ভ্রমণ অন্যভ্রমণ- লক্ষ গাছের কথা-রজত চক্রবর্তী বসন্ত ২০২০

আগের পর্ব- পায়ে পায়ে হরিপদ

অন্যভ্রমণ

রজত চক্রবর্তী

উৎসঃ আশ কথা পাশ কথা” গ্রন্থ থেকে লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।
প্রকাশকঃ রূপালী পাবলিকেশন
২০৬, বিধান সরণি, কলকাতা ৭০০০০৬

লক্ষ গাছের কথা

জুলাই মাস। বৃষ্টি পড়েছে। অজিতবাবুর মনটা টুপটাপ টুপটাপ বৃষ্টির ফোটায় নেচে। উঠেছে। হাফ-বয়সি সাথি শিবুরও আনন্দ সারা মুখে। আয় বৃষ্টি আয়। হাওড়া-তিরুচিরাপল্লি এক্সপ্রেস ছেড়ে দিল হাওড়া স্টেশন। স্লিপার কোচে অজিতবাবু আর শিবু তিনমাস আগে। থেকে টিকিট কেটেছেন। অজিতবাবু সাইড লোয়ার। আর শিব উলটোদিকে লোয়ার বার্থ,জানলার ধারে। সিটের তলায় ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়েছে ঢাউস ঢাউস ভারী ব্যাগ। ট্রেন স্পিড নিয়েছে। অজিতবাবু বলে উঠলেন – “দে শিবু শুরু করি,আয়।” শিবু ছোট্ট একটা প্যাকেট নিয়ে লোয়ার সাইড বার্থে বসল। প্যাকেট খুলে অজিতবাবুর হাতে। উলটোদিকের ভট্টাচার্য মশাই যাচ্ছেন সপরিবার “সাউথ -টুরে। তিনি লক্ষ করেছেন। অজিতবাবু আর শিবু প্যাকেট থেকে মুঠো করে কী তুলছে আর ছুঁড়ে দিচ্ছে রেললাইন ঘেঁসা জংলা জমিতে। ভট্টাচার্যমশাই অবাক—“কী করছেন বলুন তো?”

শিবু নির্বিকার, “বীজ ছড়াচ্ছি, এই নিন আপনিও ছড়ান।”

“মানে?”

অজিতবাবু পাকাচুলে হাত বোলান, “মানে কিছু নেই,গাছই প্রাণ। আমাদের সঙ্গে লক্ষ লক্ষ বীজ আছে। ছড়াতে ছড়াতে কন্যাকুমারী পর্যন্ত যাব,এক লক্ষ গাছ বাঁচলেও তো একটু কাজ করা হল!” শিবু মাথা নাড়ে, “এই জন্যই আমরা দু-দিকে জানলার ধারে সিট নিয়েছি, যেদিকে জমি পড়বে সেদিকে ছড়াব।” ভট্টাচার্যমশাই থেকে ছেলে-মেয়ে-গিন্নি হয়ে একসময় দেখা গেল সারা কম্পার্টমেন্টের সবাই বীজ ছড়াচ্ছে। পৃথিবীর বুকে মহানন্দ।।

নবদ্বীপের অজিত পোদ্দার আর শিবু দেবনাথের এবারের যাত্রাপথ হাওড়া-কটক-বিশাখাপত্তনম -বিজয়ওয়াড়া-চেন্নাই-তিরুচিরাপল্লি-মাদুরাই-নাগেরকয়াল-কন্যাকুমারী-ত্রিবান্দ্রম-এর্নাকুলাম-ম্যাঙ্গালোর। ঢাউস ঢাউস ব্যাগে ষাট থেকে সত্তর লক্ষ বীজ। ভারতের শেষ ভূখণ্ডে বীজ বপন করে তৃপ্ত দু-জন পনেরো দিন পরে ফিরে এলেন নবদ্বীপে। আবার ডেলি প্যাসেঞ্জারি। ফার্স্ট কাটোয়ার নবদ্বীপ-হাওড়া।

শিবুর বড়োবাজারে বেসরকারি চাকরি, আর অসিতবাবুর টেলিফোন ভবনের পাশে ফুটপাথে। বই বিক্রির কাজ। ভিন্ন পেশার দু-জন, অভিন্ন হল ভাবনায়। নিজেদের মতো করে বুঝে নিল “পরিবেশ। বিপদ। গাছ। প্রকৃতি। শুরু হল বীজ সংগ্রহ। ডালহৌসিতে সরবতওয়ালা,ট্রেনের হকার,হাওড়া ব্রিজের আনাজ-মাসি হয়ে উঠল বীজ সরবরাহকারী। তারপর রোদে শুকানো, ওষুধ দেওয়া। ফরেস্টের কর্মচারীদের পরামর্শ। বেরিয়ে পড়লেন। দুজন। প্রথম দফায় নবদ্বীপের গঙ্গার ধার বরাবর ৩০ কিলোমিটার ছড়ানো হল বীজ।

আশপাশে সমস্ত স্কুল পড়ুয়াদের হাতে হাতে বীজ। ছড়িয়ে দাও। যেখান সেখানে।। রেললাইনের ধারে ধারে অনেক অকেজো জমি। বীজ ছড়িয়ে দিলে। সারা ভারতে। ধারে ধারে সুন্দর গাছ। গাছ-বৃষ্টি-ফসল-জীবন। স্বপ্ন। গোধূলিতে নবদ্বীপ স্টেশনে। হাতে চায়ের ভাঁড় নিয়ে দুজনের চোখে স্বপ্নের জলরং। প্রথম শুরু হল নবদ্বীপ থেকে। মালদহ। সব স্টেশনেই লাগানো হল অনেক গাছ। দেওয়া হল সার। মালদহ পেরিয়ে জলপাইগুড়ি। ওদিকে গাছ আছে তাও। হাওড়ার পথেও চলল একই কাজ। স্টেশন মাস্টারদের অনেকে এগিয়ে এলেন। অনেকে “পাগলামো” বলে পাশ কাটালেন। কিন্তু ষাটোর্ধ্ব অজিত পোদ্দার আর চল্লিশের শিবু দেবনাথ স্বপ্ন দেখেছেন সবুজ ভুবনের। স্বপ্নপূরণে অজিতবাবু আর শিবু দেবনাথ ২০০৯ সালে ঠিক করেছিলেন গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গাসাগর বর্ষার আগেই ছড়িয়ে দেবেন বীজ। বৃক্ষ হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য সুস্থ। পৃথিবী গড়ায় এইটুকু কাজ করার তাগিদে নিজেদের জমানো সব অর্থ দিয়েও পেরে ওঠেননি। তাও কিন্তু হাল ছাড়েননি। যেমন কন্যাকুমারী অবধি পেরেছেন, তেমনই। কোঙ্কণ রেলপথে গোয়া-বম্বে-সুরাট-কোটা-মথুরা-বৃন্দাবন-দিল্লি-আগ্রা পর্যন্ত এক অন্য ভ্রমণে দুই ছাপোষা মানুষ। স্ব্যাকপেটানো বাঙালির প্রচারপ্রিয়তার বিপরীত নিরলস এই কাজকে, কাজের ভাবনাকে, নাছোড় ইচ্ছাকে, স্বপ্নকে বাগে আনার তাগিদকে, হেঁটমুণ্ড কুর্নিশ জানাতেই হয়। ভ্রমণের অন্য অর্থ খুঁজে দিলেন অজিতবাবু আর শিবু দেবনাথ।

ভ্রমণ সব লেখা একত্রে

1 thought on “ভ্রমণ অন্যভ্রমণ- লক্ষ গাছের কথা-রজত চক্রবর্তী বসন্ত ২০২০

Leave a comment