিনারায়ণ।

রানি কাঁদো কাঁদো চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার কিছু হয়নি মহারাজ। কিন্তু আমাদের মেয়ের…”

কথাটা আর শেষ করতে পারলেন না ভ্যাম্পাবতী, তার আগেই কান্না জুড়ে দিলেন।

“আহা, রানি কাঁদছ কেন ? কী হয়েছে রাজকুমারী ভেম্পিকুমারীর ?”

চোখের জল মুছে বারদুয়েক নাক টেনে মহারানি বললেন, “ওর ভারী কঠিন কোনও অসুখ হয়েছে মহারাজ।”

“অসুখ ! কী অসুখ ?” ভুরু দুটো কুঁচকে উঠল মহারাজের।

“হ্যাঁ মহারাজ। ভেম্পিকুমারী আজ সকাল থেকে রক্ত খেতে চাইছে না। বলছে সব রক্ত নাকি বিস্বাদ !”

“সেকি !!” রাজার চোখ কপালে উঠবার জোগাড়। “ভ্যাম্পায়ারের ঘরের মেয়ের কিনা রক্ত স্বাদ লাগছে না! এ তো খুব সাংঘাতিক অসুখ।”

রাজা তক্ষুণি রানিকে নিয়ে ছুটলেন রাজকুমারীর ঘরে। মন্ত্রী দৌড়লেন রাজবদ্যিকে তলব করতে।

রাজা-রানি যখন ভেম্পিকুমারীর ঘরে পৌঁছলেন তখন সে মনমরা হয়ে তার সোনার বিছানায় শুয়ে আছে। পাশে রুপোর টেবিলে রক্তভরা গ্লাস পড়ে আছে এখনও। মহারানি সেই কোন সকালে দিয়ে গেছিলেন, খায়নি ভেম্পিকুমারী।

“কী হয়েছে মা ? শুনলাম তুমি নাকি রক্ত খেতে চাইছ না ?” পাশে বসে রাজকুমারীর মাথায় হাত বুলিয়ে জিগ্যেস করলেন রাজা।

রাজকুমারী কিচ্ছুটি বলল না। আগের মতোই মনমরা হয়ে শুয়ে রইল। রাজা কপালে হাত দিয়ে দেখলেন; নাহ, জ্বর তো আসেনি। তবে কী হল মেয়ের ? রাজার মুখটাও কালো হয়ে উঠতে লাগল চিন্তায়। কিছুক্ষণ পর রাজবদ্যিকে সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রীও এসে হাজির হলেন রাজকুমারীর ঘরে।

“বদ্যিমশাই দেখুন না, মেয়েটার হঠাৎ কী যে হল!”  কাতর গলায় বললেন মহারাজ।

রাজবদ্যি নিজের বাক্সপেটরা খুলে বসলেন রাজকুমারীর পাশে। নাড়ি দেখলেন, জিভ দেখলেন, চোখ দেখলেন এমনকি রাজকুমারীর রক্তচোষা দাঁত দুটোও নেড়েচেড়ে দেখলেন ; সবই ঠিক আছে। কোথাও তো কোনও রোগের লক্ষণ নেই। শেষে প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে বদ্যি রাজকুমারীকে জিগ্যেস করলেন, “কী হয়েছে রাজকুমারী ? রক্ত খেতে চাইছ না কেন ?”

“সব রক্ত বিস্বাদ লাগছে বদ্যিকাকু।” মুখ ভার করে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল ভেম্পিকুমারী।

রাজবদ্যিও এবার ভারী চিন্তায় পড়ে গেলেন। ভ্যাম্পায়ারের রক্ত স্বাদ লাগছে না ! তাও কি কখনও হয় ?

রাজা চিন্তিত মুখে জিগ্যেস করলেন, “কী বুঝলেন বদ্যিমশাই ? কী হয়েছে ওর ?”

“মাপ করবেন মহারাজ, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কিছুই বুঝতে পারলাম না। শরীরে তো কোনও ব্যামোর লক্ষণ নেই।” ম্লান মুখে বদ্যি বললেন।

চিন্তায় মুখটা আরও কালো হয়ে উঠল রাজার। “তাহলে উপায় ?”

“একটাই উপায় হতে পারে, অন্য কোনও ধরণের রক্ত খাইয়ে দেখুন রাজকুমারীকে, যদি তাতে ওর রুচি ফিরে আসে।” বদ্যি একথা বলে নিজের জিনিসপত্র গুটিয়ে চলে গেলেন।

রাজার আদেশে তক্ষুণি রাজ-ভাঁড়ারে যত রকম রক্ত মজুত ছিল সব গ্লাসে গ্লাসে ঢেলে আনা হল। কত রকমের যে রক্ত সেখানে। দেশ-বিদেশ থেকে আনা বিভিন্ন স্বাদের রক্ত। নতুন করেও রাজা আরও অনেক রক্ত আনালেন বিদেশ থেকে। কোনওটা এসেছে জলপরীদের দেশ থেকে তো কোনওটা বা গোলাপি রাক্ষসদের দেশের। কোনও রক্তের স্বাদ নোনতা, কোনওটা বা মিষ্টি। কোনও এক দেশের রক্ত সবুজ তো আরেক দেশের আকাশি। কিন্তু রাজকুমারীর কোনওটাই মুখে লাগল না। গ্লাস তুলে সে ঠোঁটের কোণে ছোঁয়ায় আর এক চুমুক দিয়েই থু-থু করে ফেলে দেয়।

অনেক চেষ্টা করেও কোনও ফল হল না। এ কী সব্বনেশে রোগে ধরল রাজকুমারীকে ! রানি এদিকে কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে বসে আছেন। রাজারও ভীষণ মন খারাপ। রাজকাজে আর কিছুতেই আগের মতো মন দিতে পারছেন না তিনি। রাজকুমারীর রক্তে অরুচির কথা আস্তে আস্তে দেশসুদ্ধ সব ভ্যাম্পায়াররা জেনে গেল। “আহা, এত ভালো রাজকুমারী আমাদের, আর সে কিনা রক্ত খেতে চাইছে না! এমন রোগ তো ভেম্পিগড়ে কেউ কোনওকালে শোনেনি।”

পথেঘাটে বাজারহাটে সব ভ্যাম্পায়াররা এই কথাই বলতে লাগল। সব্বাই কত কত উপায় বলল এসে রাজামশাইকে। কেউ বলল রক্তের সঙ্গে নুন-চিনি গুলে শরবত করে খাওয়াতে, কেউ বা বলল তার মধ্যে দই দিয়ে বেশ করে ঘোল বানিয়ে রাজকুমারীকে দিতে। কিন্তু কিস্যুটি হল না। ভেম্পিকুমারীর কোনওভাবেই রক্ত স্বাদ লাগছে না।

রাজকুমারী রক্ত খাচ্ছেন না। রাজা-রানির মন খারাপ। মন্ত্রীর মন খারাপ। দেশসুদ্ধ সব ভ্যাম্পায়ারদের মন খারাপ। ভেম্পিগড়ের সব আনন্দ যেন কোথায় উধাও হয়ে গেল।

একদিন ভেম্পিকুমারীর এই রোগের কথা ভাবতে ভাবতে মনের দুঃখে গাল ফুলিয়ে রাজা ছাদে বসে আছেন, এমনসময় হঠাৎ তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি এল। মন্ত্রীকে ডেকে বললেন, “দেশে দেশে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দাও, যে রাজকুমারীর মুখে রক্তের রুচি ফিরিয়ে আনতে পারবে তার সঙ্গেই আমি রাজকুমারীর বিয়ে দেব আর দেব অর্ধেক রাজ্যের রাজত্ব।”

অমনি রাজার আদেশে দেশে দেশে ছুটল ভ্যাম্পায়ারের দল। যক্ষপুরী থেকে খোক্ষসদেশ, নীলপরী, লালপরী, জলপরীদের দেশ, সর্বত্র খবর ছড়িয়ে পড়ল।

(২)

এদিকে ভেম্পিগড় থেকে অনেক অনেক ক্রোশ দূরে এক গ্রাম ছিল, গোবিন্দপুর। গঙ্গানদীর ধারে। সেই গ্রামেই থাকত এক রাখাল ছেলে। গঙ্গার ধারের বিশাল মাঠে সারাদিন সে গরু চরাত আর বিকেল হলে সেগুলোকে আবার বাড়ি নিয়ে যেত। বাড়িতে সে একাই থাকত, মা-বাবা কেউ ছিল না তার। কিন্তু গ্রামের সবাই তাকে খুব ভালোবাসত। তার একটা কারণও ছিল অবশ্য। সেই রাখাল ছেলের চাটনি রান্নার হাত ছিল দারুণ। যখনই কারও বাড়িতে চাটনি রান্নার আয়োজন হত বা গ্রামে কোনও বাড়িতে বড় অনুষ্ঠান হত তখনই ডাক পড়ত রাখাল ছেলের। গাঁয়ে এমন লোক নেই যে কিনা তার হাতের চাটনি খেয়ে আঙুল চাটেনি। বাইরে থেকেও যারা আসত তারাও মুগ্ধ হয়ে যেত রাখাল ছেলের হাতের চাটনি খেয়ে।

তা একদিন সেই রাখাল ছেলে মাঠের দক্ষিণ কোণে যে বিশাল ঝুরিদার বুড়ো বটগাছটা আছে, তারই নিচে পা ছড়িয়ে বসেছিল। গরুগুলো সব এদিক ওদিক চরে বেড়াচ্ছে। নদীর ওপারে সূর্য আস্তে আস্তে পশ্চিমমুখো হতে শুরু করেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই বিকেল নামবে। নদীর ঠাণ্ডা বাতাস আর গাছের ছায়ায় শরীরটা ভারী জুড়িয়ে এল রাখাল ছেলের। কখন যে দু’চোখ বেয়ে ঘুম নেমে এল সে নিজেও বুঝতে পারল না।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ গাছের ওপর থেকে কিছু শব্দ হতে লাগল। ঘুম ভেঙে গেল রাখাল ছেলের। ওপরের ডালে বসে কারা যেন কথা বলছে। রাখাল ছেলে তাকিয়ে দেখল সেখানে বসে আছে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী।

ব্যাঙ্গমী বলল, “শুনেছি ভেম্পিকুমারীর ভারী শক্ত ব্যামো হয়েছে। রক্ত মুখেই দিতে চাইছে না।”

ব্যাঙ্গমা বলল, “হ্যাঁ, তাই তো ভেম্পিগড়ে সবার মুখ ভার।”

“তোমরা কার কথা বলছ গো ?” নিচ থেকে রাখাল ছেলে জিগ্যেস করল।

“ভেম্পিগড়ের রাজকুমারী ভেম্পিকুমারীর কথা।” একসঙ্গে বলে উঠল ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী।

“ভেম্পিগড় ! সে আবার কোথায় ? আর কী হয়েছে সেই রাজকুমারীর ?”

রাখালের কথায় ব্যাঙ্গমা ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, “ভেম্পিগড় ? সে অনেক দূরের দেশ। সেখানকার রাজকুমারী আজ এক বছর পেরোতে চলল একফোঁটা রক্তও মুখে তুলতে চাইছে না। বলছে কিনা বিস্বাদ !”

ব্যাঙ্গমার কথায় ভারী অবাক হল রাখাল ছেলে। বলল, “রক্ত তো বিস্বাদই হয়। সে আবার খাবার জিনিস নাকি ?”

রাখালের কথায় খিকখিক করে হেসে মাথা নাড়তে নাড়তে ব্যাঙ্গমী বলল, “শোনো বোকা ছেলের কথা ! আমাদের রক্ত বিস্বাদ লাগে, কিন্তু ভ্যাম্পায়ারদের তো ওটাই আসল পানীয়। আমাদের কাছে যেমন জল, শরবত, ঘোল, ওদের কাছে তেমনি রক্ত।”

“ওহ ! ওরা বুঝি সব ভ্যাম্পায়ার ?” চোখ গোল গোল করে জিগ্যেস করল রাখাল ছেলে।

“হ্যাঁ গো। রাজা ঘোষণা করেছেন, যে ব্যক্তি রাজকুমারীর মুখে স্বাদ ফিরিয়ে আনতে পারবে তার সঙ্গেই তিনি রাজকুমারীর বিয়ে দেবেন আর অর্ধেক রাজ্যও দেবেন তাকে।”

ব্যাঙ্গমার এই কথা শুনে রাখাল ছেলের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বলল, “আচ্ছা, তোমরা আমাকে সেই ভেম্পিগড়ে নিয়ে যেতে পারবে ? তাহলে আমি একবার চেষ্টা করে দেখতাম যদি কিছু করতে পারি।”

রাখাল ছেলের কথায় ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী বলল, “সেই দেশের রাস্তা তো আমরাও জানি না, সে যে অনেক দূরের পথ। হ্যাঁ, তবে একজন তোমায় সাহায্য করতে পারে। আমরা তার ঠিকানা জানি।”

“কে সে ? কোথায় পাব তাকে ?” রাখাল জিগ্যেস করল।

ব্যাঙ্গমী বলল, “ওই যে পুবদিকে পাহাড়টা আছে, সেটা পেরোলেই তার বাড়ি। পাহাড়ের নিচেই কোনও এক গুহায় থাকে সে।”

কপাল কুঁচকে রাখাল জিগ্যেস করল, “কিন্তু তাকে চিনব কীভাবে ?”

“তোমায় চিনতে হবে না, সে-ই এসে হাজির হবে তোমার কাছে। তোমাকে শুধু সেখানে গিয়ে জোরে জোরে একটা মন্ত্র বলতে হবে।” এই বলে ব্যাঙ্গমা রাখালের কানে কানে এসে একটা মন্ত্র বলে দিল। রাখাল বেশ করে শিখে নিল মন্ত্রটা। তারপর ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী রাখালের কাছে বিদায় নিয়ে উড়ে গেল তাদের বাড়ির পথে। গঙ্গার ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে কোথায় যেন আকাশে মেঘের দেশে মিশে গেল তারা।

ততক্ষণে বিকেল গড়িয়ে গেছে, আরেকটু পরেই সন্ধে নামবে। রাখালও তাই গরু নিয়ে গ্রামের পথ ধরল।

পরদিন খুব ভোরেই বেরিয়ে পড়ল রাখাল ছেলে। কাঁধে একটা ইয়া বড় ঝোলা নিয়ে। তারপর ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর কথামতো সে হাঁটতে লাগল পুবের ওই পাহাড়টার দিকে। গ্রাম ছাড়িয়ে মাঠ, মাঠ ছাড়িয়ে প্রান্তর। সব পেরিয়ে তবে সে পৌঁছল পাহাড়ের কাছে। এবার যেতে হবে ওপারে। একটু একটু করে পাহাড়ে উঠতে লাগল সে। ভারী শক্ত সেই কাজ। অনেকদিন লাগল তার ওই পাহাড় চড়তে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাখাল গিয়ে পৌঁছল পাহাড়ের ওপারে। আশেপাশে কেউ নেই সেখানে। শুধু সবুজ ঘাসের মাঠ। যতদূর চোখ যায়, মানুষজন, ঘরবাড়ি কিচ্ছুটি দেখা যাচ্ছে না।

রাখাল এবার ব্যাঙ্গমার শেখানো সেই মন্ত্রটা বলতে শুরু করল। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত নেড়ে জোরে জোরে বলতে লাগল,

“আয় ঘোড়া যায় ঘোড়া, উড়ে উড়ে আয়

ঝুঁটি নেড়ে ডানা মেলে আকাশের গায়।

সাতরঙা রামধনু পতপত ওড়ে,

স্বপ্নের পথে ঘোড়া নিয়ে চল দূরে।”

আর অমনি কোত্থেকে এক বিশাল পক্ষীরাজ ঘোড়া এসে হাজির হল রাখালের সামনে। কী যে সুন্দর দেখতে সেই ঘোড়া ! ধবধবে সাদা মখমলের মতো গায়ের রং, ঘাড়ের ওপর সাদা কেশরের ঢেউ, ঠিক যেন শরৎকালের কাশবন আর দু’পাশে দুটো ডানা, মেললে যেন আস্ত আকাশ ঢাকা পড়ে যায়।

“কোথায় যেতে চাও বলো।” মাথা দুলিয়ে জিগ্যেস করল সেই পক্ষীরাজ ঘোড়া।

রাখাল ছেলে বলল, “ভেম্পিগড়ের রাজার বাড়িতে।”

পক্ষীরাজ বলল, “বেশ। উঠে বসো তবে আমার পিঠে।”

রাখাল ছেলে তার ঝোলাটা নিয়ে চড়ে বসল পক্ষীরাজের পিঠে। “শক্ত করে ধরে রেখো কিন্তু।” বলেই শোঁ করে এক লাফে আকাশে উঠে গেল সেই পক্ষীরাজ ঘোড়া। বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ে চলল সে। রাখাল অবাক চোখে চেয়ে দেখল পায়ের নিচে ধোঁয়ার মতো সাদা সাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে। কত কত দেশ যে মুহূর্তে পেরিয়ে যেতে লাগল সে ! মেঘের আড়াল থেকে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে সেসব। ওই খোক্ষসদের দেশ, ওই যে হলদে রাক্ষসদের দেশ আর ওই যে ওখানে সবুজ পরীরা উড়ে বেড়াচ্ছে। একে একে সাত সমুদ্র, তেরো নদী, তেপান্তরের মাঠ আর অচিনপুর পেরিয়ে পক্ষীরাজ এসে নামল মহারাজ ভেম্পিনারায়ণের প্রাসাদের ছাদে। রাজা-রানি তখন সেখানেই চেয়ার পেতে বসে ছিলেন। হঠাৎ পক্ষীরাজ আর তার পিঠে রাখাল ছেলেকে দেখতে পেয়ে বেশ অবাক হলেন দুজনেই। ভেম্পিগড়ে এর আগে তো কখনও কোনও মানুষ আসেনি।

রাখাল ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে পক্ষীরাজ আবার কোথায় যেন উড়ে গেল। রাখাল এগিয়ে এসে মহারাজ আর রানিমাকে প্রণাম করে বলল, “মহারাজ আমি অনেক দূরের এক গ্রাম থেকে রাজকুমারীর অসুখের কথা শুনে এখানে এসেছি। যদি অনুমতি করেন তবে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি।”

“কত দেশ থেকে কত তাবড় তাবড় বদ্যি-হাকিমরা এলেন, কত রক্তরসিক ভ্যাম্পায়াররা চেষ্টা করল কিন্তু কিছুতেই আমার মেয়েটার রক্তে রুচি ফেরানো গেল না। তুমি কি পারবে ?” ভারী উদাস গলায় জিগ্যেস করলেন রাজা।

“একবার চেষ্টা করতে দোষ কি মহারাজ ?” রাখাল বলল। রানিমাও সায় দিলেন তার কথায়। বললেন, “দেখোই না বাবা, যদি আমাদের মেয়েটাকে সুস্থ করে তুলতে পারো।”

রাখাল ছেলে হাত জোড় করে বলল, “অবশ্যই রানিমা। কিন্তু আমি একটা বিশেষ ধরণের রক্ত তৈরি করি আর তার জন্যে আমার একখানা রান্নাঘর চাই।”

রানি বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, বেশ তো। আমাদের রাজবাড়ির এত বড় রান্নাঘরটা তো আছেই। তুমি ওখানেই কাজ করতে পারবে বাবা।”

রাখাল ছেলে তাঁদের বেশ একখানা প্রণাম করে গিয়ে ঢুকল রাজবাড়ির রান্নাঘরে। উনুনে কড়াই চাপিয়ে নিজের ঝোলা থেকে একে একে টমেটো, আম, চাটনি রান্নার মশলাপাতি আর লঙ্কাগুঁড়ো বের করল। তারপর খুব যত্ন করে পরিমাণমতো সব মিশিয়ে টুকটুকে লাল একটা চাটনি রাঁধল সে। দেখতে এক্কেবারে রক্তের মতো। গন্ধে মো মো করে উঠল রাজবাড়ি। রাজকুমারীর নাকেও পৌঁছল সেই গন্ধ। পেটের ভেতর খিদেটা যেন কেমন মোচড় দিয়ে উঠল সেই গন্ধেই।

এবার রাখাল ছেলে একটা সোনার বাটিতে সেই চাটনি নিয়ে গেল রাজকুমারীর কাছে। রাজা-রানিও চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানেই। রাজকুমারী বাটিটা হাতে নিয়ে একবার গন্ধ শুঁকল। তারপর হালকা করে একটু ছোঁয়ালো ঠোঁটের কোণে। ব্যস, আর যায় কোথা ! চুকচুক, সুপসাপ শব্দে পুরো বাটি খালি করে দিল ভেম্পিকুমারী। চেটেপুটে খেল পুরোটা। এমন স্বাদ রক্তও যে হয় সে কোনওদিন জানতই না ! এদিকে রাজকুমারী রক্ত খেয়েছে এই আনন্দে তো রাজা-রানির মুখ ঝলমল করে উঠল। একবছর পর মেয়ে রক্ত মুখে তুলল, রাজার তো আর আনন্দ ধরে না। নিমেষে খবর ছড়িয়ে পড়ল ভেম্পিগড়ে। সবাই খুশিতে নাচতে গাইতে লাগল। তাদের রাজকুমারী সেরে উঠেছেন, কী আনন্দ, কী আনন্দ ! আবার আগের মতো হাসি খুশিতে ভরে গেল ভ্যাম্পায়ারদের দেশ।

রাজাও নিজের কথা রাখলেন। খুব ধুমধাম করে রাখল ছেলের সঙ্গে ভেম্পিকুমারীর বিয়ে দিলেন আর তারপর তাকে অর্ধেক রাজ্যের রাজা করে দিলেন। সুখে-শান্তিতে, হাসিতে-আনন্দে আবার আগের মতো ঝলমল করতে লাগল ভেম্পিগড়।               

ছবিঃ রাহুল মজুমদার

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

3 thoughts on “গল্প ভেম্পিগড়ের রূপকথা বিভাবসু দে বর্ষা ২০১৯

  1. লেখক মহোদয়… তবে কি এবার চাটনি খাওয়া বাতিল করিয়ে ছাড়বেন!

    খুব ভালো লেগেছে। নতুন সাজে রুপকথার কাহিনী।

    Like

  2. চাটনি প্রেমিক একেই বলে। যা তা লেভেলের গল্প। দারুণ।

    Like

Leave a comment