বৈজ্ঞানিকের দপ্তর সাবধানে যেও অমিতাভ প্রামাণিক শীত ২০১৬

biggansabdhane

“দাদু, তুমি নাকি নিয়মিত গল্প লিখতে?”

“নিয়মিত মানে, ওই আর কি –”

“না, আজ রবিবাসরীয়তে দেখলাম তোমার সম্পর্কে লেখা, লিখেছে তুমি ম্যাগাজিনে অনেক গল্প লিখতে।”

“সে অনেক দিন আগে দাদুভাই।”

“তাহলে ছেড়ে দিলে কেন?”

“বাধ্য হয়ে। গল্পকাররা চায় তাদের কিছু গল্প যেন গল্পই থাকে, যেন কখনো সত্যি না হয়। আমার ক্ষেত্রে সেটা তো হল না, তাই আর গল্প লিখতে পারিনি দাদুভাই।”

“মানে? তুমি একটা গল্প লিখলে, আর সেটা সত্যি হয়ে গেল?”

“হ্যাঁ।”

“কী সেই গল্প? বলো না, বলো না।”

“থাক, আর একদিন শুনিস।”

“না, তুমি এখুনি বলো।”

“সে বিশ-বাইশ বছর আগের কথা দাদুভাই। আমি তখন দিল্লীতে একটা কাগজের রিপোর্টার। তার আগে কাজ করতাম ন্যাশন্যাল সেফটি কাউন্সিলে। সেফটি জানো তো? সুরক্ষা। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, অফিস, কারখানা কোথায় কী কী সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন, সেগুলো ঠিকঠাক করা হচ্ছে কিনা, সেসব দেখা ছিল আমার কাজ। ওসব করতে করতে আমি তা নিয়ে গল্পও লিখতাম।”

“কী গল্প? গল্পটা তো বলো।”

“বলছি। এই যে দেখিস মোটরগাড়ি। ফোর্ড সাহেব আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি কি জানতেন এমন এক সময় আসবে যখন মধ্যবিত্ত লোকেরাও মোটরগাড়ি চড়ে ঘুরবে? এখন দ্যাখ রাস্তায় কত গাড়ি। গাড়িতে গাড়িতে ধাক্কা লাগলে পথচারী আর যাত্রী উভয়েরই প্রাণনাশের আশঙ্কা।”

“তো?”

“সেই জন্যেই তো স্পিড লিমিট বেঁধে দেওয়া হয়। গাড়িতে থাকে সিটবেল্ট, এয়ার ব্যাগ।”

“ধুর, এখানে কলকাতায় তো চল্লিশের ওপরে স্পিডই ওঠে না, এতে কী হবে? লাগলেও কেউ মরবে?”

“কী বলছিস দাদুভাই! নে, খাতা পেন নিয়ে অঙ্ক কষ। মনে কর চল্লিশ না, স্পিড আরো কম, ছত্রিশ কিলোমিটার পার আওয়ার। তার মানে ছত্রিশ হাজার মিটার পার ছত্রিশশো সেকেন্ড, মানে দশ মিটার পার সেকেন্ড, ওকে? এবার মনে কর তোকে উল্টো করে একটা উঁচু জায়গা থেকে ছেড়ে দেওয়া হল। তাহলে পৃথিবীর টানে তুই ধপ করে নীচে পড়বি, পড়বি তো? পড়ার সময় তোর স্পিড বাড়তে থাকবে। শুরুতে ছিল জিরো, যত নীচে আসবি তত বাড়বে, সেই যে অভিকর্ষজ ত্বরণের ফলে। এবার অঙ্ক কষে বল, কত উঁচু জায়গা থেকে তোকে ছাড়লে মাথাটা যখন মাটিতে টাচ করবে তখন তোর স্পিড হবে দশ মিটার পার সেকেন্ড?”

“এ তো ইজি। ভি স্কয়ার ইজুকাল্টু ইউ স্কয়ার প্লাস টু জি এইচ। ভি মানে ফাইনাল ভেলোসিটি হচ্ছে দশ, মানে ভি স্কয়ার ইজ হান্ড্রেড। ইনিশিয়াল ভেলোসিটি ছিল ইউ, সেটা জিরো, অ্যাক্সিলারেশন ডিউ টু গ্রাভিটি জি হচ্ছে নাইন পয়েন্ট এইট, আচ্ছা দশই ধরে নিই। তাহলে হাইট এইচ হচ্ছে গিয়ে একশো বাই কুড়ি মানে পাঁচ।”

“রাইট। কিন্তু পাঁচ কী? পাঁচ মিটার, মানে সাড়ে ষোল ফুট। দেড়তলা বাড়ির ছাদ থেকে তোকে উল্টো করে ছেড়ে দিলে তোর মাথাটা মাটি টাচ করার সময় কী হবে?”

“ফটাস করে ফেটে যাবে, ঘিলু ছিটকে বেরোবে, আবার কী?”

“তো সেই হচ্ছে ছত্রিশ কিলোমিটার পার আওয়ার স্পিডের রেজাল্ট। এই স্পিড যদি ষাট কিলোমিটার পার আওয়ার হয়, তবে এই অঙ্কে হাইট হবে চোদ্দ মিটার, মানে ছেচল্লিশ ফুট, বুঝলি?”

“হুম। তার মানে মোটর গাড়ি হচ্ছে একটা পোটেনশিয়াল ওয়েপন অফ মাস ডেস্ট্রাকশন।”

“এগ্‌জ্যাক্টলি তাই। তার জন্যেই তো এর সেফটি নিয়ে আরো বেশি ভাবনাচিন্তা করা দরকার”।

“তো তোমার গল্পটা কী ছিল?”

“আমার গল্পটা ছিল যাত্রীর সুরক্ষা নিয়ে। গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হলে শুধু যে পথচারীর দুরবস্থা তা তো নয়, যাত্রীরও মারাত্মক আঘাত বা মৃত্যু হতে পারে। আর এসবের অধিকাংশই হয় গাড়ির চলমানতার জন্যে না, হঠাৎ করে থেমে যাওয়ার জন্যে।”

“মানে?”

“এই ধর গাড়ি যখন চলছে, গাড়ির মধ্যে বসে যারা, তারাও তো একই স্পিডে চলছে। তারা বুঝছে না এটা। কিন্তু গাড়ি যেই থেমে যায়, হঠাৎ ব্রেক মারার জন্যেই হোক বা অ্যাক্সিডেন্টে, শরীরের যে অংশটা গাড়ির সঙ্গে লেগে, সেটা ফট করে থেমে যায়, বাকিটা ইনার্শিয়ার জন্যে চলতে চায়। এই বাকিটা মানে শরীরের ওপরের অংশটা, বুক, গলা থেকে মাথা।”

“তো?”

“তো বুঝে নে। তোকে যদি পেছন থেকে কেউ হঠাৎ মাথায় জোরে ধাক্কা দেয়, লিকলিকে গলাটা সেই ধাক্কা সহ্য করতে পারবে? পারে না। হয় কী, মট করে ভেঙে যায় ওখানকার গিঁট। আর এটা হচ্ছে স্পেশ্যাল জাংশান, যেখানে স্পাইন্যাল কর্ডের শুরু, মানে মাথার সঙ্গে বাকি শরীরের যোগাযোগের মাধ্যম যে সমস্ত নার্ভের মাধ্যমে, তাদের জটা বাঁধা। ওখানে আঘাত মানে পঙ্গু হয়ে যাওয়া, বা মৃত্যু।”

“তো তুমি এই নিয়ে গল্প লিখেছিলে?”

“হ্যাঁ। আমি লিখেছিলাম যে আমি একদল খুব উঁচু পদের লোকদের এসব নিয়ে লেকচার দিলাম। তারা শুনলো, অনেক কোশ্চেন টোশ্চেন করলো। সিকিউরিটি ওয়ার্কশপ শেষ হয়ে গেলে সবাই হাত মিলিয়ে ধন্যবাদ টাদ দিয়ে বাড়ি যাওয়ার পথ ধরলো। আধঘন্টা পরেই খবর পেলাম, ওদের একজন রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। খবর নিয়ে জানা গেল, আমার এত সব লেকচার বিফলে গেছে, সে সিটবেল্ট পরেনি। গাড়ির অ্যাক্সিডেন্টে আঘাত গুরুতর নয়, কিন্তু ঐ যা বললাম, গলার কার্টিলেজে ভীষণ চাপ পড়ে ইন্টারনাল হ্যামারেজে ডেড।”

কিন্তু এটা তো গল্প।”

“হ্যাঁ, কয়েকবছর পর ঠিক এটাই হল আমার চোখের সামনে, দিল্লীতে। নতুন মন্ত্রীসভা গঠন হয়েছে তখন, তাতে প্রায় সবাই ফার্স্ট টাইম সেন্ট্রাল মিনিস্টার। আমি তখন সাংবাদিক। কয়েকজনের ইন্টারভিউ নেবো বলে খুব করে ধরেছিলাম। একজন রাজি হতেই তার গাড়িতে চেপে বসলাম। ভাবলাম রাস্তায় যেতে যেতেই ইন্টারভিউটা সেরে নেবো। শুরুও করেছিলাম।”

“তারপর?”

“আমরা দুজন, আমি আর মিস্টার নতুন মিনিস্টার বসেছিলাম গাড়ির পেছনে। গাড়ি চলতে শুরু করলে ওকে রিকুয়েস্ট করলাম সিটবেল্ট পরে নিতে। কিছুতেই কথা শোনে না। বলতে থাকল, কিচ্ছু হবে না, সামনে দুটো পাইলট কার, পেছনে দুটো ফলোইং কার লাইট লাগিয়ে প্যাঁ পোঁ করে যাচ্ছে, সব গাড়িই মন্ত্রীদের গাড়ি দেখলে সাইডে সরে যায়, সো হি ইজ পার্ফেক্টলি সেফ। আমি তাও জোরাজুরি করতে আমাকে বলল, আপনার কি কিছু জিজ্ঞেস করার আছে, নাকি আমাকে জ্ঞান দিতে এসেছেন?”

“হুম। তারপর অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেল?”

“হ্যাঁ। কাগজে ফলাও করে বেরিয়েছিল। আমার চোখের সামনে ঘটল সব। ধাক্কা লাগার পরেও বুঝিনি। আমার কাছে জল চাইল একটু। দিলাম। খেতে খেতেই পেছনের সিটে এলিয়ে পড়ল। তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। এমার্জেন্সির ডাক্তার নাড়ি দেখে বলল, ব্রট ডেড।”

“ওহ্‌। স্যাড।”

“আমি সেই যে গল্পটা লিখেছিলাম, যাতে এ রকম ঘটনা বাস্তবে না ঘটে। অথচ আমার সামনেই জলজ্যান্ত লোকটা, সদ্য ভোটে জিতে আসা মিনিস্টার তখন, এক মুহূর্তে লাশ হয়ে গেল। এরপর আর আমি কোনো গল্প লিখতে পারিনি দাদুভাই। মৃত্যুর কাছে সব গল্পই অসহায়। তোমরা এ রকম যেন ভুল কোরো না। মনে রেখো, আমাদের সমস্ত গরিমাই জীবনের মহত্ব ঘিরে। মৃত্যুর কোনো মাধুর্য নেই। গল্পেও না।”

 বৈজ্ঞানিকের দপ্তর সব লেখা একত্রে

2 thoughts on “বৈজ্ঞানিকের দপ্তর সাবধানে যেও অমিতাভ প্রামাণিক শীত ২০১৬

  1. খুব শিক্ষামূলক, সন্দেহ নেই। লেখার শৈলীটি খুব মনকাড়া। কিন্তু চোরা শোনেনা বলে ধর্মের কাহিনী বলা বন্ধ করে দিতে হবে? মন সায় দেয় না। সেফটি ম্যানেজমেন্ট বলে, এক্ষেত্রে সেফটি রুল এনফোর্স কলেই হয়না, তাকে রি-এনফোর্স করতে হয়।

    Like

  2. অমিতাভর “প্রামাণিক” দক্ষতা ও মুচমুচে ভঙ্গিতে লেখা আর একটি শিক্ষামূলক উপাখ্যান l তবে আমাদের মুশকিল হল গল্প আমরা শুধুই পড়ি, তার থেকে শিখি অল্পই l ধন্যবাদ সম্পাদক ও লেখককে l

    Like

Leave a reply to কৃষ্ণেন্দু ব্যানার্জি l Cancel reply