গল্প হরিদ্রাবৃত্ত চুমকি চট্টোপাধ্যায় শরৎ ২০২০

চুমকি চট্টোপাধ্যায়ের আরো গল্প
আজব মানুষের গজব কাহিনী, ভগবানের বেটা বেটি, শুদ্ধ ভক্তের ঘড়ি, জ্বর গাছ

হরিদ্রাবৃত্ত

চুমকি চট্টোপাধ্যায়

বেশ একটু চিন্তাই হচ্ছে রাহুলের। রেজাল্ট বেরোবার সময় যত এগিয়ে আসছে, ততই অঙ্ক পেপারের কথা ভেবে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। এত খারাপ পরীক্ষা হবে যে, ভাবতেই পারেনি রাহুল। অঙ্কে কোনোদিনই ভালো নয় ও, তাই বলে ফেল করার মতোও নয় মোটেই। কিন্তু এবারের পরীক্ষাটা মোটেই সুবিধের হয়নি। পাশ নম্বর উঠবে কি না সেটা ভাবতে ভাবতে বেখেয়ালে কখন যে ও রেল কলোনি ছাড়িয়ে ভালকে বনে ঢুকে পড়েছে, বুঝতেই পারেনি।

আগামী সপ্তাহে রেজাল্ট বেরোবে শুনে থেকে অস্থির লাগছিল। তাই অক্ষয়ের বাড়ি যাবার জন্য বেরিয়েছে রাহুল। অক্ষয়ের বাড়ি মেন রোড দিয়ে গেলে একটু বেশি হাঁটতে হয় বলে রেল কলোনিকে ডাইনে রেখে শর্টকাট যে কাঁচা রাস্তাটা আছে, সেটা ধরেই যায় ও। আজ অন্যমনস্ক হয়ে রেল কলোনি যে রাহুলের বাঁদিকে রয়ে গেছে, সেটা খেয়ালই করল না সে।

নাম ভালকে বন হয়েও আসলে এটা বিশাল একটা মাঠ। কিছু বড়ো বড়ো গাছ তো অবশ্যই আছে, তবে আগে নাকি রীতিমতো ঘন জঙ্গল ছিল। ভালুকও বেরোত বলে শুনেছে রাহুল। তখন সবাই ভালুক বন বলত। পরে লোকের মুখে মুখে ভালুক শব্দটা ভালকে হয়ে গেছে। এখন সেসব আর নেই। তবে সরকারি লোকজন ছাড়া বিশেষ কেউ ঢোকে না এই ভালকে বনে।

একটু এগিয়েই চেতনা ফেরে রাহুলের। আরে, এ তো ভুল রাস্তা! ফেরার জন্য পেছনদিকে ঘুরতেই বড়ো দুটো ঝাঁকড়া গাছের মাঝখানে হলুদ আলোর একটা বৃত্ত চোখে পড়ে ওর। ওই গোল অংশের ঘাসের রঙ অমন হলুদ কেন জানার কৌতূহল হয় রাহুলের। গুটি গুটি এগিয়ে হলুদ বৃত্তটার মধ্যে ঢুকে নীচু হয়ে দেখতে যায় ঘাসের রঙ হলুদ কেন।

***

“এ কী, এ এখানে এল কীভাবে? এ তো আমাদের এখানকার কেউ নয়!” লম্বামতো এক সাধু জিজ্ঞেস করল মাঝারি হাইটের আরেক সাধুকে।

“আজ্ঞে, মনে হয় কোনোভাবে হরিদ্রাবৃত্তে ঢুকে পড়েছিল।”

“নেহাতই ঘাবড়ে গেছে মনে হচ্ছে। পুরুষোত্তম, তুমি ওকে পাকশালায় নিয়ে গিয়ে কিছু খাইয়ে তারপর বিশ্রাম কক্ষে রেখে এসো। আমি কাজ সেরে গিয়ে কথা বলব।”

“এসো ছেলে। তোমার নাম কী?”

চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছিল রাহুলের। এ কোথায় এসে পড়ল সে! ছোটো থেকে বড়ো, প্রত্যেকেই সাদা ধুতি পরা, গায়ে সাদা চাদর জড়ানো, একমাথা চুল চুড়ো করে মাথার ওপরে বাঁধা। যারা বড়ো, তাদের লম্বা দাড়ি। একেবারে ছবিতে দেখা প্রাচীন সাধুদের মতো। কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার হল, সকলেই বাংলাতে কথা বলছে।

পুরুষোত্তমের পেছন পেছন চলতে চলতে রাহুল মনে করার চেষ্টা করল কীভাবে ও এখানে এল। হলুদ গোলটার ভেতর ঢুকে নীচু হতেই কেমন একটা টান অনুভব করেছিল ও। সাকশন যাকে বলে। মাটি থেকে খানিকটা ওপর দিকে ওঠার পর হাত-পা ছুড়তে শুরু করেছিল যে, সেটুকু মনে আছে। কিন্তু তারপর আর কিছু মনে নেই। চোখ খুলতেই দেখে এইখানে পৌঁছে গেছে। জায়গাটা কেমন পুরনো পুরনো।

মাটির রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল রাহুল। অপার বিস্ময়ে দু’পাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছে সে। বাড়িগুলোর বেশিরভাগেরই চালগুলো হয় টালির, নয় খড়ের। একধরনের পাতায় ছাওয়া চালও আছে। যেটা দেখার মতো সেটা হচ্ছে গাছপালা। কত কত গাছ চারদিকে, আর কী সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে, প্রজাপতি উড়ছে, কাঠবেড়ালি দৌড়াদৌড়ি করছে, কতরকম পাখি ডাকছে।

পাঁচ মিনিটেই এটুকু দেখে ফেলেছে রাহুল। বাকি জায়গাটা কেমন কে জানে! একটা বড়ো ঘরে পুরুষোত্তম নিয়ে গিয়ে বসাল ওকে। মাটিতে পরিষ্কার সাদা চাদর মোড়া গদিতে বসতেই রাহুল বুঝল, ওর খুব খিদে পেয়েছে।

মাটির থালায় ভাত, শুক্তো, আলুভাজা, আর কীসের যেন একটা তরকারি এনে সামনে রাখল পুরুষোত্তম নামের সাধুটি। ছোটো মাটির ভাঁড়ে ডাল আর মাটির গেলাসে জল দিয়ে গেল আরেকজন সাধু।

বাড়িতে জম্মেও শুক্তো ছোঁয় না রাহুল। উচ্ছে দেখেই ও বুঝেছে এটা তেতো খেতে হবে। কিন্তু অচেনা অজানা পরিবেশে ট্যাঁ-ফুঁ না করাই যে ভালো, সে বোধ আছে ওর। একটা ব্যাপার ঠিক, এই অজানা জায়গায় না-চেনা মানুষদের দেখে অবাক হলেও ভয় তেমন লাগছে না কিন্তু। হঠাৎই মনে পড়ল, সময়মতো বাড়ি না ফিরলে মা খুব চিন্তা করবে। তারপর কান্নাকাটি, বাবা ফিরলে হয়তো থানাতেও চলে যাবে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল রাহুলের। মুখ নীচু করে কপালে হাত দিয়ে বসে থাকল খানিকক্ষণ।

ক’টা বাজে সেটাও বুঝতে পারছে না। আরে, পকেটে মোবাইলটা তো আছে! কী বোকা আমি। এতক্ষণ মনে পড়েনি কেন? তড়িঘড়ি মোবাইল বের করে রাহুল। অন করতে গিয়ে বুঝল বন্ধ হয়ে গেছে ফোন। কোনও কাজই করছে না যন্ত্রটা। রাহুল হতাশ হয়ে পড়ে।

“খাওয়া হয়েছে? পেট ভরেছে তো?”

সামনে দাঁড়িয়ে পুরুষোত্তম। রাহুল মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। পুরুষোত্তম বলে, “চলো, একটু বিশ্রাম নেবে। তারপর শিক্ষকমশাই তোমার সঙ্গে কথা বলবেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে খুব চিন্তা করছ। চিন্তার কিচ্ছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

পুরুষোত্তমের পেছন পেছন অন্য একটা বাড়িতে এসে পৌঁছয় রাহুল। ভেতরে ঢুকতেই চন্দনের গন্ধে মন ভালো হয়ে যায় ওর। ফুল রাখা আছে মাটির ফুলদানিতে। ধূপ জ্বলছে। দারুণ অ্যাম্বিয়েন্স। রাহুলের মনে এই কথাটাই ভেসে ওঠে। একটা মোড়া দেখিয়ে ওকে বসতে বলে পুরুষোত্তম।

দু-তিন মিনিটের মধ্যেই ঘরে ঢোকে সেই বয়স্ক সাধুবাবা। এরা কি সাধু? কে জানে বাবা। জপতপ তো করতে দেখছি না কাউকে।

“রাহুল তো তোমার নাম?”

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে রাহুল।

“পদবি কী?”

“ভট্টাচার্য্য।”

“ব্রাহ্মণ সন্তান। বেশ। ব্রতচারী, যোগাসন, প্রাণায়াম এসব করো?”

মুখ শুকিয়ে যায় রাহুলের। কী সব বলছে রে! এসব করে না শুনলে মারবে নাকি!

“বুঝেছি। কিছুই করো না। তোমাদের জগতের নব্বই ভাগ মানুষই করে না। তাই তো আমরা সরে এসেছিলাম সমান্তরাল এক পৃথিবীতে। তোমাদের ওখানে রোগ, ব্যাধি, দুশ্চিন্তা, হিংসা, ক্রোধ, লোভ, চাহিদা এত বেশি যে বাতাস বিষাক্ত হয়ে গেছে। শ্বাস নেওয়া যায় না।

“যাই হোক, যখন এসেই পড়েছ তখন কিছু ভালো জিনিস শিখে যাও। ভারতবর্ষ এক অতি অদ্ভুত দেশ। প্রাকৃতিক বলো, সাংস্কৃতিক বলো, আয়ুর্বেদ বলো, দৈবিক বলো, বিজ্ঞান বলো—সব বিষয়েই অতুল ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার। যে আবিষ্কার দশ হাজার বছর আগে আমাদের দেশে হয়েছে, আজও তা করে উঠতে পারেনি বর্তমান ভারত। পারবে কী করে? জং ধরে না এমন ইস্পাত বের করতে পেরেছে আজ অবধি? সাত-আট হাজার বছর আগে কিন্তু আমরা পেরেছিলাম। আরও একটু বড়ো হয়ে খুঁজে নিজের চোখে দেখে নিও তার প্রমাণ।”

সাধু মতন লোকটি বলে চলেছে। তার কিছু কথা রাহুল বুঝছে, কিছু বুঝছে না। চুপ করে শুনছে। সমান্তরাল না কী একটা পৃথিবী বলল, বোঝেনি ও। যাক গে, এখান থেকে ফেরত যাবার রাস্তাটা জানতে হলে এসব বকবকানি শুনতেই হবে।

“ঠিকঠাকই চলছিল, বুঝলে। কিন্তু ওই সাদা চামড়ার লোকগুলো যখন থেকে ভারতবর্ষের দখল নিল, তখন থেকেই দেশটার বারোটা বেজে গেল। যোগাভ্যাস ছেড়ে পিটি করা শুরু করল ছেলেমেয়েরা। উজবুকের দল সব! সে অনেক লম্বা আলোচনা। বলতে গেলে দু’রাত্তির কাবার হয়ে যাবে।

“আচ্ছা, আমার পরিচয় তো দেওয়া হয়নি। আমি সোমেশ্বরানন্দ লাহিড়ি। পেশায় শিক্ষক। তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি উদ্বিগ্ন। কীসের উদ্বেগ তোমার? উদ্বেগ থাকলে মনের যেমন ক্ষতি হয়, শরীরেরও ক্ষতি হয়।

“প্রথমে তুমি সামান্য সাধনা করে নাও। উদ্বেগ দূর হবে। একে বলে ভস্ত্রিকা প্রাণায়াম। যেভাবে দেখাচ্ছি সেভাবে করো।”

সোমেশ্বরানন্দের দেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী প্রাণায়াম করে রাহুল। একটু বেটার ফিলিং হচ্ছে বটে।

“এবার বলো তোমার সমস্যা।”

“আমার অঙ্ক পরীক্ষা একদম ভালো হয়নি। আমি কোনোদিনও ফেল করিনি। এবার মনে হয় পাশ করতে পারব না অঙ্কে। খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে সেই নিয়ে। রেজাল্ট বেরোবার সময় হয়ে এসেছে।”

“ওহো, বুঝেছি। এ সমস্যা তো তোমাদের দুনিয়ার অর্ধেকের বেশি ছাত্রছাত্রীর। আসলে তোমাদের তো বিষয়বস্তু শেখানো হয় না, গেলানো হয়। ভিত্তি না জানলে সেই শিক্ষার মানে কী? মাস্টাররাও জানে না ভিত্তি, তোমাদের কী শেখাবে! তুমি কোন শ্রেণিতে পড়ো?”

“সেভেনে।”

“সেভেন মানে সপ্তম শ্রেণি। তা, তুমি ঋণাত্মকে ঋণাত্মকে যে ধনাত্মক হয় তা জানো তো?”

ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে রাহুল। বলে কী এ!

“ও বুঝেছি, বাংলা জানো না। হে হে, কী অবস্থা! খাঁটি বাঙালির ছেলে বাংলা জানে না। আমি বলছি, মাইনাসে মাইনাসে প্লাস হয় জানো সেটা?”

ঢোঁক গিলে রাহুল বলে, “জানি।”

“কেন হয়?”

“এ তো ফর্মুলা। মুখস্থ করতে হয়। তারপর জায়গা বুঝে কাজে লাগাতে হয়।”

“মাটি করেছে। ভিত নেই তার চারতলা বাড়ি! সুদক্ষিণ, ও সুদক্ষিণ! এদিকে আয়।”

বছর এগারোর একটা ছেলে, সেই ধুতি চাদর পরা, ঘরে এসে ঢুকল। এর অবশ্য চুল ছোটো করেই কাটা।

“আমাকে কিছু বলছেন মাস্টারমশাই?”

“এ হচ্ছে রাহুল। ওকে একটু বুঝিয়ে দে তো, ঋণাত্মকে ঋণাত্মকে কেন ধনাত্মক হয়। আরও বলে দে মুখে মুখে কীভাবে গুণ করা যায়, হাতের আঙুলের সাহায্যে নামতা মনে রাখা যায় অনায়াসে। এটুকু আগে শেখো, তারপর আরও কিছু শেখাব। এ হচ্ছে আমাদের দেশের নিজস্ব বৈদিক গণনা পদ্ধতি।”

সুদক্ষিণের কাছ থেকে অঙ্কের অনেক মজার মজার অথচ সহজ নিয়ম শেখে রাহুল। আরও জানার আগ্রহ বেড়ে যায় ওর।

এরপর সোমেশ্বরানন্দ ওকে বলে দেন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর কীভাবে পনেরো মিনিট ধ্যান করতে হবে। ধ্যান শুনেই তো ব্যোমকে গেছিল রাহুল। ধ্যান তো মুনি-ঋষিরা করে! সোমেশ্বরানন্দ বুঝতে পেরে বলে দিয়েছে যে ধ্যান মানে মেডিটেশন। সঙ্গে কোন কোন প্রাণায়াম করবে, যোগাসন করবে তা বুঝিয়ে দিয়েছে।

অদ্ভুত একটা আনন্দ হচ্ছে রাহুলের। যেন আর কোনও সমস্যা নেই ওর জীবনে, এমনটা অনুভূতি হচ্ছে। যা যা শিখল আজ, সবকিছু ঠিকঠাক ফলো করবে প্রমিস করে নিজের কাছে।

সোমেশ্বর-স্যার বলেছে, “তুমি কী করছ না করছ, সব খবর কিন্তু পেয়ে যাব আমি। যদি ঠিকমতো মেনে চলো তাহলে এমন বিদ্যা আমি শিখিয়ে দেব তোমাকে, যা কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যাবে তুমি।”

সোমেশ্বর-স্যারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে রাহুল। ভদ্রলোককে ভালো লাগতে শুরু করেছে ওর।

“আর একটাই জিনিস জানার ছিল স্যার।”

“একসঙ্গে এত কিছু জানলে স্মৃতিতে রাখতে পারবে তো?”

“না, মানে, আমি এখানে কীভাবে এলাম আর ফিরবই বা কীভাবে? মা খুব দুশ্চিন্তা করছে হয়তো।”

“তুমি ওই অসভ্য পৃথিবীর মানুষ হলেও তোমার মধ্যে কিছু ভালো গুণ আছে। তুমি এখনও প্রণাম ভোলোনি। মায়ের কথা ভেবে বিচলিত হচ্ছ। আমি খুশি হলাম দেখে। তোমাদের পৃথিবী আর আমাদের পৃথিবীর মধ্যে জায়গায় জায়গায় যোগসূত্র আছে। যাকে বলে হরিদ্রাবৃত্ত। যতটা সম্ভব অব্যবহৃত স্থানেই সেই পথগুলো আছে। তুমি কোনোভাবে সেই বৃত্তে ঢুকে পড়ে এখানে চলে এসেছ। আমরাই তোমাকে তোমার জায়গায় ফেরত পাঠিয়ে দেব।

“আর, মা চিন্তা করবেন বলে ভাবছ তো? কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। তুমি বন্ধুর বাড়িতে কতক্ষণ থাকতে?”

“এই দু-তিন ঘণ্টামতো।”

“ব্যস, তাহলে তো তুমি সময়মতোই বাড়ি পৌঁছে যাবে।”

বুঝতে না পেরে চোখ বড়ো করে তাকিয়ে থাকে রাহুল। এখন তো সন্ধে হয়ে গেছে। অলরেডি হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেছে বাড়িতে। আর সোমেশ্বর-স্যার বলছে কিনা সময়মতোই পৌঁছে যাবে!

“শোনো ছেলে, আমাদের এই পৃথিবী তোমাদের পৃথিবীর থেকে তিন ঘণ্টা তেত্রিশ মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ড এগিয়ে রয়েছে। বৈদিক গণনা পদ্ধতি বেশ কিছুটা শিখেছ, এবার হিসেব করে দেখো, তুমি এখানে আছ তিন ঘণ্টামতো। তাহলে? এবার তোমাকে নিজের জায়গায় ফেরত পাঠাবার পালা।

“শোনো রাহুল, যা কিছু তুমি দেখলে, জানলে, শিখলে, ফিরে গিয়ে কাউকে বোলো না। এমনটা নয় যে আমরা লুকিয়ে থাকতে চাই। বললে যেটা হবে, কেউ তোমার কথা বিশ্বাস করবে না। তোমাকে পাগল বলবে, আজেবাজে কথা বলবে। তাই চুপচাপ থেকো।

“আরেকটা কথা। যা কিছু শিখবে তার গোড়াটা জানার চেষ্টা কোরো। ‘এটাই হয়’ নয়, কেন হয় সেটার খোঁজ কোরো। দেখবে কোনোদিন কেউ তোমাকে পরাস্ত করতে পারবে না। সত্যিকারের জ্ঞানী হয়ে উঠবে তুমি। হ্যাঁ, কখনও যদি খুব অসুবিধেয় পড়ো, সারাদিন ধরে মানে, যতক্ষণ তুমি জেগে থাকবে, হরিদ্রাবৃত্তকে স্মরণ কোরো মনে মনে। তোমার চলার পথে কোথাও না কোথাও দেখা পেয়ে যাবে সেই পথের। তারপর তো তুমি জানো কী করতে হবে।”

ঝপ করে সাষ্টাঙ্গে সোমেশ্বরানন্দের পায়ে পড়ে যায় রাহুল। তাড়াতাড়ি দু’হাত দিয়ে তুলে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে সোমেশ্বরানন্দ বলে, “আয়ুষ্মান ভবঃ। নিজের দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ভুলে যেও না। পারলে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা কোরো।”

তারপর, “যাজ্ঞসেনী! রাজনন্দিনী!” বলে ডাক পাড়লেন তিনি।

শাড়ি পরা, মাথায় ফুল লাগানো দু’জন মহিলা এসে দাঁড়ালে সোমেশ্বরানন্দ বলল, “একে বিপরীত হরিদ্রাবৃত্ত দিয়ে নিয়ে গিয়ে ওর জায়গায় পৌঁছে দিয়ে এসো তোমরা দু’জন।”

অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ বুঝিয়ে দিলে পর সেই মহিলাদের সঙ্গে চলল রাহুল। কেমন কান্না কান্না পাচ্ছে যেন। যেতে ইচ্ছে করছে না। কী সুন্দর এই পৃথিবী! কী ভালো মানুষজন!

***

চোখ খুলতেই রাহুল দেখল ভালকে বনের দু’খানা বড়ো গাছের মাঝখানে বসে আছে ও। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। ক’টা বাজে এখন? উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে অন করে দেখে একটা পাঁচ। তাড়াতাড়ি বাড়ির রাস্তা ধরে ও।

দরজা খুলেই ওর মা বলে ওঠে, “কোথায় গেছিলি রে? অক্ষয়ের বাড়ি যাচ্ছিস বলে বেরোলি, কিন্তু যাসনি তো! তোকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছিল না। অক্ষয় দু’বার ফোন করেছিল। চিন্তা হয় না, নাকি?”

“হ্যাঁ, ওই না, মানে রাস্তায় বিনোদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওর বাড়িতে জোর করে নিয়ে গেল। কোনোভাবে ফোনটা অফ হয়ে গেছিল। তাই পাওনি।”

“স্নান করে আয়। খেয়ে নে।”

***

রাহুলের কাণ্ড দেখে পাড়ার লোক, আত্মীয়, বন্ধুরা তো কোন ছার, বাড়ির লোকেরাই অবাক হয়ে যাচ্ছে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে মেডিটেশন করছে আধঘণ্টা। তারপর যোগাসন এবং প্রাণায়াম আরও আধঘণ্টা। একদিন ওর বাবা মনে হয় ওই সময় বাথরুমে যাচ্ছিল, রাহুলের ঘরের ভেতর থেকে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ শুনে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “রাহুল, অ্যাই রাহুল, কী হয়েছে রে?”

রাহুল তো হেসেই অস্থির। বাবাকে বুঝিয়েছিল, ব্যায়াম করছিল ও। আসলে ভস্ত্রিকা প্রাণায়াম করছিল।

পড়াশোনার পদ্ধতিই পালটে গেছে রাহুলের। বিজ্ঞান বিষয়ক যা কিছু পড়ছে তা কেন হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করছে। অঙ্ক তো এখন জলভাত ওর কাছে। চার সংখ্যাকে আরও চার সংখ্যা দিয়ে গুণ মুখে মুখে করছে। স্কোয়ার রুট নিমেষে করে ফেলছে। নেট ঘেঁটে বেশ কিছু ‘ভেদিক ম্যাথস’-এর বই কিনেছে। মন দিয়ে অভ্যেস করছে। শরীরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে আগের থেকে। সবসময় হাসিখুশি চনমনে থাকে এখন। যাই হোক না কেন, মনখারাপ ছুঁতে পারে না ওকে।

বন্ধুরা ছেঁকে ধরলে হেসে বলে, “আমি যা বলব যদি করিস, তাহলে তোরাও পারবি।”

বেশ কিছু চ্যালা জুটেছে রাহুলের। তাদের শেখাচ্ছে ও। বড়ো হয়ে ওর ইচ্ছে, ভূমিকম্পে ভাঙবে না কিন্তু খরচ সাধ্যের মধ্যে, এমন বাড়ি তৈরির সরঞ্জাম বানানোর। একটা ভাবনা আছেও মাথায়। সেটা টপ সিক্রেট। তবে আচ্ছে দিন যে আসবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

ছবি: রাহুল মজুমদার

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

6 thoughts on “গল্প হরিদ্রাবৃত্ত চুমকি চট্টোপাধ্যায় শরৎ ২০২০

  1. -4 এর সাথে -2 যোগ হবে এবং তার চিহ্ন শেষে – হবে উত্তর হবে -6 । bajhyik অর্থ হল যদি কোনো বিন্দু ঋনাত্মক অক্ষে থাকে 0 থেকে 4 ইউনিট দূরত্বে তবে সে দিকে আর দুই ইউনিট সরে গেলে তার অবস্থান হবে -6 কিন্তু তার চিহ্ন পরিবর্তিত হয়ে – থেকে + হবে না – হবে ।

    Like

  2. চুমকি-ম্যাডাম, আপনার “হরিদ্রাবৃত্ত” গল্পটা পড়ে মন ভরে গেল। গতানুগতিক কল্পবিজ্ঞান নয়, তা ছাপিয়ে আরও অনেক কিছু! “সমান্তরাল বিশ্ব” অনেক কল্পবিজ্ঞান গল্পে আছে। এখানে আপনি যে অন্য মাত্রা সংযোজন করেছেন, তাতে আমি মুগ্ধ! অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে গল্প শেষ করেছেন। অনেক লেখক যেখানে ইতি টানতেন গল্পের সেখানে আপনি ইতি টানেননি আর সেজন্যেই অসাধারণ হয়ে উঠেছে “হরিদ্রাবৃত্ত”, উত্তরণ ঘটেছে গল্পের । প্রশংসনীয় আপনার অভিনবত্ব । আশা করি, অন্তর্নিহিত বার্তা বোধগম্য হবে নবীন প্রজন্মের কিশোর কিশোরীদের — চেষ্টা আর অধ্যবসায়ের কোনও বিকল্প নেই। এমন শারদ উপহারের জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং আন্তরিক শুভেচ্ছা।

    Like

  3. খুব ভালো লাগলো গল্পটা। এইরকম সমান্তরাল পৃথিবীতে আমিও যেতে চাই।

    Like

Leave a comment