ডানাওয়ালা বন্ধুগণ আমায় ওরা পোষে কিশোর ঘোষাল

আমায় ওরা পোষে

কিশোর ঘোষাল

আমি তো ওদের পুষি না, বরং আমার তো মনে হয় ওরাই আমায় পোষে, অন্ততঃ খুশি হই এই ভেবে, “দেখ, ওরা কেমন পোষ মানিয়েছে আমায়!”

তা নাহলে রোজ সকালে ঘুম ভেঙে, দাঁত ব্রাশ করেই কেন আমি ছাদে যাই, আমার চার দেওয়ালের খাঁচা ছেড়ে? কেনই বা চুপিচুপি ক’মুঠো চাল নিয়ে যাই আমার পাঞ্জাবির পকেটের প্যাকেটে? খাঁচা ছাড়া মুক্ত আমাকে দেখেই, ওরা কেন উড়ে আসে আমার চারপাশে? পায়রা, কাক, একজোড়া শালিক, দু’তিনটে চড়ুই? আমার ওপর শালিক আর চড়ুইদের টানটা একটু কম, ওরা রোজ আসে না। রোজ আসে পায়রা আর কাকের ঝাঁক।

আমি মুঠোভরা চালের দানা ছড়িয়ে দিই ছাদের মেঝেয়,ওরা মহানন্দে খুঁটে খুঁটে তুলে নেয় ওদের ঠোঁটে। পায়রা, শালিক, চড়াই তাদের ছোট্ট ঠোঁটে দানা খুঁটে খাওয়ার ব্যাপারে অভ্যস্ত, ওরা ওস্তাদ! কিন্তু কাকেরা লম্বা ঠোঁটে ততটা অভ্যস্ত নয়। কাজেই পায়রারা যখন অতি দ্রুত চালের দানা শেষ করতে থাকে, হতাশ কাকেদের দু’একজন রেগে গিয়ে টেনে ধরে পায়রাদের পুচ্ছ!  পায়রারা ভয় পায়, অস্ফুট একটু ডাক দিয়ে, ডানা ঝাপটে উড়ে সরে বসে। কাকেদের এই দুষ্টুমি দেখলে, ওদের দিকে আমি একটু ভঙ্গি করি, কাকেরা পিছিয়ে যায়, কিন্তু পালায় না। ওরাও বুঝে গেছে, পায়রাদের প্রতি আমার একটু বেশিই পক্ষপাত আছে। আমি সামনে থাকলে, ওরা পায়রাদের ঘাঁটায় না, কিন্তু একটু ওদিকে গেলেই, দুষ্টুমি করতেও ছাড়ে না!

মাঝে মাঝে আমিও দুষ্টুমি করি, ছাদে গিয়ে ওদের মাঝে ঘুরতে ঘুরতে এমন ভাব করি, ওদের যেন দেখছিই না। আজ আর চালের দানা দেবই না!  কিন্তু সেটি হবার যে জো নেই! কয়েকটি পায়রা সামনে এসে এমন ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকায়, যেন বলে, “কী হল, আজ দেবে না?” আর কাকগুলো আমার চারপাশে ছাদের আলসেতে বসে বসে, তারস্বরে বলতে থাকে, “বলি ভেবেছোটা কী? চাল বের করার কোনো লক্ষণই দেখছি না, যে? কতক্ষণ বসে থাকব, শুনি?”

পায়রাগুলোর মধ্যে একটি মেয়ে পায়রা মাঝে মাঝে আসে, তার গোছের নীচে পা কাটা, অর্থাৎ আঙুলগুলো একটাও নেই। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে, পায়রারা এমনিতেই ভীতু, ও আরও একটু বেশি। খুব মায়া হয়। যেদিনই আসে, মনে মনে বলি, “অ্যাদ্দিন আসিসনি কেন,মুখপুড়ি? সকালে এসে একবার দেখা দিতেও পারিস না?” যেদিন আসে সেদিন সবাই চলে যাবার পরেও ও অনেকক্ষণ থাকে, সাধ মিটিয়ে চাল দিই ওকে, কাকেরা যেন বিরক্ত না করে খেয়াল রাখি। জিগ্যেস করে লাভ নেই, তবু জিগ্যেস করি, “কী করে কাটলি পাটা?” নিজেই তার উত্তরও দিই, “হয়তো চাইনিজ মাঞ্জা! একটু সাবধানে উড়তে পারিস তো, মা!”

বর্ষার দিনে, আর খুব শীতের সকালে,ছাদে যাওয়া হয় না। সেদিন ছটফট করি আমার চার দেওয়ালের নিরাপদ খাঁচার মধ্যে। তোদের দু’টো চালের দানা খাইয়ে, আমি কী পাই জানিস, তোদের সঙ্গে আকাশ জোড়া মানসিক মুক্তির উড়ান। ওই নেশাতেই আমি পোষ মেনেছি তোদের! যেদিন আমি যেতে পারি না, অথবা এমন  কোনোদিন যদি হয়, আমি গিয়েছি অথচ তোরা আসিসনি, সেদিন সব দিক থেকেই আমি বন্দী হয়ে যাই।

2 thoughts on “ডানাওয়ালা বন্ধুগণ আমায় ওরা পোষে কিশোর ঘোষাল

  1. সত্যিই এমনই এ টান। এদের জন্যই, পৃথিবী এখনও বাসযোগ্য। খুব ভাল লাগলো।

    Like

    1. আপনিই Himadri তো? নাম দেখাচ্ছে allmytalks, সেটা আবার কে?

      Like

Leave a comment